সেই সন্ধ্যা পর্ব-৩৪

0
1292

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩৪
.
কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে কম্বলের নিচে মুখ গুঁজে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে সকাল। তার ফোন বেজে চলেছে প্রায় দশ মিনিট ধরে। কিন্তু সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ ভেসে আসতেই ঘুম কিছুটা হালকা হয়ে এলো তার। আবারও ফোন বেজে উঠতেই এক প্রকার বিরক্তি নিয়ে বালিশের পাশে হাতিয়ে ফোন খুঁজতে লাগলো। অনেক খুঁজেও যখন ফোন পেলো না তখন চোখ মেলে উঠে বসলো সকাল। অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর ফোন পাওয়া গেল কম্বলের ভেতরে কোলবালিশের নিচে। ১৯ টা মিসড কল উঠে আছে স্ক্রিনে। তার ভেতরে দুটো কাস্টমার কেয়ারের। আর বাকিগুলো স্নিগ্ধর নম্বর থেকে এসেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে কম্বল জড়িয়ে আবারও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই রেহেনা বেগম রুমে ঢুকলেন। মেয়েকে এত আরামে ঘুমোতে দেখে ডাকতে ইচ্ছে করছে না তার। তখনি আবারও ফোন বেজে উঠলো সকালের। রেহেনা বেগম ফোন হাতে নিতেই দেখতে পেলেন স্ক্রিনে ডাক্তার সাহেব নামটা ভেসে উঠেছে। সাথে রয়েছে স্নিগ্ধর ছবি। ছবিতে সেই মনমাতানো মুচকি হাসি দিয়ে আছে স্নিগ্ধ। রেহেনা বেগম হালকা হেসে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলেন। সাথে সাথেই ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো বড়সড় এক ঝারি। যা শুনে রেহেনা বেগম হকচকিয়ে গেলেন। স্নিগ্ধ আরও কিছু বলতে যাবে তার আগে রেহেনা বেগম বললেন,
-“বাবা আমি সকালের মাম্মা বলছি।”

ওপাশ থেকে দু-তিন মিনিট কোনো আওয়াজ শোনা গেল না। রেহেনা বেগম হ্যালো বলার কয়েক সেকেন্ড পরে স্নিগ্ধর গলার আওয়াজ শোনা গেল। সে রেহেনা বেগমকে সালাম দিল।
-“স্যরি আন্টি মাফ করবেন। আমি বুঝতে পারিনি আপনি মিস বিকাল আই মিন সকালের ফোন ধরবেন। আসলে ওকে গত পনেরো মিনিট ধরে কল দিচ্ছি। কিন্তু ফোন ধরছিল না। তাই ঝারি দিয়েছি।”
-“আচ্ছা বাবা সমস্যা নেই। বুঝতে পেরেছি আমি। আসলে সকাল ঘুমোচ্ছে। সেজন্যই কল রিসিভ করছিল না। দাঁড়াও আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।”
-“জ্বি আন্টি।”

রেহেনা বেগম সকালকে ডাকতে লাগলেন। ফোনের ওপাশে স্নিগ্ধ হাত দিয়ে কপাল চাপড়াচ্ছে। স্নিগ্ধ ভীষণ ভাবে লজ্জা পেয়েছে যখন সে শুনেছে ফোনটা রেহেনা বেগম ধরেছে। আর ও সকালের বদলে ঝারিটা সকালের মা রেহেনা বেগমকে দিয়েছে। সকালের ঘুমন্ত কণ্ঠস্বর শুনে ফোন কানে ধরলো স্নিগ্ধ।
-“হ্যালো!”
-“উমম… ডাক্তার সাহেব! এত সকাল সকাল কল কেন দিলেন? আমি কি সুন্দর ঘুমোচ্ছিলাম। গতকাল আপনি ঘুমের মেডিসিন দিয়েছিলেন। তাই ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি আমার।”
-“এই মেয়ে কখন থেকে কল করছি তোমাকে? কানে শোনো না না-কি! তোমার জন্য শুধু শুধু একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো আমায়।”
-“আমি কি করলাম!”
-“তুমি ফোন ধরছিলে না বলে আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। পরে আবারও কল দিয়েছি, তখন তোমার বদলে যে তোমার মা ফোন রিসিভ করবে আমি বুঝতে পারিনি। তুমি ভেবে আমি উনাকে ঝারি মেরে দিয়েছি।”
চোখ দুটো বড় বড় করে সকাল শোয়া থেকে উঠে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে খিলখিল করে হেসে উঠলো সে।
-“হাহাহা… সিরিয়াসলি ডাক্তার সাহেব! পাপা জানলে আপনার আর রক্ষে থাকবে না। পাপা মাম্মাকে অনেক ভালোবাসে। সেজন্য আজ পর্যন্ত নিজে কখনো বকা দেয়নি মাম্মাকে। শুধু তখন একটু মিথ্যে মিথ্যে রাগ দেখায় মাম্মাকে যখন মাম্মা আমাকে বকা দেয়।”
-“এজন্যই তো বলি এত পিচ্চি মেয়ে এত ছোট বয়সে প্রেম, ভালোবাসা বুঝলো কি করে। ঘরের ভেতরে নিজের মা-বাবার প্রেম দেখে যে বড় হয়েছে সে-তো ভালোবাসায় পিএইচডি করবেই।”
-“হুহ্! ডাক্তার সাহেব ভুলে যাবেন না এই পিচ্চিই আপনার বউ হবে কিছুদিন পরে।”
-“না ভুলবো কেন! তোমাকে পালার জন্য তোমাকে বিয়ে করতে চলেছি আমি। এটা আমার সব সময় মনে থাকবে।”
-“ওই বেশী ফালতু বকবেন না বুঝেছেন! বিয়ে করলে পরের বছরেই যে আপনার বাচ্চার মা হয়ে যাবে আপনি তাকে বাচ্চা বলে অসম্মান করছেন! আপনার সাহস তো কম না।”
-“কিহ!”

সকাল নিজেই বেক্কল হয়ে গেল নিজের কথায়। যখন বুঝতে পারলো কি বলেছে ও স্নিগ্ধকে তখনি সে জিহ্বে কামড় দিল। ও কি বলতে যেয়ে কি বলে ফেললো এসব! লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গেছে ওর। কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিল। যা বলেছে ও, এরপর কীভাবে স্নিগ্ধর সামনে যাবে সেটাই বুঝতে পারছে না। কাঁদো কাঁদো চেহারা বানিয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে বসে পরলো। উপায় খুঁজতে লাগলো স্নিগ্ধর হাত থেকে বাঁচার জন্য।
স্নিগ্ধ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। একটু আগে ও যা শুনলো তা ঠিক না ভুল সেটা বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক। সিয়্যর হওয়ার জন্য সকালকে জিজ্ঞেস করতে গেলেই সকাল ফোনটা কেটে দিল। এটা দেখে আরও অবাক হলো স্নিগ্ধ। পরক্ষণেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তার মানে একটু আগে ও যা শুনেছে তা ঠিকই শুনেছে। স্নিগ্ধ বুঝতে পারলো ফোন যখন কেটে দিয়েছে তার মানে মুখ ফসকেই কথাটা বলে ফেলেছে সকাল। এই কথা বলার পর সকালের অবস্থা এখন কেমন তা ভাবতেই হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে সকালকে একটা ম্যাসেজ দিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল সে।

মেডিকেলে ঢুকে বারবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। স্নিগ্ধকে কোথাও দেখতে না পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সকাল। সব জায়গায় চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়ে তারপর ক্লাসে ঢুকলো। ক্লাসে ঢুকতেই দেখলো আজও অনেকেই তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আজ আবার কি হলো! কিছু না জিজ্ঞেস করে মাঝের দিকের সিট বেছে নিয়ে বসে পরলো সে। প্রায় সাথে সাথেই ক্লাসের একটা দল এসে ওকে ঘিরে ধরলো। সকাল ভ্রু কুঁচকে ফেললো তাদের দেখে।
-“আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন তোমরা?”
-“তুমি সত্যিই স্নিগ্ধ স্যারের বাগদত্তা!”
-“গতকাল ডাক্তার সাহেব নিজের মুখেই বলেছেন কথাটা। এখন তোমাদের যদি একান্তই কোনো সন্দেহ থেকে থাকে তাহলে এক মিনিট! আমি এখনি তোমাদের সন্দেহ দূর করে দিচ্ছি।”

সকালে নিজের ফোন বের করে ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে ওর আর স্নিগ্ধর আংটি বদলের সময়ের একটা ছবি বের করলো। ছবিগুলো মূলত স্নিগ্ধর মা তুলেছিল। পরে স্নিগ্ধ তার কাছ থেকে নিয়ে ওকে পাঠিয়েছে। সকাল সেই ছবিগুলো ওদের দেখালো। যা দেখে সবাই অবাক। সকাল মুচকি হেসে ফোন রেখে এবার নিজের বাম হাতের অনামিকা আঙুল দেখিয়ে বললো,
-“এই হলো ডাক্তার সাহেবের আমাকে পড়িয়ে দেয়া আংটি। যার কারণে আমি তার বাগদত্তা। তাছাড়া বিয়ে তো সামনেই! অবশ্যই তোমরা নিমন্ত্রণ পাবে।”

কেউ কেউ সকালের কথায় খুশি হলেও অনেকেই মুখটাকে বাংলার পাঁচ বানিয়ে রেখেছে সকালের কথা শুনে। কারণ মেয়েগুলো প্রায় সবাই স্নিগ্ধকে পছন্দ করতো, আর ছেলেরা সবাই সকালকে। আফি আজ আসেনি দেখে সকাল বই বের করে তার ভেতরে মুখ গুঁজে বসে আছে। বাসা থেকে আসার সময় নাস্তা করে এসেছে স্নিগ্ধর ডায়েট চার্ট অনুযায়ী। সকালে ফোন কেটে দেয়ার পর স্নিগ্ধ তাকে ম্যাসেজ করেছিল এজন্যই যাতে সে সময় মতো খেয়ে নেয় ডায়েট চার্ট অনুযায়ী। প্রথমে স্নিগ্ধর ক্লাস থাকলেও স্নিগ্ধর বদলে নতুন এক স্যারকে দেখে অবাক হলো সকাল। নতুন স্যার এসে নিজের পরিচয় দিলেন। আর এ-ও বললেন যে আজ একটা সার্জারী থাকায় স্নিগ্ধ আসতে পারেনি। কথাটা শুনে একটু হালকা হলো সকাল। গতকাল পুরোনো প্রফেসরদের বের করে দেয়ার পর এরা নতুন এসেছে। আর স্নিগ্ধ নিজেও তার ডাক্তারি পেশায় টিকে আছে। ক্লাস শেষ করে মেডিকেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কি মনে করে যেন হসপিটালের দিকে তাকালো সকাল। হসপিটাল বিল্ডিংয়ের চারতলার বেলকনির রেলিং এর সাথে স্নিগ্ধকে হেলান দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল সকালের। ও তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। ওপর থেকে তা দেখে মুচকি হাসলো স্নিগ্ধ।

আফি ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে বসতেই দেখতে পেলো তার মা রুম গোছগাছ করছে। তা দেখে মুচকি হেসে উঠে গিয়ে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। আফির মা চমকে উঠলেন। কিন্তু পরে বুঝতে পেরে আফির গালে হাত দিয়ে ওকে ফ্রেস হয়ে আসতে বললো। আফি ওয়াশরুমে যেতেই আফির মা তার মেয়ের আলমারি গোছাতে লাগলো। হঠাৎ নীল রঙের একটা ফাইল দেখতে পেয়ে সেটা বের করলেন। ফাইলটা কীসের তা দেখার জন্য সেটা খুলে পড়তে গেলেই আফি এসে টান দিয়ে ফাইলটা নিয়ে নিলো। কিছুটা রাগীভাবে চেঁচিয়ে উঠলো সে।
-“কি করছিলে তুমি? মা আমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি। নিজের ঘর নিজে গোছাতে পারি। তোমাকে কষ্ট করে গুছিয়ে দিতে হবে না। আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে হাত কেন দিচ্ছ তুমি? আমার এসব একদম পছন্দ নয়। যাও এখান থেকে। আমি বাকিটা গুছিয়ে নিবো। আর কোনোদিনও না বলে আমার কোনো জিনিসে হাত দিবে না।”
-“আমি তো শুধু….”
-“যাও তো প্লিজ! মেজাজ খারাপ করো না আমার।”

আফির মা কিছু না বলে মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মলিন মুখে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। প্রায় সাথে সাথেই খুব জোরে শব্দ করে রুমের দরজাটা লাগিয়ে দিল আফি। দরজার সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে নিলো সে। হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। এক সময় চোখের পানিগুলো বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ধপ করে নিচে বসে পড়লো। চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েও চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না সে। আজ যদি তার মা এই ফাইলটা পড়ে ফেলতো তাহলে নিশ্চয়ই তিনি মরে যেতো! এটা ভেবেই আফির আরও বেশী করে কান্না পাচ্ছে। নিজের মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই ফাইলটা তাকে লুকিয়ে রাখতে হবে সবার কাছ থেকে। যে ভুল তার! সেই ভুলের মাশুল তার মা কেন দিবে? এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই আফির। কিন্তু শুধু মাত্র নিজের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এখনো বেঁচে আছে সে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ফ্লোরেই ঘুমিয়ে গেল সে।
ঘন্টা খানেক পর ঘুম ভাঙতেই কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে পরে গেল তার। উঠে বসে ফাইলটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে জামা পাল্টে তৈরি হয়ে নিলো। ফোন আর ব্যাগ নিয়ে তার মাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল পরশের বাসার উদ্দেশ্যে।

ছাদের দোলনায় বসে বিকেলের ঠান্ডা আবহাওয়া উপভোগ করছে সকাল। তার দৃষ্টি রয়েছে সামনের টবগুলোর দিকে। যেখানে রয়েছে স্নিগ্ধর দেয়া গোলাপ গাছগুলো। সবগুলো গাছে ফুল ফুটেছে। দেখতে চমৎকার লাগছে। ডেইরি মিল্ক সিল্ক চকলেট খেতে খেতে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে সে। সকালে স্নিগ্ধকে ও যা বলেছে এরপর স্নিগ্ধর সামনে যাওয়ার সাহস নেই তার। ও একা একাই লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। স্নিগ্ধর সামনে গেলে তো তাকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না লজ্জার কারণে। বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণ শুনে বুঝলো আরিফুল ইসলাম এসে গিয়েছে। কিন্তু এখন সকালের বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই নিচে যাওয়ার। তাই চুপ করে দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে চকলেট খেতে লাগলো। ঘাড়ের কাছে কারও গরম নিশ্বাস টের পেতেই শিউরে উঠলো সকাল। তৎক্ষনাৎ পেছনে ঘুরতেই মাথায় বারি খেলো সে। ব্যথা পেয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো। মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ মেলে সামনে তাকাতেই কাঁদো কাঁদো চেহারা বানিয়ে ফেললো সকাল। ওর সামনেই নিজের চমৎকার মুচকি হাসিটি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধ।
-“ডাক্তার সাহেব আপনি আমায় মারলেন কেন?”
-“আমি কোথায় মারলাম? তুমি নিজেই তো আমার মাথার সাথে বারি খেলে।”
-“আমি তো জানতাম না আপনি আমার এতটা কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।”
-“কতটা কাছে?”

দুষ্টু হেসে কথাটা বলেই স্নিগ্ধ সকালের দিকে আরও ঝুঁকে গেল। সকাল শুকনো দু-তিনটে ঢোক গিলে একটু পিছিয়ে গেল। ইদানীং স্নিগ্ধকে তার অন্যরকম লাগে। আগের স্নিগ্ধ সবসময় তার থেকে দূরে দূরে থাকতো। কিন্তু স্নিগ্ধ ইদানীং তার খুব কাছে চলে আসে। যা তার হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বাড়িয়ে দেয় নিমিষেই। তার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হয় স্নিগ্ধ কাছে এলে। সকাল ভীত চোখে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
-“ডা..ডাক্তার সাহেব আ..আপনি আসবেন বলেন নি তো!”
-“তুমি আমার ফোন ধরলে তো বলবো। সেই যে সকালবেলা ফোন কেটে দিলে, এরপর তো আর কোনো খোঁজ-খবর নেই তোমার। মেডিকেলে একটু দেখলাম তা-ও আমাকে দেখে মনে হলো তুমি পালিয়ে গেলে। কেন মিস বিকাল!”
-“আ..আমি কেন পালাবো? আমার একটু কাজ ছিল। তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।”

মিনমিন করে কথাগুলো বললো সকাল। সকালের অবস্থা দেখে স্নিগ্ধর হাসি পেলেও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে নিলো। নাহলে সকালের সাথে আরও মজা নিতে পারবে না সে। স্নিগ্ধ পেছন থেকে সামনে এসে সকালকে নিজের দু’হাতের মাঝে বন্দী করে ফেললো। দোলনার সাথে একদম মিশে আছে সকাল। আশেপাশে তাকিয়ে পালানোর কোনো রাস্তা সে খুঁজে পেলো না। কারণ তার দু’পাশে স্নিগ্ধ হাত দিয়ে তাকে মাঝখানে বন্দী করে রেখেছে। স্নিগ্ধ সকালের দিকে আর একটু ঝুঁকতেই সকাল নিজের চোখ দুটো চেপে বন্ধ করে নিলো। ইতোমধ্যে তার শ্বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। স্নিগ্ধ তার ডান হাতের এক আঙুল দিয়ে সকালের ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা চকলেট মুছে নিতেই সকাল চোখ মেললো। স্নিগ্ধর আঙুলে চকলেট দেখে ও বুঝলো যে স্নিগ্ধ এজন্যই তার এত কাছে এসেছে। সকালকে দেখিয়ে চকলেট লেগে থাকা আঙুলটা নিজের মুখে পুরে নিলো স্নিগ্ধ। সকাল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আবার লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। সকাল শ্বাস নিচ্ছে না বুঝতে পেরে স্নিগ্ধ বললো,
-“শ্বাস নাও।”

সাথে সাথেই সকাল জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। স্নিগ্ধ হালকা হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সকাল বেশ কিছুক্ষণ সেভাবে থাকার পর চোখ মেলে স্নিগ্ধকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক লাফে উঠে দাঁড়ালো। আশেপাশে তাকিয়ে একদৌড় দিল। ছাদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে তার হাত ধরে ফেললো স্নিগ্ধ। সকাল কয়েকটা ঢোক গিলে নিলো। স্নিগ্ধ হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো সকালকে। দু’হাতে সকালের কোমড় চেপে ধরে পেছনের দেয়ালের সাথে লাগিয়ে ধরলো সকালকে। সকাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। বাঁকা হেসে স্নিগ্ধ বললো,
-“তা সকালে কি যেন বলছিলেন আপনি মিস বিকাল?”
-“কিক..কি বলেছিলাম?”
-“মনে পরছে না?”
সকাল নিচে তাকিয়ে দু’পাশে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ তার মনে পরছে না কিছু। স্নিগ্ধ মুচকি হেসে বললো,
-“আচ্ছা কোনো সমস্যা নেই। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি।”
-“(…..)”
-“বিয়ে করলে পরের বছরেই যে আপনার বাচ্চার মা হয়ে যাবে আপনি তাকে বাচ্চা বলে অসম্মান করছেন! এটাই তো বলেছিলে তাই না? ওহ তোমার আবার মনে নেই কিছু।”

সকাল লজ্জায় লাল হয়ে গেল। শরীর কাঁপছে তার। গাল দুটো গরম হয়ে এসেছে। স্নিগ্ধ সকালের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। হাসি মুখেই সে বললো,
-“তার মানে বিয়ের পরের বছরই বাচ্চা লাগবে তোমার তাই তো!”
সকাল চোখ বড় বড় করে তাকালো। মুহূর্তেই স্নিগ্ধ শব্দ করে হেসে উঠলো। সকাল স্নিগ্ধকে সরানোর চেষ্টা করলে স্নিগ্ধ আরও শক্ত করে তাকে চেপে ধরলো। সকালের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সকালের মুখের ওপর থেকে আলতো স্পর্শে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ওর কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো স্নিগ্ধ। সকালও চুপ, স্নিগ্ধও চুপ। কিছু সময় এভাবে কেটে যাওয়ার পর ঘোর লাগা কণ্ঠে স্নিগ্ধ বললো,
-“এখনি এসব বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ভেবো না। তুমি নিজেই এখনো বাচ্চা। আগে তুমি বড় হও। পড়াশোনা শেষ করো। একজন ভালো ডক্টর হও। তারপর আমাদের বাচ্চার চিন্তা করা যাবে; বুঝেছো? এটা ভেবো না যে বিয়ের পর তোমার পড়াশোনা বন্ধ। বরং বিয়ের পর আরও বেশী করে পড়তে হবে তোমায়। আমি তো আছিই। আমি সাহায্য করবো তোমাকে। মেডিকেলে যখন পড়ছো তখন তোমাকে একজন ভালো ডক্টর হতেই হবে। পারবে না তুমি?”

অস্পষ্ট স্বরে সকাল জবাব দিল,”হু!” স্নিগ্ধর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সকালের থুঁতনিতে হাত রেখে মুখটা উঁচু করে তার কপালে চুমু দিল। চোখ বন্ধ অবস্থায় সকালের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সকালের নাক ধরে হালকা টেনে দিতেই চোখ মেললো সকাল। গাল ফুলিয়ে বললো,
-“আমি বাচ্চা না।”
-“আমার কাছে তুমি বাচ্চাই।”

কথাটা বলে স্নিগ্ধ সকালের নাকে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো সকালকে। আবেশে চোখ বুঁজে নিলো সকাল। সে নিজেও দু’হাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো তার ডাক্তার সাহেবকে। বেশ কিছুক্ষণ সেভাবে থাকার পর দুজনে নিচে নেমে গেল। নিচে এসে আসমা বেগমকে দেখে উনার সাথে বসে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে নিলো। অনেক্ক্ষণ আড্ডা দেয়ার পর ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসমা বেগম আর স্নিগ্ধ চলে গেল। যাওয়ার আগে স্নিগ্ধ একটা লজ্জা জনক পরিস্থিতি তৈরি করে গিয়েছে। সবার সামনে সে সকালের হাতে চুমু দিয়ে ডানে-বামে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে সে। আর সকাল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পরক্ষণেই সে একবার আসমা বেগম, রেহেনা বেগম আর আরিফুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে এক দৌড়ে ওপরে চলে এসেছে। সকালের দৌড় দেখে তারা যে উচ্চস্বরে হাসছিল তা শুনতে ভুল করেনি সকাল।

ভোরের আলো ফুটতেই হাতে ব্রাশ নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালো রহিম মিঞা। তিনি পেশায় একজন জেলে। পাশেই তার বাড়ি। রোজ সকালে সে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করার পর তার সাথীদের সাথে নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। দাঁত ব্রাশ করা শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়াতেই দেখলো তার সাথীরা এদিকেই আসছে জাল হাতে নিয়ে। রহিম মিঞা তার সাথীদের সাথে নৌকায় চড়ে মাঝ নদীতে যেয়ে জাল ফেলে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে জাল ধরে টেনে ওঠাতে গেলে ভারের কারণে ওঠাতে পারলো না। পরে সবাই মিলে একসাথে জাল টেনে ওপরে ওঠালো। জাল ওপরে আসার পর ওরা যা দেখলো তাতে ভয় এবং আতঙ্কে একেকজন কথা বলতেই ভুলে গেল।
নদীর পাড়ে শত শত মানুষের ভিড় জমে আছে। তাদের সামাল দিচ্ছে পুলিশ কনস্টেবলরা। বাকি পুলিশ অফিসাররা লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লাশের অবস্থা দেখে একেক জনের রুহ্ কেঁপে ওঠার মতো অবস্থা হয়েছে। এক অফিসার জেলেদের সাথে কথাবার্তা বলে লাশ দেখে কমিশনারের সামনে এসে দাঁড়ালো।
-“কি বুঝলেন অফিসার?”
-“স্যার লাশগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। যে এদের মেরেছে সে নিশ্চয়ই কোনো মানসিক রুগী। নাহলে এত নৃশংসভাবে কাউকে মেরে ফেলা সম্ভব নয়।”
-“হুমম। তো এখন কি মনে হচ্ছে আপনার! আমরা এই কেসটা তদন্ত করতে পারবো?”
-“আমার মনে হয় এই কেসটা সিআইডিদের কাছে হস্তান্তর করলে বেশী ভালো হবে স্যার। কারণ গত বছর ঠিক একইভাবে দুইজন লোককে খুন করা হয়েছিল। আর সেই কেসটা সিআইডিরাই তদন্ত করছিল। অবশ্য এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি যে খুনি কে। কিন্তু ওদের জন্য অনেকটা সহজ হবে এই কেস তদন্ত করা।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে আমি কথা বলে দেখছি। আপনি ততক্ষণে আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখুন কিছু জানতে পারেন কি-না।”
-“জ্বি স্যার।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here