#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩৭
.
নয়নকে কোলে নিয়ে রুমে পায়চারী করছে সকাল। কাল সারারাত সে ঘুমোতে পারেনি। মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। তার একটু ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু স্নিগ্ধর বলা কথাগুলো বারবার তার কানে বারি খাচ্ছে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে আজ সকালের। মেডিকেলে যাওয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেছে। হালকা গোঙানির শব্দ পেতেই সকাল নয়নের দিকে তাকালো। নয়ন মুখে আঙুল দিয়ে চুষছে। সকাল বুঝতে পারলো নয়নের খিদে পেয়েছে। ও দ্রুত ফিটারে দুধ গুলে নিয়ে নয়নকে খাওয়াতে লাগলো।
আখি রুমে ঢুকে দেখে সকাল নয়নের মুখ থেকে ফিটার সরিয়ে রুমাল দিয়ে ওর মুখ মুছে দিচ্ছে। আখি এসে সকালের পাশে বসে বললো,
-“বাহ! তুমি তো জাদু জানো পিচ্চি। নয়ন সহজে খেতে চায় না। অথচ তোমার কাছে সে কোনো প্রকার ঝামেলা করা ছাড়াই খেয়ে নিলো।”
-“নয়ন খুব লক্ষ্মী ছেলে ভাবী।”
-“শুধু তোমার কাছেই। আচ্ছা তুমি কি রাতে ঘুমাওনি? চোখ-মুখ ফোলা ফোলা লাগছে কেমন যেন!”
-“তেমন কিছু না ভাবী। একটু মাথা ব্যাথা করছে তাই এমন লাগছে।”
-“ওহ আচ্ছা। এক কাজ করো! তুমি ফ্রেস হয়ে কিছু খেয়ে নাও। আমি তোমার জন্য মেডিসিন নিয়ে আসছি।”
-“লাগবে না। আমার কাছে আছে মেডিসিন। আমি খেয়ে নিবো।”
-“ঠিক আছে। তাহলে এখন নয়নকে আমার কাছে দাও। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।”
-“ভাবী আমি আজ মেডিকেলে যাবো না। মাম্মা আর পাপা আমার খোঁজ করবে ঘুম থেকে উঠে। তুমি একটু কষ্ট করে ওদের বলে দিও। আমি এখন মেডিসিন খেয়ে একটু ঘুমাবো।”
-“চিন্তা করো না আমি বলে দিব।”
সকাল মুচকি হাসলো। আখি সকালের কাছ থেকে নয়নকে কোলে নিতে গিয়ে চমকে উঠলো। তাড়াতাড়ি সকালের গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ওর শরীর।
-“তোমার গায়ে তো অনেক জ্বর!”
-“ওহ আচ্ছা। আমিও আন্দাজ করেছিলাম যে হয়তো জ্বর আসবে।”
-“মানে!”
-“আমার মাথা ব্যাথা তখনি হয় যখন জ্বর আসে।”
-“মেডিসিন আছে তোমার কাছে!”
-“হ্যা আছে। তুমি চিন্তা করো না। মাম্মা-পাপা আর ভাইয়াকে কিছু জানিয়ো না। নাহলে ওরা অনেক চিন্তা করবে।”
-“কিন্তু!”
-“কোনো কিন্তু না ভাবী। যাও এখন আর ওদের কিছু বলার দরকার নেই।”
-“ঠিক আছে বলবো না। তুমি নিজের খেয়াল রেখো।”
-“হুম।”
আখি রুম থেকে বের হতেই সকাল দরজা লাগিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে আলমারি থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। টানা আধঘন্টা ঠান্ডা পানির নিচে দাঁড়িয়ে থেকে মনের সকল দুঃখগুলোকে ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করলো। কিন্তু তেমন কোনো লাভ হলো না। জামাকাপড় পাল্টে বাইরে এসে কোনো রকমে চুলগুলো মুছে তাওয়াল চেয়ারের সাথে রেখে খাটের পাশে থাকা ছোট টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা বক্স বের করে নিলো। তার থেকে দুটো ঘুমের ওষুধ নিয়ে খেয়ে নিলো। এই মুহূর্তে তার গভীর ঘুম প্রয়োজন। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে সে ঘুমিয়ে গেল।
নয়নকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ফোন হাতে নিলো আখি। স্নিগ্ধর নম্বরে কল করলো সে। এতদিন পর দেশে ফিরেছে আর স্নিগ্ধর সাথে দেখা করবে না এটা তো মানা যায় না। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর কল ধরলো স্নিগ্ধ।
-“কোথায় তুই?”
-“আমি বাসায়। তৈরি হচ্ছি মেডিকেলে যাবো। মিটিং আছে একটা।”
-“ওহ আচ্ছা। তুই কি আমার নম্বর খেয়াল করিস নি?”
-“না তো কেন?”
-“আমি বাংলাদেশে এসেছি। পলকের বাবা-মা মেনে নিয়েছে আমাদের।”
-“কংগ্রাচুলেশন।”
-“আর সবথেকে মজার ব্যাপার হলো তোর ফিয়ন্সে সকাল আমার একমাত্র ননদ। মানে পলক সকালের ভাই।”
হতভম্ব হয়ে গেল স্নিগ্ধ। সকালের কাছ থেকে সে যতটুকু শুনেছিল তাতে করে তার ভাই কাজের জন্য বিদেশে গিয়েছিল। তাহলে পলক কি করে সকালের ভাই হতে পারে! ভাবতে লাগলো স্নিগ্ধ। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো গতকাল রাতের ঘটনা। চোখ বন্ধ করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো স্নিগ্ধ।
-“কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি?”
-“না কোথাও না। আজ বিকেলে তাহলে পলক আর নয়নকে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আয়। সাথে তোর শ্বশুর-শ্বাশুড়িকেও নিয়ে আসিস।”
-“হ্যা আমিও তাই ভাবছিলাম যে তোর সাথে দেখা করতে যাবো।”
-“আচ্ছা তাহলে এখন রাখছি। বিকেলে বাসায় আসলে কথা হবে।”
-“ঠিক আছে। আর শোন! সকালকে কল দিস না এখন। ও মেডিসিন খেয়ে ঘুমোচ্ছে। হুট করে প্রচন্ড জ্বর এসেছে ওর আর সাথে মাথাব্যাথাও ছিল। তাই বলছিলাম যে এখন ওকে ডিস্টার্ব করিস না।”
-“হুম।”
কল কেটে বিছানায় বসে নিজের চুল ধরে টানতে লাগলো স্নিগ্ধ। সকালের জ্বর এসেছে কথাটা শোনা মাত্রই তার মনটা ভীষণ উশখুশ করছে। মেয়েটার এই অবস্থা আজ তার জন্য। বুঝতে পেরেও যেন না বোঝার নাটক করছে সে। নীলামের ছবিটার সামনে যেয়ে পর্দা সরিয়ে দিল। চোখ দুটো ছলছল করছে স্নিগ্ধর। ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সকালকে কষ্ট দিয়ে তার থেকে দ্বিগুণ কষ্ট স্নিগ্ধ নিজে পাচ্ছে। কিন্তু সে নীলামকে ভুলতে পারবে না। শত হোক নীলাম তার প্রথম ভালোবাসা। নিজের ভালোবাসাকে সে কোনো ভাবেই মিথ্যে প্রমাণ হতে দিবে না।
-“আমি তোমাকে ভালোবাসি নীলাম। আমি এখনো তোমাকেই ভালোবাসি। যে যাই বলুক না কেন, তুমি এখনো আমার হৃদয় দখল করে বসে আছো আমি জানি। তাহলে অনন্যা কেন বারবার এটা বললো যে আমি তোমাকে ভুলে গিয়েছি! আমি কি কখনো তোমাকে ভুলতে পারি? তোমার স্নিগ্ধ কখনো তোমাকে ভুলতে পারে না নীলাম। কারণ এই স্নিগ্ধ আগেও তোমায় ভালোবাসতো আর এখনো তোমায় ভালোবাসে।”
পরক্ষণেই স্নিগ্ধ চিন্তিত সুরে বললো,
-“তাহলে সকালের সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? আমি কেন চাইলেও ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারিনা? কেন সকালের কান্না আমার বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে? কেন ও কষ্ট পেলে তার থেকে দ্বিগুণ বেশি কষ্ট আমি পাই? কেন আমি ওকে দূরে ঠেলে দিতে পারিনা? তবে কি সত্যি সত্যি আমি তোমাকে ভুলে ওকে…. নাহ! কখনো না। আমি তোমাকে ভুলতে পারি না। সকালের সাথে আমার শুধু মায়ার সম্পর্ক। এর বেশি কিছু আমি অনুভব করি না ওর প্রতি। হুম। আই জাস্ট লাভ ইউ নীলাম।”
কথাগুলো বলার পরও বুকের ভেতর এক ধরনের শূন্যতা কাজ করছে। ভেতরে ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসছে স্নিগ্ধর। মনে হচ্ছে কেউ কলিজাটা খামছে ধরে আছে। সকাল কি তবে আজ মেডিকেলে আসবে না! কথাটা ভাবতে ভাবতে সে সকালের নম্বরে কল দিল। কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। তাই আর কল দিল না। চুপচাপ কিছু সময় বসে থেকে উঠে তৈরি হতে লাগলো মেডিকেলে যাওয়ার জন্য।
ভ্রু কুঁচকে বুকে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে মিহু। তার সামনে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই শাহিন এবং আরও দু’জন অফিসার কথা বলছে। মেঘ বিরবির করে বললো, “যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়।” মেঘকে একা একা বিরবির করতে দেখে নাক-মুখ কুঁচকালো মিহু। পরক্ষণেই শান্ত গলায় মেঘকে প্রশ্ন করলো,
-“এই কেসের তদন্ত কতদূর!”
আমতা আমতা করে মিনমিনে গলায় মেঘ জবাব দিল,
-“মোটামুটি এগিয়েছে।”
-“মোটামুটি কি ধরনের কথা!”
-“মানে যতটুকু জানার জেনেছি। বাকিটুকু জানার জন্য একজনের অপেক্ষা করছি। তিনি আসলেই বাকি প্রশ্নের উত্তরগুলোও পেয়ে যাবো আশা করি।”
-“মাঝে মাঝে আমার আফসোস হয় আপনাকে আমার টিমে রাখার জন্য। গত বছরের কেসটারও তো কোনো কূল-কিনারা করে উঠতে পারলেন না। খুব তো বড় মুখ করে বলেছিলেন আমার কারও সাহায্যের প্রয়োজন নেই, আমি একাই পারবো। কোন কচুটা পেরেছেন শুনি!”
মিহুর কথায় মেঘ গাল ফুলিয়ে ওর দিকে তাকালো। হঠাৎ চমকে উঠলো সে মিহুর অবস্থা দেখে। মেয়েটার চোখ-মুখ অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। দেখতে প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। অসুস্থ মনে হচ্ছে মিহুকে দেখে। মেঘ চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“ম্যাম আপনি কি ঠিক আছেন?”
-“কেন আমার আবার কি হবে?”
-“না মানে আপনাকে দেখে ঠিক লাগছে না।”
-“ঠিক আছি আমি।”
-“আপনি কি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানে এসেছেন?”
-“হুম। কেন?”
-“আমার মনে হয় আপনার বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করা উচিৎ। কেননা আপনার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।”
-“বাহ! আপনি আমাকে এতটা খেয়াল করেছেন?”
-“খেয়াল করিনি। শুধু চোখে পড়ে গিয়েছে এই আর কি।”
-“ওহ! কিন্তু কি করব বলুন! আমাদের চাকরিটাই এমন। তাই হাজার চাইলেও আমরা নিজেদের মন মতো চলতে পারবো না।”
মেঘ বিরক্ত হয়ে বললো,
-“আপনার হাজবেন্ড নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে বাসায়! তাই আপনার যাওয়া উচিৎ।”
-“আপনি এত চিন্তা কেন করছেন? আমার হাজবেন্ডকে আমি সামলে নিবো। আর নিজেকেও আমি সামলে নিবো। আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। কেস এর দিকে মনোযোগ দিন আপনি।”
মেঘ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকালো। মিহু ফোন বের করে ঘাটাঘাটি করতে লাগলো। শাহিন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে। মেঘ আর মিহু একই টিমে কাজ করলেও সহজে তাদের বনিবনা হয়না। দু’জন একটু সুযোগ পেলেই একে অপরকে ঘোল খাওয়াতে সামান্যতম ছাড় দেয়না। কিন্তু দু’জনের ভেতরে এত কিসের শত্রুতা তাই বুঝে উঠতে পারে না শাহিন। আজও সেদিনের কথা মনে আছে শাহিনের, যেদিন মেঘ জানতে পেরেছিল মিহুকে ৯ জন অফিসার দিয়ে সেই টিমের হেড বানানো হয়েছে এবং সেই ৯ জনের ভেতরে মেঘ একজন। সেদিন মেঘ তার স্যারের পেছনে যে কতক্ষণ ঘুরঘুর করেছিল যাতে তাকে মিহুর টিমে না দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এই যে মেঘ এখন রেগে তাকিয়ে আছে মিহুর দিকে। এটার কারণও খুঁজে পেলো না শাহিন।
মিহু তার ডান হাতটা একদমই নাড়াচ্ছে না দেখে মেঘের ভ্রু আরও বেশি কুঁচকে গেল। মেঘ কিছু বলার আগেই শাহিন এসে হাজির হলো।
-“ডক্টর স্নিগ্ধ এসেছে।”
মিহু ফোনটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ইশারা করে যেতে বললো এবং নিজেও গেল পেছনে।
স্নিগ্ধ তার কেবিনে বসে আছে। সামনে মিহু, মেঘ, শাহিন আর বাকি দু’জন অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য মিহু আর মেঘ বসে আছে চেয়ারে। মেঘ হালকা হেসে হাত বাড়িয়ে দিল স্নিগ্ধর দিকে।
-“কেমন আছো ব্রো?”
-“এইতো ভালো। তোমার কি খবর?”
-“ভালো। তোমার নাম শুনে আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম যে ব্যক্তিটা অবশ্যই তুমি হবে।”
মিহু চোখ ছোট ছোট করে মেঘকে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনারা একে অপরকে চিনেন?”
-“জ্বি। স্নিগ্ধর গার্লফ্রেন্ড মিসিং ছিল। তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব ও আমায় দিয়েছিল। তাছাড়া ও একসময় আমার প্রতিবেশী ছিল। সেই সুবাদে ওকে চেনা।”
-“ওহ আচ্ছা। যাই হোক! আসল কথায় আসি এখন। ডক্টর নাজিম আহমেদকে চিনেন নিশ্চয়ই?”
প্রশ্নটা মিহু স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে করলো। স্নিগ্ধ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।
-“আচ্ছা উনাকে এই কলেজ থেকে বের করে দেওয়ার কারণটা জানতে চাচ্ছি আমরা। অবশ্য অন্য টিচারদের কাছ থেকে আমরা শুনেছি। কিন্তু ঘটনার মূলকেন্দ্রবিন্দু যেহেতু আপনিও একজন ছিলেন তাই আপনার কাছ থেকেই শুনতে চাই।”
-“উনি এবং আরও দু’জন টিচার মিলে আমার নামে এবং মিস বিক….”
চুপ হয়ে গেল স্নিগ্ধ। সকালকে সে যত চাচ্ছে মনে করতে না ততই আরও বেশি করে মনে পড়ছে ওর কথা। আচ্ছা মেয়েটা কেমন আছে এখন? জ্বরটা কি কমেছে? স্নিগ্ধর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো মিহু।
-“কি হলো থেমে গেলেন যে!”
-“তেমন কিছু না। আচ্ছা যা বলছিলাম আমি। নাজিম স্যার, রুবেল স্যার আর পাটোয়ারী স্যার মিলে আমার নামে এবং আমার বাগদত্তা সকালের নামে জঘন্য অপবাদ দিয়েছিলেন। অপবাদ যা-ও ঠিক ছিল। কিন্তু উনারা অনেক বিশ্রী ভাষা ব্যবহার করেছিলেন সকালের ক্ষেত্রে। এতে অবশ্য আমাদের মেডিকেলের ছাত্রী ইমির হাত ছিল….”
স্নিগ্ধ সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করলো। সবটা শোনার পর মেঘ বললো,
-“একটা জিনিস আমি বুঝলাম না!”
-“কি বুঝোনি তুমি?”
-“তোমার গার্লফ্রেন্ডের নাম তো নীলাম ছিল। তবে সকাল….”
-“নীলামকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না তুমিই তো বলেছিলে তাই না! সেজন্যই ওর আশা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু কখনো অন্য কাউকে বিয়ে করব এই চিন্তা মাথায় আসেনি। তবে মায়ের জন্য বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে।”
-“মানে কি! বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে এই কথাটা আমি ঠিক হজম করতে পারলাম না স্নিগ্ধ। তুমি যদি সকালকে পছন্দ না-ই করে থাকো, তবে তাকে বিয়ে কেন করছো! এখানে শুধু শুধু ওই মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করবে তুমি।”
-“সকাল আমাকে ভালোবাসে। মূলত ওর পাগলামি আর মায়ের জন্যই ওকে বিয়ে করতে চাইছি।”
-“আর তুমি! তুমি কি ওকে পছন্দ করো? একটা কথা ভেবে দেখেছো কখনো! সকাল তোমাকে ভালোবেসে তোমার সাথে থাকতে চাইছে। কিন্তু তুমি বলছো তুমি তাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করছো। তোমাদের বিয়ের পর তাহলে তোমাদের সম্পর্কের পরিণতি কি হবে! মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে তুমি ভালো থাকতে পারবে?”
-“(…..)”
-“আমি দুঃখিত তোমার ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার জন্য। তবে আমার যা মনে হলো আমি শুধু তা-ই বললাম।”
-“না ঠিক আছে।”
-“আর একটা কথা বলি। সকাল যখন তোমাকে ভালোবাসে তখন তোমারও উচিৎ ওকে ভালোবাসার চেষ্টা করা। নীলাম এখন তোমার অতীত। সে আর বেঁচে নেই। তাই তাকে নিজের মনের মনিকোঠায় আঁটকে না রেখে মুক্ত করে দাও। তোমার কাছ থেকেই একসময় শুনেছিলাম অতীতকে আঁকড়ে ধরে বর্তমানকে নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না। এখন তুমি নিজেই তোমার অতীত আঁকড়ে ধরে আছো। আর নিজের বর্তমানকে কষ্ট দিচ্ছ।”
-“(…..)”
-“ভেবে দেখো আমার কথাগুলো একটু। আমরা এখন উঠছি তাহলে!”
-“হুম।”
মেঘ, মিহু উঠে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধর থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লো মিহু। স্নিগ্ধর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
-“সকাল কোথায় এখন? ও তো শুনলাম এই মেডিকেলেরই ছাত্রী। আজ আসেনি?”
-“না আজ আসেনি। ওর জ্বর এসেছে। তাই বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছে।”
-“ওহ আচ্ছা। আসছি।”
মেডিকেল থেকে বের হওয়ার সময় মিহু মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপনি এত ভালো ভালো কথা বলতে জানেন আগে জানতাম না তো!”
-“জানেন তো না আপনি অনেক কিছুই।”
-“তা কি কি জানি না শুনি একটু!”
-“উঁহু! সিঙ্গেলদের ব্যক্তিগত কথাবার্তা বিবাহিতদের সাথে বলতে নেই।”
-“কে বলেছে কথাটা?”
-“আমি নিজে।”
মিহু ভ্রু উঁচু কিছু সময় মেঘের দিকে তাকিয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে সামনে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো। পেছন থেকে শাহিন বারবার মাথা কাঁত করে ওদের দু’জনকে দেখছে।
রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সকালকে ঘুমোতে দেখে চিন্তিত হলেন রেহেনা বেগম। এগিয়ে এসে মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গেলে মনে হলো গরম তাওয়ায় নিজের হাত দিয়ে ফেলেছেন। রেহেনা বেগম বুঝতে পারলেন তার মেয়ের সাংঘাতিক জ্বর এসেছে। সকালকে অনেকবার ডেকেও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে জোরে কেঁদে উঠলেন উনি। পলক আর আখিকে ডাকতে লাগলেন। আরিফুল ইসলাম কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গিয়েছেন অফিসের উদ্দেশ্যে। পলক আর আখি রুমে এসে রেহেনা বেগমকে কাঁদতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই সকালের জ্বরের কথা জানালেন তিনি।
-“এই মেয়েকে কি পাগল! এত সকাল সকাল গোসল করেছে কেন ও? এখন জ্ঞান ও নেই।”
পলক উত্তেজিত হয়ে বললো। তার হাত-পা কাঁপছে। চেহারায় কান্না কান্না ভাব। একটা মাত্র ছোট বোন তার। সামান্য কিছু হলেও তার কলিজায় আঘাত লাগে। পলক ফোন বের করে ডক্টরকে কল দিতে গেলেই আখি ওকে থামিয়ে দিল।
-“শান্ত হও তুমি। আমি দেখছি।”
-“কি দেখবে তুমি! আমার…আমার বোন কোনো কথা বলছে না। আর আমি ডাক্তার ডাকবো না?”
-“পলক তুমি মনে হয় ভুলে যাচ্ছ আমিও একজন ডাক্তার। তাই বলছি উত্তেজিত না হয়ে একটু শান্ত হয়ে বসো। আমি দেখছি ওকে।”
আখির কথায় পলক কিছুটা শান্ত হলো। ও ভুলেই গিয়েছিল যে ডাক্তার এখন বাসাতেই আছে। আখি সকালকে দেখে নিয়ে ওর জ্বর মেপে নিলো। শরীর তাপমাত্রা খুবই ভয়াবহ সকালের। একটা কাগজে কিছু ওষুধের নাম আর একটা ইনজেকশনের নাম লিখে সেটা পলককে দিয়ে ফার্মেসি থেকে নিয়ে আসতে বলা মাত্রই পলক এক দৌড়ে চলে গেল।
ছোট টেবিলের ওপরে ওষুধের বক্স নামানো দেখে সেটা নিয়ে দেখতে লাগলো আখি। সবগুলো ওষুধের পাতাই নতুন। শুধু একটা ওষুধের পাতা থেকে দুটো মেডিসিন নেই। মেডিসিনটা দেখেই আখি বুঝতে পারলো এটা ঘুমের ওষুধ। কিন্তু কাউকে কিছু বললো না। নাহলে এই নিয়ে সকালকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। সকাল কেন ঘুমের ওষুধ খেয়েছে আর ওর কি হয়েছে তা পরে একান্তে জিজ্ঞেস করবে বলে ভেবে রাখলো আখি।
রেহেনা বেগম সকালের পাশে বসে মাথা জলপট্টি দিচ্ছেন। আখি রান্নাঘরে এসে কাজের লোকদের স্যুপ রান্না করতে বলে আবারও সকালের রুমে ফিরে এলো। কিছুক্ষণ বাদেই পলক ওষুধের প্যাকেট নিয়ে রুমে ঢুকলো। আখি প্যাকেট থেকে ইনজেকশন বের নিলো। ইনজেকশন ঠিক করে সকালের হাতে পুশ করে দিল।
ঘন্টাখানেক পর সকালের জ্ঞান ফিরলো। পিটপিট করে চোখ মেলে দেখে আরিফুল ইসলাম বাদে বাকি সবাই ওর পাশে বসে আছে। সকাল অসুস্থ গলায় বললো,
-“তোমরা সবাই এখানে কেন?”
-“একটা থাপ্পড় দিয়ে তোর সবগুলো দাঁত ফেলে দিব আমি। তোর জ্বর এসেছে তুই জানাসনি কেন আমাদের? আর তোকে কে বলছিল এত সকালে গোসল করতে?”
পলকের ধমকে ভড়কে গেল সকাল। পলকের চোখ ছলছল করছে। তার চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা। চোখ দুটো ছোট ছোট করে সকাল বললো,
-“তুমি আমাকে মারবে!”
-“মার খাওয়ার মতো কাজ করলে মারবো না?”
-“বকছো কেন? আমি কিন্তু পাপার কাছে নালিশ করবো।”
-“করিস দেখবো নে পাপা তোকে কি বলে। পাঁজি মেয়ে! আমাদের চিন্তায় ফেলতে খুব মজা লাগে তোর তাই না!”
-“আরে ভাই থামো না! অনেক তো বকা দিলে। আসলে আমার মাথাব্যাথা করছিল প্রচন্ড। তাই ভেবেছিলাম গোসল করলে হয়তো মাথাব্যাথাটা একটু কমবে।”
-“তু…
-“আহ পলক থামো তো তুমি! কি শুরু করেছো তখন থেকে? দেখছো তো মেয়েটা অসুস্থ। আর কথা বাড়িয়ো না। ওকে গরম স্যুপটুকু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে বিশ্রাম করতে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে ও।”
আখির ধমকে থেমে গেল পলক। রেহেনা বেগম একবার ভেবে ছিলেন মেয়েকে আচ্ছা মতো বকে দিবেন। কিন্তু মেয়ের অসুস্থ গলার স্বর শুনে উনি আর কিছু বলতে পারলেন না। পলক নিজ হাতে সকালকে স্যুপ খাইয়ে দিল। আখি ওষুধ খাইয়ে দিল। রেহেনা বেগম কম্বলটা ভালো ভাবে টেনে দিলেন মেয়ের গায়ে।
-“পলক তুমি রুমে যাও নয়নের কাছে। মা আপনি বিশ্রাম নিন আপনার রুমে গিয়ে। সকালের এখন পর্যাপ্ত পরিমাণের ঘুম দরকার। ও একটু ঘুমিয়ে নিক এখন।”
আখির কথায় রেহেনা বেগম আর পলক সকালের মাথায় হাত হাত বুলিয়ে চলে গেল। আখি এসে সকালের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আখির চোখের দিকে তাকিয়ে সকাল বুঝতে পারলো আখি কিছু বলতে চায় ওকে।
-“কিছু বলবে ভাবী?”
-“কি হয়েছে তোমার? দেখো আমার সাথে তোমার সম্পর্ক কিন্তু অন্যরকম তুমি তা জানো। তাই নির্দ্বিধায় আমার সাথে সব শেয়ার করতে পারো।”
-“কিছু হয়নি আমার। শুধু একটু মাথাব্যাথা করছে।”
-“তাহলে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলে কেন?”
চমকে উঠলো সকাল। আখির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
-“ঘুম আসছিল না। তার ওপর প্রচন্ড মাথাব্যাথা ছিল। সহ্য করতে পারছিলাম না আমি। তাই ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো।”
সকালের চেহারা দেখে আখির বিশ্বাস হলো না সকালের কথাগুলো। সে চুপচাপ কিছুক্ষণ সকালকে পর্যবেক্ষণ করে বললো,
-“স্নিগ্ধর সাথে কিছু হয়েছে?”
-“না ভাবী। উনার সাথে আমার কখনো কিছু হয় না। উনি সবসময় আমি কিসে ভালো থাকবো সেই চিন্তাই করেন। যে আমার মন খারাপ সহ্য করতে পারে না, সে করবে আমার সাথে ঝগড়া! হাসিয়ো না ভাবী।”
চুপ হয়ে গেল আখি। সকালের কথা কিছু একটা ছিল। কথাগুলো বলার সময় ওর গলা কাঁপছিল। চোখ দুটো ছলছল করছিল যা চোখ এড়ায়নি আখির। মেয়েটা কিছু একটা লুকোতে চাইছে। কিন্তু কি! তা মাথায় আসলো না ওর। কিন্তু সকাল যখন কিছু ওকে কিছু বলতে চাইছে না, তখন সকালকে না ঘাটানোই ভালো মনে করলো সে। সকালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে ঘুমোতে বলে চলে গেল রুম থেকে।
সকাল কম্বলের নিচ থেকে বাম হাত বের করে অনামিকা আঙুলে থাকা আংটির দিকে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধর সাথে তার বাগদান হয়ে যাওয়ার পর এমন ব্যবহার কখনোই প্রত্যাশা ছিল না সকালের। আজ সে বুঝতে পেরেছে স্নিগ্ধ তার সাথে এত ভালো ব্যবহার করে, তার যত্ন করে শুধু মাত্র বাধ্য হয়ে। মন থেকে কখনোই স্নিগ্ধ তাকে চায় নি। তাই হয়তো এমন ব্যবহার করতে পেরেছে সে। চোখ চোখ বুঁজে নিতেই চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো ওর।
চলবে….