সেই_সন্ধ্যা পর্ব_৩৬

0
1296

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩৬
.
ড্রইংরুমে বসে গল্পে মশগুল হয়ে আছে পলক, আখি, আরিফুল ইসলাম আর রেহেনা বেগম। নয়ন রেহেনা বেগমের কোলে ঘুমোচ্ছে। সকালের ফোন আসায় সে তার রুমে চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই সে ড্রইংরুমে এসে সবার সাথে বসলো। বাটি থেকে চানাচুর নিয়ে খেতে খেতে সবার কথা শুনতে লাগলো। একটু পর পর মিটিমিটি হাসছে আর স্নিগ্ধর ম্যাসেজের রিপ্লাই করছে। পলক ব্যাপারটা খেয়াল করে সকালের হাত থেকে টান দিয়ে ফোনটা নিয়ে নিলো। প্রায় সাথে সাথেই হকচকিয়ে উঠলো সকাল। হোয়াটসঅ্যাপে ডাক্তার সাহেব নামটা দেখে আর কয়েকটা ম্যাসেজ দেখে ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ উঁচু করে তাকালো সকালের দিকে।

-“ডাক্তার সাহেব কে? আর তার সাথে তোর এত ম্যাসেজ কেন? কথা বলার ধরন দেখে তো মনে হচ্ছে খুব কাছের কেউ।”

গলা ঝেরে নিলো সকাল। নিজের ভাইয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে বেশ লজ্জা লাগছে তার। আখি সকালের চেহারা দেখে বুঝতে পেরে হালকা হেসে বললো,
-“আমি যদি ভুল না হই তবে এই ডাক্তার সাহেবটা স্নিগ্ধ। তাই না পিচ্চি?”

সকাল মুখে কিছু না বলে লাজুক হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো। পলক চোখ ছোট ছোট করে আখিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“তুমি কি করে জানলে ছেলেটা স্নিগ্ধ!”
-“পিচ্চি তো প্রথম থেকে স্নিগ্ধকে ডাক্তার সাহেব বলে ডাকে।”
-“ওহ আচ্ছা।”

এবার পলক সকালের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-“স্নিগ্ধর সাথে কি সম্পর্ক তোর?”

সকাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো পলকের প্রশ্ন শুনে। আরিফুল ইসলাম মেয়ের অবস্থা দেখে হালকা হেসে বললেন,
-“আরে স্নিগ্ধর সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ছেলেটা খুব ভালো। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে খোঁজে নিয়ে দেখেছি ওর। কোনো খারাপ কিছু পাইনি। তাই বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। ইতোমধ্যে বাগদান হয়ে গেছে ওদের।”

পলক থতমত খেয়ে গেল আরিফুল ইসলামের কথায়। ড্যাবড্যাব করে সকালের দিকে তাকিয়ে ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলো।

-“তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে? মানে আমি ভুল শুনছি না তো! তোর বিয়ে! কেমনে কি? আমি তো এটাই ভেবে পাচ্ছি না স্নিগ্ধর মতো একটা ছেলে তোকে পছন্দ কীভাবে করলো! ওর টেস্ট এত খারাপ আগে জানতাম না।”

সকাল পলকের কথায় রেগে গিয়ে পাশ থেকে সোফার কুশন নিয়ে ছুঁড়ে মারলো পলকের গায়ে। পলক সেটা ক্যাচ ধরতেই ওর হাত থেকে নিজের ফোনটা নিয়ে নিলো সকাল। গাল ফুলিয়ে বললো,
-“লজ্জা করে না তোমার, নিজের বোন আর তার ফিয়ন্সের পার্সোনাল চ্যাটিং দেখতে!”
-“ইশশ! কি এমন চ্যাটিং করেছিস যে দেখতে লজ্জা পাবো?”
-“ভাবী তোমার জামাই আস্ত একটা নির্লজ্জ। একে তুমি সামলাও কীভাবে?”

আখি বিরবির করে বললো,
-“ও যে কত বড় নির্লজ্জ তা আমার থেকে ভালো আর কে জানে। ওকে সামলানো চারটি খানি কথা না। অসভ্য একটা।”

আড়চোখে পলকের দিকে তাকাতেই দেখলো পলক তার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে রেখেছে। আখি জোরপূর্বক একটি মিথ্যে হাসি দিল পলককে তাকিয়ে থাকতে দেখে। সকাল মিটিমিটি হাসছে তার ভাই-ভাবীর কাহিনি দেখে। আরিফুল ইসলাম গলা খাঁকারি দিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

-“পলক, আখি যাও ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে। মামনি তুমিও যাও।”
-“ঠিক আছে পাপা।”
-“ও ভাবী আমি নয়নকে আজ আমার কাছে রাখি প্লিজ!”

সকাল বাচ্চাদের মতো বায়না করে বললো। আখি হালকা হেসে সকালের গাল টেনে দিয়ে বললো,
-“ওর মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে যাওয়ার অভ্যাস আছে। তুমি সামলাতে পারবে না।”
-“সমস্যা নেই আমি পারবো। আমি ওর ফুপি না! ও আমার কাছে অনেক শান্ত থাকবে। প্লিজ ওকে আমার কাছে রাখি।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে রাখো সমস্যা নেই। ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমি তোমার রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
-“থ্যাঙ্ক ইউ ভাবী।”

সকাল খুশি হয়ে পরম যত্নে নয়নকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে নিলো। তারপর আস্তেধীরে উপরে নিজের রুমে চলে গেল। আরিফুল ইসলাম আর রেহেনা বেগমও চলে গেলেন নিজেদের রুমে। আখি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে পলক এসে আখির বাহু ধরে এক চোখ টিপ দিয়ে বললো,
-“আমার বোন কত বুদ্ধিমতী দেখেছো! সে ঠিক বুঝতে পেরেছে তার ভাই তার ছেলের জ্বালায় নিজের বউকে ঠিক মতো একটু কাছে টানতে পারে না। তাই পিচ্চি নয়নকে নিজের কাছে রেখে আমাদের সুযোগ করে দিল।”

আখি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে কিছুটা জোরে শব্দ করেই পলককে অসভ্য বলে হনহন করে উপরে চলে গেল। এদিকে পলক হেসে নিজের ভ্রু চুলকিয়ে সে নিজেও উপরে চলে গেল।

আখি নয়নের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো সকালের রুমে দিতে গেলে দেখে সকাল খুব যত্ন করে নয়কে বিছানার মাঝে শুইয়ে একপাশে নিজের বড় কোলবালিশটা দিয়ে আটকে দিল। যাতে নয়ন পড়ে না যায়। আখি হালকা হেসে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে নয়নের ছোট কাঁথা, বালিশ, ওয়ালক্লথ, কোলবালিশ সব দিয়ে বিছানা তৈরি করে দিল সকালের খাটে। সকাল নয়নকে নিয়ে সেখানে শুইয়ে দেয়। আখি নয়নের কপালে আর সকালের কপালে চুমু দিয়ে হেসে চলে গেল। প্রায় সাথে সাথেই পলক প্রবেশ করলো রুমে। সকাল তখন নিজের বালিশ ঠিক করছিল।

-“ওই চুন্নি নিজের খেয়াল রাখিস। সাথে আমার বাচ্চাটারও। কোনো সমস্যা হলে আমাদের ডাক দিবি।”
-“ইশশ! আমি কি কোথাও যাচ্ছি না-কি যে এভাবে জ্ঞান দিচ্ছ?”
-“না তারপরও।”

পলক নয়নের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে সকালের কাছে এসে ওর মাথায় হাত রেখে ওর কপালেও আলতো করে চুমু দিল। সকাল হেসে ভাইয়ের গাল দুটো টেনে দিল। পলক রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল।

সকাল ছোট কম্বলটা নয়নের শরীরে ভালো করে মেলে দিল। নিজেও নয়নের পাশে শুয়ে কম্বল টেনে নিলো নিজের শরীরে। পাশে নয়নের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আলতো করে কপালের একপাশে চুমু দিয়ে ফোন হাতে নিলো।

পলক রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে পেছন ঘুরে দেখে বউ তার ইতোমধ্যে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়েছে। বাঁকা হাসলো পলক। কারণ সে জানে আখি এখনো ঘুমায়নি। শুধু ঘুমানোর নাটক করছে। যাতে পলক তার কাছে ঘেঁষতে না পারে। কিন্তু পলক তো আজ আখির কথা শুনবে না। লাইটটা অফ করে দিয়ে একহাতে শার্টের বোতাম সবগুলো খুলে শার্টটা বালিশের পাশে নামিয়ে রেখে সে নিজেও কম্বলের ভেতরে ঢুকে গেল।

পেটে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো আখি। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে এখনো চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। আখি শুকনো কয়েকটা ঢোক গিলে নিলো। কতক্ষণ আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারবে তা তার জানা নেই। পলক যখন একবার তাকে ধরেছে তখন এত তাড়াতাড়ি এত সহজে সে ছাড়া পাবে না। তা ভালোই বুঝতে পারছে আখি। সে শ্বাস আটকে চুপ করে আছে। পলক কানের সামনে এসে হালকা করে ফুঁ দিতেই আখি নড়েচড়ে কেঁপে উঠলো।

-“ঘুমানোর নাটক করে কি লাভ হচ্ছে! তুমি যদি আজ সত্যি সত্যিও ঘুমিয়ে থাকতে তা-ও আজকে তোমাকে আমি ছাড়তাম না।”

পলকের ফিসফিসানো আওয়াজে ইতোমধ্যে আখির শরীরে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। আখিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর কাঁধে মুখ গুঁজে দিল পলক। এবার আখি চোখ মেললো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো পলককে। পলক মুখ তুলে আখির দিকে তাকিয়ে ওর চোখের পাতায় চুমু দিয়ে, আখিকে ভালোবাসতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আখিও আর কিছু বললো না।

পলক সবসময় সবরকম পরিস্থিতিতে তার পাশে থেকেছে। কখনো তাকে একা ছাড়েনি। পলক চাইলেই নিজের চাহিদা মিটিয়ে আখিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি। বরং ভালাবেসে যত্ন করে সবসময় আগলে রেখেছে আখিকে। পলকের ভালোবাসা আর যত্ন প্রতিটা মুহূর্তে তাকে সুখের সাথে দেখা করায়। মাঝে মাঝে আখি খুব ভাবে যে আদৌও কি সে এত সুখ পাওয়ার যোগ্য? কিন্তু পলক সবসময় তার ভালোবাসা দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে সে যোগ্য নাহলেও পলক তাকে এসবের যোগ্য ভাবে। তখন মুহূর্তেই মনটা খুশিতে ছেয়ে যায় আখির। এই ছেলেটা কেন তাকে এত ভালোবাসে তা কখনোই বুঝে উঠতে পারেনি আখি। তবে সে নিঃসন্দেহে বলতে পারে, পলকের ভালোবাসাই তাকে বাধ্য করেছে পলককে ভালোবাসতে। আর এই ভালোবাসার জালে সে সারাজীবন আটকে থাকতে চায়।

গোসল করে এসে তাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ফোন অন করলো স্নিগ্ধ। রাত আটটার দিকে তার একটা সার্জারী ছিল। তাই অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে সকালের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নিয়েছে। কথা শেষ করে ফোন বন্ধ করে দেওয়ার পর আর ফোন অন করতে মনে ছিল না। ফোন অন হতেই একনাগাড়ে ৫২ টা মিসডকল এলার্ট আর ২১ টা ম্যাসেজ এসে ভিড় জমালো তার ফোনে। স্নিগ্ধ হাসলো তা দেখে। কারণ সবগুলো কল আর ম্যাসেজ সকালের নম্বর থেকে এসেছে। সকালকে কল দিতে গিয়েও দিল না। রাত এখন অনেক গভীর হয়েছে। এতক্ষণে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে এই ভেবে ফোনটা বিছানায় রেখে সে বেলকনিতে চলে গেল।

তাওয়ালটা বেলকনির রশিতে মেলে দিয়ে রেলিং ধরে এক লম্বা শ্বাস নিলো। কতটা নিরিবিলি হয়ে আছে এই মুহূর্তে শহরটা। একটা সুই পড়ার আওয়াজও মনে হয় অনেক জোরে শোনা যাবে এখন। এই মুহূর্তে এক মগ কফি পাওয়া গেলে মন্দ হতো না। যেই ভাবা সেই কাজ। স্নিগ্ধ দেরি না করে কালো হুডিটা গায়ে জড়িয়ে নিচে নেমে গেল। রান্নাঘরে যেয়ে চুলায় পানি গরম দিয়ে বিস্কিটের বোয়ামটা নিয়ে পাশে খালি তাকে উঠে বসলো সে। বিস্কিট খেতে খেতে চুলায় থাকা পানির দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্কিট খাওয়া শেষ হতেই কফি বানিয়ে নিয়ে উপরে নিজের রুমে চলে এলো। বিছানার উপর থেকে ফোন নিয়ে ইয়ারফোন কানেক্ট করে আবার বেলকনিতে চলে এলো স্নিগ্ধ। হঠাৎ তার গান শুনতে মন চাইছে খুব। দেরি না করে অনুপম রায় এর “এখন অনেক রাত” গানটা ছেড়ে মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো। তার সাথে কফি খেতে লাগলো।

গানের তালে তালে কফিতে চুমুক দিচ্ছে স্নিগ্ধ। হঠাৎ ফোনে একটা ম্যাসেজ আসায় ভ্রু কুঁচকে গেল তার। ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। এখন রাত প্রায় দুটোর বেশি বাজে। এই সময়ে কে ম্যাসেজ দিবে! গান বন্ধ করে কফি মগটা পাশে নামিয়ে রাখলো। ম্যাসেজটা একটা অপরিচিত নম্বর থেকে এসেছে। ম্যাসেজ অন করে পড়তেই স্নিগ্ধর মাথা গরম হয়ে গেল। তৎক্ষনাৎ সেই অপরিচিত নম্বরে কল দিল সে। রিং হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো।

-“হ্যালো! কে বলছেন আপনি? নীলাম আর আমার ব্যাপারে কি করে জানেন!”
-“আমাকে চিনতে পারোনি তুমি স্নিগ্ধ? এটা তো আশা করিনি তোমার কাছ থেকে।”
-“অনন্যা! আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল এটা তুমি। যাই হোক, এইসব কি উল্টো পাল্টা ম্যাসেজ দিচ্ছ তুমি?”
-“আমি কোনো উল্টো পাল্টা ম্যাসেজ দিইনি। শুধু সত্যিটা বলেছি। তুমি নীলামকে কখনোই ভালোবাসো নি। যদি সত্যি নীলামকে ভালোবাসতে তাহলে এত তাড়াতাড়ি ওকে ভুলে কখনোই ওই সকালকে বিয়ে করতে পারতে না।”
-“আমি বারবার বলছি নীলাম আমার অতীত ছিল। অতীতকে আঁকড়ে ধরে নিজের বর্তমানকে কেন নষ্ট করব আমি বলতে পারো অনন্যা? আর রইলো নীলামকে ভালোবাসার কথা! আমি নীলামকে ঠিক কতটা ভালোবাসতাম তা তোমার অজানা নয়। তাই এইসব ফালতু কথা বলবে না।”
-“আমি জানি আমি কি বলছি। নীলামকে তুমি তখন ভালোবাসতে। কিন্তু এখন তুমি ওকে ভুলে গিয়েছো। তুমি নীলামকে ভুলে সকালকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছো। এতেই তো বোঝা যায় যে নীলামকে তুমি এখন আর ভালোবাসো না।”
-“না জেনে শুনে কথা বলবে না অনন্যা। আমি এখনো নীলামকে ভালোবাসি।”
-“তাহলে সকালকে বিয়ে কেন করছো?”
-“কারণ সকালকে আমি… আমি…”
-“কি হলো বলো! সকালকে তুমি কি?”
-“কারণ সকাল আমাকে ভালোবাসে। আর আমি ওর মায়ায় জড়িয়ে গেছি। তাই সকালকে আমার লাগবে। আমার নিজের ভালো থাকার জন্য সকালকে আমার চাই। হয়তো আমি সকালকেও ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু না ভালোবাসলেও ওকেই আমার লাগবে আমি এতটুকু জানি।”
-“আচ্ছা স্নিগ্ধ, কখনো শুনেছো একসাথে দুজনকে ভালোবাসা যায়!”
-“(…..)”
-“তুমি যদি নীলামকে ভালোবেসে থাকো তাহলে তুমি কীভাবে সকালকে ভালোবাসতে পারো? একজনকে ভালোবেসে তাকে ভুলে গেলেই শুধুমাত্র অন্য আরেকজনকে ভালোবাসা যায় বুঝেছো!”
-“(…..)”
-“তো সেই হিসেবে তুমি নীলামকে ভুলে গিয়েছো।”
-“কখনো না। ফালতু কথা বলবে না অনন্যা।”
-“আমি শুধু সত্যিটা বলছি। তুমি নীলামকে আগে ভালোবাসতে এখন আর বাসো না। নাহলে তুমি সকালকে বিয়ে করতে পারতে না।”
-“(…..)”
-“নীলামের ছবির সামনেও তো যাও না আজকাল। তুমি যে ভুলে গিয়েছো নীলামকে এই তার আরও একটা প্রমাণ।”
-“জাস্ট…জাস্ট স্টপ ইট অনন্যা। এমন কিছুই না।”

স্নিগ্ধ চিল্লিয়ে বললো কথাটা। ওপাশ থেকে অনন্যার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো। ও আবারও বললো,
-“আমার উপর চেঁচিয়ে কি লাভ! নিজের মনকে জিজ্ঞেস করে দেখো। তোমার মনও তোমাকে একই উত্তর দিবে যে তুমি নীলামকে আর ভালোবাসো না।”
-“(…..)”
-“থাক এত চিন্তা করতে হবে না। যাও ঘুমাও; আমি রাখছি এখন। গুড নাইট।”

অনন্যা কল কেটে পায়ের উপর পা তুলে বসে হাসতে লাগলো। তার হাতে রয়েছে মদের গ্লাস। গ্লাসে চুমুক দিয়ে সে নিজে নিজে বলতে লাগলো,
-“আমি তো জানি স্নিগ্ধ তুমি খুব বোকা। নীলাম এখনো তোমার মনে আছে আমি তা-ও জানি। আবার তুমি সকালকেও ভালোবেসে ফেলেছো এটাও জানি। কিন্তু কি বলোতো! তোমাকে উল্টো পাল্টা বুঝিয়ে দেওয়াটা খুব সোজা। উঁহু! সব ব্যাপারে নয়। শুধু নীলামের ব্যাপারেই তোমাকে উল্টো পাল্টা বোঝানো সম্ভব। এই যে আমি তোমাকে একটু নাড়িয়ে দিলাম। এখন তুমি বারবার শুধু এই চিন্তাই করবে যে তুমি কাকে ভালোবাসো! নীলামকে না সকালকে! যদিও তুমি বুঝতে পারছো না যে তুমি সকালকে ভালোবাসো। তারপরও তোমার মেজাজ গরম হবে সকালের উপর। তুমি ক্ষেপে যাবে বারবার আমার বলা কথাগুলো মনে করে। এরপর সেই রাগগুলো তুমি সকালের উপর ঝারবে। এটাই হলো তোমাকে আর সকালকে আলাদা করার প্রথম ধাপ। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার নাহলে আর কারও হবে না। আমাকে কষ্ট দিয়েছো তুমি। অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছো। কিন্তু আমি সব মুখ বুঁজে সহ্য করে নিবো। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার নাহলে একা থাকো তা-ও সমস্যা নেই। কিন্তু অন্য কারও হতে পারবে না।”

স্নিগ্ধ নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ও কি সত্যি সত্যি তবে নীলামকে ভুলে যাচ্ছে! সত্যিই তো একসাথে কি কখনো দু’জনকে ভালোবাসা যায়! যায় না তো। তার মানে সে নীলামকে ভুলে সকালকে জায়গা দিয়ে ফেলছে নিজের মনে! তাহলে তো নীলামের প্রতি তার ভালোবাসাগুলো মিথ্যে হয়ে গেল। স্নিগ্ধ ছটফট করতে লাগলো এসব চিন্তা করে। ঠিক সেই মুহূর্তেই সকালের নম্বর থেকে কল এলো স্নিগ্ধর ফোনে। স্ক্রিনে “মিস বিকাল” নামটা দেখেই মাথা গরম হয়ে গেল ওর। এমনিতেই দোটানায় আছে। তার উপর সকালের কল। স্নিগ্ধ ফোনটা কেটে দিল। সকাল আবারও কল দিল। স্নিগ্ধ পরপর চারবার কল কেটে দিল। কিন্তু তা-ও সকাল কল করছে বলে এবার কলটা রিসিভ করলো স্নিগ্ধ।

-“সমস্যা কি তোমার! দেখছো তো কল বারবার কেটে দিচ্ছি। তাহলে কেন কল দিচ্ছ? মিনিমাম লজ্জাটুকুও কি তোমার নেই? এত রাতে কাউকে কল দেওয়াটা কোথাকার সভ্যতা! বাগদান হয়েছে বলে এই না যে আমার মাথা কিনে নিয়েছো তুমি। খবরদার আর কখনো আমাকে কল দিবে না। তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। তোমাকে আমার জাস্ট অসহ্য লাগছে। রাখো ফোন!”

বিরক্ত হয়ে চিল্লিয়ে কথাগুলো বলে স্নিগ্ধ নিজেই ফোন কেটে দিল। তার মাথা কাজ করছে না এখন। রুমে যেয়ে টেবিলের উপর কফি মগটা রেখে ফোনটা ছুঁড়ে ফেললো খাটে। সে নিজেও উবু হয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। তার এখন মাথা ঠান্ডা করা জরুরি।

বালিশ আঁকড়ে ধরে চোখের জল ফেলছে সকাল। পাশেই নয়ন ঘুমিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে নয়নের কান্নায় তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। উঠে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেখে নয়ন হিসু করে ওয়ালক্লথের উপরে থাকা কাঁথা ভিজিয়ে ফেলেছে। সকাল কাঁথা বদলে নতুন কাঁথা বিছিয়ে আবারও ঘুম পাড়িয়ে দিল নয়নকে। নয়ন ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সকাল ফোন হাতে নিয়ে দেখে এখনো পর্যন্ত স্নিগ্ধর কোনো কল বা ম্যাসেজ কিছুই আসেনি। তার খুব চিন্তা হচ্ছিল স্নিগ্ধর জন্য। অন্তত একটা ম্যাসেজ তো দিয়ে রাখতে পারতো যে সে ঠিক মতো বাসায় পৌঁছে গিয়েছে। সকাল অনেক্ক্ষণ চিন্তা করলো এখন কল দিবে কি দিবে না। শেষে সকল চিন্তার অবসান ঘটিয়ে সে স্নিগ্ধর নম্বরে কল দিয়েই ফেললো। রিং হচ্ছে বলে সকাল খুশি হলো। কিন্তু ফোন কেটে দেওয়ায় অবাক হলো সে। তার মানে স্নিগ্ধ জেগে আছে। কিন্তু কল কেটে দিল কেন সেটা বুঝলো না। এরপর যতবার কল দিয়েছে বারবার স্নিগ্ধ কেটে দিয়েছে। শেষে যখন রিসিভ করলো তখন তাকে কিছু বলতে না দিয়ে স্নিগ্ধ উল্টো-পাল্টা যা নয় তাই শুনিয়ে দিল তাকে। এতটা খারাপ ব্যবহার সকাল কখনোই প্রত্যাশা করেনি স্নিগ্ধর কাছ থেকে। চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে বালিশ। চিৎকার কাঁদতে মন চাইছে এই মুহূর্তে। কিন্তু তা-ও সম্ভব নয়। তাহলে কি সে ভুল ভেবেছিল যে স্নিগ্ধ তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে! আর কিছু ভাবতে পারছে না সকাল। বালিশ আরও জোরে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠলো সে।

সিআইডি ব্যুরোর নয়তলা ভবনের একটি অফিসের কেবিনে বসে মনোযোগ দিয়ে একটি ফাইল দেখছে মেঘ। গতমাসের কেসটা নিয়ে সে খুবই চিন্তিত। এখনো পর্যন্ত কোনো প্রমাণ বা এমন কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি যাতে করে কেসটাকে আরও গভীরভাবে তদন্ত করা যায়। ঠিক এই রকমই একটি কেস গতবছর মার্চের দিকে হাতে পেয়েছিল সে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই কেসেরও কোনো সুরাহা হয়নি। ভাবতেই মেজাজ খারাপ লাগছে তার। এই মুহূর্তে তার টিমের হেড শহরে নেই। তিনি অন্য একটা কেসের জন্য শহরের বাইরে গিয়েছেন। তিনি যদি থাকতেন তবে এতক্ষণে নিশ্চিত তার আর এই কেস নিয়ে কাজ করা লাগতো না। টিমের হেড এর কথা মনে পড়তেই বিরবির করে কিছু একটা বললো ও। ঠিক সেই মুহুর্তেই দু-তিনবার তার কেবিনের দরজায় টোকা পড়তেই আগন্তুক ব্যক্তিকে ভেতরে আসতে বললো মেঘ। একটি ছেলে লাল রঙের একটি ফাইল হাতে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ছেলেটিকে দেখে মেঘ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।

-“কোনো সূত্র বা প্রমাণ পেয়েছো এই কেসের ব্যাপারে শাহিন! আমি যেসব জায়গায় খোঁজ নিতে বলেছিলাম খোঁজ নিয়েছো?”
-“জ্বি স্যার। আপনার কথা অনুযায়ী খোঁজ নিয়েছি আমি। কিন্তু বেশি কিছু জানতে পারিনি।”
-“কি কি জানতে পেরেছো? লাশ তিনটা কাদের এই ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছো?”
-“স্যার তিনজনের ব্যাপারে নয় শুধু একজনের ব্যাপারে জানতে পেরেছি। বাকি দু’জনের চেহারা তো পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই তাদের ব্যাপারে এখনো কিছুই জানতে পারিনি।”
-“আচ্ছা যার ব্যাপারে জানতে পেরেছো বলো।”
-“নাম নাজিম আহমেদ। পেশায় ডক্টর ছিলেন। একটি মেডিকেল কলেজে প্রফেসর হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন। এর বেশি আর কিছু জানা যায়নি”
-“কোন মেডিকেলে ছিলেন সেই খোঁজ পেয়েছো?”
-“জ্বি।”
-“তাহলে দেরি কেন চলো খোঁজ নিয়ে আসি।”
-“চলুন স্যার।”

সামনেই পরীক্ষা বলে মেডিকেলের সকল শিক্ষকরা একটা মিটিং এর আয়োজন করেছেন। মিটিং শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কয়েকজন অপরিচিত ব্যক্তি ভেতরে ঢুকলেন। সাথে রয়েছে মেডিকেলের একজন পিওন। শিক্ষকদের দিকে তাকিয়ে পিওন বললেন,
-“স্যার উনারা পুলিশের লোক। এখানে কিসের দরকারে যেন এসেছে।”
-“ওহ আচ্ছা। জ্বি বলুন আমরা কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাদের?”

শাহিন সব শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বললো,
-“আমরা সিআইডি থেকে এসেছি। একটা কেসের ব্যাপারে তদন্ত করতে।”
-“কিন্তু কেসের সাথে আমাদের মেডিকেলের কি সম্পর্ক?”
-“সম্পর্ক আছে বলেই তো এসেছি।”

শাহিন তার স্যারের দিকে তাকালো। মেঘ এগিয়ে এসে বললো,
-“আমি সিআইডি অফিসার মেঘ। আমরা তিনটে লাশ পেয়েছি। আর তার ভেতর থেকে একটি লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। লাশটি এই মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষকের।”
-“আমাদের মেডিকেলের শিক্ষকের লাশ! কে উনি?”
-“নাজিম আহমেদ।”
-“আমি তো এই নামে কাউকে চিনি না। আমি নতুন এখানে। আপনি চাইলে পুরোনো শিক্ষকদের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন।”

মেঘ পুরোনো শিক্ষকদের সাথে কথা বলে অনেক কিছুই জানতে পারলো। সকাল আর স্নিগ্ধর ব্যাপারটা শুনে ও কিছু একটা ভাবলো। তারপর বললো,
-“মিস সকাল আর ডক্টর স্নিগ্ধ কোথায় এখন?”
-“আজ তারা এখনো আসেনি। তবে ডক্টর স্নিগ্ধ কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। কারণ একটু পরেই একটা মিটিং শুরু হওয়ার কথা ছিল আমাদের।”
-“ঠিক আছে আমি নিচে অপেক্ষা করছি। উনি আসলে আমাকে জানাবেন।”
-“জ্বি অবশ্যই।”

মেঘ ফোন টিপতে টিপতে শাহিনের সাথে নিচে চলে এলো। মেডিকেলের মাঠে এসে দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো। অনেকেই মাঠে বসে আছে যার যার মতো। অনেকে গ্রুপ হয়ে বসে আছে। মেঘ আবারও ফোনের দিকে তাকাতেই শাহিন মেঘকে ডাকতে লাগলো। মেঘ ভ্রু উঁচু করে তাকালে শাহিন বললো,
-“ম্যাম এসেছেন।”
-“কোন ম্যাম?”
-“আমাদের টিমের হেড মিহু ম্যাম এসেছেন।”

কথাটা শোনা মাত্রই মেঘের হাত থেকে ফোন পড়ে যেতে গেলে শাহিন খপ করে ধরে ফেললো। মেঘ মেডিকেলের গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখলো মিহু প্রবেশ করছে ভেতরে। সাথে দু’জন সিআইডি অফিসার আছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here