“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৩৯
(নূর নাফিসা)
.
.
রুমে বসে সুষনা ও ফারিয়া গল্প করছিলো, পাশে বসে ফোনে গেমস খেলছে সাফওয়ানা। শারমায়াকে বক্স হাতে রুমে প্রবেশ করতে দেখে সে ফোন রেখে উঠে এসে বললো,
“এটা কি, আপু?”
“কি জানি! কুরিয়ারের লোক এসে দিয়ে গেলো। আমার নামে কেউ পাঠিয়েছে। প্রেরকের নাম-ঠিকানা কিছুই নেই।”
“দাও, খুলে দেখি।”
সাফওয়ানা বক্স নিয়ে মেঝেতে বসে খুলতে লাগলো। সুষনা বললো,
“কি এটা?”
“জাদুর বাক্স।”
জবাব দিয়ে নিজেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সাফওয়ানা। অতঃপর বক্স খুলে দেখলো খান সাহেবের চানাচুর! শারমায়া বিস্মিত! বুঝতে বাকি নেই এটা জোভানের কাজ! তার বড্ড হাসি পাচ্ছে কিন্তু সে মুখ চেপেই হাসছে। ওদিকে সাফওয়ানা হাসতে হাসতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। আপুরাও হাসছে। সাফওয়ানা হাসতে হাসতে বললো,
“আপু, এটা ভাইয়া পাঠিয়েছে। আমি নিশ্চিত। দেখিতো, লাভ লেটার দিয়েছে কি না সাথে।”
সাফওয়ানা প্যাকেটগুলো সব নামিয়ে কোনো কিছু পেলো না। হতাশ হয়ে বললো,
“নাহ! দেয়নি কিছু।”
ফারিয়া বললো,
“জোভান ভাইয়া হয়তো আগে থেকেই জানে বক্সটা শালিকার হাতে পড়বে। তাই দেয়নি রে সাফু।”
“হুহ্! যাক, চানাচুরের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাইয়াকে।”
ওদিকে শারমায়া মিটিমিটি হেসে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। জোভানের ফোনে ডায়াল করলে জোভান কল কেটে ব্যাক করলো।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি করছো?”
“এইযে, আপনার সাথে কথা বলছি। হঠাৎ এতো চানাচুর কীজন্য?”
“ওহ্, পেয়ে গেছো। স্পিড ক্যান কিনতে দোকানে গিয়ে দেখতে পেলাম খান বাহাদুর নানার প্রোডাক্ট। মনে হলো বউ আর বোনটার প্রিয়। সাতাশটা ছিলো, সবগুলো কিনে নিয়েছি। অফিসে চারজনের জন্য চারটা রেখে বাকিগুলো পাঠিয়ে দিয়েছি। খুশি হওনি? সাফওয়ানা দেখলে খুশি হবে নিশ্চিত।”
“হুম, খুশিতে একেবারে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আপুরাও দেখে হাসছে।”
“আপুরা মানে! তুমি আপুদেরও দেখিয়েছো? শ্বশুর বাড়িতে দুই টাকার জিনিস পাঠায়, কি ভাববে বলোতো!”
“কেউ কিছু ভাববে না। আপনিই বেশি বেশি ভাবছেন।”
“আমি এলে সাথে আরও কিছু নিয়ে আসতাম। একটু ব্যস্ত ছিলাম তো তাই ছেলেটাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
“ছেলেটাকে মানে? এটা কুরিয়ারের লোক না?”
“মাথা খারাপ তোমার! এতো কাছে থেকে কুরিয়ার করতে যাবো? আমাদের অফিসের কর্মচারীকে পাঠিয়েছি।”
“ওহ্! এজন্যই তো চেনা চেনা লাগছিলো। একবার গাড়ি দিয়ে গিয়েছিলো, তাই না?”
“হুম।”
“আচ্ছা রাখি। আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম।”
“কি করলে?”
“কিছুনা।”
“তোমার পানিশমেন্ট জমা হচ্ছে। একসাথে শোধ নিবো।”
“লাঞ্চ করেছেন?”
“হুম।”
“আচ্ছা, রাখি। ওই হাতে কিন্তু প্রেশার নিবেন না।”
“তোমাকেও উঠাতে পারবো, কিছু হবে না।”
“আপনি অনেক খারাপ একটা লোক। আশেপাশে কেউ নেই? যেন অফিস নয়, বেড রুমে আছে।”
জোভান হেসে বললো,
“আছে তবে কেউ শুনছে না। আমার প্রেম দুনিয়ায় শুধু তুমি আর আমি।”
“এই দুনিয়ায় ডুবে থাকলে চলবে না। কাজে মনযোগ দিন।”
শারমায়া তাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না। একটু সুযোগ পেলেই যেন দুষ্টুমির কিতাব খুলে বসে। ওদিকে সাফওয়ানা চানাচুর খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। শারমায়া তার কাছ থেকে কিছু প্যাকেট কেড়ে নিয়ে আপুদের সাথে চানাচুরের স্বাদ উপভোগ করলো। অতঃপর ছাদে গেলো চারজন। বহুদিন পর আজ আবার ঘুড়ি উড়ালো সাফওয়ানা। ছাদে এসে ফুয়াদ ভাইয়াকে পেয়ে গেছে। ভাইয়া তাকে ঘুড়ি উড়াতে সাহায্য করেছে।
বৃহস্পতিবার ফারিয়া কল করে জোভানকে আসতে বলেছে। জোভান কথা দেয়নি তবে বলেছে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। বিকেল থেকেই বাড়িতে মেহমান এসে জমজমাট করে তুলছে বিয়ে বাড়ি। যদিও বিয়ের প্রোগ্রাম হবে কমিউনিটি সেন্টারে তবে হলুদের প্রোগ্রামটা ছোটখাটোভাবে বাসাতেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। সন্ধ্যার পূর্ব থেকেই ব্যস্ত সবাই। তবে শত ব্যস্ততার মাঝেও জোভানের অপেক্ষা জেগে ছিলো শারমায়ার মনে। সন্ধ্যার পর জোভানকে আসতে দেখে মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। সেই যে হসপিটালে দেখা করে এসেছে এরপর আর দেখা হয়নি তার সাথে। আজ অন্যরকম একটা আনন্দ হচ্ছে। শারমায়ার পরিবারের সাথে দেখা করে শারমায়া ও সুষনার সাথে জোভান চাচীদের ফ্ল্যাটে এলো। ফারিয়াও বেশ খুশি হয়েছে। ফারিয়ার ভাবিসহ কাজিনদের সাথেও পরিচিত হলো। অতঃপর হলুদের প্রোগ্রাম চললো। একের পর এক ফটোশুট, ভিডিও চলছেই। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে শারমায়া জোভানকে নিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে এলো। তাদের ফ্ল্যাটে সাখাওয়াত সাহেব, ফারিয়ার বাবা ও এক মামা ড্রয়িংরুমে বসে কিসের যেন তালিকা তৈরি করছেন। শারমায়া জোভানকে তার রুমে যেতে বলে বাবাকে কেবল সংকেত দিয়ে এলো সে আছে ঘরে৷ বের হওয়ার সময় যেন আবার তালা না দিয়ে যায়। রুমে আসতেই জোভান বললো,
“ঘুড়িটা কার?”
“সাফওয়ানার।”
জোভান ঘুড়িটা নেড়েচেড়ে দেখে আবার যথাস্থানে রেখে বললো,
“সাফওয়ানা ঘুড়ি উড়াতে পারে! জানতাম না তো।”
“হুম, পারে। কাল উড়ানোর পর নুহাস খামচি দিয়ে ছিড়ে ফেলেছে। সেজন্য ফুয়াদ ভাইয়াকে একটার বদলে পাঁচটা জরিমানা করেছে।”
“ভালোই তো। শুধু লাভ আর লাভ। আমারও ভালো লাগে ঘুড়ি উড়াতে। সাফওয়ানার সাথে একদিন এনজয় করতে হবে।”
শারমায়া দরজা লাগিয়ে এসে খাটে বসে বললো,
“দেখি, পা টা কেমন হয়েছে?”
“কাটা শুকিয়ে গেছে তো কবেই।”
“দেখি না…।”
জোভান খাটে বসে প্যান্ট উপরে তুলে পা দেখালো৷ ফর্সা পায়ে সেলাইয়ের দাগগুলো কালচে হয়ে বসে আছে। শারমায়া বললো,
“শিক্ষা হয়েছে না এবার?”
জোভান মুচকি হেসে প্যান্ট ঠিক করতে করতে বললো,
“শিক্ষার শেষ আছে? জীবন যতদিন আছে শিক্ষা ততদিন থাকবেই। চলো, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই৷ বাইরে হালকা বাতাস আছে।”
শারমায়ার মুখ মলিন থাকায় জোভান তার হাত ধরে বারান্দায় যেতে যেতে বললো,
“জানো, আমার বউটাকে আজ ভারি মিষ্টি লাগছে।”
“আজ এতো পরিশ্রম না করলে কি হতো? চেহারায় কতটা ক্লান্তি ভেসে উঠেছে দেখেছেন একবার আয়নায়?”
“তোমার চোখই তো আমার আয়না।”
“লাঞ্চ করেছেন কখন?”
“তিনটার দিকে।”
“দাঁড়ান, আমি আসছি।”
জোভান তার হাত টেনে বললো,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“মিষ্টি নিয়ে আসি।”
“ওসব লাগবে না। আমার মিষ্টি বউ আছে পাশে।”
“পেটেও তো কিছু দিতে হবে নাকি?”
“মিষ্টি কেনার সময় আমি একটা খেয়েছি। এখন আর খাবো না।”
“অন্যকিছু নিয়ে আসি।”
“কিছু না।”
জোভান তাকে কাছে টেনে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভালোবাসি অনেক বেশি। আরও বেশি ভালোবাসতে চাই, সুইটহার্ট।”
মুহুর্তেই যেন শীতল হয়ে গেলো শারমায়া। আর শীতল মনে নেমে এলো এক ফালি অস্বস্তি! জোভান আহ্লাদীত সুরে প্রশ্ন করলো,
“শাড়িটা কার?”
শারমায়া নরম গলায় জবাব দিলো,
“মায়ের।”
“কালও শাড়ি পরবে?”
“ইশ! প্রতিদিন সম্ভব না।”
“প্রতিদিন কোথায়? সবসময় কি আর পরে থাকো? কাল বিয়ের শাড়িটা পরো। হুম?”
“বোনের বিয়ে, আমি বউ সেজে বসে থাকবো?”
জোভান তাকে নিজের সাথে আরও চেপে ধরে বললো,
“বউ সাজতে বলেছি? আজকের মতো নরমালি পরবে। এই, তুমি না বড়বোন হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলে সেদিন? বরযাত্রী এসে যদি পিচ্চি মেয়ে দেখে পেছনে লেগে যায়, তখন কি হবে?”
শারমায়া নিচু শব্দে খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
“তখন আপনাকে সামনে নিয়ে দাঁড় করাবো। আপনার হাত ধরে ঘুরতে দেখলে এমনিতেই দৌড়ে পালাবে সব।”
জোভান পরম আবেশে জড়িয়ে বললো,
“আমি ছাড়া আমার বউ যেন আর কারো নজরে না পরে।”
এমনি শারমিন সাখাওয়াতের হাক পড়লো,
“শারমায়া?”
“জ্বি আম্মু?”
“এদিকে আয়তো একটু।”
জোভান তাকে ছেড়ে দিলে শারমায়া যেতে যেতে মুচকি হেসে বললো,
“পৃথিবীর সব পুরুষ নিজের বউয়ের ব্যাপারে আপনার মতো হিংসুটে হোক।”
তার হাসির বিপরীতে জোভানের হাসিও প্রশস্ত হয়ে গেলো। শারমায়া বেরিয়ে আসতেই শারমিন বললেন,
“জোভান কোথায়?”
“এখানেই।”
“কিচেনে বিরিয়ানি রেখে এসেছি। এনে দে। তুইও খেয়ে নে। আর দরজা লাগিয়ে যা। বিয়ে বাড়ি, কখন কে এসে পড়ে বলা যায়?”
“আম্মু, সুষনা আপু আর সাফওয়ানাকে পাঠিয়ে দিয়ো তো।”
“সুষনা খেয়েছে, এখন আসবে না। ফারিয়ার হাতে মেহেদী লাগাচ্ছে। আর সাফওয়ানার কোনো খবর আছে? মানুষ দেখলে তার পেট ভরাই থাকে।”
শারমিন চলে গেলে শারমায়া দুই প্লেট খাবার নিয়ে এলো। জোভানকে ডাকতেই জোভান বারান্দা থেকে রুমে এসে খাবার দেখে বললো,
“এই সুন্দর মুহূর্তে খাবারের এন্ট্রি না হলে কি হতো। তোমার এতোই ক্ষুধা লেগেছে? আমার কথায় কি মন ভরছিলো না? তোমাকে নিয়ে ভাবতে বসলেই তো আমার সব ভুলে যেতে ইচ্ছে করে।”
শারমায়া মুখ চেপে হেসে গ্লাসে পানি নিতে নিতে বললো,
“শুধু মন ভরলেই হবে? পেট ভরতে হবে না? বসুন, ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না।”
“বিরিয়ানি, আবার চিকেন ফ্রাই কেন?”
“আপনি আসবেন জেনে আম্মু ফ্রাই করে রেখেছিলো।”
জোভান খাওয়ার জন্য বসলো ঠিকই, কিন্তু খেলো শারমায়ার হাতে। শারমায়ার আজ এতোটাই অস্বস্তি লাগছিলো যে নিজের কাছেই নিজেকে আনাড়ি মনে হচ্ছিলো। যেন আজ প্রথম হাতে তুলছে খাবার। খাওয়া শেষে খালি প্লেট নিয়ে উঠতে গেলে জোভান বাঁধা দিয়ে তার গা ঘেঁষে বসলো এবং বললো,
“খুব বেশি জ্বালাতন করি, তাই না?”
শারমায়া লজ্জায় দৃষ্টি নিচের দিকে রেখেই মাথা দু’দিকে নেড়ে না সূচক জবাব দিলো। জোভান মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বললো,
“অভ্যাস করে নাও। আরও অনেক সহ্য করতে হবে যে। একসময় তো নিয়মিত জ্বালাতন করবে টুকটুকির আব্বু।”