সেই_সন্ধ্যা পর্ব_৩৫

0
1248

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩৫
.
নদী প্রবাহমান। সময়ও প্রবাহমান। ঠিক যেমন নদীর স্রোত ফিরে আসে না, তেমনি সময় কখনও পেছন ফিরে তাকায় না। এগিয়ে চলাই তার কাজ। দেখতে দেখতে অতিবাহিত হয়ে গেল একটা মাস। এই একমাসে অনেক কিছুই পাল্টেছে। আফি আর পরশের একে অপরের প্রতি ধারণা পাল্টেছে। স্নিগ্ধ আর সকালের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছে। হসপিটাল কতৃপক্ষের থেকে স্নিগ্ধকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। সকালও তার পড়াশোনায় খুব মনোযোগী হয়ে উঠেছে। সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে থাকে না।

খাটে বসে পা নাড়িয়ে ব্যায়াম করছে পরশ। আফি তাতে সাহায্য করছে পরশকে। ঘন্টা খানেক ব্যায়াম করার পর পরশকে বিশ্রাম নিতে বলে ওয়াশরুমে গেল আফি। গত একমাসে আফি তার অনেক সেবাযত্ন করেছে। পা যেভাবে ভেঙেছিল তাতে এত দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার কথাই ছিল না। কিন্তু আফি যেভাবে সকাল বিকাল তার যত্ন নিয়েছে, ব্যায়াম করিয়েছে তাতে সে এই অল্প সময়েই খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছে। আফির প্রতিটা কাজকর্ম তাকে খুব করে আফির কাছে টানে। আফি এখন তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। এই কথাটা চাইলেও অস্বীকার করতে পারবে না পরশ। আফির কথায় ভাবনা থেকে ধ্যান ভাঙলো পরশের।

-“কি খাবে দুপুরে?”
-“উমম… তোমার যা মন চায় রান্না করো। এতদিন তোমার হাতের মজার মজার খাবার খেয়ে এখন আমার মুখে আর অন্য কারও রান্না করা খাবার রুচে না। তোমার হাতের রান্না অসাধারণ।”
-“হয়েছে থামো এবার। ফ্রিজে দেখলাম গরুর মাংস আছে। তাহলে খিচুড়ি রান্না করি আর গরুর মাংস ভুনা করি। সাথে ইলিশ মাছ ভাজা। চলবে?”
-“দৌড়াবে। আচ্ছা আলুর চপ করতে পারবে সাথে?”
-“হ্যা পারবো। তুমি বসে টিভি দেখো বা ঘুমিয়েও নিতে পারো।”
-“না গোসলে যাবো। গরম লাগছে অনেক।”
-“হ্যা করে ফেলো। আজকে এমনিতেও প্রচুর গরম পড়েছে। আমি জামাকাপড় বের করে দিচ্ছি তোমার।”

আফি আলমারি থেকে পরশের জামাকাপড় বের করে দিয়ে হাতখোঁপা করতে লাগলো। পরশ মুহূর্তেই থমকে গেল এই দৃশ্য দেখে। কারও খোঁপা করার দৃশ্যটা যে এত সুন্দর লাগতে পারে আগে জানা ছিল না। কত মেয়ের খোঁপা করার দৃশ্যই তো সে দেখেছে। কিন্তু কখনো তো এমন চোখ ধাঁধানো কিছু মনে হয়নি তার কাছে। তবে আফির খোঁপা করার দৃশ্যটাই কেন এত ভালো লাগছে তার? পরশের তাকিয়ে থাকা দেখে আফি হেসে রান্নাঘরে চলে গেল। পরশ সেদিকে তাকিয়ে নিজের বুকে হাত রেখে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে জামাকাপড় নিয়ে গোসলে চলে গেল।

এক চুলায় খিচুড়ি বসিয়ে অন্য চুলায় ইলিশ মাছ ভাঁজছে আফি। গরুর মাংস মশলা দিয়ে মেখে ঢেকে রেখে দিয়েছে। টুপটুপ করে কাঁধে কয়েক ফোঁটা পানি পড়তেই পেছনে না তাকিয়ে হাতের খুন্তি দিয়ে ঠাস করে একটা বারি দিল। পরশ হাত ধরে লাফাতে লাগলো।

-“বুঝলে কি করে আমি দাঁড়িয়ে আছি পেছনে?”
-“বাসায় তুমি আর আমি ছাড়া একটা কাকপক্ষীও নেই যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধের ওপর নিজের চুলের পানি ফেলবে।”
-“হুহ্! তোমার ভেতরে কি ভয়ডর বলতে কিছু নেই?”
-“অবশ্যই আছে। কিন্তু আমি ম্যাগি নুডুলসওয়ালা চুলের ছেলেদেরকে ভয় পাই না।”
-“এই ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপ একদম আমার চুলের ব্যাপারে কিছু বলবে না। আমার এই চুল দেখে কত মেয়েরা আমার ওপর ক্রাশ খেয়েছে তুমি জানো!”
-“ক্রাশ তো খাবেই। ম্যাগী নুডুলস কার না পছন্দ বলো! তোমাকে পটিয়ে তোমার চুলগুলোকে সিদ্ধ করে নুডুলস বানিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাদের। এই সামান্য কথাটা তুমি না বুঝলে আমি কি করতে পারি?”
-“ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপ বেশী বেশী বলো না নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।”
-“আচ্ছা বললাম না সরো এবার। আমাকে কাজ করতে দাও।”
-“কোনো সাহায্য লাগবে? লাগলে বলো আমাকে।”
-“এক কাজ করো তাহলে, আলু সিদ্ধ করে রেখেছি। ওগুলোর খোসা ছাড়িয়ে দাও।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

পরশ আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে আফি ইলিশ মাছ ভাজা শেষ করে গরুর মাংস চুলায় বসিয়ে দিল। খিচুড়ির ঢাকনা সরিয়ে দেখলো খিচুড়ি হয়ে গিয়েছে। খিচুড়ি চুলা থেকে নামিয়ে দেখে পরশ সবগুলো আলুর খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছে।

-“তোমার কাজ শেষ। এবার সরো আমাকে বাকি কাজ করতে দাও।”

পরশ সেখান থেকে সরে একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আফির কাজ দেখতে লাগলো। কাজ বললে ভুল হবে। মূলত সে আফিকে দেখছে। এই যে আফি গায়ের ওড়নাটা নিয়ে বুক ঢেকে কোমড়ে বেঁধে রেখেছে। চুলগুলো হাতখোঁপা করে রেখেছে। এতে কিন্তু আফিকে পাক্কা গৃহিণী লাগছে। যেন আফি এই বাড়ির বউ। অবশ্য আফি এই বাসায় এসে যে সমস্ত কাজগুলো করে তা সাধারণত একজন স্ত্রী-ই করে থাকে। কিন্তু আফি তো করছে বন্ধুত্বের খাতিরে। আচ্ছা! এই বন্ধুত্বকে যদি অন্যকোনো সম্পর্কের নাম দেওয়া যায় তবে কি খুব বেশী খারাপ হবে? আফি যেমন পরশকে বুঝে আর পরশ যেমন আফিকে বুঝে অন্য কেউ হয়ত এভাবে করে তাদের বুঝবে না। সম্পর্কটা যখন অন্য একজনের সাথে গড়তেই হবে তখন একে অপরের সাথে কেন নয়?

আফি পরশের দিকে তাকিয়ে দেখে পরশ কি যেন গভীরভাবে চিন্তা করছে। বাটি থেকে হাতে করে পানি নিয়ে পরশের মুখে হালকা পানি ছিটিয়ে দিতেই হকচকিয়ে উঠলো পরশ। তা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো আফি। আফির হাসি দেখে পরশের কিছু বলতে মন চাইলো না আফিকে। সে এক দৃষ্টিতে আফির হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো।

আফি কিছুক্ষণের মধ্যেই আলুর চপ তৈরি করে ফেললো। এখন শুধু এগুলো ভাজার অপেক্ষা। মাংস নেড়েচেড়ে অন্য চুলায় ফ্রাইপ্যান বসিয়ে আলুর চপগুলো ভেজে নিলো। ততক্ষণে গরুর মাংসও প্রায় হয়ে এসেছে। পরশ একটা আলুর চপ নিতে গেলেই আফি থাপ্পড় দিয়ে হাত সরিয়ে দিল। গাল ফুলিয়ে ফেললো পরশ।

-“ঘরে যাও। একটু পরে খাবার নিয়ে আসছি আমি।”
-“একটা আলুর চপ দাও না।”
-“এখন না। খিচুড়ির সাথে দিব একেবারে।”
-“আচ্ছা তখন দিও। এখন একটা দাও প্লিজ।”
-“একটা আলুর চপ দিলে আর ডিস্টার্ব না করে ঘরে চলে যাবে?”
-“হ্যা পাক্কা। প্লিজ এবার দাও একটা।”

পরশের চেহারা দেখে হেসে দিয়ে একটা আলুর চপ নিয়ে ফু দিয়ে ঠান্ডা করে পরশের হাতে ধরিয়ে দিল আফি। পরশ খুশি হয়ে মুচমুচে আলুর চপ চিবুতে চিবুতে ঘরে চলে গেল। গরুর মাংস হয়ে গেলে চুলা থেকে নামিয়ে বাটিতে পরিবেশন করে নিলো। খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা, আলুর চপ আর গরুর মাংস খাবার ট্রলিতে সাজিয়ে গ্লাস আর জগ ট্রলিতে রেখে ট্রলি নিয়ে পরশের রুমে চলে এলো আফি। পরশ অধীর আগ্রহে বসে আছে খাবারের জন্য। খাবারের ট্রলিটা একপাশে রেখে আফি আসছি বলে আবারও বেরিয়ে গেল রুম থেকে। কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে এলো হাতে দুটো আচারের বোয়াম নিয়ে। খিচুড়ির সাথে জলপাই এর আচার আর বরই এর আচার খেতে বেশ লাগে।

প্রতিদিনের মতো আজও পরশ আফির হাতেই তার দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো। আফি রোজ তাকে এই নিয়ে যে কত বকা দেয়, কিন্তু পরশের জেদের কাছে সে সবসময় হার মানতে বাধ্য হয়। ছেলেটা বড্ড জেদি। মাঝে মাঝে ভাবতেই হাসি পায় যে এই ছেলেকে সে কোনো এক সময় দুচোখে সহ্য করতে পারতো না। সারাক্ষণ তার সাথে ঝগড়া করতো। আর আজ গত একমাসের বেশি হলো সে পরশের বাসায় প্রতিদিন যাতায়াত করছে। পরশের দেখভাল করছে। তার জন্য রান্না করছে। আবার নিজ হাতে তাকে খাইয়ে পর্যন্ত দিচ্ছে। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হলেও সত্যি।

রুমের জানালার পাশে বসে ফোনে স্নিগ্ধর সাথে কথা বলছিল সকাল। কিছুক্ষণ আগেই স্নিগ্ধ একটা সার্জারী শেষ করে তাকে কল দিয়েছে কথা বলার জন্য। কথা বলার মাঝে নিচ থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললো সকাল। সে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো তার ভাই এসেছে। সকাল খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। রুমে এসে ফোনে স্নিগ্ধকে বললো,
-“ডাক্তার সাহেব আমি আপনাকে রাতে ফোন করবো। আমার ভাইয়া এসেছে দীর্ঘ দুই বছর পর।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তাহলে ভাইয়ের সাথে দেখা করো গিয়ে। আমিও এখনি ফোন কাটতাম। কারণ আমার একটু পরে আরও একটা সার্জারী আছে।”
-“আচ্ছা তাহলে রাখছি। আর ভালো থাকবেন, সাবধানে থাকবেন।”
-“তুমিও নিজের খেয়াল রেখো; রাখছি।”

সকাল ফোন রেখে একদৌড়ে নিচে চলে গেল। এতদিন পর নিজের ভাইকে দেখে সকাল ‘ভাইয়া’ বলে জোরে চিল্লিয়ে তাকে যেয়ে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরলো সকালের ভাইও। তার একমাত্র আদরের বোনকে এতদিন দেখা তো দূরে থাক তার সাথে কথাও হয়নি। প্রচুর মনে পড়েছে এই পিচ্চিটার কথা। তার কলিজার টুকরা ছোটবোন। যে সবসময় তার কাছে এটা-সেটা বায়না করতো, গত দুই বছর ধরে সেই বোন কোনো বায়না করে নি তার কাছে। কথাগুলো ভাবতেই বুক ফেটে কান্না আসছে তার। বোনকে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদেই ফেললো। সকাল নিজেও কাঁদছে। পাশে দাঁড়িয়ে নীরব দর্শক হয়ে কেউ একজন ওদের দেখছে। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই সকালের।

আরিফুল ইসলাম আর রেহেনা বেগম চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। রেহেনা বেগমের চোখে পানি চিকচিক করছে এত বছর পর নিজের ছেলেকে দেখে। তার দুই ছেলেমেয়ের ভাই-বোনের ভালোবাসা দেখে তার চোখে পানি এসে গিয়েছে। কিন্তু আরিফুল ইসলামের চেহারায় এখনো রাগের ছাপ স্পষ্ট। সকাল তার ভাইকে ছেড়ে কাঁদো কাঁদো গলায় অভিযোগের সুরে বললো,
-“তুমি খুব খুব খুব পঁচা ভাইয়া। সকাল তোমার সাথে অনেক রাগ করেছে। তুমি সকালের সাথে এতদিন কোনো কথা বলোনি কেন? কোনো রকম যোগাযোগই রাখোনি। কেন ভাইয়া! আমার কথা কি তোমার একটুও মনে পড়েনি? আমি এতটাই বেশী জ্বালাতাম তোমাকে?”
-“আমি জানি তো আমি পঁচা। আমি পঁচা নাহলে কি আমার এই পিচ্চি বোনটার সাথে যোগাযোগ না করে থাকতে পারতাম! বিশ্বাস কর পিচ্চি আমি বহুবার চেয়েছি তোর সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু পাপার জন্য পারিনি। উনি তো আমাকে নিষেধ করে দিয়েছিল যাতে আমি তোর সাথে কোনো যোগাযোগ না রাখি। তাই আমি রাখিনি। ভেবেছিলাম পাপা যেদিন আমাকে মাফ করে দিবে সেদিনই তোর সাথে কথা বলবো।”
-“পাপা না করেছিল মানে? তুমি তো কাজের জন্য বাইরে ছিলে তাই না! আমি তো এটাই জানি।”

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো সকাল। সকালের ভাই তার মায়ের দিকে তাকাতেই তিনি মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলেন। যার অর্থ সকালকে কিছুই জানানো হয়নি। নাহলে সকাল খুব কষ্ট পেতো। সকালের ভাই তা বুঝতে পেরে বললো,
-“আমি কাজের জন্য নয়; বরং পাপার সাথে রাগ করে বিদেশে চলে গিয়েছিলাম।”
-“কিন্তু কেন! আর আমাকে কেউ কিছু জানায়নি কেন?”

কথা বলার মাঝেই সকালের চোখ গেল তার ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের দিকে। যার কোলে একটি ছোট্ট বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। বাচ্চাটা হুবহু তার ভাইয়ের মতো দেখতে। সকালের কেন যেন ভীষণ চেনা চেনা লাগলো মেয়েটিকে। পরক্ষণেই সে চিনতে পেরে বললো,
-“আখি আপু তুমি!”

আখি সকালকে দেখেই চিনে ফেলেছিল। কিন্তু সকাল যে পলকের বোন তা সে ভাবতে পারেনি। এতগুলো বছরে আজ পর্যন্ত পলকের বোনকে সে সামনা-সামনি বা ছবিতে দেখেনি। শুধু পলকের মুখেই শুনেছে তার বোনের কথা। কিন্তু পলক কখনোই বলেনি যে তার বোনের নাম সকাল। সে সবসময় অপর্ণা নামটাই বলে এসেছে সকালের। তাই এত পরিচিত হয়েও সকালকে চিনতে পারেনি আখি। সকালের কথায় মুখে হাসি ফুটিয়ে আখি জিজ্ঞেস করলো,
-“কেমন আছো পিচ্চি?”
-“ভালো। কিন্তু তুমি এখানে এত বছর পর এলে যে! এতদিন কোথায় ছিলে?”
-“সেটা নাহয় তোমার ভাই বলুক।”

পলক অবাক হয়ে সকালের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“তুই আখিকে চিনিস?”
-“হ্যা। তুমি বিদেশ যাওয়ার বছরখানেক আগে আমার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল না! সেখানে তো আখি আপু আর তার বন্ধু স্নিগ্ধ মানে ডাক্তার সাহেব, উনারা দু’জন মিলে আমার চিকিৎসা করেছিল। সেই সুবাদেই চিনি আমি আপুকে। কিন্তু তুমি আপুকে কি করে চেনো?”
-“আখি আমার স্ত্রী আর তোর ভাবী। আর এই যে পচকুটাকে দেখছিস! ও তোর এই ভাই-ভাবীর ছেলে। ওর নাম নয়ন।”
-“ভাই তুমি বিয়ে করে ফেলেছো! কবে কখন কীভাবে? আমাকে কিছুই জানালে না! আরে বিয়ের খবর বাদ দাও। বেবিকে দেখে তো মনে হচ্ছে ওর এক বছর আপ হয়ে গেছে। তুমি আমাকে বেবির খবরও জানাওনি?”
-“পরিস্থিতি ছিল না জানানোর মতো। পাপা তো আমার সাথে সকল সম্পর্কই ছিন্ন করে দিয়েছিল।”
-“কেন?”
-“কারণ আমি তাদের না জানিয়ে আখিকে বিয়ে করেছিলাম। তা-ও বিয়ে করে দুই বছর লুকিয়ে রেখেছিলাম এই কথাটা। তাছাড়া আখি অনাথ। ওর এই পৃথিবীতে কেউ নেই। ও অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। ভাগ্যক্রমে কোনো একভাবে স্নিগ্ধর সাথে ওর বন্ধুত্ব হয়। আর সে-ই ওকে নিজের বোনের মতো আদর-যত্ন করে বড় করেছে। পড়াশোনার জন্য টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে। সেজন্যই আখি আজ একজন ভালো ডাক্তার। পাপাকে বলেছিলাম যে আমি আখিকে ভালোবাসি। আমি কোনো কিছুর বিনিময়ে ওকে ছাড়তে পারবো না। কিন্তু পাপা মানেনি। উল্টো আখিকে অপমান করেছে। তাই আমি আখিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।”

সকাল সবটা শুনে পেছন ঘুরে আরিফুলের দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে হালকা রাগের ছাপ স্পষ্ট। সকাল জানে কীভাবে তার পাপার মন এখন গলাতে হবে। সে পলকের দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে পাপার কাছে চলে গেল। অধীর আগ্রহের সাথে দাঁড়িয়ে আছে পলক। তার একমাত্র ভরসা এখন তার বোন সকাল। শুধু সকালই পারবে পাপাকে মানিয়ে নিতে যাতে উনি পলক আর আখিকে মেনে নেয়।

সকাল আরিফুল ইসলামের মুখ দেখেই বুঝেছে যে আরিফুল ইসলাম তেমন একটা রেগে নেই এখন। অবশ্য রাগ কমে যাওয়ারই কথা। নয়নকে দেখ তো তারই প্রাণটা জুড়িয়ে গিয়েছে। কি সুন্দর মিষ্টি একটা মুখ। সকাল তার পাপার সামনে যেয়ে দু’হাতে দু’গাল টেনে আহ্লাদী সুরে বললো,
-“ও পাপা দেখো না কি কিউট বাচ্চা। তুমি ভাইয়া আর ভাবীর উপর রাগ করে ওই বাচ্চাটার থেকে মুখ কেন ফিরিয়ে রেখেছো? এরকম ফুটফুটে বাচ্চার থেকে কেউ কি করে পারে মুখ ফিরিয়ে নিতে! পাপা অন্তত এই বেবিটার জন্য ওদের মাফ করে দাও। ভাইয়া আর ভাবী তো মাফ চাইছেই। আর তাছাড়া এখন তো ভাইয়া-ভাবী একা নয়। ওদের সাথে তোমার নাতিও আছে। একবার চিন্তা করে দেখো তো! আরিফুল ইসলামের নাতি তার দাদুর ছায়া ছাড়া বড় হচ্ছে এই খবর যদি বাইরের মানুষ জানে তখন উনারা কি ভাববেন! পাপা আমি কিন্তু ভাইয়াকে ছাড়া আর থাকছি না। তুমি যদি ভাইয়াকে চলে যেতে বলো তাহলে কিন্তু আমিও ভাইয়ার সাথে চলে যাবো।”

মেয়ের কথা শুনে আরিফুল ইসলাম চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকালেন। সকাল একগাল হেসে পাপার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
-“আমি জানি আমার পাপা কখনো আমার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখতেই পারে না। তার মানে ভাইয়ারাও কোথাও যাচ্ছে না। আমার পাপা দুনিয়ার সব থেকে ভালো পাপা। এই জন্যই তো আমি আমার পাপাকে এত ভালোবাসি।”

আরিফুল ইসলাম বলার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। তার এই দুই ছেলে মেয়ে তার জান। ছেলেটা নাহয় তার একটা ভুল করেই ফেলেছে। সেজন্য উনি পলককে পরিবার থেকে দূরে রেখে শাস্তিও দিয়েছেন। কিন্তু এখন অনেক হয়েছে। এবার এই ছেলেকে আসলেও তার মেনে নেয়া উচিৎ। নাহলে তার নাতি যে তার ছায়াতলে বড় হতে পারবে না। মনে মনে এত কথা ভাবলেও মুখটাকে তিনি আগের মতো গম্ভীর করেই রইলেন। সকাল কিছুটা বুঝতে পেরে হেসে আখির কাছে গেল।

-“ভাবী নয়ন তো উঠে গেছে। আমি কোলে নিই ওকে!”
-“হ্যা অবশ্যই নাও। তোমারও তো ছেলে।”

নয়ন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সকালের দিকে। সকাল হেসে হাত বাড়াতেই নয়ন একলাফ দিয়ে সকালের কোলে চলে গেল। এটাকেই হয়ত রক্তের টান বলে। নয়ন সকালের কোলে গিয়েই বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে চুপচাপ। পলক আর আখি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কারণ নয়ন সচরাচর কারও কোলে যেতে চায় না। অন্য কারও কোলে গেলেই সে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। আর সকালের কোলে গিয়ে কি সুন্দর চুপচাপ শুয়ে আছে। আখি বা পলকের কোলেও সে এত চুপচাপ থাকে না। সকাল নয়নের মুখ উঁচু করে কপালে, গালে আর ঠোঁটে চুমু দিল। নয়ন খিলখিল করে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ আদর করে সকাল নয়নকে নিয়ে আরিফুলের কোলে দিল।

আরিফুল ইসলাম ছলছল দৃষ্টিতে তার নাতির দিকে তাকিয়ে থেকে অগণিত চুমু খেলেন তার মুখে। সকাল তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো। পলক আর আখির চোখ দুটোও ছলছল করছে। অবশেষে আরিফুল ইসলাম ওদের মেনে নিলো। নয়নকে কোলে নিয়ে উনি পলক আর আখির দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসতে ইশারা করতেই পলক এক প্রকার দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তার পাপাকে। ছেলের কপালে চুমু দিতেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো তার। আখি এসে পাশে দাঁড়ালো। বাবা ছেলের মিলন দেখছে সে। পলককে সরিয়ে আরিফুল ইসলাম আখির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ভালোবাসা স্বরূপ নিজের হাত থেকে দুটো স্বর্ণের আংটি খুলে দিলেন আখিকে। আর গলার মোটা স্বর্ণের চেইনটা খুলে নয়নের গলায় পড়িয়ে দিলেন।

রেহেনা বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে এতদিনের জমিয়ে রাখা চোখেরজল দিয়ে বুক ভেজাচ্ছে পলকের। মাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে পলক। ছেলেকে ছেড়ে আখির কপালে একটা চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আখিকে। এরপর নিজের নাতিকে কোলে তুলে নিলেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত যেই ছেলে তার কোলে করে ঘুরে বেড়াতো, আজ সেই ছেলের সন্তান তার কোলে। ভাবতেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো রেহেনা বেগমের।

পলক আরিফুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে আছে বলে সকাল গাল ফুলিয়ে ধাক্কাতে লাগলো পলককে। পলক সরে যেতেই সকাল তার পাপাকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“পাপা শুধু আমাকে আদর করবে। তুমি সরো কাবব মে হাড্ডি।”
-“ইহ্! পাপা আমাকে আদর করবে। তুই সর চিকনি।”
-“এই ভাই খবরদার আমাকে চিকনি বলবে না। দেখেছো আগের থেকে আমার ওজন বেড়েছে। আমি আর আগের মতো পাতলু নেই।”
-“দেখে তো মনে হচ্ছে না। আর একদম ঢপ দিবি না। তুই এখনো আগের মতোই বাঁশ হয়েই আছিস। ফুঁ দিলে তো উড়ে যাবি।”

সকাল কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
-“দাও ফুঁ দাও। যদি আজকে ফুঁ দিয়ে আমাকে না ওড়াতে পেরেছো না তাহলে তোমার একদিন কি আমার একদিন।”
-“নাহ থাক যা দয়া করলাম তোকে। তুই উড়ে গেলে আমার সাথে ঝগড়া করবে কে বল!”
-“তুমি কি বলতে চাইছো আমি ঝগড়ুটে?”
-“আমি কি একবারও তা বলেছি! তুই তো বললি তুই ঝগড়ুটে।”
-“ভাইয়া ভালো হবে না কিন্তু! তুমি পরোক্ষভাবে আমাকে ঝগড়ুটে বলেছো।”
-“আচ্ছা বাবা স্যরি। তোর সাথে এতদিন পর দেখা হলো তো তাই ঝগড়া করার লোভটা সামলাতে পারলাম না। আগে তো সারাদিন ঝগড়া করতাম।”
-“হ্যা এরপর তো আর আমাকে মনে পড়েনি তাই তো কোনো খোঁজ-খবর নাও নি।”
-“তোকে তো সব বললাম তারপরও রাগ করছিস!”
-“তুমি পঁচা। অনেক অনেক অনেক পঁচা। সকাল পঁচাদের সাথে কথা বলে না।”
-“তাহলে কি আবার চলে যাবো?”
-“ভাইয়া…”

সকাল কেঁদে জড়িয়ে ধরলো তার ভাইকে। পলক হেসে দিলেও তার চোখে পানি রয়েছে। দু’হাতে নিজের বোনকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে তাকে পলক।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here