মনের কিনারে তুই
লেখিকা:Tarin Niti
পর্ব: ২৭
রাতে আরিয়ান ডিনার করে রুমে এসে গিটার নিয়ে ব্যালকনিতে চলে যায়। আজকে কেন জানি ওর কিছু ভালো লাগছেনা। রিহান আজকে আরিয়ানের সাথে ভালো করে কথা বলেনি। আরিয়ান ব্যালকনিতে রাখা সোফায় বসে গিটারের টুংটাং আওয়াজ করতে থাকে।
আরিয়ানের দৃষ্টি আকাশের দিকে। ওর ইশার কথা মনে পড়ে যায়।ওদের যখন রিলেশন ছিল তখন ইশা মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে বলতো,
এই আকাশ দেখেছো? পশ্চিম দিকটা কেমন লাল হয়ে আছে,, কি সুন্দর লাগছে। আবার কখনো বলতো, এই আজকে পূর্ণিমা দেখো চাঁদটা কত্তো সুন্দর লাগছে।
আরিয়ানের এসব খুব ভালো না লাগলেও কখন বিরক্ত হতো না।ইশার আকাশ নিয়ে পাগলামির কথা ভেবে আরিয়ান হেসে দে।
আরিয়ান গিটার বাজাচ্ছে তখন ওর হাতের দিকে চোখ যায়। আরিয়ানের হাতে “আই” লেটার লেখা ব্রেসলেট। আরিয়ান অবাক হয়ে ভাবে ও এখনো ব্রেসলেটটা হাতে পড়ে আছে?আরিয়ান ব্রেসলেট টা খুলতে গিয়ে আবার কি যেন ভেবে হাতে রেখে দে। আরিয়ান ইশার কথা ভাবছে।আরিয়ান ধোঁকা দেওয়ার পর ইশা এতো স্ট্রং থাকবে আরিয়ান ভাবতে পারেনি কারণ আরিয়ান জানে যে ইশা ওকে কতো ভালবাসে!ওদের রিলেশনের সময় ইশার পাগলামি গুলো দেখে আরিয়ান ভেবেছিল আরিয়ান সব সত্যি বলার পর ইশা ভেঙ্গে পড়বে। কিন্তু না!ইশা ভেঙে পড়েনি।
তারপর আবার আরিয়ান ভাবে যার মা এত স্ট্রং,মেয়ে তো স্ট্রং হবেই।ইশা আরিয়ানকে ওর ফ্যামিলির ব্যাপারে সব বলেছে। ওর বাবার এক্সিডেন্ট, তারপর মায়ের একা লড়াই, এসব বলতে গিয়ে কান্না করে দিয়েছে তখন আরিয়ান ইশাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিয়েছিলো।
আরিয়ান কখন থেকে ইশার কথা ভেবে যাচ্ছে দরজায় নক পরায় ওর হুঁশ আসে।ব্যালকনি থেকে রুমে এসে দেখে ওর মা দরজায় দাঁড়িয়ে প্লেট হাতে নিয়ে।আরিয়ান ওর মাকে বলে,
“তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে এসো”
আরিয়ানের মা ভেতরে আসতে আসতে বলে, ” তুই কোথায় ছিলি?কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাসনি? ”
“না আসলে ব্যালকনিতে ছিলাম”
আরিয়ানের মা হাতের প্লেটটা আরিয়ানের দিকে বাড়িয়ে বলে,
” নে এগুলো খা। দেখ তো কেমন হয়েছে?”
আরিয়ান ভ্রু কুঁচকে প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলে, “কি এগুলো?”
“পিঠা,,, তুই তো ডিনার করে চলে আসলি আর দিতে পারলাম না, এখন খা”
আরিয়ান বিছানায় বসে বলে, “আম্মু একটু আগে ডিনার করলাম এখন আবার এসব?”
আরিয়ানের মা ওর পাশে বসতে বসতে বলে,
“আমি এত কষ্ট করে তোর জন্য বানালাম তুই খাবি না?”
আরিয়ান প্লেট নিতে নিতে বলে, ” আচ্ছা ঠিক আছে”
তারপর আরিয়ান একটা পিঠা মুখে দে।আরিয়ানের মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“কোন সমস্যা হয়েছে? আজকাল তোকে কেমন অন্যমনস্ক লাগে”
আরিয়ান খাওয়া বন্ধ করে বলে, ” না না..কই আমি তো ঠিক আছে ”
“আমি তোর মা, আমি বুঝতে পারি আরিয়ান। কিছু হয়েছে?”
” না আম্মু, সব ঠিক আছে। বাই দ্যা ওয়ে পিঠাগুলো খুব মজার। আব্বু খেয়েছে?”
“হ্যাঁ এখন ওকে দিয়ে এখানে এলাম”
কিছুক্ষণ পর আরিয়ানের মা আর কিছু বলতে যাবে তখন আরিয়ান ওর মার হাতে প্লেটটা দিয়ে বলে,
“আম্মু আর খাব না প্লিজ…”
“আচ্ছা ঠিক আছে এখন ঘুমা”
তারপর আরিয়ানের মা প্লেট নিয়ে চলে যায়। আরিয়ান ওর মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।মায়েরা সন্তানের মন কি করে বুঝতে পারে!
মায়ের হাতের পিঠা খেয়ে আরিয়ানের ইশার কথা কথা মনে পড়ে যায়। ইশাও খুব ভালো রান্না করতে পারে। রিলেশন চলাকালীন ইশা প্রায় রান্না করে আরিয়ানের জন্য খাবার আনতো। ইশার রান্না সত্যি অসাধারণ। আরিয়ান ইশার কথা ভেবে নিজে নিজে বলে,
ধুর আমি কেনো বারবার ওই মেয়েটার কথা ভাবছি! আরিয়ান রিল্যাক্স.. তারপর আরিয়ান ল্যাপটপ নিয়ে বসে।ও আর ইশার কথা ভাববে না।ফালতু মেয়ে একটা!
.
প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে।ইশা প্রতিদিন ভার্সিটি আসে। যদিও অনেক অপমানের মুখোমুখি হতে হয় তবুও ইশা পিছিয়ে পড়ে না। ইশা ওর আম্মুর সাহসী মেয়ে তো।
এই দুই সপ্তাহে আরিয়ান ওকে নানা ভাবে অপমান করেছে। কখনো ক্লাসে, কখনো ক্যান্টিনে।রাইমা আরিয়ানের সাথে ঝগড়া লাগতে চায় কিন্তু ইশা বারবার থামিয়ে দেয়। কি হবে ওদের সাথে লেগে? আরিয়ান ইশা সামনে জারার সাথে ন্যাকামো করে। ইশা দেখেও না দেখার ভান করে কিন্তু আরিয়ানকে জারার সাথে দেখলে ওর বুকের ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
আরিয়ান গাড়ির উপর বসে আছে পাশে ওর বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছে।আরিয়ান ইশার অপেক্ষা করছে,আরিয়ান ইশাকে প্রতিদিন জ্বালায়, অপমান করে। কেন জানি ইশাকে না জ্বালালে ওর ভালো লাগেনা।প্রতিদিন একবার না একবার যেকোনো বাহানায় ইশার সামনে যাবে আর ওকে অপমান করবে।আরিয়ানের কাছে ইশার কান্না করা চেহারাও ভালো লাগে!কিন্তু মেয়েটা কান্না করে না এতো অপমানের পরও…
বেশি অপমান করলে হাত মুঠো করে দাঁত কিড়মিড় করে।ইশার এই স্বভাবটা আরিয়ানের কাছে আরো কিউট লাগে। যখনই ইশা হাত মুঠ করে নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা করে তখন আরিয়ান বাঁকা হাসে।
আরিয়ানের সাথে রিহানও আছে। ওদের সম্পর্কটা আগের মত হয়ে গেলেও আরিয়ান ইশার সাথে যা করেছে সেটা রিহান এখনো মানতে পারেনি।
আরিয়ান তাকিয়ে দেখে ইশা রিক্সা থেকে নামছে আরিয়ান বাঁকা এসে ভাবতে থাকে আজকে ইশাকে কিভাবে জ্বালানো যায়।
ইশা ভার্সিটিতে এসে রিক্সা থেকে নেমে গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে তখন দেখে আরিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে আছে।আরিয়ানকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে।কালো প্যান্টের সাথে নীল শার্ট। ফর্সা শরীরে নীল রং টা ফুটে উঠেছে। ইশা একবার আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।এই সুন্দর চেহারার পেছনে যে কত কুৎসিত একটা মন আছে সেটার কথা ভেবেই ইশার ঘৃণা লাগে।এইদিকে ইশার এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতে আরিয়ান রেগে যায়।
ক্লাসে গিয়ে ইশা রাইমার পাশে বসে। রাইমা রিহানের সম্পর্কটা এখন ঠিকঠাক ভাবে চলছে। ইশা রাইমাকে বলে,
“কেমন আছিস? ”
রাইমা ইশাকে দেখে একটা হাসি দিয়ে বলে,
” হুম ভালো.. তুই?”
ইশা রাইমার পাশে বসতে বসতে বলে, ” ভালোই ”
কিছুক্ষণ পর ইশা বলে, “রিহান ভাইয়া…”
ইশাকে থামিয়ে দিয়ে রাইমা উৎফুল্ল হয়ে বলে,
“রিহান বলতে মনে পড়েছে, জানিস কালকে ওনি কতো পাগলামি করেছে! রাত্রে দশটা বাজে আমার বাসার নিচে এসে আমাকে কল দিয়ে বলে বারান্দায় আসতে, আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তারপর বারান্দায় গিয়ে দেখি উনি নিচে দাঁড়িয়ে আছে!”
বলেই রাইমা মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে।ইশা রাইয়ার কাঁধে হাত রেখে বলে,
“বলেছিলাম না রিহান ভাই তাকে ধোঁকা দেবে না”
রাইমা হাসি থামিয়ে বলে, ” হ্যাঁ আমারো মনে হয় রিহান আমাকে খুব ভালোবাসে।কিন্তু সত্যি বাসেতো? ”
“রাইমা! আবার শুরু করলি?তুই ওনাকে ভালোবাসিস কিন্তু বিশ্বাস করিস না?”
রাইমা ইশার হাত ধরে বলে, ” করিতো কিন্তু ভয় হয় যদি হারিয়ে ফেলি!”
ইশা রাইমার কাঁধে হালকা একটা থাপ্পর দিয়ে বলে, “ধুর এতো চিন্তা কিসের?”
রাইমা কিছু বলে না।হঠাৎ ইশার সোজাসুজি হয়ে বসে বলে,
“আজকে আরিয়ান ভাইয়া তোকে কিছু বলেছে? প্রতিদিনই তো একটা না একটা ঝামেলা করে তোর সাথে!”
“তো কি হয়েছে!আমি কিছু না বললেই তো হয়।দেখি উনি কতদিন আমাকে অপমান করতে পারে”
রাইমা ইশার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুই এতো কিছু কি করে সহ্য করিস?”
ইশা একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলে, ” করতে হয় রে..!পরিস্থিতি সবাইকে সবকিছু মেনে নিতে শেখায়”
.
ক্লাস শেষে ইশা ভার্সিটির করিডোর দিয়ে হাঁটছে। রাইমা ক্লাস শেষে চলে গেছে রিহানের সাথে দেখা করবে বলে।ইশা একা একা হাঁটছে তখন হঠাৎ পর ওরনায় টান পড়ে!পেছন ফিরে দেখে আরিয়ান ওড়না ধরে আছে। ইশা রেগে বলে,
“কি অসভ্যতামি হচ্ছে? ওরনা ধরেছেন কেন?”
আরিয়ান ইশার কাছে এসে বলে, “তোমার ওরনা তো খুব সুন্দর!কোথা থেকে কিনলে?”
“কেনল আপনি কি এবার থেকে মেয়েদের মত ওরনা পড়বেন নাকি? তবে আপনাকে সেটাই মানায়! বিশ্বাসঘাতকতা একটা”
আরিয়াম রেগে বলে, ” মুখ সামলে কথা বলো ইশা।সব সময় ত্যাড়া ত্যাড়া কথা না বললে হয় না,না?”
ইশা আরিয়ান হাত থেকে ওরনা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে, ” যে যেমন তার সাথে সেভাবে কথা বলতে হয়”
ইশা চলে যেতে নে আরিয়ান ইশাকে একটা ফাঁকা ক্লাসে নিয়ে জোরে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে বলে,
“এখনো এতো তেজ! তুমি কি দিয়ে তৈরি?এতকিছুর পরও এভাবে মাথা উঁচু করে কথা বলছো!”
ইশা আরিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে নিজে থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলে,
“আমি কোনো অন্যায় করিনি যে মাথা নিচু করে কথা বলবো।আর একদম আমার কাছে আসবেন না”
আরিয়ান ইশার কাছে এসে রেগে বলে,
“আসবো কি করবে? ”
আরিয়ানের রাগ দেখে ইশা একটু দমে যায়। যখন একজন রেগে থাকে তখন আরেকজনকে শান্ত থাকতে হয়। দুইজনে রেগে গেলে খুব ভয়াবহ অবস্থা হয়। তাই ইশা শান্তকণ্ঠে বলে,
“আমাকে যেতে দিন”
আরিয়ান এক দৃষ্টিতেই সে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।আর ইশা অস্বস্তিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।তারপর ইশা আরিয়ানের পাশ কেটে চলে যায়।আরিয়ান ইশাকে আটকায় না।
আরিয়ান কি করছে নিজেও বুঝতে পারছে না। ও কেন বারবার ইশার কাছে আসছে!ও তো ইশাকে ভালোবাসে না তাহলে কেন প্রতিদিন ইশার কাছে আসে? যদিও সেটা অপমান করার জন্য আর জ্বালানোর জন্য তবুও ইশার কাছে আসলে আরিয়ানের ভালো লাগে..!
চলবে…