“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৫৯
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সন্ধ্যায় জোভান অফিস থেকে বাসায় ফিরলে শারমায়া সাদাতের স্ত্রী আখির সাথে কথা বললো ভিডিও কলে। কথাবার্তা, আচার-আচরণ বেশ ভালো লাগলো শারমায়ার। খুবই আন্তরিক। শারমায়া প্রথমে ভাবি বলে সম্বোধন করছিলো, কিন্তু আখি বলে দিয়েছে তাকে যেন নাম ধরেই ডাকে। আর যাইহোক, শারমায়ার বিয়ে আগে হয়েছে তাই বড় এর সম্মানটা শারমায়াকে দিয়ে রাখলো। অতঃপর মিরাজের কাছে কল করেও তার স্ত্রী, লিসার সাথে ভিডিও কলে কথা বললো। পাশে ছিলো তার কাজিন সিনথিয়াসহ আরও দুজন। সবার সাথেই কিছুটা সময় জুড়ে হাসিঠাট্টা চললো। জোভান রুমে থাকলেও দূরেই ছিলো। তাকে দেখলে অতিরিক্ত দুষ্টুমি করতে পারে এবং শারমায়াকে জেলাসি করে তুলতে পারে তাই সে ক্যামেরার সামনে আসেনি। তার মিষ্টি বউয়ের মিষ্টি মুখখানা দেখতেই তার ভালো লাগে। অযথা অন্যের সাথে গল্প করার মানসিকতা জোভানের মাঝে নেই। কল কেটে শারমায়া দুহাত মেলে আড়মোড়া ভাঙলো। জোভান টি-টেবিলের উপর পা তুলে সোফায় বসে আছে। আড়মোড়া ভাঙতে দেখে শারমায়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“ঘুম থেকে জাগলে নাকি?”
শারমায়া মুচকি হেসে খাটে হেলান দিলো। অতঃপর বললো,
“উহুম, শরীর কেমন যেন ঝিমিয়ে আসছে। চলো না, ছাদ থেকে একটু ঘুরে আসি।”
“এখন ছাদে যাবে? ভাড়াটিয়ারা তো আড্ডা দেয়। চলো, বাইরে থেকে হেটে আসি।”
“তাহলে তো আরও বেশি ভালো হয়। এমনিতেও ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছিলো আজ।”
“তাহলে আগে বললে না, আমি আসার সময় নিয়ে আসতাম।”
“আমি কি জানতাম, তুমি তারাতাড়ি ফিরবে আজ!”
“তাহলে মাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে।”
“ইশ! মাকে বলি কিভাবে! চাচীমা কিংবা আপু থাকলে বলতাম।”
“আহা, কি লজ্জা! আরে বোকা, এটা জানো? আপুর আগে মা যাবে তোমাকে নিয়ে। আপু তার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সময় করে উঠতে পারলে না সময় দিবে তোমাকে। মা তো ফ্রি ছিলেন৷ মায়ের সাথে ইজি হতে না পারলে এভাবে অনেক কিছুই মিস করবে। এসো, যাই তারাতাড়ি। আমি আসার সাথে সাথে বললেও তো হতো৷ এখন ডিনার করারই সময় হয়ে গেছে।”
“থাক তাহলে, অন্য কোনো সময় যাবো।”
“উহুম, এসো। ইচ্ছাকে অবহেলা করতে নেই। প্রয়োজনে একটু লেট করে ডিনার করবো।”
“মায়ের কাছে বলে আসি?”
“আমি বলছি, তুমি রেডি হও।”
জোভান মাকে বলতে চলে গেলো। শারমায়া ঝটপট বোরকা হিজাব পরে নিলো। রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই জুলেখা ইয়াসমিন বললেন,
“ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছিলো, আমাকে বললি না কেন? লজ্জা নিয়ে বসে থাকলে চলবে? আগে বললে তো আমিও উপভোগ করতে পারতাম।”
শারমায়া মুচকি হেসে বললো,
“তাহলে এখন চলো?”
“উহুম। এখন তো যাবো না। তোমার বাবা আসতাছে। ফাঁকা বাড়ি দেখলে আবার ভাববে রাগ করে উনাকে না জানিয়ে চলে গেছি বুঝি বাপের বাড়ি।”
জোভান ও শারমায়া মুখ চেপে হাসলো। এ পরিবারের সদস্যরা হাসাতে পারে বেশ ভালো। জুলেখা ইয়াসমিন বললেন,
“দ্রুত চলে আসিস। বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবি না। দিনের বেলা যত ঘুরার ঘুরবি।”
“আচ্ছা।”
জোভান বললো,
“মা, দূরে নিয়ে যাবো না তো। এদিকেই একটু হেটে চলে আসবো।”
“ফুচকাও খেয়ে আসিস।”
জোভান হেসে বললো,
“তা তো অবশ্যই।”
দুজন বেরিয়ে গেলো ব্যস্ত শহরের জমজমাট সন্ধ্যা পথে। কিছুদূর পরপরই ফুটপাত জুড়ে আসন পেতে বসে আছে বিভিন্ন খাবারের ফেরি। রাস্তায় ধুলাবালির সমাহারের কারণে জোভান রেস্টুরেন্টে ফুচকা খাওয়ার জন্য বলছিলো। কিন্তু রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকার স্বাদ উপভোগ করার মজাটা অন্যরকম, যেটা সজ্জিত রেস্টুরেন্টে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই শারমায়া রাজি হলো না। তারা রাস্তার ধারের ফেরি থেকেই ফুচকা খেয়েছে। অতঃপর হাতে হাত রেখে কদমে কদম মিলিয়ে পথ ধরে দুজন হেটেছে আর গল্প করেছে। ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট বাইরে কাটিয়ে আবার বাড়ি ফিরে এসেছে।
তারপর দিন শারমায়ার বাবা, মা ও চাচা এসেছে তাদের বাসায়, ইফাজের বাসায় যাওয়ার জন্য। তাই জোভান দুপুরের দিকে মিরাজকে অফিসে রেখে চলে এসেছে। শারমায়া বাসায় রইলো। আশরাফ স্যার কলেজে থাকায় জোভান ও জুলেখা ইয়াসমিন সাথে গেলেন। এদিকে শারমায়া সাফওয়ানার সাথে ভিডিও কলে কথা বললো কিছুক্ষণ। সাফওয়ানা ফারিয়া আপুর সাথে ছিলো তাই আপুর সাথেও গল্প করা হলো। কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো মুশলধারে বৃষ্টি। মুহুর্তেই শীতল করে দিলো প্রকৃতি। সাথে ঠান্ডা বাতাস থাকায় শারমায়ার বেশ ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। সে আলমারি খুলে চাদর জড়িয়ে নিলো। পরক্ষণে কিচেনে চলে গেলো কফি বানাতে। কফি তৈরি হয়ে গেলে কফি কাপ নিয়ে রুমে এসে দেখলো বাতাসের গতির ফলে বৃষ্টির পানিতে বারান্দা ভিজে যাচ্ছে। সে পার্টিশনের গ্লাস লাগিয়ে পর্দাগুলো সরিয়ে দিলো। অতঃপর সোফায় বসে গরম কফির কাপ হতে উঠে আসা ধোঁয়াতে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। পরক্ষণে বাইরে তাকিয়ে কফির সাথে বৃষ্টি উপভোগ করতে মনে মনে বললো,
“এই বৃষ্টিভেজা শহরে তোমাকেই যে বেশ পড়ছে মনে। মন্দ হতো যদি তুমিও থাকতে পাশে বসে।”
মাগরিবের দিকে শারমিন কল করে জানালেন উনারা ইফাজের বাসা থেকেই চলে যাচ্ছে। এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে তাই এখন আর তাদের বাসায় আসবেন না। মিনিট দশেক পর জোভান চলে এলো তার মাকে নিয়ে। শারমায়াকে চাদরে জড়িয়ে থাকতে দেখে জোভান বললো,
“শীতকাল চলে এলো নাকি!”
“উহুম, ঠান্ডাকাল এসেছে।”
জোভান তার কপাল গলায় হাত রেখে তাপমাত্রা পরিমাপ করতে করতে বললো,
“জ্বর টর আসেনি তো আবার?”
“উহুম। ঠান্ডা লাগছিলো তাই পড়েছি।”
“আমার তো লাগছে না।”
“তো আমার কি করার? ফ্রিজের পানি এনে ঢেলে দেই?”
“দাও।”
শারমায়া তার হাত থেকে শার্ট নিতে নিতে মুচকি হাসলো। টেবিলে কাপ দেখে জোভান বললো,
“ঠান্ডার প্রকোপে কফি খেয়েছিলে?”
শারমায়া কাভার্ড থেকে টিশার্ট, প্যান্ট নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“হুম। আজ খুব মিস করছিলাম যে তোমাকে।”
জোভান প্রথমে তার কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিলো, তারপর বললো,
“কারণ কি?”
“বৃষ্টিস্নাত মুহূর্ত।”
“ওফ্ফ! ইফাজ আমার এতোবড় ক্ষতি করে দিলো!”
“কি করেছে?”
“তার জন্যই তো তোমাকে মিস করতে হলো।”
“এই ব্যাপার! আমি তো ভাবলাম কি না কি!”
জোভান দু’হাতে শারমায়াকে জড়িয়ে আরও কাছে টেনে বললো,
“ব্যাপারটা তোমার কাছে সাধারণ!”
“ইশ! কতো ঢং! এতো ঢং কোথা থেকে পাও শুনি?”
“টুকটুকির আম্মুর আস্কারা থেকে।”
“তাই?”
“ডেফিনিটলি।”
শারমায়া টিশার্টে তার মাথা ঢুকিয়ে দিতে দিতে বললো,
“আব্বু আম্মু কি বললো?”
“পরে জানাবেন। মেবি গ্রিন সিগন্যাল। যদি গ্রিন সিগন্যাল কনফার্ম হয়, তুমি কিন্তু মা-বাবাকে রাজি করিয়ে নিয়ো ৯ জুন এর জন্য।”
“ডেট তো বরপক্ষই ফিক্সড করবে।”
“উনারা তো বলবেই। তবুও কোনো কারণে মতামতের অভিন্নতা হতে পারে না? তাই এদিকটা একটু তুমি সাপোর্ট করবে।”
“তুমিও তো থাকবেই। তোমার মতামত না নিয়েই কি আব্বু মত দিবে?”
“আমি তো থাকবোই এবং বলবোও। তারপরও বাবা কোনো কারণ দেখালে তো আমার পক্ষে জোর করাটা সম্ভব হবে না। উনারা তো আর জানেন না আমাদের এনিভার্সারি মিশনের কথা। তবে এমন কিছু হলে তুমি জোর দেখাতে পারবে। তাই বলছি।”
“আচ্ছা, পরেরটা পরে দেখা যাবে। টিশার্ট কি গলায়ই ঝুলিয়ে রাখবে?”
“তুমি চাইলে কেন নয়?”
“পরো! আর আমাকে ছাড়ো। খাবারগুলো গরম করে ফেলি। নষ্ট হয়ে যাবে নয়তো। চাচ্চুরা তো আগামীকাল আসছে, তাই না?”
“হুম।”
শারমায়ার পরিবার থেকে সিগন্যাল গ্রিনই এলো। রহমতের প্রথম দিন অর্থাৎ প্রথম রমজানে জোভানের পরিবার থেকে এতিমখানায় ইফতার দেওয়া হলো। পঞ্চম রমজানে আত্মীয়স্বজন দাওয়াত করা হলো। শারমায়াদের পরিবার থেকে শারমায়ার বাবা মা এসেছে কিন্তু সাফওয়ানা আসেনি। কারণ সে জানে এখানে ইফাজ ও তার পরিবার থাকবে। তাই শারমায়া বারবার বলার পরও সে এলোই না। রোযা রেখে সারাদিন কাজে ব্যস্ত থেকে এক প্রকার হাপিয়ে গেছে শারমায়া, তানহা ও জুলেখা ইয়াসমিন। আর জেভা তো বাচ্চা নিয়ে এমনিতেই ব্যস্ত! তারউপর তাদের কাজকর্ম এগিয়ে দেওয়া। আসরের পর থেকে মেহমান আসতে লাগলো। মোটামুটি বড়সড় এক ইফতার আয়োজন হয়ে গেলো। কলেজের প্রিন্সিপালের পরিবারও উপস্থিত ছিলেন। শারমায়ার বেশ অস্বস্তি লাগছিলো। কিন্তু জোভানের পরিবারের সাথে প্রিন্সিপালের পরিবারের আন্তরিকতা দেখে শারমায়া মুগ্ধ। ইফতার ও ডিনার করে একে একে মেহমান চলে গেলো। বাবা-মা চলে যাওয়ার সময় চাইছিলেন শারমায়া সাথে যাক। সারাদিন কাজকর্ম করে শরীর যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। এখন যেতে হলেও কত গোছগাছ করতে হবে। তাছাড়া এলোমেলো আসবাবপত্র না গুছিয়ে এভাবে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই শারমায়া নিজেই নিষেধ করে দিলো আজ যাবে না। কাল বা পরশু জোভান নিয়ে যাবে।
মেহমান চলে গেলে জুলেখা ইয়াসমিনের নির্দেশনা মতে কাজ একপাশে চাপিয়ে সকলেই বিশ্রামের জন্য চলে গেলো। সারাদিন সকলের উপরই ধকল গিয়েছে। শারমায়ার চেহারায় ক্লান্তি ভেসে উঠেছে স্পষ্টভাবে। সে রুমে এসে হাতমুখ ধুয়ে এলে জোভান তাকে শুতে নিষেধ করলো। শারমায়া কারণ জানতে চাইলে সে জবাব না দিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে তেল নিয়ে এলো। শারমায়া বললো,
“বাহ! তুমি দিয়ে দিবে নাকি?”
জোভান মুচকি হেসে বললো,
“আমার টায়ার্ডনেস তুমি দূর করতে পারলে, তোমার বেলায় আমি কেন নয়?”
শারমায়া মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো চুপচাপ। জোভান দু’হাতে শারমায়ার মাথা মেসাজ করে দিতে লাগলো। দু-তিন মিনিট অতিক্রম হতেই শারমায়া তাকে থামিয়ে দিতে হুট করেই জড়িয়ে ধরে বললো,
“যথেষ্ট হয়েছে। আমার টায়ার্ডনেস দূর হয়ে গেছে।”
“এতো দ্রুত!”
“হুম। ভালোবাসি প্রিয়। প্রতিটি মেয়ের জীবনে তোমার মতো একজন ভালোবাসা থাকুক।”
তার হুটহাট কর্মে মুচকি হেসে জোভান তেলমাখা হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু একে বললো,
“প্রতিটি মেয়েও তোমার মতো হোক। ভালোবাসি, জান।”
শারমায়া তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“এক মিনিট। আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছো?”
“আসছি, বললাম তো।”
শারমায়া কাভার্ড খুলে কিছু নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। জোভান তেলের কৌটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে টিস্যু নিয়ে হাত মুছে নিলো। শারমায়াকে প্লাজুর সাথে টিশার্ট পরে বের হতে দেখে জোভান অবাক হয়ে তাকালো! এটা সেই লাল টিশার্ট, যেটা ইংল্যান্ডে শারমায়াকে দিয়ে এসেছিলো। শারমায়া লজ্জিত হেসে দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে বললো,
“একদম লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা করবে না।”
জোভান তার নিকটে এগিয়ে যেতে যেতে শব্দযোগে হেসে বললো,
“লজ্জা আমি কি দিবো, এমনিতেই তো রঙিন হয়ে উঠেছো! টুকটুকির আম্মু, ইউ আর ব্লাশিং।”
জোভান হাত বাড়াতেই শারমায়া তাকে বাঁধা দিয়ে বললো,
“শাট আপ! কোলেও নিবে না।”
জোভান তাকে হেচকা টানে বুকে বেঁধে বললো,
“কোথায় দৌড়ে চলে আসবে, তা নয়! আমাকেও আটকে দেয়! এতো বাঁধা মানবো নাকি আমি? কখনোই না। এখনো রেখে দিয়েছো এটা?”
“হুম। এখানে আসার পর সেই যে গুছিয়ে রেখেছি, গত দিনগুলোতে ভুলেই গিয়েছিলাম এটার কথা। গতকাল আলমারি গুছানোর সময় চোখে পড়লো। ইংল্যান্ডে অসংখ্যবার এটা পরেছি। এখনো ঠিক ততোটাই প্রিয়, যতটা প্রিয় তখন ছিলো।”
“আচ্ছা? আর আমি কতটা?”
“যতটা প্রিয় হলে ভালোবাসার চূড়া পরিপূর্ণ হয় ঠিক ততটা।”
“আলহামদুলিল্লাহ।”