বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ৩৭

0
4640

বিকেল গড়িয়েছে।শীতের বৈকাল বেলা যেতে বেশি সময় নেয় না।দুপুর পড়তেই কেমন যেনো থমথমে হয়ে যায় পরিবেশ।পিনপিন করে শীতল হাওয়া বইতে শুরু করছে
একটা চায়ের দোকানে বসে আছে আজরাহান।গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে রেখেছে।
সামনেই একটা কোচিং সেন্টার।প্রহর কে সেখানেই ভর্তি করানো হয়েছে।আজরাহান কলেজের চাকরি টা ছেড়ে দিয়েছে।এখন সে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে।আর পাশাপাশি মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের প্রিপারেশ নিচ্ছে।তাই এখন আর প্রহর কে পড়ানোর সময় করে উঠতে পারে না।
হাতে একটা চাদর নিয়ে বসে আছে আজরাহান।এক কাপ চা নিয়ে তাতে চুমুক দেয়।চায়ের উষ্ণ ছোঁয়ায় শরীরের উষ্ণতায় ভরে কানায় কানায়।
চারটা বাজতেই কোচিং ছুটি হয়।সেখানে থেকেই বেরিয়ে আসে প্রহর।আজরাহান কে দেখে পায়ের গতি বাড়ায়।প্রহর কে দেখেই স্মিত হাসে আজরাহান।উচ্ছ্বসিত গলায় প্রহর বললো—

“আপনি??

আজরাহান শান্ত ভঙ্গিতে বললো–

“হুম।অফিস ছুটি তাই তোকে নিতে এলাম।”

ঠান্ডা হাওয়া লাগতে কুঁকড়ে উঠে প্রহর।আজরাহান ধমকে বললো–

“শীতের কাপড়ে পড়িস নি কেন তুই?

প্রহর ঠোঁট উল্টে স্বাভাবিক গলায় বললো–

“আরে তখন এতো ঠান্ডা ছিলো নাকী!

আজরাহান শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতে থাকা চাদর টা প্রহর এর গায়ে জড়িয়ে দেয়।উজ্জ্বল হাসে প্রহর।সানোয়ার আহমেদই প্রহর কে আনা নেওয়া করে কিন্তু আজ আজরাহান এর অফিস জলদি শেষ হওয়ায় ও নিজেই আসে প্রহর কে নিতে।
আজরাহান বিগলিত হেসে বললো—

“কিছু খাবি?

“হুম।”

“কী খাবি বল।”

“আইসক্রীম।”

আজরাহান ভ্রু ক্রটি করে তপ্ত গলায় বললো–

“ঠাটিয়ে এক চড় মারবো গালে।এই ঠান্ডায় কেউ আইসক্রীম খায়!

প্রহর কপট অভিমানের সুরে বললো–

“খাওয়াবেন না যখন জিঙ্গেস করলেন কেন?

ওদের কথার মধ্যেই সেখানে এসে দাঁড়ায় এক অর্ধ বয়স্ক মহিলা।প্রহর কে দেখে সরস হাসলেন।মহিলাটিকে প্রহর চিনে।প্রায়ই সানোয়ার আহমেদ এর সাথে বসে গল্প করেন। প্রহর মৃদু গলায় মহিলাটিকে বললো–

“কেমন আছেন আনটি?

মহিলাটি পান খাওয়া লাল লাল দাঁত গুলো বের করে কেলিয়ে হাসলেন।আজরাহান অপ্রস্তুত হলো।মহিলাটি স্বাভাবিক গলায় বললেন–

“আজ তোমার বাবা আসেনি?

“উহু।”

সানোয়ার আহমেদ অচেনা মানুষের কাছে প্রহর কে নিজের মেয়ে বলেই পরিচয় দেয়।আর এখনো প্রহর এর আঠারো বছর হয়নি।মহিলাটি উদ্বিগ্ন গলায় বললেন–

“তাহলে তুমি যাবে কী করে?

প্রহর স্মিত হেসে সরস গলায় বললো–

“এই যে রাহান ভাইয়ার সাথে যাবো।”

মহিলাটি আজরাহান এর দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ মুখ বাঁকালেন।এতোবড় একটা ছেলের পর আবার মেয়ের জন্মদিলেন!
মহিলাটি আজরাহান কে লক্ষ্য করে মৃদু হেসে বললেন–

“কেমন আছো বাবা?

আজরাহান শান্ত গলায় বললো–

“জ্বী ভালো।আপনি ভালো আছেন?

“আমার আর কী।এই আছি তো এই নেই।”

আজরাহান বেখেয়ালি ভাবে বললো–

“ও আচ্ছা।”

মহিলাটি এইবার গলার স্বর একটু নিচু করে বললেন–

“তোমাকে একটা কথা বলবো?
আসলে তোমার বাবাকেই বলতাম।কিন্তু তিনি তো আজ আসেন নি তাই তোমাকেই বলছি।”

আজরাহান কপাল ভাঁজ করে বললো–

“বলেন কী বলতে চান।”

মহিলাটি তার পানের পিক পিচ করে ফেলে ভজ ভজ করে তা চিবুতে চিবুতে বললেন—

“তোমার বোনকে বিয়ে দিবে?
একটা ভালো ছেলে আছে।”

আজরাহান মুহুর্তেই চক্ষু গরম করে শক্ত গলায় বললো–

“বোন!কে বোন!আর কীসের বিয়ের কথা বলছেন?

মহিলাটি তার একহাত আজরাহান গায়ে বুলাতে বুলাতে বললেন—

“আরে রাগ করছো কেন?জানি ভাইরা বোন কে একটু বেশিই ভালোবাসে।আর ছেলেটাও কিন্তু লাখে এক।ইঞ্জিনিয়ার ছেলে।ঢাকায় নিজেদের বাড়ি আছে।এছাড়াও বনানী আর গুলশান দুটো ফ্ল্যাটও আছে।তোমার বোন সুখেই থাকবে।”

আজরাহান বিরক্তিকর গলায় শক্ত হয়ে বললো–

“থামুন আপনি।আর কে বললো ও আমার বোন!
বউ হয় আমার।ছয় মাস হয়েছে বিয়ে হয়েছে আমাদের।এক ঘরেই থাকি আমরা।”

“অ্যাহ!

“জ্বী হ্যাঁ।চল প্রহর।”
,
,

কাউচে বসে ইচ্ছে মতো হাসছে প্রহর।আজরাহান এর রাগে চোখ জ্বলে যাচ্ছে।হাত দুটো মুঠ করে প্রহর এর দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই নিজের মুখে হাত চেপে ধরে প্রহর।আজরাহান সামনে গিয়ে ফিচেল গলায় বললো—

“কুল মি.হ্যাজবেন্ড কুল।এই পৌষের শীতে এতো হট হয়ে যাচ্ছেন কেন!
আইসক্রীম খাবেন?

আজরাহান তীক্ষ্ম গলায় বললো–

“ফাজলামো করিস!এইসব পাগল ছাগল আসে কোথায় থেকে!যত্তসবহ।”

প্রহর খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।দুষ্ট বুদ্ধি চাপে প্রহর এর মাথায়।আজরাহান কে রাগানোর জন্য মৃদু শব্দে বললো—

“তোমার বোনকে বিয়ে দিবে?ছেলে কিন্তু লাখে এক।”

প্রহর আবারো খিলখিলিয়ে উঠে।আজরাহান ক্ষীপ্র গতিতে ওকে হ্যাচকা টানে বিছানায় শোয়ায়।ওর উপর ঝুঁকে বললো—

“ফাজলামো করিস আমার সাথে!গর্দভ মহিলা।খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আর কী!

“একদম ঠিক করেছে।”

আজরাহান গাঢ় গলায় বললো–

“বিয়ে করার স্বাদ জেগেছে তোর!

আজরাহান প্রহর এর নরম গালে একটা ছোট্ট কামড় বসায়।প্রহর ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো–

“সরেন এখান থেকে।ব্যথা লাগে না আমার!

” এইটা তো ট্রেলার ছিলো।রাতে বোঝাবো তোকে মজা।”

প্রহর আজরাহান কে ধাক্কা মেরে উঠে দাঁড়ায়।ব্যস্ত গলায় বললো—

“আপনি শুধু এইসব ই পারবেন।মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।”

“তবে রে ডিঙি নৌকা!

প্রহর একছুটে রুম থেকে বেরিয়ে সামানের ঘরে গিয়ে ঢুকে।হাঁপাতে থাকে প্রহর সেই সাথে মিচকি হাসে।নন্দিতা ওকে বললো–

“থাম,থাম।আর কতো হাসবি!আমাদেরও একটু বল।আমরাও হাসি।”

নন্দিতার কথায় তাল মিলিয়ে সানায়া বললো—

“ভাবী ঠিকই বলেছে।কী হয়েছে আগে বল।”

প্রহর হাসতে হাসতে লুটোপুটি।অনেক কষ্টে নিজেকে থামিয়ে প্রহর কোচিং ক্লাসের বাইরের ঘটনা খুলে বলতেই সানায়া আর নন্দিতা হাসতে হাসতে বেহুশ।সানায়া নন্দিতা কে চোখে টিপ্পনি কেটে ফিচেল গলায় প্রহর কে বললো–

“বাহ!ভালোই হয়েছে।অনেকদিন হলো বিয়ে খাইনা।এইবার প্রহর এর বিয়েটা দিয়ে ভালো খাওয়া যাবে।”

প্রহর ঝপ করে রাগী গলায় বলল–

“আমি কেন বিয়ে করবো!করবো না আমি বিয়ে।”

সানায়ার কথার রেশ ধরে নন্দিতা বললো—-

“একদম ঠিক কথা।আর ছেলেটাও বেশ ভালো ঘরের মনে হচ্ছে।বড়লোক্স।”

“না,না,না।বড়লোক্স ম্যাক্স প্রো।”

প্রহর চোখ,মুখ কুঁচকে ফেলে।চোখ ছলছল করে উঠে প্রহর।কান্না পাচ্ছে খুব।সে কখনো অন্য কাউকে বিয়ে করবে না,কখনো না।
প্রহর উঠে তার কান্না লুকানো চেষ্টা করতেই ধাক্কা খায় তারাফের সাথে।

তারাফ আর সানায়া বিয়ে হয়েছে তিন মাস।তারাফের কেউ না থাকায় সে এই বাড়িতেই থাকে কিন্তু বিনা পয়সায় না।মাস শেষে সে তার আর সানায়ার থাকার জন্য নির্দিষ্ট এমান্টে পেমেন্ট করে।
তারাফ কে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় প্রহর বললো–

“দেখোনা তারাফ ভাইয়া এরা কী বলছে!

তারাফ হালকা গলায় বললো–

“কার এতোবড় সাহস আমার সুখতারা কে কিছু বলে!

সানায়া হাসতে হাসতে সব খুলে বললো।তারাফ মৃদু হেসে ফিচেল গলায় বললো—

“ওমা তাই নাকী!
সে তো বেশ ভালো কথা।বড়লোক্স দুলাভাই পাবো এইবার।”

প্রহর ক্ষেপে উঠে তারাফ এর হাতে একটা কামড় বসায়।রুষ্ট গলায় বললো–

“যা,শয়তান তারা মিয়া।কথা বলবি না।”

কামড়ে প্রহর এর দাঁত বসে যায় তারাফের হাতে।মৃদু ব্যথায় আওয়াজ করতেই সানায়া শশব্যস্ত হয়ে বললো–

“দেখি,দেখি কী হয়েছে!ইশ !কী অবস্থা করেছে!প্রহর কী দিন দিন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে নাকী!

তারাফ আশ্বস্ত সূচক গলায় বললো–

“ছোট মানুষ ও।বাদ দাও।”

“তাই বলে…!

“তোমার তো খুশি হওয়া উচিত।ছোট হলেও আমার বোন কিন্তু তোমার ভাইকে ভীষন ভালোবাসে।দেখলে বিয়ের কথা বলতেই কেমন কেঁদে দিলো।”

,
,
কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে প্রহর।আজরাহান কে জড়িয়ে ধরে কান্নার বেগ বাড়াতে থাকে।আজরাহান ব্যস্ত গলায় বললো—

“কী হয়েছে রেড রোজ?কাঁদছিস কেন?

প্রহর ধরা গলায় সবটা বললে আজরাহান মুচকি হাসে।ফিচেল গলায় বললো—

“ভালোই বলেছে সবাই।বিয়ে করে নে।ছেলের তো অনেক টাকা।তোকে রাণী বানিয়ে রাখবে।”

প্রহর আহ্লাদী গলায় অভিমান করে বললো—

“সর,কুত্তা।
কথা বলবি না আমার সাথে।”

প্রহর কাউচে গিয়ে বসে।এখনো নিঃশব্দ কেঁদে হেচকি টেনে যাচ্ছে।আজরাহান ওর সামনে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসে।দুই হাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয় প্রহর এর।শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বললো—

“কান্না বন্ধ কর,গাধি।”

“আপনি গাধা।”

“তুই গাধার গাধি।”

“সর আজাইরা রাহান।”

“তোর রাহান।”

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর (খন্ডাংশ)
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here