সেই সন্ধ্যা পর্ব-৩১

0
1763

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩১
.
মেডিকেলের ভেতরে প্রবেশ করতেই সকাল অবাক হয়ে গেল। সবাই কেমন করে যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগলো সকালের কাছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো সবকিছুই ঠিক আছে তার। তাহলে এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কি! এক প্রকার বিরক্ত হয়েই ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ালো সে। ক্লাসরুমে ঢুকতেই সবাই ওকে দেখে ফিসফিস শুরু করে দিল। সবার এই ব্যবহার সকালকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিল। সিটে ব্যাগ রেখে বসতে গেলেই কয়েকজন প্রফেসর ও ডক্টর ক্লাসে ঢুকলো। তাদের দেখে সকলেই উঠে দাঁড়ালো। সকালও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। উনারা সকালের সামনে এসে দাঁড়ালো দেখে অনেক অবাক হলো সকাল।
-“তোমার নামই তাহলে সকাল!”
-“জ্বি।”
-“পুরো নাম কি?”
-“অপর্ণা ইসলাম সকাল।”
-“দেখে তো ভদ্র ঘরের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। এরকম অশ্লীলতা করতে বিবেকে বাঁধলো না তোমার?”
-“স্যরি কিন্তু আমি আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না স্যার।”
-“হ্যা এখন তো কিছুই বুঝবে না।”
-“দেখো! ভালো সাজার অভিনয় করে লাভ নেই। আমাদের মেডিকেলে তোমার মতো শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো জায়গা নেই। যারা পড়াশোনার নামে অশ্লীলতা করতে আসে।”
-“আজব তো! তখন থেকে কি সব উল্টো পাল্টা বকছেন আপনারা? আমি কি অশ্লীলতা করেছি! আমার অপরাধ কি?”
-“আমাদের মেডিকেলের প্রফেসর ডক্টর স্নিগ্ধর সাথে তোমার কিছু আপত্তিকর ছবি দেখেছি আমরা। আমরা ভাবতেও পারছি না তোমার মতো এত ভালো একজন ছাত্রী এরকম হতে পারে! এই নূরানী চেহারার পেছনে এমন কুৎসিত কাজকর্ম করতে লজ্জা করে না তোমার?”
-“না জেনে শুনে কারো ব্যাপারে কথা বলতে হয় না এটা বোধহয় আপনাদের কেউ শেখায়নি। স্যরি স্যার কিন্তু আমি কথাটা বলতে বাধ্য হলাম। তাছাড়া ডক্টর স্নিগ্ধর সাথে আমাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছেন বলতে কি বুঝাতে চাইছেন আপনারা?”
-“বেয়াদব মেয়ে। টিচারদের সাথে কথা কীভাবে বলতে হয় তোমার বাবা-মা শেখায়নি? তুমি যে কি ধরনের মেয়ে তা আমাদের জানা হয়ে গেছে। এতই যখন দেহের জ্বালা মেটানোর শখ তখন নিষিদ্ধ পল্লিতে গেলেই তো পারো। আমাদের এই নামি-দামি মেডিকেলের সুনাম নষ্ট করার অধিকার তোমার নেই। এই রূপের জালে আবার আমাদের মেডিকেলেরই প্রফেসরকে ফাঁসিয়ে নিয়েছো। কি পরিমাণ বেহায়া হলে এখনো এই মুখ নিয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছো আমি সেই কথাই ভাবছি।”

কথাগুলো শেষ করেই প্রফেসর কিছু ছবি ছুঁড়ে মারলেন সকালের দিকে। সকালের দুচোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ও চাইলেই সবার ভুল ধারণাটা ভাঙিয়ে দিতে পারে। কিন্তু নিজের নামে এত বিশ্রী বদনাম শুনে ওর পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গিয়েছে। গলাটা কেউ চেপে ধরে আছে বলে মনে হচ্ছে সকালের। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলো এগুলো গতকালের ছবি। যখন অনন্যা স্নিগ্ধর কেবিন থেকে চলে গেল তারপর স্নিগ্ধ সকালের হাতে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরেছিল সেই মুহূর্তগুলোর ছবি কেউ একজন তুলে সবার সামনে বাজেভাবে উপস্থাপন করেছে। সকাল কিছু বলতে যাবে তার আগেই এক প্রফেসর বললো,
-“আজকের পর থেকে তোমাকে যেন এই মেডিকেলের ত্রিসীমানাতেও না দেখি। তুমি এই মেডিকেলে পড়তে পারবে না। শুধু এই মেডিকেলে কেন তুমি আর অন্য কোনো মেডিকেল বা ভার্সিটিতে পড়তে পারবে না। সেই ব্যবস্থা করা হয়ে গিয়েছে। তোমার মতো অসভ্য, বেশ্যা মেয়ের জায়গা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নয়। গেট আউট।”

সকাল আর কিছু বলতে পারলো না। জীবনে কখনো এরকম কোনো পরিস্থিতিতে পরতে হয়নি তাকে। না কখনো এই ভাষাগুলো শুনতে হয়েছে। সকাল কাঁদতে কাঁদতে একহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বেরিয়ে গেল মেডিকেল থেকে। গাড়িতে বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সে। এত অপমান সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার নেই। কেউ কখনো তাকে অপমান করার সাহস বা সুযোগ পায়নি। এসব থেকে সব সময় ওর বাবা-মা ওকে আগলে রেখেছে। আজ প্রথমবার এমনটা হওয়াতে সে মুহূর্তেই ভেঙে পড়েছে। ড্রাইভার সকালের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আজ পর্যন্ত সকালকে তিনি কাঁদতে দেখেন নি। কোনো প্রশ্ন না করে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে সোজা বাসার দিকে রওয়ানা হলেন।

আফি মেডিকেলে এসে এসব শুনতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। সকাল কিছু না বলে চলে গেছে শুনে আফি সকালের নম্বরে কল দিল। কিন্তু সকালের ফোন বন্ধ বলছে। আর কোনো উপায় না পেয়ে স্নিগ্ধর নম্বরে কল দিল সে। চার-পাঁচবার কল দেয়ার পর কল রিসিভ করলো স্নিগ্ধ।
-“হ্যালো কে বলছেন?”
-“ভাইয়া আমি আফি।”
-“ওহ আফি! হ্যা বলো।”
-“মেডিকেলের খবর কিছু শুনেছেন আপনি?”
-“কি ব্যাপারে!”

আফি সবকিছু খুলে বলতেই স্নিগ্ধ খট করে কলটা কেটে দিল। রাগে তার শরীর কাঁপছে। এত বাজে কথা উঠেছে ওকে আর সকালকে নিয়ে! শিক্ষকরা কি করে পারলো এসব বলতে? উনারা শিক্ষক হয়ে এত বাজে ভাষা ব্যবহার করতে পারে কি করে? উনাদের বিবেকে বাঁধলো না এসব বলতে! স্নিগ্ধ দেরি না করে দ্রুত তৈরি হয়ে মেডিকেলে চলে গেল। মেডিকেলে ঢুকতেই তার কানে সকালের ব্যাপারে কিছু বাজে কথা ভেসে এলো। কারা বলছে কথাগুলো তাদের একবার দেখে সে সোজা বাকি প্রফেসরদের সাথে দেখা করতে চলে গেল। অনুমতি না নিয়ে তাদের কেবিনে প্রবেশ করলো স্নিগ্ধ। রাগে তার চেহারা লাল হয়ে আছে। কপালের রগ ফুলে নীল হয়ে আছে। স্নিগ্ধকে এভাবে ভেতরে ঢুকতে দেখে বাকি প্রফেসররা কিছুটা চটে গেল।
-“ডক্টর স্নিগ্ধ! এটা কি ধরনের অভদ্রতা?”
-“আপনি অনুমতি না নিয়ে হুটহাট এভাবে আপনার সিনিয়রদের কেবিনে প্রবেশ করতে পারেন না।”
-“আর আপনারাও একজন ছাত্রীর ব্যাপারে সবটা না জেনে তাকে মেডিকেল থেকে বের করে দিতে পারেন না।”
-“আপনার মুখে এত বড় বড় কথা মানায় না ডক্টর স্নিগ্ধ। আপনি যে কাজটা করেছেন তাতে মেডিকেলের সুনামে ব্যাপকভাবে আঘাত হয়েছে। আপনার মতো একজন ব্রিলিয়ান্ট ডক্টর কি করে এরকম একটা জঘন্য কাজ করতে পারলেন আমরা সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।”
-“মুখ সামলে কথা বলুন ডক্টর।”
-“আপনি মুখ সামলে কথা বলুন। আমরা আপনার ডাক্তারি লাইসেন্স বাতিল করছি এই কাজের জন্য।”
-“আপ…”

ফোনের শব্দে স্নিগ্ধ কথা শেষ করতে পারলো না। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে ওর মায়ের কল। একবার কেটে দিতে চেয়েও কি ভেবে যেন রিসিভ করে নিলো। ফোনের ওপাশ থেকে স্নিগ্ধর মা বললো,
-“হ্যালো স্নিগ্ধ! তুই যেখানেই থাকিস না কেন এই মুহূর্তে সকাল মায়ের বাসায় যা। মেডিকেল থেকে না-কি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে সে। আর বাড়ি গিয়েই রুমের দরজা লাগিয়ে বসে আছে। বাইরে থেকে রেহেনা আপা আর আরিফুল ভাই ডাকাডাকি করছেন তবুও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আল্লাহ না করুক মেয়েটার খারাপ কিছু যেন না হয়। তুই এক্ষুণি সেখানে যা। দেখ কি হয়েছে মেয়েটার।”

মুহূর্তেই স্নিগ্ধর বুকটা ধক করে উঠলো। সকালের কথা মাথা থেকেই বেরিয়েই গিয়েছিল তার। মেয়েটা এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েনি। না জানি ওর মনের অবস্থাটা কেমন এখন। সহ্য করতে না পেরে নিজের সাথে খারাপ কিছু করে ফেলবে না তো! বলা যায় না করতেও পারে। স্নিগ্ধ আর একটা কথাও না বলে বেরিয়ে যেতে গেলে পেছন থেকে একজন প্রফেসর বললেন,
-“কোথায় যাচ্ছেন!”
-“পালিয়ে যাচ্ছি না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসছি। এখন একটু ইমার্জেন্সি আছে।”

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। কোনোমতে গাড়ি চালিয়ে সকালের বাসায় পৌঁছালো। এক দৌড়ে বাসার ভেতরে ঢুকে উপরে সকালের রুমের সামনে চলে এলো সে। সেখানে আগে থেকেই রেহেনা বেগম আর আরিফুল সাহেব দরজা ধাক্কাচ্ছেন। কিন্তু ভেতর থেকে সকালের কোনো শব্দ নেই। স্নিগ্ধকে দেখে রেহেনা বেগম কেঁদে দিলেন। আরিফুল সাহেবও কেঁদে দিবেন চোখ-মুখ দেখে এমনই লাগছে তার। স্নিগ্ধ কাঁপা কাঁপা গলায় সকালকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু তা-ও সকালের কোনো খবর নেই। ভয়ে আর চিন্তায় শরীর কাঁপছে তার। স্নিগ্ধ আশেপাশে তাকিয়ে এক দৌড়ে ছাদে চলে গেল। ছাদের পূর্ব দিকের ঠিক নিচেই সকালের রুমের জানালা। আর ঠিক পাশেই পাইপ দেখে স্নিগ্ধ দেরি না করে পাইপ ধরে সানসেটে নেমে গেল। পাইপ শক্ত করে ধরে কিছুটা নিচে নামার পর অসাবধানতার জন্য হাত ছুটে গেল তার। নিচে পরে যেতে গেলেই একহাত দিয়ে সকালের রুমের জানালা শক্ত করে ধরলো। অবশেষে অনেক কষ্টে রুমে প্রবেশ করলো সে। হাত অনেকটা ছিলে গিয়েছে সাথে ব্যথাও পেয়েছে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সকালকে খুঁজতে লাগলো সে। হঠাৎ খেয়াল করলো আলমারির পাশে পা দেখা যাচ্ছে। স্নিগ্ধ দ্রুত সেদিকে গেল। সকালকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠলো। তাড়াতাড়ি হাঁটু মুড়ে নিচে বসে সকালের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে আলতো করে গালে হাত রেখে ডাকতো লাগলো সকালকে। স্নিগ্ধ বুঝতে পারলো সকাল ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে সে। তাই মানসিক দূর্বলতার কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। সকাল চোখ খুলছে না বলে উঠে গিয়ে পানির গ্লাসটা এনে ওর চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে দিতেই নড়ে উঠলো সকাল। স্নিগ্ধর চোখ দুটো হালকা ভিজে আছে। সকালের অবস্থা দেখে স্নিগ্ধর আরও বেশি খারাপ লাগছে। পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে স্নিগ্ধকে দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মুহূর্তেই আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলো সকাল। স্নিগ্ধ সাথে সাথেই সকালকে জড়িয়ে ধরলো।
-“হুঁশ! একদম কাঁদবে না। তুমি কেমন তা তুমি জানো, আমি জানি আমাদের পরিবারের সবাই জানে। তাই বাইরের মানুষের কথায় কান দিয়ে নিজের এই অবস্থা করার কোনো মানেই হয় না। তাছাড়া তুমি ভুলে যাচ্ছো কেন তুমি আমার বাগদত্তা! আমাদের অর্ধেক বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে। উনারা তো আর জানে না যে তোমার আমার সম্পর্কটা ঠিক কি। তাই ওইসব বলেছে। উনাদের সঠিক শিক্ষা দেয়া হবে। তবে তার জন্য তোমাকে শান্ত হতে হবে। প্লিজ চুপ করো পিচ্চি।”

বাইরে থেকে এখনো দরজা ধাক্কাচ্ছে। শব্দ শুনে স্নিগ্ধ সকালকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। রুমের দরজাটা খুলে দিয়ে আবারও সকালের পাশে এসে বসলো সে। একহাতে সকালকে জড়িয়ে ধরে টেবিল থেকে অন্য পানির গ্লাসটা নিয়ে সকালকে পানি খাইয়ে দিল। আরিফুল ইসলাম চমকে উঠেছিলেন স্নিগ্ধকে ভেতরে দেখে। সকাল এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে স্নিগ্ধকে জড়িয়ে ধরে। রেহেনা পাশে বসে সকালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই স্নিগ্ধ সম্পূর্ণ ঘটনা বললো। আরিফুল ইসলাম রেগে গিয়ে বললেন,
-“এখনি মেডিকেলে চলো। আমিও দেখি আমার মেয়েকে এইসব কথা বলার সাহস কি করে হলো উনাদের। আর উনাদের কত বড় স্পর্ধা যে উনারা আমার মেয়েকে বের করে দেয়!”
-“জ্বি আঙ্কেল আমিও এই ব্যাপারেই কথা বলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আগে ওকে শান্ত করার দরকার ছিল। তাই এখানে চলে এসেছি।”
ওদের কথার মাঝে সকাল কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-“স্যারদের কোনো দোষ নেই। এইসব ইমি করেছে। আমাকে যখন স্যাররা এসব বাজে কথা শোনাচ্ছিলেন তখন আমি দেখেছি ইমি সবার পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে হাসছে।”
স্নিগ্ধ অবাক হয়ে বললো,
-“ইমি! মানে ক্লাসের ওই অসভ্য মেয়েটা?”
-“হ্যা।”
-“ক্লিয়ার করে বলোতো ঘটনা কি!”

সকাল সবটা বললো। স্নিগ্ধ রেগে আরিফুলের দিকে তাকিয়ে দেখে আরিফুল ইসলামও যথেষ্ট রেগে আছেন।
-“স্নিগ্ধ বাবা তুমি মামনিকে নিয়ে আসো। আমি মেডিকেলে যাচ্ছি।”
স্নিগ্ধ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here