#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_২৯
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
সাইড টেবিলে রাখা ছোট্ট ডিজিটাল ঘড়িটায় সময় বলছে রাত দুটো। কুহেলি অনেকক্ষণ হল ঘুমিয়ে পড়েছে, শারীরিক ক্লান্তির থেকে মানসিক ক্লান্তিটা অনেকটাই বেশি। পোশাকটা পর্যন্ত পাল্টায়নি, আলেখ শুধু ওর ক্যাপ আর স্কার্ফ টা খুলে সরিয়ে রেখেছে একপাশে। ক্লান্ত মুখটায় এখনও নোনা জলের রেখা স্পষ্ট হয়ে রয়েছে, আলেখ এক দৃষ্টে চেয়ে আছে কুহেলির দিকে। বারবার ভেসে উঠছে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগের সেই মুহূর্ত টা, আলেখ যেন নিজের মধ্যেই ছিল না। বরাবরের সংযমী আলেখ এতোটা বাঁধনহারা আগে কখনও হয়নি, যেন তার অবচেতন মনের ইচ্ছে গুলো তার চেতন মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। নিজের সুপ্ত অনুভূতি গুলোকে সংযত করার শক্তি তার ছিল না, হয়তো বা ইচ্ছেটাও ছিল না। কুহেলিও যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল, বাধা দেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেনি। ওই মুহূর্ত টায় যেন তারা দুজনেই কোনো এক উত্তাল আবেগের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল। দীর্ঘ সেই চুম্বনের পরও কুহেলি যেন একটা ঘোরের মধ্যেই ছিল, আলেখ দুহাতে কুহেলিকে কোলে তুলে এনে শুইয়ে দিয়েছিল। ভিজে যাওয়া চোখের পাতায় ঘুমের ছোয়া লাগতে দেরী হয়নি। কিন্তু আলেখের চোখে আজ ঘুম নেই, পোশাকটা পাল্টে কুহেলির দিকে ফিরে শুয়ে এক ভাবে চেয়ে ছিল তার দিকে। কিছুটা চেনা কিছুটা অচেনা যে অনুভূতি গুলো মাঝে মাঝেই ওর মন জুড়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যেত, তারা আজ আর অজানা নয়। আলেখের কাছে আজ তারা খুব স্পষ্ট, কখন যেন নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছে সে কুহেলিকে। হ্যা, সে ভালোবাসে কুহেলিকে, কখন কিভাবে সে জানে না, কিন্তু ওর অজান্তেই ধীরে ধীরে ওর মনে প্রবেশ করেছে ভালোবাসা। মনে মনে দেবার্ঘ্যকে একটা ধন্যবাদ জানাল আলেখ, আজ ওর সাথে দেখা না হলে হয়তো নিজের অনুভূতি গুলোকে এত সহজে চিনতে পারতো না। একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে, ভালোবাসার অনুভূতি গুলো যে এত সুন্দর হয় জানা ছিল না। ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগল, সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হবে না বলেই কুহেলির সঙ্গে শর্তের ভিত্তিতে গড়ে তুলেছিল এই সম্পর্ক। অথচ কখন কিভাবে নিজের অজান্তেই সেই কুহেলির সঙ্গেই জড়িয়ে পড়েছে এক মধুর বন্ধনে। যে বন্ধনের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে থাকা যায় সারাটা জীবন। ভালোবাসার ছোয়ায় জীবনটা যে এত রঙিন হয়ে ওঠে, সেটা যেন নতুন করে উপলব্ধি করল আলেখ। একটা হালকা হাসির রেখা যেন ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই হাসিটা মিলিয়ে এল। আলেখ না হয় নিজের অনুভুতি গুলোকে চিনতে পেরেছে, কুহেলির প্রতি মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া ভালোবাসার উপলব্ধি করতে পেরেছে। কিন্তু কুহেলি… ওর মনে কি আলেখের জন্য কোনও অনুভূতি আদৌ আছে? বন্ধুর থেকে বেশি কি ভাবতে পেরেছে ওকে? আজকের ওই এক মুহূর্তের ঘটনার ভিত্তিতে ওর মনের হদিস পাওয়া সম্ভব না। দুর্বল মুহূর্তে আবেগের বশে মানুষ এমন অনেক কিছু করে যার কল্পনাও হয়তো সে করতে পারে না। কুহেলির ক্ষেত্রেও আজকের পরিস্থিতিটা অনেকটা তেমনই, কুহেলি তো তখন নিজের মধ্যেই ছিল না, কি ঘটেছে কেন ঘটেছে সবটাই তার অজানা। হয়তো সবটাই ওর কাছে একটা ধোয়াশায় মোড়া স্বপ্নের মত। আলেখ বুকের বা পাশটায় যেন একটু চিনচিনে যন্ত্রণা অনুভব করল। কুহেলির মনে ওর জন্য কোনও অনুভূতি হয়তো সত্যিই নেই, না থাকাটাই হয়তো স্বাভাবিক। কুহেলি তো ওকে বলেই দিয়েছিল, দ্বিতীয় বার হয়তো আর ভালবাসতে পারবে না। আর ঠিক সেই কারণেই তো আলেখের এই শর্ত সাপেক্ষ বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হয়েছিল। সবটাই তো আলেখের জানা, তাহলে এই কষ্ট টা কেন হচ্ছে! আলেখ কুহেলির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবল, কুহেলির মনে যদি ওর প্রতি কোনও বিশেষ অনুভূতি না সৃষ্টি হয় তাতে কুহেলির তো কোনও দোষ নেই। এমনটাই তো কথা ছিল, সে নিজেও তো এমনটাই ভেবেছিল। কিন্তু মানুষ যা ভাবে, সবসময় কি আর তেমনটা হয়! আলেখও কি ভাবতে পেরেছিল, তার পূর্ব পরিকল্পিত জীবনের ছবিটা এমন ভাবে পাল্টে যাবে! ওলোট পালোট হয়ে যাবে সব হিসেব! আমরা নিজেদের ইচ্ছে মত জীবনটা সাজাতে চাই। নিজেরাই ঠিক করে নিতে চাই সবটা, কিন্তু সেটা কি সবসময় হয়! জীবন তার নিজের ছন্দে এগিয়ে চলে, আর রইল বাকি ভালোবাসার কথা…. সে তো সেই আদিকাল থেকেই নিয়ম ছাড়া। হাজার চেষ্টাতেও তাকে নিয়মের গণ্ডিতে বাধা যায় না, আপন খেয়ালে মানব হৃদয়ের আঙ্গিনায় নিভৃতে পা রাখে সে। আলেখ কুহেলির মুখের ওপর এসে পড়া চুলগুলো আলতো হাতে কানের পিছনে সরিয়ে মনে মনে বলল,
কখন কিভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি জানিনা। জানি, এমনটা হওয়ার কথা হয়তো ছিল না, কিন্তু এটাই সত্যি। আমি তোমাকে ভালোবাসি কুহেলি। তোমার মনে আমার জন্য হয়তো তেমন কোনও অনুভূতি নেই। বন্ধুত্বের বাইরে তুমি হয়তো আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে ভাবতেই চাও না। তেমনটাই তো কথা ছিল, কিন্তু সব হিসেব যে পাল্টে গেছে কুহেলি। আমার নিজের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস আছে, একদিন তুমি ঠিক আমাকে ভালোবাসবে, আমি জানি। অপেক্ষা করব সেই দিনটার, যত দিন অপেক্ষা করতে হয় করব। তোমার বন্ধ মনের দরজা একদিন তুমি নিজে হাতেই আবার খুলে দেবে। ততদিন আমার সীমার মধ্যে থেকেই না হয় ভালোবেসে যাব তোমাকে। যেদিন আমার ভালোবাসা স্পর্শ করবে তোমার মন, জাগিয়ে তুলবে তোমার মনের গহীনে ঘুমিয়ে থাকা সুপ্ত অনুভূতি গুলোকে, সেদিন না হয় পূর্ণ হবে আমাদের ভালোবাসা। সেইদিন টা একদিন ঠিক আসবে, আসবেই।
আবার একটা আলতো হাসি ছড়িয়ে গেল আলেখের ঠোঁটে। আজ আর পাশ ফিরল না, কুহেলির দিকে ফিরেই চোখ দুটো বন্ধ করল। বড্ড ভালোলাগছে, একটা নতুন খুশির আমেজ যেন ওর সারা মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ভালোবাসার পরশ লাগলে হয়তো এমনটাই হয়, শেষে আলেখের চোখেও ঘুমের ছোয়া লাগল। সদ্য অনুভূত ভালোবাসার খুশির আমেজ নিয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাল। বেশ সকালেই ঘুম ভাঙ্গল কুহেলির, ব্যালকনির স্বচ্ছ কাচের দরজাটা ভেদ করে সারাটা ঘরে নরম রোদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। মাথাটা একটু যেন ভারী ভারী লাগছে, উঠে বসতেই খেয়াল হল ওর পরনে এখনও কালকের পোশাক। নিমেষে যেন ওর চোখের সামনে কালকের ঘটনা গুলো সাজানো অ্যালবামের পাতার মত ফুটে উঠতে লাগল। দেবার্ঘ্যর সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে আলেখ আর ওর সেই আবেগঘন মুহূর্ত পর্যন্ত সবটাই যেন আরও একবার ওর চোখের সামনে ছায়াচিত্রের মত ঘটে গেল। কুহেলি একবার পাশে ঘুমিয়ে থাকা আলেখের দিকে তাকাল, নাহ, একটুও রাগ হল না। বরং মানুষটার প্রতি একটা অদ্ভুত অনুভূতি উপলব্ধি করল। শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, বন্ধুত্ত্ব সবকিছুর পরেও একটা অন্য অনুভুতি যেন বারবার মনের আনাচে কানাচে উকি দিয়ে যেতে লাগল। আলেখের জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকত তাহলে রাগ না করলেও দুঃখ নিশ্চয়ই পেত, মনে একটা খারাপ লাগা অবশ্যই কাজ করত। যতই হোক না কেন, নিজের বিবাহিতা স্ত্রীয়ের প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে হঠাৎ আলাপ হলে পৃথিবীর কোনও স্বামীই নিশ্চয়ই খুশি হবে না। বিশেষ করে যদি সে জানে যে সম্পর্কটা ভালোবাসার অভাবে ফুরিয়ে যায় নি। যতই শর্তের ভিত্তিতে দাড়িয়ে থাকুক ওদের সম্পর্ক, তাহলেও খারাপ লাগার, দুঃখ পাওয়ার বা রাগ করার পূর্ণ অধিকার ছিল আলেখের। কিন্তু আলেখ সেটা করেনি, এমনকি কুহেলির নিজেকে অপরাধী মনে হলেও আলেখ তাকে দোষী মনে করেনি। বরং ওর মন থেকেও অপরাধ বোধের বোঝাটা সরিয়ে দিয়েছে, শান্ত করেছে ওর মনের মধ্যে চলতে থাকা ঝড়। এমন একজন মানুষের প্রতি রাগ করা যায়! কেন করবে রাগ! ওই ঘটনার জন্য? কিন্তু কেন? আবেগের বশে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার জন্য রাগ কেন করবে? ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো কিছু হয়নি, ও তো চাইলেই বাধা দিতে পারত। কিন্তু বাধা তো সে দেয়নি, হয়তো সেই মুহূর্ত টায় অন্য কোনও অনুভূতির ডাকে সাড়া দেওয়ার মত অবস্থায় সে ছিল না। আর তাছাড়া রাগ তখনই হয় যখন কোনও ঘটনার জন্য মনে অস্বস্তি হয় খারাপ লাগে। কুহেলির কি খারাপ লাগছে! কোনও অস্বস্তি কাজ করছে কি? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর আর খোজার প্রয়োজন হল না। নাহ, কালকের ঘটনা টা নিয়ে ওর মনে কোনও অস্বস্তি কাজ করছে না, কোথাও এতটুকু খারাপ লাগার লেশমাত্র নেই। বরং সেই আবেগী মুহূর্তটা আবারও চোখের সামনে ভেসে উঠতেই একটু লজ্জা পেল কি? কুহেলির মনে নতুন কিছু প্রশ্ন উকি দিতে লাগল।
আচ্ছা, আমার মনে কি আলেখের জন্য নতুন কোনও অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে? আর আলেখ…. ওর মনেও কি…. ধুর এসব কি ভাবছি আমি! এটা কীকরে সম্ভব? কিন্তু কাল তাহলে… না না, আবেগের স্রোতে ভেসে ওই হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটা মুহুর্তের জন্য এমনটা ভাবার তো কোনও কারণ নেই। কিন্তু তাহলে এই অদ্ভুত অচেনা অনুভূতি গুলোর অর্থ কি? আহ্, আর ভালোলাগছে না। সবকিছু এত জট পাকিয়ে যাচ্ছে কেন? নাহ, যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে এত ভেবে আর লাভ নেই। আগে ফ্রেশ হওয়া দরকার, ইশ সেই কালকের ড্রেসেই এখনও রয়েছি।
কুহেলি ওর ভাবনায় বিরাম দিয়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। নতুন প্রশ্ন গুলোর উত্তর না হয় তার সময় মতোই আসবে। আলেখ বেশ রাত করে ঘুমিয়েছে, তাই বেলা আটটা হয়ে গেলেও এখনও ঘুম ভাঙ্গেনি। কিন্তু ফোনের রিংটোনের শব্দে ঘুমটা ভাঙল, ঘুম জড়ানো চোখেই দেখল লিয়াম ফোন করছে।
হ্যা লিয়াম বলো।
গুড মর্নিং স্যার। আজ কখন বেরোবেন?
আজ হয়তো বেরোবো না।
কেন স্যার? শরীর ঠিক আছে তো আপনাদের?
ছেলেটার গলায় উদ্বেগ ঝরে পড়ল, আলেখের বেশ ভালোলাগলো। একটা অচেনা ছেলে, মাত্র দুদিনের আলাপ, তাও কত আন্তরিক ব্যবহার। এতক্ষণ শুয়ে শুয়েই কথা বলছিল আলেখ, এবার উঠে বসে বলল,
ডোন্ট ওয়ারি লিয়াম, আমরা ঠিক আছি। আজ এমনিই একটু রেস্ট করতে ইচ্ছে করছে।
ওকে স্যার, তবে যখনই দরকার হবে জাস্ট একটা ফোন করে দেবেন।
শিওর।
ফোনটা রেখে আলেখ একবার সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে নিল, কুহেলি কোথাও নেই। তার মানে ওয়াশরুমে আছে হয়তো, ওর কথা ভেবেই আজ লিয়ামকে বারন করে দিল। কে জানে কালকের পর ঠিক কেমন মুড থাকবে আজ। ওর ভাবনার মধ্যেই কুহেলি স্নান সেরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল, সেদিকে তাকিয়ে যেন আলেখের হৃদযন্ত্র টা কিছুক্ষণের জন্য স্পন্দিত হতে ভুলে গেল। হালকা গোলাপি রঙের একটা টপ আর গাঢ় নীল রঙের একটা পাজামা পরা। দেহের উন্মুক্ত অংশের ইতি উতি এখনও কয়েক ফোটা জলবিন্দু লেগে আছে। কালো এক ঢাল চুল গুলো দুধ সাদা তোয়ালেতে জড়িয়ে রাখা আছে কাধের একটা পাশে, ঠিক যেন একটা সদ্য ফোঁটা বৃষ্টি ভেজা পদ্মফুল। কুহেলির প্রতি নিজের ভালোবাসাটা উপলব্ধি করার পর থেকে যেন সেই তীব্র আকর্ষণটা আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। কুহেলি আলেখকে দেখে আলতো হেসে বলল,
গুড মর্নিং।
মর্নিং।
কুহেলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল থেকে ভিজে তোয়ালেটা খুলে রেখে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে ভিজে চুলগুলোকে শুকিয়ে নিতে লাগল। আলেখ কুহেলিকে দেখে একটু অবাক হল, এতোটা স্বাভাবিক আচরণ হয়তো আশা করেনি। ধীর পায়ে উঠে এসে কুহেলির পিছনে দাড়াল, কুহেলি আয়নায় ফুটে ওঠা আলেখের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে একটু যেন থমকে গেল। কিসের যেন একটা কালো ছায়া ফুটে উঠেছে আলেখের চোখে মুখে। হেয়ার ড্রায়ারটা অফ করে রেখে পিছন ফিরে বলল,
কিছু হয়েছে?
আলেখ কুহেলিকে দেখে ঠিক বুঝতে পারল না, ওর গত রাতের কথা আদৌ মনে আছে কিনা! কিন্তু মনে না থাকার তো কোনও কারণ নেই। তাহলে এত স্বাভাবিক আচরণ করছে কেন! যেন কিছুই হয়নি। তাও আলেখের মনে হল ওর কুহেলির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। ও যা করেছে নিজের ভালোবাসার অনুভূতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে করেছে, সেটা কোনও অন্যায় না হলেও কুহেলির অনুমতি না নিয়েই করেছে, সেটা কিছুটা হলেও অন্যায়। বিশেষ করে কুহেলির মনে হয়তো তেমন কোনও অনুভূতি নেই জেনেও এটা করা হয়তো উচিৎ হয়নি। কিন্তু কুহেলির এই অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরনটাই ওর অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ প্রথম যেন কুহেলির মনের কথা সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ সেই বিখ্যাত কথাটা মনে পড়ল, ‘নারী মনের তল পাওয়া ঋষি মুনিদেরও অসাধ্য’
কথাটা আজ অত্যন্ত সত্যি বলে মনে হল। নানা চিন্তার জালে সব ভাবনা গুলো কেমন জড়িয়ে যাচ্ছিল, কুহেলির ডাকে যেন হঠাৎ সব জাল ছিড়ে বাস্তবে ফিরল আলেখ।
কি হল? কোনও সমস্যা হয়েছে?
হ্যা? না, কোনও সমস্যা হয়নি তবে…
আলেখ একটু থামল, একটু ভেবে বলল,
অ্যাম সরি কুহেলি।
কুহেলি খুব সহজেই বুঝতে পারল আলেখ কেন সরি বলছে। মনে মনে ভাবল,
আমার অনুমানই তবে ঠিক, আলেখও আবেগের বশেই… আমি অযথাই উল্টোপাল্টা চিন্তা করছিলাম।
হায়! কুহেলি যদি আরেকটু বোঝার চেষ্টা করত তাহলে হয়তো বুঝতে পারত, আলেখ কেন ক্ষমা চাইছে! কুহেলি আলতো হেসে বলল,
সরি বলার কিছু নেই আলেখ, অনেক সময় এমনটা হয়, আমাদের আবেগ গুলো আমাদের বোধশক্তি কে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এতে কারো কোনও দোষ নেই, না তোমার না আমার। তাই সরি বলারও কোনও প্রয়োজন নেই।
আলেখ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল কুহেলির দিকে, তাহলে ওর ধারণাটাই ঠিক। কুহেলির মনে ওর জন্য তেমন কোনও অনুভূতি নেই, সবটাই একটা আবেগঘন মুহুর্তের দুর্বলতা ছিল মাত্র। কিন্তু এত সহজে সেটা মেনে নেবে ভাবতে পারেনি, ম্লান একটু হেসে বলল,
হুম, ঠিকই বলেছ। তবে আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো রাগ করবে বা তোমার হয়তো খারাপ লাগবে। যতই হোক এভাবে…..
আলেখকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কুহেলি বলল,
অযথা কেন রাগ করব বলতো! আমাকে কি তোমার এতটাই অবুঝ মনে হয়?
তোমাকে অবুঝ ভাবার ভুল আমি অন্তত করব না, তোমার মত এত পরিণত মনষ্ক মেয়ে খুব কমই আছে।
তাহলে? কেন ভাবলে আমি রাগ করব? আর তোমার উপরে রাগ করার কোনও কারণ আদৌ আছে কি? বরং আমি তো ভেবেছিলাম দেবার্ঘ্যকে দেখার পর তুমি রাগ করবে, কষ্ট পাবে। কিন্তু তুমি…..
এবার কুহেলির কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। আলেখ বলল,
আমার অজানা তো কিছু ছিল না, সবটাই জানতাম। তুমি তো কিছুই লুকাওনি আমার কাছ থেকে, তাহলে আমিও বা শুধু শুধু রাগ কেন করব?
কুহেলি কিছু না বলে একভাবে চেয়ে রইল আলেখের দিকে। আলেখ ঠিক আগের মতই একটু দুষ্টুমি ভরা হেসে বলল,
ওভাবে তাকিয়ে থেকো না, প্রেমে পড়ে যেতে পার কিন্তু।
কুহেলি যেন লজ্জায় লাল হয়ে গেল, হঠাৎ হঠাৎ এমন এক এক একটা কথা বলে না! কোনও মানে হয়? এত গম্ভীর ভাবে কথা বলতে বলতে এমন দুম করে কেউ মজা করতে পারে! আলেখের এই মজার ছলে বলা কথা গুলোও কেন যে ওকে এতটা প্রভাবিত করে কে জানে! কথাগুলো আলেখ মজার ছলে বললেও আজ যেন আর শুধুই মজা ছিল না, একটু লক্ষ্য করলেই কুহেলি বুঝতে পারত মজার ছলে বলা কথাগুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে আলেখের মনের গহীনে থাকা ভালোবাসার আহ্বান। আলেখের খুব ভালোলাগছিল কুহেলির লাজে রাঙা মুখটা দেখতে। কুহেলি একটু সামলে বলল,
তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না!
বলে আবার ঈষৎ ভেজা চুল গুলো সম্পূর্ণ শুষ্ক করার কাজে লেগে পড়ল। আলেখ একটু হেসে ওর লাগেজ থেকে একসেট ড্রেস বের করে ওয়াশরুমের দিকে এগোল। কুহেলি জিজ্ঞেস করল,
আজ লিয়াম কখন আসবে?
আমি লিয়ামকে আসতে বারন করেছি।
কুহেলি অবাক হয়ে বলল,
কেন?
আলেখ একটু ইতস্তত করে বলল,
না আসলে.. আমি ভাবছিলাম.. তোমার হয়তো মন ভালো থাকবে না.. তাই…
কুহেলি এবার উঠেই পড়ল, আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,
তাই তুমি লিয়াম কে বারন করে দিয়েছ?
হুম।
যাহ, আচ্ছা তুমিই তো বললে আমি এত অবুঝ নই তুমি জান, তাহলে শুধু শুধু কেন ওকে বারন করলে? কালকে হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার জন্য আমি আজও মন খারাপ করে বসে থাকব! হ্যা, তখন আমি সত্যিই খুব দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম এটা ঠিক কিন্তু আমি নিজেকে সামলাতে জানি। গেল একটা দিন মাটি হয়ে, তুমি কি যে করো না!
বাচ্চাদের মত মুখ ফুলিয়ে বসে পড়ল কুহেলি। আলেখের বড্ড ভালোলাগলো ওকে এইভাবে দেখে, এক চিলতে হাসি এমনিই ফুটে উঠল।
আরে মন খারাপ করো না, লিয়াম বলেছে দরকার হলেই ওকে ফোন করতে।
সত্যি?
হুম, আমি এক্ষুনি ওকে বলে দিচ্ছি।
আলেখ ওয়াশরুমে যাওয়ার আগেই লিয়াম কে ফোন করে জানিয়ে দিল ওরা বেরোবে। লিয়াম একঘন্টার মধ্যে আসছে জানাল। আলেখ ওয়াশরুমে যাওয়ার পর কুহেলি খুশিমনে উঠে আগে ব্রেকফাস্ট অর্ডার করল তারপর ড্রেস নিয়ে চলে গেল তৈরি হতে। কুহেলি সত্যি কালকের জন্য মনখারাপ করে বসে থাকার মেয়ে নয়। হ্যা, মুহুর্তের জন্য দুর্বল হয়ে পড়ে, ভেঙে পড়ে কিন্তু আবার ঠিক সামলে নেয় নিজেকে। কিন্তু এই নিয়ম টা কেন যে ভালোবাসার ক্ষেত্রে বদলে ফেলেছে সেটা জানা নেই। আজ কুহেলি একটা রেড স্কিনি জিন্সের সঙ্গে একটা হোয়াইট ফুলস্লিভ টপ আর একটা ব্ল্যাক নি লেন্থের ফার জ্যাকেট পরল। চুলগুলো আজ একটা পনি করে ছেড়ে দিল, আজ আর ক্যাপ না পরে একটা ইয়ার মাফ পরে নিল। চোখে আজকে একটু মোটা করেই আইলাইনার লাগাল, ঠোঁটে চেরী রেড লিপস্টিক টা লাগাতে গিয়ে আবার হঠাৎ করেই কালকের সেই মুহুর্ত টা ভেসে উঠল চোখের সামনে। আলেখের ঠোঁটের স্পর্শ টা যেন এখনও অনুভব করতে পারছে। স্পর্শ টা অনুভব করেই যেন সারা শরীর জুড়ে একটা শিহরণ খেলে গেল। হৃদযন্ত্র টা আবারও অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগল, আবার সেই অচেনা অনুভূতি গুলো উকি দিতে লাগল। এই অনুভূতির কারণ টা আজও অজানা ওর, হয়তো সেভাবে জানার চেষ্টাই করেনি। ডোর বেলের আওয়াজে কুহেলির ঘোর কাটল, আলেখও সদ্য স্নান সেরে বেরোল। কুহেলি নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি মুখেই এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে ছেলেটি চলে গেল, কুহেলি আর আলেখ চট পট ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে নীচে নেমে এল। লিয়াম আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল, ওদের দেখেই হাসি মুখে গাড়ির দরজাটা খুলে দিল। আজ আবার নতুন করে ওরা রওনা হল নতুন গন্তব্যের দিকে। হাসি ঠাট্টা কিছুটা খুনসুটি আর প্রাণখোলা আনন্দে মেতে কেটে গেল বাকি দিনগুলো। দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ যে কোথা থেকে পেরিয়ে গেল কেউ যেন বুঝতেই পারল না। গত রবিবার ওরা রওনা হয়েছিল সুইটজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে, আজ আবার সেই রবিবারেই ওরা ফিরছে। কুহেলির মনটা একটু খারাপ, দিনগুলো যেন বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল। তবে এতদিনের প্রাণভরা আনন্দের সম্ভারের কাছে সেসব তুচ্ছ। আজও লিয়ামই ওদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল, ওর মনটাও ভালো নেই। এই কয়েকদিনে বেশ মিশে গিয়েছিল ওদের সাথে, ওদেরও একটু খারাপ লাগছিল। কুহেলি সবার জন্য কিছু না কিছু কিনেছে, লিয়ামের জন্যও একটা সুন্দর রিস্টওয়াচ কিনেছে। আজ গাড়ি থেকে নেমে বক্সটা লিয়ামের হাতে দিতে গেলেই সে প্রবল আপত্তি করল। কিছুতেই নেবে না, আলেখ অনেক বলার পরেও সে সে কিছুতেই নিতে চাইল না। শেষে কুহেলি বলল,
লিয়াম, তুমি যদি এটা না নাও আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাব।
কিন্তু ম্যাম…
মনে কর না, তোমার এক ছোট বোন ভালোবেসে এটা তোমাকে দিচ্ছে।
কুহেলির কথায় যেন লিয়ামের মনটা খুশিতে ভরে উঠল। হেসে বলল,
জানেন ম্যাম, আজ পর্যন্ত অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কিন্তু আপনাদের মত এতোটা আপন কাউকে মনে হয়নি।
লিয়াম হাসি মুখেই বক্সটা নিল। কুহেলি হেসে বলল,
ভাল থেকো, আর এই ঘড়িটা দেখে আমাদের কথা মনে করো। হয়তো আর কোনদিনও দেখা হবে না, কিন্তু তোমাকে কোনদিনও ভুলব না।
লিয়াম হাসি মুখেই ওদের বিদায় জানাল। ফ্লাইটের সময় হয়ে এসেছে এবার আলেখ আর কুহেলিও সব নিয়ম কানুন পেরিয়ে উড়োজাহাজ টার গর্ভে উঠে পড়ল। নির্দিষ্ট সময়ে ওদের নিয়ে উড়োজাহাজ টা পাড়ি দিল দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে, সেখান থেকে আবার ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে, সব মিলিয়ে আবার সেই ষোলো ঘণ্টার জার্নি।
ক্রমশ___________
© স্বত্ব সংরক্ষিত
কেমন লাগল আজকের পর্ব জানাতে একদম ভুলবেন না কিন্তু। প্রতিবারের মত এবারও অপেক্ষা করব। আজ তবে এইটুকুই। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।