সেই সন্ধ্যা পর্ব-২৯

0
1607

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২৯
.
সকাল মাঠে বসে বারবার মেডিকেলের গেইটের দিকে তাকাচ্ছে। আফি এখনো আসে নি। পরশকেও খুঁজেছে ও। কিন্তু পরশও এখনো আসে নি। সেদিনের পর থেকে পরশকে কোথাও দেখেনি সকাল। তাই একটু চিন্তা হচ্ছে ওর। একা একা ভালো লাগছেনা বলে ফোনে ডোরেমনের এপিসোড গুলো সার্চ দিয়ে দেখতে লাগলো সকাল। মাথায় কেউ টোকা দিতেই সকাল চোখ-মুখ কুঁচকে মাথায় হাত বুলিয়ে পাশে তাকিয়ে স্নিগ্ধকে দেখলো। স্নিগ্ধকে দেখে মিষ্টি হাসলো সে। হাসলো স্নিগ্ধ নিজেও।
-“আপনি আমাকে মারলেন কেন?”
-“মারলাম কোথায়! শুধু হালকা করে টোকা দিয়েছি।”
-“কিন্তু আমি তো ব্যথা পেলাম।”
-“আচ্ছা স্যরি।”
-“আপনি কত্ত সুইট। আমি একটু মুখ ফুলিয়ে নিলেই বারবার স্যরি বলা শুরু করে দেন।”
-“ওহ তো ম্যাডাম আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন!”
-“না তো। সকাল তো শুধু একটু মজা করেছে।”
-“ওরে দুষ্টু… তোমাকে তো পরে দেখে নিবো আমি।”
-“আচ্ছা দেখে নিয়েন।”
-“এখানে একা একা বসে আছো কেন! আফি কোথায়?”
-“আফি আসলে কি আর আমি এখানে থাকি! তার উপরে পরশও আজ আসেনি। আর আপনাকেও পাচ্ছিলাম না। তাই তো এখানে বসে বসে ডোরেমন দেখছিলাম।”
-“হুম তুমি যে পিচ্চি তার প্রমাণ আমি প্রতি পদে পদে পাই।”
-“আমি পিচ্চি না। আমি পিচ্চি হলে কি আপনি আমাকে বিয়ে করতেন না-কি!”
-“তুমি পিচ্চি বলেই রাজি হয়েছি। আসলে কি বলো তো, একটা বাচ্চা দত্তক নিতে চাচ্ছিলাম পালবো বলে। কিন্তু পরে আবার ভাবলাম একটা বাচ্চা তো ইতিমধ্যে আমাকে পছন্দ করে। মানে তুমি আর কি! তোমাকে তো আর দত্তক নেয়া যাবে না তাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিয়ের পর আমার আর বাচ্চার প্রয়োজন নেই। তোমাকে পালতে গেলেই আমার সময় শেষ হয়ে যাবে।”
-“সকাল কিন্তু রাগ করবে।”
-“আচ্ছা মিস বিকাল দয়া করে আপনি এখন আর রাগ করবেন না। এখন চলো আমার সাথে। একা বসে থাকার দরকার নেই এখানে।”
-“চলুন।”

আফি রিকশায় করে মেডিকেলে আসার সময় রাস্তার একপাশে ছোটখাটো একটা জটলা দেখলো। মানুষজন ভীড় জমিয়ে কি যেন বলাবলি করছে। রিকশাটা থামিয়ে রিকশাওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ও সেদিকে এগিয়ে গেল। ভীড় ঠেলে কিছুটা এগিয়ে যেতেই ওর চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি সবাইকে ঠেলে সরিয়ে সামনে গেল সে।
-“পরশ তুমি ঠিক আছো?”
পরশ আফিকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
-“তুমি এখানে!”
-“মেডিকেলে যাচ্ছিলাম এখানে ভীড় দেখে কৌতুহল বশত দেখতে এসেছিলাম। এসে দেখি তুমি পড়ে আছো। কিন্তু তুমি বাইক এক্সিডেন্ট কীভাবে করলে?”
-“এখন এত কথা বলার সময় নেই। আমাকে উঠতে সাহায্য করতে পারবে?”
-“হ্যা অবশ্যই।”
আফি পরশকে ধরে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে বাইকের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তুমি এখন বাইক চালাতে পারবে না। এর থেকে ভালো কাউকে কল করে নিয়ে যেতে বলো বাইকটা। আর তুমি আমার সাথে রিকশায় চলো। তোমাকে ডক্টর দেখাতে হবে।”
-“বাম পায়ে বেশ ভালোই চোট পেয়েছি মনে হচ্ছে। ব্যথায় নাড়াতেও পারছি না।”
-“আচ্ছা তুমি আসো রিকশায় বসবে।”

আফি পরশকে শক্ত করে ধরে কষ্ট করে রিকশার সামনে এনে রিকশায় বসিয়ে দিল। পরশ প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে ওর এক বন্ধুকে কল দিয়ে বাইকটা নিয়ে যেতে বললো। আফি রিকশায় পরশের পাশে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো,
-“পরলে কীভাবে বাইক থেকে?”
-“আর বলো না। বাইক নিয়ে মেডিকেলে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে একটা গাড়ি ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়েছে। ড্রাইভিং একটা মেয়ে করছিল শুধু এতটুকুই দেখেছি। শালিকে সামনে পেলে আজকে ওর ব্যান্ড বাজিয়ে দিতাম। গাড়ি চালাতে পারে না তো চালাতে আসছে কেন!”
-“এসব চালকদের লাইসেন্স বাতিল করে দেয়া উচিৎ। দেখি তোমার হাতে কতটুকু লেগেছে।”
-“আরে না হাত ঠিক আছে।”
-“হ্যা সেজন্যই রক্ত বের হচ্ছে। যতসব! দেখি।”
হাতেও বেশ খানিকটা ছিলে গেছে পরশের। আফি পরশের দিকে তাকিয়ে কৌতুকের সুরে বললো,
-“বাইক চালানো বাদ দিয়ে তাকে প্লেন ভেবে উড়াতে গেলে এমনই হয়।”
-“আমি মোটেও বাইককে প্লেন ভেবে উড়াচ্ছিলাম না।”
-“হ্যা হ্যা জানা আছে আমার।”
-“আমি আপাতত ঝগড়া করার মুডে নেই।”
-“আমি মনে হয় খুব মুডে আছি ঝগড়া করার!”
-“তুমি কখন ঝগড়া করো না একটু বলো তো! না মানে আমি আজ পর্যন্ত তোমাকে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে দেখিনি। যখনি তোমার সাথে আমার কথা হয়েছে তুমি ঝগড়া করেছো।”
-“এই একদম মিথ্যে কথা বলবে না। আমি মোটেও সব সময় ঝগড়া করিনি। ঝগড়া তো তুমি করেছো। তোমাকে না দেখলে জানতামই না যে ছেলেরা এত ঝগড়া করে জানে।”
-“হ্যা তা তো দেখতেই পাচ্ছি কে ঝগড়া করছে।”
-“পরশ তুমি থামবে! খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।”
-“আর খারাপ হওয়ার বাকি কী আছে? ইতিমধ্যে এক্সিডেন্ট করে বসে আছি। বাম পা সম্ভবত প্লাস্টার করতে হবে।”
-“তাও তো ঝগড়া করা থামাচ্ছো না। তোমার এত এনার্জি আসে কোত্থেকে?”
-“সোজাসাপ্টা বললেই পারো যে তুমি ঝগড়া করতে চাও। তা নাহলে আমার স্বাভাবিক ভাবে বলা কথাবার্তাকেও ঝগড়ার নাম দিতে না।”
-“তুমি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছো! আমি তো দেখছি তুমি ঝগড়া করছো।”
-“তুমি করছো ঝগড়া।”
-“বললাম না তুমি করছো!”
-“আমি বললাম না তুমি!”

রিকশাওয়ালা মেডিকেলের সামনে রিকশা থামিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের ঝগড়া দেখে যাচ্ছে। কিন্তু আফি বা পরশ কারো কোনো হুঁশ নেই। ওরা নিজেদের মতো তর্ক চালিয়েই যাচ্ছে। একসময় রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে বললো,
-“আপনেরা আমার রিকশা ভাড়াটা মিটায় দিয়া রিকশা থিকা নাইমা তারপর দাঁড়ায় দাঁড়ায় ঝগড়া করেন। আমার আরো বহুত কাম আছে। আমারে যাইতে দেন।”

রিকশাওয়ালার কথায় চমকে উঠলো ওরা দু’জন। একে অপরের দিকে তাকিয়ে মেডিকেলের গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখে ওরা পৌঁছে গিয়েছে। আফি রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে অপর পাশে গিয়ে খুব সাবধানে পরশকে নামালো। তারপর পরশকে ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে মেডিকেলের ভেতরে চলে গেল। ওদের ঝগড়া তখনো চলছে।

হন্তদন্ত হয়ে কেউ একজন স্নিগ্ধর কেবিনে প্রবেশ করতেই স্নিগ্ধ মুচকি হেসে সামনে তাকাতেই ওর মুখের হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেল। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ উঁচু করে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল সে। স্নিগ্ধ ভেবেছিল সকাল এসেছে। এতক্ষণ সকাল এখানেই ছিল। তার সাথেই গল্প করছিল স্নিগ্ধ। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই সকাল যখন শুনেছে স্নিগ্ধ খেয়ে আসেনি, তখনি সে ক্যান্টিনে চলে গিয়েছে খাবার নিয়ে আসতে। সে সব কথা বাদ দিয়ে স্নিগ্ধ প্যান্টের পকেটে হাত রেখে সামনে তাকালো।
-“তুমি এখানে কি করছো অনন্যা?”
-“তার আগে তুমি বলো আমি কি শুনছি এসব?”
-“আমি কীভাবে বলবো তুমি কি শুনেছো!”
-“তুমি বিয়ে করছো?”
-“হ্যা। এতে এত অবাক হওয়ার কি আছে! আমি বিয়ে করতে পারবো না এমনটা কি কোথাও লেখা আছে?”
-“বিয়ে যখন করবেই তখন আমাকে কেন নয় স্নিগ্ধ! আমি তোমাকে ভালোবাসি তুমি জানো না?”
-“কিন্তু আমি তোমাকে কখনো সেই নজরে দেখিনি অনন্যা। আমি সবসময় তোমাকে বোন ভেবেই এসেছি।”
-“স্নিগ্ধ! তুমি আমার সাথে এমন কেন করো একটু বলবে? যদি আমাকে তুমি বোন ভেবে থাকো তাহলে নীলামকে কেন ভালোবেসে ছিলে? নীলামকেও তো বোন ভাবা উচিৎ ছিল তোমার তাই নয় কি!”
-“নীলামের সাথে নিজের তুলনা করো না। তুমি আর নীলাম সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ।”
-“তো কি! নীলাম তো আমারই বোন ছিল। আমার ছোট বোন ছিল সে।”
-“আচ্ছা অনন্যা তোমার কি সামান্যতম লজ্জা লাগে না নিজের ছোট বোনের ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসি বলতে! নীলামের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল জেনেও তুমি বারবার আমার পেছনে ঘুরেছো। কেন?”
-“কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। নীলাম আমার ছোট। ও তোমাকে ভালোবাসার আগে থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
-“কিন্তু তোমার এটা ভাবা উচিৎ ছিল যে আমি নিজেও তখন নীলামকে ভালোবাসতাম।”
-“হ্যা মেনে নিয়েছিলাম তো একসময়। তাই তো যখন তোমার আর নীলামের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল তখন আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু এরপর! এরপর যখন নীলাম চলে গেল তখন আমি আবার আমার ভালোবাসাগুলোকে বন্দী খাঁচা থেকে মুক্ত করেছি। কারণ এখন তো আর নীলাম নেই। তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে কেন অন্য একজনকে বিয়ে করতে রাজি হলে! আমার ভালোবাসা কি তোমার চোখে পড়ে না?”
-“কারণ আমি যাকে বিয়ে করছি সে আমার মনের বেশ অনেকটা জায়গা নিজের নামে লিখে নিয়েছে। নিজের ভালোবাসা দিয়ে আমাকে এবং আমার মনকে দখল করে নিয়েছে। যেটা তুমি গত সাত বছর চেষ্টা করেও পারোনি। নীলাম আমার মনে মাত্র কয়েক মাসে জায়গা করে নিয়েছিল। ঠিক একই ভাবে সকালও মাত্র কয়েক মাসের ভেতরেই আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু নীলাম আমার জীবনে আসার আগে থেকে চেষ্টা করেও এখনো পর্যন্ত তুমি আমার মনে সামান্য জায়গাও দখল করতে পারোনি। এখানে তোমার ব্যর্থতা অনন্যা।”
-“তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না স্নিগ্ধ। প্লিজ আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিওনা। আমি ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।”
-“আমি দুঃখিত অনন্যা। কিন্তু আমি আমার জীবনটা সকালের সাথে জড়িয়ে ফেলেছি। আর আমি সত্যি মন থেকে সকালকেই চাই আমার জীবনে।”
-“আর নীলাম! সে-কি এখন আর তোমার মনে নেই?”
-“অবশ্যই আছে। তবে নীলাম আমার অতীত সেটা আমাকে বুঝতে হবে। সে এখন আমার জীবনে নেই। তবে মনের এক কোণে তালা বন্ধ স্মৃতির পাতায় সে এখনো আছে। আমি এখনো বলতে পারি আমি নীলামকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি এ-ও বলতে পারি যে সকাল আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে। ওকে ভালোবাসতে আমার সময় লাগবে না। হয়তো ইতিমধ্যে আমি ভালোবেসে ফেলেছি ওকে। কিন্তু আমি নিজে তা বুঝতে পারছি না। তবে ওর একফোঁটা চোখেরজলও আমি সহ্য করতে পারি না। ওর মন খারাপ আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তাহলে এ-র মানে কি! নিশ্চয়ই আমি ওকে ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলছি।”
-“আমার কি হবে ভেবেছো একবারও?”
-“জীবনটা তো ফেলনা না। তাই আমার আশা বাদ দিয়ে নতুন কাউকে নিয়ে জীবন সাজাও অনন্যা।”
-“তার মানে তুমি ওই মেয়েকেই বিয়ে করবে!”
-“ওই মেয়ে যাকে বলছো তার খুব সুন্দর একটা নাম আছে।”
-“ওর সেই সুন্দর নাম ধুয়ে কি আমি এখন পানি খাবো?”
-“আমি তো তা বলিনি। দেখো অনন্যা সকাল যদি আমার জীবনে না-ও আসতো, তা-ও আমি তোমাকে আমার জীবনে কখনো ঢুকতে দিতাম না। তাই বলছি, নিজের জন্য এমন কাউকে খুঁজো যে তোমাকে ভালোবাসবে। এতে করে তুমিও একদিন তাকে ভালোবেসে নিজের জীবনটাকে আরো সুন্দর করে সাজাতে পারবে।”

অনন্যার কান্না পাচ্ছে এই মুহূর্তে। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাচ্ছে তার। সাত বছর! সাতটা বছর কি কম একজনকে নিজের ভালোবাসা উপলব্ধি করানোর জন্য? সে গত সাতটা বছর ধরে স্নিগ্ধ বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়েছে যে সে স্নিগ্ধকে ভালোবাসে। কিন্তু স্নিগ্ধ আগেও ওকে পাত্তা দেয়নি আর আজও ওকে প্রত্যাখ্যান করছে। নীলাম চলে যাওয়ার পর ভেবেছিল হয়তো এবার সে স্নিগ্ধকে পাবে। কিন্তু নাহ! এবারও স্নিগ্ধ তাকে সরিয়ে অন্য একজনকে নিজের জীবনে নিয়ে এসেছে। কি কমতি ছিল তার ভালোবাসায় যে স্নিগ্ধ ওর ভালোবাসা বুঝতে চায় না। ওকে নিজের মনে জায়গা দিতে পারে না কেন স্নিগ্ধ? বর্তমানে স্নিগ্ধর উপর যতটা না রাগ উঠছে তার থেকে কয়েক গুণ বেশি রাগ হচ্ছে এই সকাল নামের মেয়েটার উপর। এই মুহূর্তে সকাল সে সামনে পেলে তাকে কি যে করবে অনন্যা নিজেও জানে না।

অনন্যার এসব ভাবনার মাঝেই সকাল হাতে একটা ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। অনন্যাকে দেখে সকালের চিনতে সমস্যা হলো না। সেদিন অনুষ্ঠানে ভালো করেই খেয়াল করেছিল সে অনন্যাকে। তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে স্নিগ্ধর দিকে তাকালো সকাল। স্নিগ্ধ সকালের কাছে এসে হাত থেকে ট্রে নিয়ে টেবিলে রাখলো।
-“মিস বিকাল কেন শুনোনা আমার কথা! আমি বলেছিলাম না এত কষ্ট করতে হবে না এখন। তা-ও জোর করে যেয়ে খাবার নিয়ে আসার কি দরকার ছিল?”
-“বা রে! আমি না খেয়ে থাকলে আপনি আমাকে বকা দেন। জোর করে খাবার খাওয়ান। তাহলে আপনি খেয়ে আসেননি শুনে আমারও তো একই কাজ করা উচিৎ। আর আমি তা-ই করেছি। বুঝেছেন!”
-“জ্বি বুঝেছি।”

স্নিগ্ধ আর সকালের কথাবার্তা শুনে অনন্যার মনে হলো ওরা দু’জন আদিখ্যেতা করছে। রাগ তার মাথায় উঠে গিয়েছে। চোখ দিয়ে যেন লাভা বের হচ্ছে। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগকে কমানোর চেষ্টা করছে। সকাল স্নিগ্ধর থেকে চোখ সরিয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বেশ হাসিমুখেই এগিয়ে গেল তার দিকে।
-“কেমন আছো আপু?”
অনন্যা তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-“নিজের প্রিয় জিনিস অন্য একজন ছিনিয়ে নিচ্ছে দেখলে কি আর ভালো থাকা যায়?”
-“ঠিক বুঝলাম না তোমার কথা।”
-“তুমি কি আমাকে চেনো!”
-“হ্যা। সেদিন রাতে মেডিকেলের অনুষ্ঠানে তোমাকে ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখেছিলাম। উনিই আমাকে বলেছিলেন যে তুমি উনার কাজিন হও।”
-“এতটুকুই বলেছে শুধু!”
-“কেন আরো কিছু বলার বাকি আছে না-কি!”
সকালকে থামিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধ বললো,
-“তুমি এখন এখান থেকে আসতে পারো অনন্যা। আমাদের একটু একান্ত সময় প্রয়োজন।”
-“কেন স্নিগ্ধ! তোমার বাগদত্তাকে জানানো উচিৎ তো যে তার থেকেও বেশি অন্য একজন তোমাকে ভালোবাসে।”
-“অনন্যা প্লিজ আমি কোনো সিনক্রিয়েট চাইছি না এখানে।”
-“আমিও চাইছি না সেটা।”
সকাল স্নিগ্ধ আর অনন্যার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো,
-“ডাক্তার সাহেব চুপ করুন। হ্যা আপু তুমি কি যেন বলতে চাইছিলে!”
-“আমি স্নিগ্ধকে ভালোবাসি। হাতে গোনা কয়েকদিন ধরে নয়। গত সাত বছর ধরে আমি ওকে ভালোবেসে আসছি। তুমি এভাবে হুট করে উড়ে এসে আমার কাছ থেকে ওকে ছিনিয়ে নিতে পারো না।”
-“আপু কিছু মনে করো না। আমার কথাগুলো একটু ভালো ভাবে বোঝার চেষ্টা করো। তুমি উনাকে ভালোবাসো ঠিক আছে। গত সাত বছর ধরে ভালোবেসে আসছো তা-ও ঠিক আছে। কিন্তু আমি এখানে হুট করে উড়ে আসিনি। আর না আমি তোমার কাছ থেকে উনাকে ছিনিয়ে নিচ্ছি। আর এক মিনিট! ছিনিয়ে নেয়ার কথা এখানে আসছেই বা কেন? উনি কোনোদিন তোমার হলে তো আমি ছিনিয়ে নিবো! যেখানে উনি তোমার কোনোদিন ছিলই না সেখানে আমার উনাকে ছিনিয়ে নেয়ার প্রশ্নই আসে না। আর আপু তুমি সাত বছর চেষ্টা করে যেটা পারোনি আমি গত কয়েক মাসে তা পেরেছি। এখানে তো আমার কোনো দোষ নেই। তুমি উনার মনে নিজের জন্য জায়গা তৈরি করতে পারোনি এটা তোমার ব্যর্থতা। এখানে আমার বা ডাক্তার সাহেবের কোনো দোষ নেই। সবকিছু ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল আপু। ওপরওয়ালা চেয়েছেন বলেই আজ স্নিগ্ধর বাগদত্তা আমি। উনি চাননি বলেই তুমি স্নিগ্ধর মনে নিজের জন্য জায়গা তৈরি করতে পারোনি। এখন এসব ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে বা রাগারাগি করে অথবা চেঁচামেচি করেও কি কোনো লাভ হবে! এসব করে কি তুমি আমাদের বিয়েটা ভাঙতে পারবে! না-কি আমাদের আলাদা করতে পারবে! এ-র থেকে এসব বাদ দাও আপু। ভেবে না-ও না যে ডাক্তার সাহেব কখনো তোমার ছিলই না। উনি তোমার ভাগ্যে নেই তাই উনাকে তুমি পাওনি।”
-“ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট তুমি বুঝবে না স্নিগ্ধর মিস বিকাল। যেদিন স্নিগ্ধকে পেয়েও হারাবে সেদিন বুঝবে। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা মৃত্যু সমান। আজকের মতো আসছি। ভালো থেকো স্নিগ্ধ।”

অনন্যা স্নিগ্ধ আর সকালের দিকে তাকিয়ে চলে গেল। সকালের মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল। স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখলো স্নিগ্ধ মুখটা হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুহূর্তেই চোখ দুটো ছোট ছোট করে ফেললো সকাল।
-“কি! এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন? যেন মনে হচ্ছে আজ নতুন দেখছেন!”
-“সত্যি তুমি মিস বিকাল তো!”
-“না।”
-“তাহলে কে?”
-“আমি সকাল।”
-“সিরিয়াসলি মিস বিকাল তুমি এত কথা জানো? এতদিন তোমাকে দেখে আমি ভেবেছি তুমি এসব কিছু বুঝো না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমি তোমাকে যতটা ছোট ভাবি তুমি অতোটাও ছোট না।”
-“হুহ্! এরপর থেকে তাহলে আর পিচ্চি বলে ডাকবেন না।”
-“নাহ! পিচ্চি তো আমি তোমাকে বলবোই। আমার পিচ্চি।”
-“এতদিন যেভাবে ঘুরিয়েছেন তাতে তো মনে হয় না এতদিন এই পিচ্চিকে একবারও নিজের মনে করেছেন!”
-“হাহাহা… এখন তো বললাম যে তুমি আমার। আর দেখো এখন প্রমাণও আছে তোমার আঙুলে।”

সকাল মুচকি হাসলো নিজের বাম হাতের অনামিকা আঙুলের দিকে তাকিয়ে। পরক্ষণেই মুখটা মলিন হয়ে গেল। স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে তার দিকে এগিয়ে এসে হাত দুটো শক্ত করে ধরলো সকাল। স্নিগ্ধ একটু অবাক হলো কিন্তু তা চেহারায় প্রকাশ করলো না। সকাল স্নিগ্ধর চোখে চোখ রাখলো।
-“আপনাকে না পাওয়ার যন্ত্রণাও আমাকে এতটা কষ্ট দিতো না যতটা কষ্ট এখন আপনাকে পাওয়ার পর হারালে হবে। প্লিজ স্নিগ্ধ কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমি আপনার সব কথা শুনবো। আপনি যা বলবেন তাই করবো। তাও কখনো ছেড়ে যাবেন না। আপনাকে হারিয়ে ফেললে আমি সহ্য করতে পারবো না। হয়তো মরে যাবো না আপনাকে না পেলে, কিন্তু সেটাকে বেঁচে থাকাও বলা যাবে না। আমি আপনাকে ভালোবেসেছি। আমার মনটা আপনাকে দিয়ে দিয়েছি। আপনি যদি কখনো আমাকে ছেড়ে চলে যান তাহলে কিন্তু আমার মনটাও আপনার সাথে চলে যাবে। আর আমি বেঁচে থেকে মরে যাবো। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না স্নিগ্ধ।”

সকালের চোখ দুটো ছলছল করছে। স্নিগ্ধ কি বলবে ভাষা খুঁজে পেলো না। এই পিচ্চিটা তাকে এত ভালোবাসে তা এতদিন কেন বুঝেনি সে? স্নিগ্ধ সকালের হাত দুটো তুলে এক এঁকে চুমু দিল। সকালের গালে তার দু’হাত রেখে বললো,
-“কথা দিলাম কখনো তোমায় ছেড়ে যাবো না। যদি-ওবা কখনো যাওয়ার চেষ্টা করি তাহলে তুমি আমাকে তোমার ভালোবাসা দিয়ে আটকাবে। অন্তত তোমার ভালোবাসা উপেক্ষা করার মতো শক্তি আমার নেই। কখনো ভাবিনি এতকিছুর পর জীবনে তোমার মতো এত ভালোবাসার মানুষ পাবো। ওপরওয়ালাকে অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে আমার ভাগ্যে লিখে রাখার জন্য। তুমি আমার জীবনে আসতেই আমার সকল দুঃখ-কষ্ট ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এতদিন এই বুকে যে আগুন জ্বলছিল তুমি আসায় নিমিষেই তা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। তুমি আমার ভালো থাকার ওষুধ মিস বিকাল। তোমাকে ছাড়া কি করে থাকবো আমি! এই স্নিগ্ধ এখন তোমার আছে আর ভবিষ্যৎ-এও তোমারই থাকবে। ওয়াদা রইলো।”

মুহূর্তেই সকালের মনে এক শীতল হাওয়া বয়ে গেল। এরকম কিছুই শুনতে চাইছিল সে স্নিগ্ধর কাছ থেকে। আর সত্যি স্নিগ্ধ তা-ই বলেছে। সকালের কপালে এক গাঢ় চুমু এঁকে দিল সে। আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললো সকাল। ভীষণ শান্তি লাগছে এই মুহূর্তে তার। যদি সময়টা এখানেই থেমে যেতো তবে মন্দ হতো না। ভালোবাসার মানুষটা সারাজীবন পাশে থাকলে আর কি চাই! কাউকে ভালোবাসা খুব সহজ। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে যত্ন করে আগলে রাখতে ক’জনই বা পারে! স্নিগ্ধ মুখে স্বীকার না করলেও সকাল বুঝে তার ভালোবাসা। মনে মনে সে-ও যে সকালকে ভালোবাসে তা জানে সকাল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here