সংগোপনে’ পর্ব-৪৫

0
1232

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৪৫
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————

সকাল থেকেই কুহেলি মহা ব্যস্ত, অবশ্য শুধু কুহেলি নয় আজ মোটামুটি সবাই ব্যস্ত। আজ থার্টিফাস্ট ডিসেম্বর, ওঙ্কার গ্রুপস আর আগরওয়াল অ্যান্ড সন্সের দ্বিতীয় জয়েন্ট ভেঞ্চার নিয়ে সবাই সবিশেষ উৎসাহিত এবং কৌতূহলী। আগেরবার বার যে ভেনুতে প্রোডাক্ট লঞ্চের পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল এবারেও সেখানেই সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে। কুহেলি এই মুহূর্তে সেখানেই রয়েছে, নিজে সবটা আবার চেক করে নিচ্ছে। কোথাও কোনও কমতি থেকে যাক সেটা কুহেলি চায় না, আলেখও সকাল থেকেই অফিসে বসে লাস্ট মিনিট সব চেকিং গুলো সেরে নিচ্ছে। মোটামুটি সব কাজ সেরে যখন ওরা দুজনে ওঙ্কার ভিলায় ফিরল তখন দুপুর প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কুহেলি তো তাও কিছুটা আগে এসেছে কিন্তু আলেখের ফিরতে বেশ কিছুটা দেরী হয়ে গেছে। দুজনে লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার লেগে পড়ল কাজে, মানে এবার পার্টির জন্য প্রস্তুত হওয়ার পালা আর কি। কুহেলি নিজেকে খুব সুন্দর মার্জিত ভাবে একদম ফরম্যাল সাজে সজ্জিত করে নিল। আলেখও যথারীতি একটা গাঢ় বাদামী রঙের স্যুটে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে। দুজনেই প্রায় তৈরি বলা চলে এমন সময় হৈ হৈ করতে করতে রাত্রি এসে হাজির। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভিষন রকমের উৎসাহিত, তবে ঘরে ঢুকতেই ওর উৎসাহ উত্তেজনা সব যেন নিমেষের মধ্যে মিলিয়ে গেল। হা করে কিছুক্ষণ কুহেলির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

কুহেলি হোয়াট ইজ দিস?

কুহেলি একটু অবাক হয়ে বলল,

কি? কিসের কথা বলছ?

আরে তোমার ড্রেসের কথা বলছি আবার কিসের কথা বলব? এটা কি পরেছ তুমি? মনে হচ্ছে এক্ষুনি ব্যাগ কাধে নিয়ে অফিসে ছুটবে।

অফিস না হলেও অফিসিয়াল ইভেন্ট তো।

আরে, তার সাথে থার্টিফার্স্ট নাইটের পার্টিটাও তো আছে নাকি? এত ফর্ম্যাল সাজে তুমি পার্টি অ্যাটেন্ড করবে?

হুম, যতই থার্টিফার্স্ট এর পার্টি হোক মেইন ইভেন্ট তো সেই প্রোডাক্ট লঞ্চ, তাই না? সো, ফর্ম্যাল ড্রেসআপ করাটাই তো ঠিক।

একেবারেই না, আজকের দিনে তুমি এই বোরিং ড্রেসে কিছুতেই যেতে পারবে না।

রাত্রি, বাট আমি যদি কোনও ক্যাজুয়াল ড্রেস পরে যাই সেটাও তো খুব একটা ভালো দেখাবে না তাই না?

অত আমি জানি না, তবে তুমি এই ড্রেসে যেতে পারবে না।

রাত্রি….

আমি কিছু শুনছি না, এই আলু তুই কিছু বলছিস না কেন?

আমি এর মধ্যে নেই, তোরা যা ভালো বুঝিস কর।

নেই বললেই হল?

হ্যা, হল। কারণ আমি যদি এখন তোদের এই ড্রেসের চক্করে পড়ি তাহলে আমার মাথার আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। তোরা যা ভালো মনে করিস কর, আমি নীচে গেলাম, অঙ্কিত কে একটা জরুরী কল করতে হবে।

আলেখ মোটামুটি ঘর থেকে যেন পালিয়ে বাঁচল, মেয়েদের এই পোশাক নির্বাচনের হাঙ্গামার মধ্যে নিজেকে জড়ানোর কোনও ইচ্ছে নেই ওর। এদিকে রাত্রি তো নাছোড় বান্দা, কুহেলিকে শেষমেশ ড্রেস চেঞ্জ করতেই হল। রাত্রি নিজেই কুহেলির ওয়ার্ডরোব ঘেঁটে একটা সুন্দর শাড়ি পছন্দ করে বলল,

এটা পর, দারুন লাগবে আর তোমার ফর্ম্যাল ড্রেসও মেনটেন করা হয়ে যাবে। শাড়ি টাও কিন্তু ফর্ম্যাল ড্রেসের পর্যায়ে পড়ে জানো তো?

জানি কিন্তু এইরকম ডিজাইনার শাড়ি! একটু বেশি হয়ে যাবে না?

একেবারেই না, তুমি ওঙ্কার গ্রূপসের সি ই ও এর ওয়াইফ বলে কথা, তার উপরে এই প্রজেক্ট টা তোমার আন্ডারেই। নাও এবার ঝটপট এটা পরে এস, পরে দেরী হলে আমাকে দোষ দিতে পারবে না কিন্তু।

কুহেলি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ গিয়ে চেঞ্জ করে এল। সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে কুহেলিকে, ব্ল্যাক অ্যান্ড সিলভার কম্বিনেশনের ডিজাইনার শাড়িটা যেন একটা অন্যরকম মাত্রা যোগ করেছে ওর সৌন্দর্য্যে। লম্বা এক ঢাল চুলগুলো ছেড়েই রাখল, সেটাও অবশ্য রাত্রির কথা মতই। বাকি জুয়েলারী গুলোও রাত্রি নিজেই বেছে দিল, মোট কথা কুহেলির আজকের পুরো সাজটাই রাত্রির পছন্দে সম্পূর্ণ হল।

ওয়াও, জাস্ট লুক অ্যাট ইউ! কি দারুন লাগছে। আর আগে কি বোরিং লাগছিল, নাও ইটস পারফেক্ট।

হয়েছে? এবার খুশি তো? নাকি আরও কিছু বাকি আছে?

আমার কাছে তো একদম পারফেক্ট… বাকিটা না হয় তোমার ডিয়ার হাবিকে জিজ্ঞেস করে নিও। অবশ্য আলু কে জিজ্ঞেস করে খুব একটা লাভ হবে না, বিকজ তুমি যে রূপেই ওর সামনে যাও না কেন, বেচারা ঘায়েল হবেই।

কুহেলি একটু হেসে বলল,

হয়েছে তোমার লেগ পুলিং? এবার কিন্তু বেরোতে হবে নাহলে লেট হয়ে যাবে।

দুজনেই হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে এসে দেখল আলেখ এখনও ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে। একটু শুনেই কুহেলি বুঝল আলেখ নিশীথের সাথে কথা বলছে।

ইয়েস ইয়েস, এভরিথিং ইজ ফাইন, আমি এক্ষুনি অঙ্কিতের সাথে এটা নিয়েই কথা বলছিলাম সব কিছু একদম ঠিক আছে।

নিশীথ কি বলল সেটা শোনা গেল না, আলেখ আবার বলল,

ডোন্ট ওয়ারি মিস্টার আগরওয়াল, এটা আরও বেশি সাকসেসফুল হবে। আমরা এই কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরোব, ওকে দেন পার্টিতে দেখা হচ্ছে।

মিস্টার আগরওয়াল মানে যে নিশীথ আগরওয়াল সেটা বুঝতে রাত্রির খুব একটা অসুবিধা হল না। এক মুহুর্তের জন্য ওর মুখের অভিব্যক্তি সামান্য পরিবর্তিত হলেও সেটাকে রাত্রি বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দিল না। কুহেলি বলল,

কি বলছিলেন মিস্টার আগরওয়াল?

আলেখ কলটা সবে ডিসকানেক্ট করেছে ফলে চোখ দুটো তখনও ফোনের উপরেই নিবদ্ধ ছিল, কুহেলির আওয়াজ পেয়ে চোখ তুলে সেই যে তাকাল তো ব্যাস তাকিয়েই রইল। কুহেলি যে ওকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছিল সেটাও যেন দিব্যি ভুলে গেছে, শুধু হা করে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। রাত্রি ব্যাপার দেখে ধপ করে আলেখের পাশে বসে বেশ জোরেই কনুই দিয়ে একটা গুতো মারল। ওরকম একটা গুতো খেয়ে তবে আলেখের ঘোর কাটল, একটু চমকে উঠে বলল,

আহ্, রিতু কি করছিস?

আমি কি করছি? যা করার তা তো তুইই করছিস।

আলেখ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

আমি আবার কি করলাম?

আরে এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? নিজের ওয়াইফ কেই তো দেখছিস, অন্যের ওয়াইফ কে তো আর দেখছিস না।

আলেখ একটু হেসে বলল,

তা ঠিক।

কুহেলি এতক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে আলেখের অমন হা করে তাকিয়ে থাকা আর তারপর রাত্রি আর আলেখের এই কথা গুলো শুনছিল। আলেখের অমন মুগ্ধ দৃষ্টির ওকে ছুয়ে যাওয়াটা যে সে নিজেও বেশ উপভোগ করছিল একথা সে অস্বীকার করতে পারবে না, কিন্তু একটু কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

তোমরা দুজনে মিলে বসে তাহলে এই কর, আমি গেলাম।

কুহেলি পিছন ফিরে এগোতে গেলে রাত্রি লাফিয়ে ওর সামনে এসে বলল,

আরে দাড়াও দাড়াও, এত ব্যস্ত কেন? আগে আমার বন্ধুটিকে তোমাকে একটু প্রাণ ভরে দেখতে তো দাও।

রাত্রি!

কি রাত্রি? ঠিকই তো বললাম। এত সুন্দরী বউ হলে তো একটু দেখতে ইচ্ছে করবেই তাই না! বেচারা একেবারে ক্লিন বোল্ড হয়ে গেছে। পাঁচ মিনিট লেট হলে কিছু হবে না বুঝেছ তো, আর এখনও অনেক টাইম আছে। আমি এগোলাম তোমরা একটু রোম্যান্স করে এস, কেমন?

কুহেলি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু রাত্রি তার আগেই হাওয়া। আলেখও ততক্ষণে উঠে এসেছে কুহেলির কাছে, পিছন থেকে দুটো হাতের মাঝে কুহেলিকে বেঁধে ওর কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিল। আলেখের স্পর্শে কুহেলি যেন কেঁপে উঠল, কোনরকমে বলল,

আলেখ কি করছ! প্লিজ লিভ মি, দেরী হয়ে যাচ্ছে।

আলেখ কুহেলি কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,

তোমাকে সবসময়ই সুন্দর লাগে বাট আজকে যেন একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। লাইক, ভেরি ভেরি বিউটিফুল উইথ ফুল অফ হটনেস।

কথাটা আলেখ নেহাৎ মন্দ বলেনি। কালো রংটাই যেন একটু বেশিই আকর্ষণীয়, তার উপর যদি সুন্দরী বঙ্গললনার অঙ্গে শাড়ি ওঠে তাহলে তো আর কথাই নেই। কুহেলি একটা লাজুক হাসির রেখা ঠোঁটে এনে আলেখকে একটু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,

এখন এই হটনেস কুলনেস দেখার সময়? তোমার কি দিন দিন সময়জ্ঞান টাও লোপ পাচ্ছে নাকি?

কি আর করব বলো? এমন হট অ্যান্ড বিউটিফুল ওয়াইফ চোখের সামনে থাকলে নিজেকে কি আর কন্ট্রোল করা যায়! সময়ের হিসেব আর কীকরে থাকবে বলো?

খালি দুষ্টুমি, এখন চলো তো লেট হয়ে যাচ্ছে।

হুম, চলো।

দুজনে বাইরে এসে দেখল রাত্রি গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে, ওদের দেখেই মুচকি হেসে বলল,

কি, রোম্যান্স হলো?

আলেখ একটু দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল,

কোথায় আর হল? ভাবলাম গাড়িতে একটু সুযোগ পাব কিন্তু তারও আর উপায় নেই। তুই কাবাব মে হাড্ডির মত জুড়ে বসেছিস যখন তখন আর কি হবে!

কুহেলি একটু রেগেই বলল,

আহ্, কি হচ্ছে কি? কিচ্ছু মুখে আটকায় না নাকি?

না আটকায় না, এই রিতু তোর গাড়ি কি হল? নিজের গাড়িতে যেতে পারলি না?

নারে পারলাম না, বিকজ আমার কার আমি লাস্ট টাইমই সেল করে দিয়ে গিয়েছিলাম। আর শোন, যদি আমার কার থাকতোও তাও আমি তোর কারেই যেতাম।

তাই তো, আমাকে না জ্বালালে তোর তো শান্তি হয় না।

উফ্, তোমরা একটু থামবে? এবার কিন্তু সত্যিই লেট হয়ে যাচ্ছে।

তিনজনেই এবার বেরিয়ে পড়ল ভেনুর উদ্দেশ্যে, প্রায় মিনিট চল্লিশের রাস্তা হাসি ঠাট্টায় দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল। ভেনু তে পৌঁছানো মাত্র মিডিয়া যেন একেবারে ঘিরে ধরল, কিছুটা সময় ওদের কে দিতেই হল। তারপর যখন ওরা হলে প্রবেশ করল তখন ইতিমধ্যে বেশ কিছু অতিথি এসে গেছেন, নিশীথও ওদের আগেই এসে পড়েছে। সবার সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত থাকায় ওদেরকে খেয়াল করেনি, আলেখ কুহেলিকে বলে এগিয়ে গেল নিশীথের দিকে, আজকের দিনটা ওদের দুজনের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাত্রি হলে ঢুকেই নিশীথ কে দেখতে পেয়েছিল আর খুব অদ্ভুত ভাবেই বুকের ভিতরে একটা তীক্ষ্ম কষ্ট অনুভব করেছিল। এতদিন নিশীথের মুখোমুখি হতে হয়নি বলেই হয়তো কষ্ট টা অনুভব করতে পারেনি, আজ আবার চোখের সামনে ওকে দেখেই হয়তো ভুলতে চাওয়া কষ্টটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু রাত্রিও ঠিক করে নিয়েছে, অকারণে আর কারোর জন্যই নিজেকে কষ্ট পেতে দেবে না। তাই নিশীথের দিকে মন না দিয়ে পার্টির দিকে মন দিল, ওদিকে নিশীথ কিন্তু এখনও রাত্রিকে লক্ষ্য করেনি, আসলে রাত্রি যে আজ আসবে সেটাই তো জানা নেই ওর। একে একে সব নিমন্ত্রিত অভ্যাগতরাই উপস্থিত হলেন, শহরের সমস্ত বড় বড় বিজনেস ম্যান থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সবাই আজ এখানে উপস্থিত। আজকের অনুষ্ঠান টা বিদিশা আর রুহি দায়িত্ত্ব নিয়ে পরিচালনা করছে। সবাই প্রায় উপস্থিত শুধু রেহান খান্নার এখনও কোনও খবর নেই, তবে বালাকৃষ্ণা জী ফোন করে কনফার্ম করেছেন রেহান আর মিনিট চল্লিশের মধ্যে পৌঁছে যাবে। কিন্তু ততক্ষণ তো আর এতজন কে শুধু শুধু অপেক্ষা করানো যায় না, তাই আলেখ আর নিশীথের কথামত বিদিশা আর রুহি পার্টির সূত্রপাত করল। এবারের পার্টি আগেরবারের থেকে বেশ একটু আলাদা, সফট ড্রিঙ্কস আর হার্ড ড্রিঙ্কসের কাউন্টার তো এমনিই থাকে কিন্তু এবার তার সাথে ইন্ডিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের ফেমাস সব স্টার্টার আর মেন কোর্সের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। আর তাছাড়াও নানারকম ইভেন্টেরও আয়োজন করা হয়েছে, যেমন এই মুহূর্তে চলছে কাপল ড্যান্স। উহু, নরম্যাল ড্যান্স কিন্তু নয় পেপার ডান্স, একদম ঠিক ধরেছেন, ওই ড্যান্স গেম টাই। রাত্রি তো শুনেই দারুন একসাইটেড হয়ে পড়ল, কিন্তু নিজে তো আর অংশ নিতে পারবে না তাই কুহেলিকে নিয়ে পড়ল।

এই কুহেলি, তুমি আর আলু পার্ট নাও।

না না, একদম না।

না কেন?

আরে আমি এইসব পারি না, তুমি এক কাজ কর তুমি আর আলেখ পার্ট নাও।

আরে ধুর, তোমরা রিয়েল লাইফ কাপল থাকতে হঠাৎ আমি মাঝখানে কোথা থেকে এলাম? এই চলো তো, এস আমার সঙ্গে।

বলে রাত্রি কুহেলিকে প্রায় টানতে টানতে আলেখের কাছে নিয়ে এলো। আলেখ তখনও নিশীথের সঙ্গেই কথা বলছিল, রাত্রিকে হঠাৎ ওভাবে আসতে দেখে ওরা দুজনেই কথা থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। বিশেষ করে নিশীথ, রাত্রি যে আসবে এটা ওর জানা ছিল না, তবে খুব একটা অবাক হয়নি। আলেখের কোনও ইভেন্টে রাত্রির উপস্থিত থাকাটাই বরং বেশি স্বাভাবিক। রাত্রি কিন্তু যেন নিশীথ কে দেখেও দেখল না, সোজা আলেখকে বলল,

এই যে মিস্টার শর্মা, নিজের মিসেসের সঙ্গে একটু ড্যান্স করুন।

কুহেলি তখনও না না করেই চলেছে, আলেখও একটু ইতস্তত করতে লাগল কিন্তু রাত্রির জেদের কাছে ওর কোনও বারণই ধোপে টিকল না। শেষ পর্যন্ত ওদের রাজি হতেই হল, কিন্তু কুহেলিও কম যায় না, সেও একটা শর্ত রেখে বসল,

ওকে ফাইন, আমরা পার্ট নেব কিন্তু একটা শর্ত আছে।

কি?

তুমিও পার্ট নেবে।

রাত্রি একটু হেসে বলল,

কুহেলি আমি পার্ট নিলে কিন্তু তুমি হেরে যাবে, কলেজ লাইফে এইসব আমার কাছে জল ভাত ছিল।

ফাইন, আমার হারতে কোনও প্রবলেম নেই।

ওকে, বাট আমি নিশ্চয়ই পার্টিসিপেট করতাম কিন্তু অ্যাস ইউ সি এটা কাপল ড্যান্স। একজন পার্টনার প্রয়োজন, আর আমার কোনও পার্টনার নেই সো বেচে গেলে।

উহু, আমি এত সহজে বাঁচতে চাই কে বলল? পার্টনার নেই তো কি হয়েছে? হতে কতক্ষন?

আচ্ছা? এমন করে বলছ যেন তোমার হাতের মুঠোয় আমার ডান্স পার্টনার নিয়ে ঘুরছ!

উহু, হাতের মুঠোয় নয়, হাতের কাছে।

মানে?

মানে মিস্টার আগরওয়াল উইল বি ইওর পার্টনার।

কথাটা শুনে রাত্রি আর নিশীথ দুজনেই চমকে উঠল, নিশীথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই রাত্রি বলে উঠল,

হোয়াট! আর ইউ ম্যাড? ইম্পসিবল।

কেন? এতে ইম্পসিবলের কি আছে? কি মিস্টার আগরওয়াল আপনার কোনও আপত্তি আছে নাকি?

নিশীথ একটু আমতা আমতা করে বলল,

না মানে, আসলে… আমি এসব ঠিক..

কুহেলি ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল,

ডোন্ট টেল মি দ্যাট দ্য নিশীথ আগরওয়াল কান্ট ড্যান্স।

নিশীথ হেসে বলল,

নো, ঠিক তা নয়… অ্যাকচু…..

এবারও নিশীথের কথাটা অসম্পূর্ণই থেকে গেল, কুহেলি আবার বলে উঠল,

সো, তাহলে প্রবলেম টা কোথায়? আপনারা তো এমনিতেই পূর্ব পরিচিত।

এবার রাত্রি বলার চেষ্টা করল,

বাট কুহেলি….

কিন্তু কুহেলি রাত্রির কথাও সম্পূর্ণ হতে দিল না। যেন হঠাৎ করেই রাত্রি আর কুহেলির মধ্যে চারিত্রিক অদল বদল ঘটেছে। কুহেলি কিছুতেই শুনবে না, তার এক কথা রাত্রি যদি পার্টিসিপেট না করে তাহলে সেও পার্টিসিপেট করবে না। এতক্ষণ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করার পর আলেখ বলল,

কাম অন রিতু, হোয়াটস দ্য বিগ ডীল! তোর জন্য দেখ আমার চান্স টাও মিস হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

রাত্রি রাজি হওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় দেখতে পেল না। ওর বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই নিশীথের সাথে ড্যান্স করার, ড্যান্স কেন সে নিশীথের মুখোমুখিও হতে চায় না। কিন্তু এখন আর কোনও উপায় নেই, রাত্রি জানে নিশীথের কাছাকাছি গেলেই ওর চেপে রাখা কষ্ট গুলো আবার জেগে উঠতে চাইবে। অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে চাওয়া অনুভূতি গুলো হয়তো আবারও নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে চাইবে। হয়তো রাত্রি আবারও দুর্বল হয়ে পড়বে কিন্তু রাত্রি সেটা হতে দিতে চায় না। এখন এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়ারও কোনও পথ সে দেখতে পাচ্ছে না। ওর নিজের জন্য কুহেলি বা আলেখ কষ্ট পাক সেটা সে চায় না, তাই মনটাকে শক্ত করে রাত্রি একটু হেসে বলল,

ওকে ফাইন।

কুহেলি খুশি হয়ে আলেখের বাড়িয়ে দেওয়া হাত টা ধরে এগিয়ে গেল ড্যান্স ফ্লোরের দিকে। রাত্রি সেদিকে তাকিয়ে নিজের মনটাকে একবার গুছিয়ে নিল। রাত্রি বুঝতে পারছে ওর হৃদযন্ত্র টা ইতিমধ্যেই বেশ দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে কিন্তু নিজের মনের কোনও খবরই সে নিশীথ কে জানতে দেবে না। কর্মসূত্রে আলাপ হওয়া একজন ব্যক্তির সঙ্গে যেরকম আচরণ করা উচিৎ রাত্রিও ঠিক তেমনই ব্যবহার করবে নিশীথের সঙ্গে। ঠোঁটে একটা স্বাভাবিক মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,

সো, মিস্টার আগরওয়াল, শ্যাল উই?

নিশীথ একটু যেন দ্বিধায় ছিল, তবে রাত্রির চোখে নিজের জন্য যে অন্যরকম অনুভূতিগুলো সেদিন লক্ষ্য করেছিল সেগুলো যেন আজ আর দেখতে পাচ্ছে না। নিশীথ মনে মনে ভাবল, তার ভাবনাটাই তবে ঠিক ছিল, রাত্রির মনেও শুধুই একটা সাময়িক মোহই জন্ম নিয়েছিল। তাই তো, সেই মোহ কেটে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু নিশীথ যতই বিচক্ষণ হোক না কেন, দিনের শেষে সেও একজন পুরুষ, একজন সাধারণ মানুষ। আর এই জগতে কারোর পক্ষেই সব কিছু বুঝতে পারা সম্ভব নয়, নিশীথও তার ব্যতিক্রম নয়। আর কথাতেই তো আছে নারী হৃদয়ের তল পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব। নিশীথও তাই রাত্রির মেকি হাসির আড়ালে দমিয়ে রাখা অনুভূতি গুলোকে লক্ষ্য করতে পারেনি। তাই খুব সহজ ভাবেই রাত্রির বাড়িয়ে দেওয়া হাত টা ধরে হাসি মুখেই এগিয়ে গেল ফ্লোরের দিকে। বেশ কিছু জুটি অংশ নিয়েছে, সবার সামনে রাখা একই মাপের কাগজের টুকরো। বিদিশার কথামত সব জুটি নিজেদের পেপারের উপর দাড়ানোর পর শুরু হল হালকা সুরের একটা মিষ্টি রোম্যান্টিক মিউজিক। প্রথম দিকটায় কারোরই তেমন কোনও অসুবিধা হল না, কিন্তু যতই কাগজের টুকরো টা ছোট হয়ে আসতে লাগল ততই জুটির সংখ্যাও কমে আসতে লাগল। কুহেলি আর আলেখ মুহূর্ত টাকে বেশ উপভোগ করছে, এই মুহূর্তে কাগজটা এতটাই ছোট যে শুধু মাত্র আলেখ সেটার উপর দাড়িয়ে আছে আর কুহেলি আলেখের পায়ের উপর পা রেখে দাড়িয়ে আছে। আলেখের দুটো হাত কুহেলির কোমর ঘিরে একটা সুদৃঢ় বলয়ের সৃষ্টি করে রেখেছে, আর কুহেলির হাত দুটো আলগোছে অবস্থান করছে আলেখের কাধের উপর। দুজনের ঠোঁট জুড়েই ছড়িয়ে আছে একটা মিষ্টি হাসি, ওদের কাছে এই মুহূর্তটা যতটা সুন্দর অন্যদিকে রাত্রির কাছে এই একই মুহূর্ত যেন যেন ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে উঠছে। নিশীথের এক একটা স্পর্শ যেন ওর বাইরের মেকি সত্তা টাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। নিশীথের এত কাছাকাছি এসে যেন রাত্রির সব অনুভূতি গুলো আবারও জেগে উঠছে। এবার কাগজের টুকরো টা এতটাই ছোট হয়ে এল যে একজন মানুষ কোনরকমে দাড়াতে পারে। সবারই নিজের সঙ্গিনীকে কোলে তুলে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সবাই বলতে এখন শুধুই আলেখ কুহেলি, নিশীথ রাত্রি আর অন্য একটা জুটি অবশিষ্ট রয়েছে। আলেখ কুহেলিকে কোলে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য ছেলেটিও তার সঙ্গিনীকে কোলে তুলে নিল। নিশীথ রাত্রির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত্রি যেন কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে, তাই নিশীথ বলল,

মিস রাত্রি, আপনি চাইলে আমরা এখানেই কুইট করতে পারি।

রাত্রি নিজেও মনে মনে সেটাই চাইছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিশীথের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারলেই ভালো। না হলে হয়তো আবার নিশীথের সামনে দুর্বল হয়ে পড়বে কিন্তু এখন হঠাৎ করে যদি মাঝপথেই ছেড়ে দেয় তাহলেও তো নিশীথ ওকে দুর্বলই ভাববে। একটা সামান্য ড্যান্স করতে এত ইতস্তত করার তো কিছু হয়নি, না নিজেকে কিছুতেই নিশীথের সামনে দুর্বল হতে দিতে চায় না সে। নিজেকে জোর করে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল,

নো নো, কুইট করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

শিওর?

ইয়েস।

ওকে।

নিশীথ রাত্রিকে কোলে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাত্রি বুঝতে পারল ওর ইতিমধ্যেই দ্রুত গতিতে চলতে থাকা হৃদ স্পন্দন আরও দ্রুত গতিতে রূপান্তরিত হল। একটু পরেই অন্য জুটির ছেলেটি নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল, এখন শুধুই আলেখ কুহেলি আর নিশীথ রাত্রি অবশিষ্ট রয়েছে। নিশীথ এতক্ষণ রাত্রিকে সেভাবে লক্ষ্য করেনি, এখন যেন একটু ভালো করে দেখল। একটা চেরী রেড অফ শোল্ডার লং ড্রেসের সঙ্গে মানানসই হালকা জুয়েলারী আর প্রসাধনীতে রাত্রিকে সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী লাগছে। যে কেউ একবার দেখেই মন দিয়ে দিতে পারে, কিন্তু নিশীথ অন্য সবার থেকে আলাদা। তবে রাত্রির সৌন্দর্য্য কে অস্বীকার করার ক্ষমতা নিশীথেরও নেই, হঠাৎ যেন নিশীথের মনে হল রাত্রির গোটা শরীর টা তিরতির করে কাপছে। অনুভুতিটা নিশীথের মনের ভুল নয়, রাত্রির গোটা শরীর জুড়ে তখন সত্যিই ছড়িয়ে পড়েছে এক অজানা শিহরন। রাত্রি যেন কিছুতেই নিজের অনুভুতি গুলোকে আর দমিয়ে রাখতে পারছে না, মনে হচ্ছে সময় টা এখানেই থেমে যাক। রাত্রির কম্পমান বন্ধ চোখের পলক নিশীথের মনে আবার একটা আশঙ্কার সৃষ্টি করল। তবে কি রাত্রি এখনও…. মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিশীথের ভারসাম্যও বেসামাল হয়ে গেল আর আলেখ আর কুহেলি বিজয়ী ঘোষিত হল। নিশীথ রাত্রিকে নামিয়ে দেওয়ার পরও যেন রাত্রি তিরতির করে কাপছিল, নিশীথ সেটা লক্ষ্য করেই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই কুহেলি এসে হাসি মুখে বলল,

কি রাত্রি? হেরে গেলে তো?

রাত্রি খুব অদ্ভুত একটা দৃষ্টি তে একবার নিশীথের দিকে তাকিয়ে কুহেলিকে বলল,

হ্যা, সত্যিই আজ আমি হেরে গেলাম।

বলে রাত্রি আর এক মুহূর্তও সেখানে দাড়াল না। কুহেলির খুব অবাক লাগল, রাত্রির হঠাৎ এরকম আচরণের কারণ টা যেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। এই তো কিছুক্ষণ আগেও মেয়েটা একদম ঠিক ছিল তাহলে এখন আবার কি হল? কুহেলির মনে হল হয়তো নিশীথের সঙ্গে আবার কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে, সে নিশীথ কে জিজ্ঞেস করতে যাবে এমন সময় পার্টিতে রেহান খান্নার আগমন ঘটল আর এই প্রসঙ্গ টা ওখানেই চাপা পড়ে গেল। নিশীথের মনেও একটা আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল যেটা সে নিশ্চিত করতে চাইছিল কিন্তু সেটাও আর হয়ে উঠল না। সবাই এবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল আজকের মূল ইভেন্ট ওঙ্কার গ্রুপস আর আগরওয়াল অ্যান্ড সন্সের নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ নিয়ে। রেহান খান্নার হাতে প্রোডাক্ট লঞ্চ থেকে শুরু করে প্রেস কনফারেন্স হতে হতে বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। আর এই গোটা সময়টা আলেখ কুহেলি আর নিশীথ তিনজনেই ব্যস্ত থাকার দরুন রাত্রির দিকে আর তাদের দৃষ্টি গেল না। রাত্রি তখন ওদের কাছ থেকে সরে এসে… না, সরে আসা নয়, পালিয়ে এসেছে। হ্যা, পালিয়ে এসেছে, নিশীথের কাছ থেকে ওর নিজের অনুভূতি গুলোর কাছ থেকে। যতই রাত্রি নিজের অনুভুতি গুলোকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করুক মনের গভীরে সেও জানে নিশীথের প্রতি তার মনে একটা অন্যরকম অনুভূতি ওর অজান্তেই গড়ে উঠেছে। আজ নিশীথ কে আবার নিজের সামনে দেখে এতোটা কাছে অনুভব করে যেন আর সেই অমোঘ সত্যি টাকে জোর করেও অস্বীকার করতে পারছে না। রাত্রির নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে, ছুটে যে তখন কোথায় এসেছিল নিজেও লক্ষ্য করেনি। এখন বুঝতে পারল ও হার্ড ড্রিঙ্কসের কাউন্টারের সামনে দাড়িয়ে আছে, এর আগে যে রাত্রি কখনও ড্রিঙ্কস করেনি তা নয় তবে বরাবরই পরিমাণটা খুবই পরিমিত ছিল। আজ রাত্রি নিজের অশান্ত এলোমেলো মনটাকে শান্ত করার জন্য অ্যালকোহল কেই যেন আকড়ে ধরতে চাইল। একের পর এক গ্লাস ফাঁকা হয়ে যেতে লাগল কিন্তু ওর ভিতরের উথাল পাথাল যেন কিছুতেই শান্ত হল না। একসময় প্রেস কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর কুহেলি একটু ফাঁকা হয়েই রাত্রিকে খুঁজতে লাগল। একটু খুঁজতেই রাত্রিকে দেখতে পেল কুহেলি, কিন্তু এই অবস্থায় যে দেখতে পাবে সেটা হয়তো আশা করেনি। রাত্রি যেন নিজের হুশেই নেই, কুহেলি ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে উদ্বিগ্ন সুরে বলল,

রাত্রি হোয়াট হ্যাপেনড? তুমি এত ড্রিংক করেছ কেন?

হুম? কে? ওহ কুহেলি, তুমি?

কুহেলি বুঝল রাত্রির বেশ ভালই নেশা হয়েছে, ওকে ধরে একটু ফাঁকা জায়গায় এনে বসিয়ে এক গ্লাস জল দিয়ে বলল,

রাত্রি এটা খাও।

নাহ, আর খাবো না। অনেক তো খেলাম কিন্তু লাভ হল কোথায়? আমার মনটা যে এখনও শান্ত হল না।

রাত্রির প্রতিটা কথার পিছনে লুকিয়ে থাকা কষ্টের সুরটা যেন কুহেলি বুঝতে পারল। কিন্তু কিসের এত কষ্ট যে রাত্রি এই পরিমাণ ড্রিংক করেছে? আর হঠাৎ করে এখানে কি এমন হল?

রাত্রি? রাত্রি তোমার কি হয়েছে? ইজ দেয়ার এনি প্রবলেম?

প্রবলেম? ওহ ইয়েস… প্রবলেম… দেয়ার ইজ এ প্রবলেম… মাই হার্ট… মাই ফিলিংস….

বলতে বলতে রাত্রি যেন ঢুলে পড়ল। কুহেলি বুঝতে পারছে মেয়েটার মনের গভীরে একটা ক্ষত রয়েছে, যেটা হয়তো রাত্রি আড়াল করে রাখতে চাইছিল কিন্তু কোনও কারণে এখানে এসে সেই ক্ষতটা আবার তাজা হয়ে উঠেছে।

রাত্রি, তোমার ফিলিংস প্রবলেম কেন হবে? কি হয়েছে রাত্রি আমাকে বলো প্লিজ।

তুমি…. তুমি শুনবে?

হ্যা, আমি শুনব। তুমি বলো, আমি সবটা শুনতে চাই।

রাত্রি একটু অদ্ভুত ভাবে হেসে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ একদিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। চোখের তারায় ফুটে উঠতে লাগল মনের কোনায় জমে থাকা অব্যক্ত কষ্টের প্রতিচ্ছবি। কুহেলি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল আলেখ আর নিশীথ এক সাথে আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে। কুহেলির মনে একটা অদ্ভুত আশঙ্কার সৃষ্টি হল, আলেখ যে রাত্রির কষ্টের কারণ নয় সেটা বলাই বাহুল্য তাহলে কি নিশীথ? কিন্তু নিশীথের রূঢ় আচরণের পরেও তো রাত্রি এতোটা দুঃখ পায়নি, আর তাছাড়াও আগের বার নিশীথ রাত্রিকে অত বড় একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করেছিল তারপরে তো আর এমন কিছু হওয়ার কথা নয়। রাত্রির কথা শুনেও তো মনে হয়েছিল ওর মনে নিশীথের প্রতি কোনো বিরক্তি বা ক্ষোভ নেই তবে? কুহেলি নিজের ভাবনার জগতে যেন এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিল হঠাৎ রাত্রির কথায় চিন্তার জাল টা ছিড়ে গেল। রাত্রির চোখ বেয়ে নামতে শুরু করেছে উষ্ণ জলের স্রোত, দৃষ্টি এখনও নিশীথের দিকেই নিবদ্ধ, কান্না ভেজা সুরে রাত্রি বলে চলেছে,

জানো কুহেলি, মাঝে মধ্যে তোমার সব থেকে প্রিয় ফিলিংস গুলোই তোমার সব থেকে বেশি কষ্টের কারণ হয়ে ওঠে।

কুহেলির মনে যে আশঙ্কা টা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, রাত্রির কথায় যেন সেটা সত্যি প্রমাণিত হল। রাত্রি… নিশীথ কে ভালোবাসে! কিন্তু কবে থেকে? কি করে? আর যদি ভালোবেসেই থাকে তাহলে এত কষ্ট পাচ্ছে কেন? নিশীথ কি জানে? নিশীথ কি রাত্রিকে ফিরিয়ে দিয়েছে? তাই রাত্রি এত কষ্ট পাচ্ছে? নাকি এখনও রাত্রি নিশীথ কে কিছু জানায়নি? হাজারটা প্রশ্ন এখন কুহেলিকে ঘিরে ধরছে যেন। উত্তর গুলো হয় রাত্রি দিতে পারে নয়তো নিশীথ। এক্ষেত্রে রাত্রির কাছ থেকেই উত্তরটা জানতে চাওয়া টা সঠিক হবে কিন্তু এটা সঠিক সময় নয়। কারণ রাত্রি এখন প্রায় বেহুঁশ, যদিও পার্টির মেইন ইভেন্ট টা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে কিন্তু তবুও এটা যেহেতু থার্টিফার্স্ট নাইটের পার্টি তাই নতুন বছরকে স্বাগত না জানিয়ে পার্টি ছেড়ে যাওয়াটা কুহেলির পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু রাত্রিকে এভাবে এখানে একা ছাড়াও সম্ভব নয়, ওকে এক্ষুনি বাড়ি পাঠাতে পারলে সব থেকে ভালো হয়। কিন্তু কীকরে পাঠাবে? ওর তো কার নেই, আর আলেখের কার আলেখ নিজে ড্রাইভ করে সুতরাং ড্রাইভারও নেই যে তাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবে। ক্যাব বুক করে পাঠানোরও কোনও প্রশ্ন ওঠে না, এই অবস্থায় কোনো অচেনা মানুষের সাথে রাত্রিকে একেবারেই ছাড়া যাবে না। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, যেদিক টায় আলেখ আর নিশীথ ছিল সেদিকে তাকিয়ে দেখল আলেখ সেখানে নেই কিন্তু নিশীথ আছে। ভাগ্যক্রমে কুহেলি যখন সেদিকে তাকায় নিশীথও কাকতালীয় ভাবে ওদের দিকে তাকানোতে কুহেলির চোখে চোখ পড়ে আর ওর চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠা ব্যাকুলতা নিশীথ কে বাধ্য করে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে। কাছে এসে রাত্রিকে এই অবস্থায় দেখে নিশীথ একটু অবাক হয়ে বলল,

কুহেলি, কি হয়েছে? মিস রাত্রি এভাবে এতোটা ড্রাংক?

কুহেলি মনে মনে বলল,

সেটা তো আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই।

কিন্তু মুখে বলল,

ঠিক জানিনা, আমিও এখন এসে দেখছি এই অবস্থা। ওকে ইমিডিয়েটলি বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা দরকার। আমি নিজেই চলে যেতাম কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন এভাবে…..

আই নো, তাহলে কি করবেন ঠিক করলেন?

প্রবলেম তো সেটাই, বুঝতে পারছি না কি করব। আলেখের পক্ষেও তো এভাবে পার্টি ছেড়ে যাওয়া টা পসিবল নয়। আর ওকে কোথাও দেখছিও না, যে একটু আলোচনা করব।

রাত্রিকে এই ভাবে দেখে নিশীথের মনের আশঙ্কা টা আরো যেন বাড়তে লাগল। তবে মেয়েটাকে দেখে কেন যেন একটু খারাপ লাগছে, ওর এই অবস্থার জন্য পরোক্ষ ভাবে হলেও তো সেই দায়ী। নিশীথ একটু ভেবে বলল,

কুহেলি যদি প্রবলেম না হয় তাহলে আমি মিস রাত্রিকে পৌঁছে দিতে পারি।

আপনি?

হ্যা, মানে এখন আমার তেমন একটা প্রয়োজন নেই এখানে। হোস্ট তো আপনারা মানে ওঙ্কার গ্রুপস, তাই আপনাদের থাকাটা জরুরি। আমি না থাকলেও কোনও অসুবিধা হবে না, তাই বলছিলাম। অবশ্যই যদি আপনার কোনও প্রবলেম না থাকে।

কুহেলি এক মুহুর্তের জন্য ভাবল, নিশীথের সঙ্গে রাত্রিকে পাঠানো টা কি ঠিক হবে? রাত্রির ভিতরে জমে থাকা কষ্টের কারণ যে নিশীথ সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে কিন্তু… এছাড়া আর কি করবে এখন? কার সাথে পাঠাবে? নিশীথ কে যে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায় সেটা কুহেলি জানে। তাই আর বেশি না ভেবে বলল,

না না, আমার কোনও প্রবলেম নেই, আপনিই তাহলে প্লিজ ওকে একটু পৌঁছে দিন।

প্লিজ বলার কিছু হয়নি কুহেলি। আপনি শুধু ওকে একটু আমার গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিন।

ওকে।

কুহেলি রাত্রিকে ধরে আস্তে আস্তে হলের বাইরে নিয়ে এল। নিশীথ আগেই পার্কিং থেকে ওর কার টা নিয়ে এসেছে। প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা টা খুলে দিলে কুহেলি ধীরে ধীরে রাত্রিকে বসিয়ে দিল। রাত্রি যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে, কি হচ্ছে কেন হচ্ছে সেসবের দিকে যেন কোনও ধ্যানই নেই। নিশীথ কুহেলিকে বাই বলে গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে পড়ল রাত্রির বাংলোর উদ্দেশ্যে। পথে রাত্রি কি যেন বিড়বিড় করে বলেই চলেছে, কোনও কথাই ঠিক স্পষ্ট নয়। একসময় হঠাৎ রাত্রি সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করে নিশীথের দিকে তাকিয়ে খুব অদ্ভুত ভাবে হাসতে হাসতে বলল,

আরে, মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল! আপনি? আপনি এখানে কি করছেন?

নিশীথ কোনও উত্তর দিল না, এমন কি তাকাল পর্যন্ত না কারণ এখন রাত্রি যা করছে তার কোনোটাই সজ্ঞানে করছে না তাই অত গুরুত্ব না দেওয়াই ভাল। নিশীথ কোনও উত্তর না দেওয়ায় হঠাৎ রাত্রি রেগে গিয়ে চেঁচাতে লাগল,

হেই ইউ, কি মনে করেন আপনি নিজেকে হ্যা? আপনি একজন অতি নিকৃষ্ট মনের ব্যক্তি। আপনার কাছে কারোর ফিলিংসের কোনও দাম নেই, আপনার কাছে তো সবটাই শুধু বিজনেস। ইউ.. ইউ…

কথা গুলো যেন আটকে গেল, নিশীথ বুঝতে পারছে ওর আশঙ্কা টাই ঠিক। রাত্রির মনে কি তবে মোহ নয় অন্য কিছু জন্ম নিয়েছে? কিন্তু সেটা তো আরো বেশি ভয়ংকর। এতে রাত্রির কষ্ট আরও বাড়বে, কারণ নিশীথের মনে যে রাত্রির প্রতি কোনো অনুভূতি নেই। ওর সমগ্র মন জুড়ে যে শুধু একজনেরই বাস, সেখানে তো অন্য কারোর জায়গা নেই, হতে পারে না। এদিকে রাত্রি হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল,

স্টপ দ্য কার।

ক্রমশ___________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগল আজকের পর্ব? কি মনে হয়? কি হতে চলেছে এরপর? কোনদিকে মোড় নেবে ওদের জীবন? কমেন্ট করে নিজেদের মতামত জানাতে ভুলবেন না যেন। অপেক্ষায় থাকলাম কিন্তু। আজ তবে আসি দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here