“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৭
(নূর নাফিসা)
.
.
শারমিন বলতে লাগলো,
“এক ভাই এক বোন। ছেলে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। তোর মতোই ফর্সা, উচ্চতায় তোর আব্বুর সমান হবে। স্কুল পড়া শেষ করে ইংল্যান্ড চলে গেছে। বাকি পড়াশোনা ইংল্যান্ডে চাচার কাছে থেকে শেষ করে গতবছর দেশে এসেছে। এখন দেশেই গাড়ির শোরুমের পার্টনারশিপ। তোর পরীক্ষার মাঝে দেখে এসেছিলাম তাদের বাড়িঘর। স্যার ও উনার দুই ভাই মিলে ছয়তলা বাড়ি করেছেন। তারা দোতলায় থাকে। আমাদের মতোই চার রুমে এক ফ্ল্যাট। তবে রুমের পরিধি অল্প একটু ছোট হবে৷”
“আম্মু, এতোকিছু বলা কি প্রয়োজন। তোমরা কি এখন আমাকে বিয়ে দিবা?”
“মেয়েদের কি সারাজীবন বাবার বাড়ি থাকার নীতি আছে? বিয়ে দিতে হবে না? তোর ভবিষ্যৎ আছে না!”
“আমার পড়াশোনা শেষ করার ইচ্ছে ভীষণ।”
“পড়াশোনা তো করাবোই। এখন শ্বশুরবাড়িও পাঠাবো না। সবাই তো সন্তানের ভালোটা কাম্য করে। সমন্ধ ভালো হওয়ায় তোর বাবা চাইছে কথাবার্তা পাকা করে রাখতে। তারাও চাইছে আংটি পড়িয়ে রাখতে। পরে বিয়ের অনুষ্ঠান। তার আগে তোর মতামত জরুরী। ছেলের ছবি দেখেছিলি?”
“উহুম।”
“সাফওয়ানা, ছবি কোথায়?”
সাফওয়ানা জিভ কেটে বললো,
“আম্মু, ভুলে গেছি ছবি নিতে। আপুটা ছবি নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছিলো ঠিকই। শেয়ারিট চালু করতে করতে পিচ্চিটা তার আম্মুর ফোন টেনে নিয়ে গেছে। তারপর ভুলেই গেছি!”
“পোলাপান একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারে না।”
“আমাকে বকো কেন? তোমার মেয়েকেও তো ছবি দেখতে বলেছিলো। দেখলো না কেন তখন? এহ! লজ্জায় একবারে ললিপপ হয়ে যায়!”
শারমিন তার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে শারমায়াকে বললো,
“সমস্যা নেই। ছেলে এখন ঢাকার বাইরে আছে তাই আজ আসতে পারেনি। ঢাকায় ফিরলে পরে বাসায় আনাবো তাকে।”
“আমার দেখার প্রয়োজন নেই। তোমাদের ভালো লাগলে যা খুশি করো।”
“তোর আপত্তি নেই তো বিয়েতে?”
“উহুম।”
“আপত্তি থাকলে আগেই বল। আশেপাশের যা অবস্থা! এর মেয়ে পালিয়ে যায়, এর ছেলে বিয়ে বাড়ি থেকে অন্যের বউ নিয়ে চলে আসে! ওফ্ফ!”
মায়ের মুখে এমন কিছু শুনে শারমায়া বললো,
“মা, আমাকে কি তোমার এমন মনে হয়?”
“আমার মেয়েদের প্রতি আমার তীব্র বিশ্বাস আছে। তারপরও যদি আমার অজানায় কিছু থেকে থাকে, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“নেই কিছু। তুমি যতটুকু জানো, ততটুকুই আছে।”
টেবিলে বই নাড়াচাড়া করতে করতে হুট করে সাফওয়ানা বলে উঠলো,
“মা, এতো চিন্তা করো না তো। পালিয়ে যাওয়ার আগে তোমাকে বলে যাবে তোমার মেয়েরা। সো, নো চিন্তা ডু ফুর্তি…”
শারমিন রুম থেকে চলে যেতে যেতে বললো,
“বইয়ে খুটিনাটি করতে হবে না। পড়াশোনা আজ কাড়ে উঠেছে। ঘুমিয়ে থাক। সকাল সকাল উঠবি আবার।”
“মা, কাড় কোথায় পেলে তুমি? এটা তোমার বাবার গ্রামের বাড়ি না যে মাথার উপর কাড় থাকবে। এটা আমার বাবার বাড়ি, মাথার উপর ছাদ আছে আর ছাদের উপর চাঁদ! সো ওই ডায়ালাগ তোমার বাবার বাড়িতে গিয়েই দিয়ো…”
“কথা না কম বলতে বলছি! আমার বাবার বাড়িতে কাড় আর তোর বাবার বাবার বাড়ি বুঝি রাজপ্রাসাদ ছিলো?”
“সে যাই হোক, আমার বাবার বাড়ি তো পাকা!”
তিনদিন পর জোভান ঢাকায় ফিরেছে তা জেনে শারমিন চেয়েছিলেন তাকে বাসায় আনতে। কিন্তু তাদের বাড়ি থেকে ঘুরে যাওয়ায় জুলেখা ইয়াসমিন আগে তাদের যেতে বললেন ইফতারের দাওয়াতে। এদিকে জেভা শারমিনের কাছে প্রস্তাব রাখলো, ‘বাসায় গেলে ছেলেমেয়ে কেউ তেমন ইজিলি কথাবার্তা বলতে পারবে না গুরুজনের সামনে। লাইফ যেহেতু তাদের, নিজেদের সিদ্ধান্তের ব্যাপার আছে। সেহেতু তাদের একে অপরের সাথে সাক্ষাৎটাও জরুরী। তাই বাইরে কোথাও সাক্ষাৎ হলে তারা ইজিলি কথাবার্তা বলতে পারবে।’
জেভার প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত মনে হলো শারমিনের কাছে। মেয়েকে পাঠানোর ভরসাও পেল কারণ জেভা থাকবে তাদের সাথে। কিন্তু মেয়ে রাজি না। উক্ত প্রস্তাবের কথা শুনতেই তার অস্থিরতার শেষ নেই! সে বারবার মাকে বললো সে যাবে না। তার ভালো লাগে না। এতো দেখাদেখির প্রয়োজন নেই। পরে একসময় দেখা হবেই।
মেয়ের অস্থিরতা বুঝতে পেরে শারমিন জেভাকে জানালেন শারমায়ার কথা। এবং তাদের পরিকল্পনা বাতিল করা হলো। অত:পর জোভানের ছবি চেয়ে নিলেন। জেভা ছবি পাঠিয়ে দিলো শারমিন সাখাওয়াতের ফোনে। সাফওয়ানাকে ডেকে ফোন ধরিয়ে দিলে সাফওয়ানা রুমে এসে দেখালো শারমায়াকে৷ শারমায়া ছবি দেখে বিস্মিত! এ তো সেই জয় স্যার!
সে বিস্ময়করভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“সাফু, তুই না বললি ওনার নাম জোভান আহমেদ!”
“হ্যাঁ।”
“উনি তো জয় স্যার!”
“অহ, হ্যাঁ জোভান আহমেদ জয়। পুরো নাম মনে ছিলো না। কিন্তু স্যার কিভাবে? ভাইয়া তো গাড়ির শো-রুমের পার্টনারশিপ শুনলাম!”
“উনাকে তো আমি একদিন দেখেছি কলেজে। অনেকেই জয় স্যার বলছিলো।”
“আরে নাহ! স্যারের ছেলে দেখে বোধহয় দুষ্টুমি করে স্যার বলছে।”
“কি জানি।”
“তোমার পছন্দ হয়েছে কি না বলো এবার। আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আবারও হয়ে যাক একটা প্রোগ্রাম। আমি ডেইলি দুইবার দাত মাজি তোমার বিয়ে খাবো বলে।”
“তুই চারবার দাঁত মাজলেও কোনো লাভ হবে না। বিয়ের কথাবার্তা জাস্ট পাকা হয়ে থাকবে।”
“তা দেখা যাবে। এবার সিরিয়াস আন্সার দাও। জননী অপেক্ষায় আছে তোমার পছন্দ হয়েছে কি না তা জানার জন্য৷”
“অপছন্দ করার মতো না।”
“জানি তো, আন্সার পজেটিভই আসবে। এতো সুন্দর ছেলে দেখে তোমার মতো কালী ভুত্নী পছন্দ না করে থাকতে পারে!”
শারমায়া তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে উঠলো এবং বললো,
“আমি কালী ভুত্নি? এদিকে আয়, দেখি কে কালী আর কে সুন্দরী।”
সাফওয়ানা ভেঙচি কেটে চলে গেলো মায়ের কাছে।
তেইশ রমজানে আশরাফ স্যারের বাড়িতে ইফতারের দাওয়াত পড়লো শারমায়ার পরিবারের। শারমায়ার বাবা-মা, চাচা, খালু-খালামনি আর দুই মামা গেলো আশরাফ স্যারের বাড়িতে৷ সকলেরই পছন্দ হয়েছে তাই এবার তারা এনগেজমেন্টের দিন পাকা করে এলো।
ঈদুল ফিতর কাটলো বেশ আনন্দে। চাচাতো ভাই ফুয়াদ বউ বাচ্চা নিয়ে বাসায় এসেছে ঈদের আগেরদিন। ঈদের দিন বিকেলে ফুয়াদ তাদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। দুইটা রিকশা নিয়েছে ঘুরাফেরার জন্য। সাফওয়ানা ভাইয়া ভাবির সাথে এক রিকশায়, ভাতিজা নুহাশকে নিয়ে শারমায়া ও ফারিয়া অন্য রিকশায়। ঢাকার রাস্তাঘাট ঘুরে বাইরে খাবার খেয়ে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু ঈদের পর বেড়াতে যেতে পারলো না তারা। কেননা চারদিন পরই শারমায়ার এনগেজমেন্ট।
শাড়ি পরে প্রস্তুত শারমায়া। সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে, হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি ততই বেড়ে চলেছে। সেই মানুষটার সাথে সে নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে যে কি না জানা অজানা কত মেয়ের ক্রাশ! সে কি কখনো দেখেছে শারমায়াকে? দেখলে, মন থেকে পছন্দ করেছে তো? আর যদি না দেখে তবে দেখার পর পছন্দ করবে তো?
নানান প্রশ্ন আর নানান ভাবনা ভীড় জমিয়েছে শারমায়ার মাথায়। যখনই সে জোভানকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে তখনই অস্থিরতায় ডুবে মরে! ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে দুপুরে জোভান ও তার পরিবারের আগমন। আজ পিচ্চিটা দৌড়েই শারমায়ার রুমে চলে এসেছে। তাই শারমায়া কোলে নেওয়ার সুযোগ মিস করেনি। তবে বেশিক্ষণ থাকেনি পিচ্চি। সাফওয়ানার সাথে চলে গেছে। কনে ও বরপক্ষের মেহমানে ফ্ল্যাট ভরপুর। একের পর এক মহিলা আসতে লাগলো শারমায়ার রুমে। শারমায়া সালাম দিচ্ছে, তারা এটা সেটা জিজ্ঞেস করে চলে যাচ্ছে। সুষনা তাকে লক্ষ্য করে বললো,
“সুন্দরী, কাপছিস কেন তুই?”
শারমায়া অস্থিরতার সাথে হেসে বললো,
“কি আর বলবো আপু! তুমিই বলো..!”
“আরে বোকা মেয়ে! এতোটা নার্ভাস কেন তুই! এখনই এই অবস্থা, সামনে গিয়ে আবার কান্না করে দিস না। নরমাল থাক। না হলে আজই বিদায় দিয়ে দিবো।”
“গাড়িতে তুলে দিয়ে এসো, প্রয়োজনে বাড়িতে দিয়ে এসো তবুও তাদের সামনে নিয়ো না।”
সুষনা হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ পর মেহমানদের খাওয়াদাওয়া হলো অত:পর এনগেজমেন্ট সম্পন্ন হলো। এরমধ্যে এক পলকও তাকাতে পারলো না শারমায়া। আজ প্রথমবার মানুষজনের ভীড়ে তার এতোটা নার্ভাস ফিল হচ্ছে। যার ফলে জোভানকে এক পলক দেখতেও পারলো না। তবে যখন জেভা তাকে সিটে বসালো তখন বুঝতে পেরেছে তার পাশের লোকটাই জোভান। ছবি তোলার জন্য শারমায়াকে ডেকে ডেকে দৃষ্টি উপরে তুলিয়েছিলো সাফওয়ানা ও জেভা। তা মনে করে ভাবতেই লজ্জা পাচ্ছে বারান্দায় দাড়ানো শারমায়া! আগে তো কখনো এমন হয়নি৷ এতোটা ভীতু সে হলো কবে! আজ প্রথম সেই অদ্ভুত অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারলো৷
“এহেম..”
হঠাৎই কাশির শব্দ পেয়ে শারমায়া পেছনে তাকালো এবং জোভানকে দেখতে পেল। এ ছিলো দুজনের চোখাচোখি প্রথম দেখা। তবে শারমায়া দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে এবং মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে দ্রুত আঁচল টেনে মাথায় দিতে দিতে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আসবো?”
“হ্যাঁ, আসুন।”
দ্রুত ঘোমটা তুলতে গিয়ে আঁচল পেচিয়ে ফেলেছে তাই মাথায় উঠলো না। তড়িঘড়ি করে তা ঠিক করতে দেখে জোভান বললো,
“এমনি থাক না!”
শারমায়া আঁচল ছেড়ে দিয়ে এমনি দাঁড়িয়ে রইলো। জোভান যতক্ষণ পর্যন্ত এগিয়ে আসছিলো ততক্ষণ পর্যন্ত তার হৃদপিণ্ড ঢিপঢিপ করে কাপছিলো। সাথে কাপছিলো আঁচলের কোণা প্যাচানো দুই হাত। জোভান তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে একটা হাত টেনে নিলো। তার সাথে সাথেই শারমায়া কেপে উঠলো। জোভান দ্রুত তার পকেট থেকে লাভশেপ একটা কার্ড বের করে কিছুক্ষণ পূর্বে পরিয়ে দেওয়া আংটির ভেতর লাভের কোণটা আটকে সে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। এলো ধীরপায়ে অথচ বেরিয়ে গেলো দ্রুত পায়ে! এভাবে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার কোনো মানেই খুঁজে পেলো না শারমায়া! তবে সে চলে যাওয়ার পরপরই বড়সড় এক নিশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। শারমায়া কার্ডটি অন্যহাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। এক্সট্রা ডিজাইন করা কার্ড। কিন্তু কেন দিলো সেটা বুঝতে পারলো না। বুঝবে কি করে! সে তো কিছু বললোই না! শারমায়া মুচকি হেসে কার্ডটি যত্ন করে তার ড্রয়ারে রেখে দিলো যাতে সাফওয়ানার চোখে না পড়ে! ওদিকে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মেহমান বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় স্যার বলে গেলেন পরদিন থেকে ভার্সিটি এডমিশন কোচিং করতে যেতে।