#বিবর্ণ_জলধর (০৪)
#লেখা: ইফরাত মিলি
__________________
বাংলাদেশ আসার পরদিন আষাঢ় কারিবকে নিয়ে কক্সবাজার ছুটে গেছে। তিনদিন কাটিয়েছে সেখানে। কবির সাহেব এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। ছেলেটা বাংলাদেশ এসেই কক্সবাজার ছুটে গেল কেন?
কক্সবাজার থেকে আষাঢ়, কারিব ফিরে আসার পর, কবির সাহেব কারিবের কাছ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে কারিব বললো,
“আষাঢ় ভাইয়ের মাঝে হঠাৎ দেশপ্রেম জেগে উঠেছিল। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের কোনো এক সুন্দর জায়গা ঘুরতে যাবেন। সমুদ্র সৈকতের মতো সুন্দর জায়গা কি আর দ্বিতীয়টি হয়? সে জন্য তিনি ঠিক করলেন, সমুদ্র ঘুরতে যাবেন। এই যা।”
কবির সাহেব সহজে বিশ্বাস করলেন না,
“এর মাঝে অন্য কোনো কিন্তু নেই তো?”
“বিলকুল না মামা। আষাঢ় ভাই শুধু সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতেই গিয়েছিলেন। আর কিছু না।”
কবির সাহেব বিশ্বাস করতে পারলেন না। কিন্তু কারিব তাকে মিথ্যা বলবে এমনটাও ভাবলেন না তিনি। অর্ধ বিশ্বাস এবং অর্ধ সন্দেহ নিয়ে থাকতে হলো তাকে।
______________
বিছানার নরম কোলে গা ডুবিয়ে ঘুমিয়ে আছে আষাঢ়। উপুড় হয়ে শোয়া। সারা বিছানা ছেড়ে বিছানার এক কর্ণারে এসে পড়ে রয়েছে। মুখটা কাত হয়ে থাকায় একপাশ সদৃশ্যমান। বাইরে বৃষ্টির রিমঝিম ধারা ঝরছে অনর্গল। কাচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের পরিবেশে ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা ভাব। গতকাল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই ঘুম দিয়েছে আষাঢ়। আর সেই ঘুম এখনও অটল। কারিব দাঁড়িয়ে আছে আষাঢ়ের থেকে একহাত পরিমাণ দূরত্ব রেখে। কিছুক্ষণ আষাঢ়ের ঘুমন্ত মুখখানিতে তাকিয়ে থেকে অতি মৃদু, আদুরে কণ্ঠে ডাকলো সে,
“আষাঢ় ভাই! আষাঢ় ভাই, উঠবেন না?”
আষাঢ় কোনো সাড়া দিলো না। আষাঢ়ের কানে তার ডাক পৌঁছেছে কি না সে বিষয়েই দ্বিধান্বিত কারিব। সে আরেকটু নিকটে এসে দাঁড়িয়ে ফের ডাকলো,
“আষাঢ় ভাই, ওঠেন। দেখা করতে যাবেন না?”
আষাঢ়ের থেকে এবার ঘুমু ঘুমু আহ্লাদী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“উহ কারিব, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি প্লিজ। আমাকে ঘুমাতে দাও। বিরক্ত করো না।”
আষাঢ়ের ঘুমু ঘুমু আহ্লাদী কণ্ঠ শুনে কারিব একটু হাসলো। হাস্যজ্জ্বল মুখে বললো,
“ঘুমালে হবে না তো আষাঢ় ভাই। আপনার গার্লফ্রেন্ড এসে তো অপেক্ষা করছে। তার সাথে দেখা করতে যাবেন না?”
আষাঢ় আগের ন্যায় কণ্ঠের রেশ রেখে বললো,
“তুমি যাও কারিব। গিয়ে বলো, ‘তোমার প্রেমিক পুরুষ ঘুমাচ্ছে’।”
কারিব হাসিটা আগের থেকে আরেকটু চওড়া করে বললো,
“আমি গেলে কি হবে? আপনাকেই যেতে হবে। আজ আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে লাস্ট মিট করবেন, ভুলে গেছেন?”
বন্ধ আঁখির ঘুমে মত্ত আষাঢ় এবার নড়েচড়ে উঠে বসলো। নিভু নিভু চোখ মেলে তাকালো কারিবের দিকে।
কারিব হাতের ঘড়ি দেখে নিয়ে বললো,
“আমাদের দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল ন’টায়। এখন দশটা পাঁচ বাজে। আমরা অনেক লেট করেছি। আপনার গার্লফ্রেন্ড হয়তো ক্ষুব্ধ।”
আষাঢ় বেড থেকে নামতে নামতে বললো,
“ক্ষুব্ধ? আমাকে দেখার পর ওর ওই ক্ষুব্ধ মুখ আর থাকবে না কারিব। হাসির ঝিলিক খেলবে ওর মুখে। কিন্তু ওর হয়তো জানা নেই, ওর ওই হাসির ঝিলিক ঘেরা মুখটা আমি আঁধারে ছেয়ে দেবো। ওর আঁধারে ছেয়ে যাওয়া মুখের জন্য ও নিজেই দায়ী। আমার প্রতি এত পাগল হওয়া উচিত হয়নি ওর।”
______________
আজকে শুক্রবার। কবির সাহেব বাড়িতে আছেন। ল্যাপটপে মনোযোগ তার। সিঁড়ি থেকে কারিব এবং আষাঢ়ের নেমে আসার গটগট শব্দ হতে তিনি চশমার ভিতর থেকে আড়চোখে তাকালেন একবার। দেখেই বুঝলেন ওরা দুজন বাইরে যাচ্ছে।
“কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”
কবির সাহেবের প্রশ্নে হোঁচট খেলো কারিব। জায়গাতেই তার পা স্থির হয়ে গেল। কারিবের চেহারায় ক্ষণিকের জন্য বিচলিত একটা ভাব দেখা দিলেও, আষাঢ়ের চেহারাতে তা দেখা গেল না। আষাঢ় ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে কেমন টানা টানা সুরে বললো,
“কারিব, আমরা যেন কোথায় যাচ্ছি?”
কারিব একগাল হাসলো। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিয়েছে সে। কবির সাহেবকে উত্তর দিলো,
“আমরা চিড়িয়াখানা যাচ্ছি মামা।”
“চিড়িয়াখানা?” কবির সাহেবের কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়লো।
“হ্যাঁ মামা। চিড়িয়াখানায় নতুন একটা বাঘ এসেছে। আষাঢ় ভাই গত রাতে বললেন, সে নতুন বাঘটা দেখতে চায়। তাই এখন বাঘ দেখার উদ্দেশ্যেই যাচ্ছি আমরা।”
কারিবের কথা শুনে মনে মনে হাসলো আষাঢ়। কারিব বুদ্ধিমান একটা ছেলে। এই জন্যই কারিবকে তার এত পছন্দ। এত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে ছেলেটা! সত্যিই মনোমুগ্ধকর! আষাঢ় সিঁড়ির অবশিষ্ট ধাপগুলো পার করে লিভিং রুমে পা রাখলো। কারিবও তার পা দুটো সচল করে ওর পিছন পিছন নেমে এলো।
“বাঘ আবার দেখতে যাওয়ার কী আছে? জীবনে কি আর চিড়িয়াখানা গিয়ে বাঘ দেখেনি?”
বাবার কথার জবাবটা এবার আষাঢ় নিজে দিলো,
“অনেক দেখেছি আব্বু, কিন্তু সেটা ছোট বেলায়। ছোট বেলায় বাঘ দেখা, আর বড়ো হয়ে বাঘ দেখার মাঝে অনেক পার্থক্য। এটা তুমি বুঝবে না।”
আষাঢ় কারিবকে তাগাদা দিয়ে বললো,
“কারিব, দ্রুত চলো। তাড়াতাড়ি না গেলে হয়তো ক্ষুব্ধ বাঘটা আরও বেশি ক্ষেপে যাবে।”
দুজন বেরিয়ে গেল।
রুপালি সব কথোপকথন শুনেছে দূরে দাঁড়িয়ে। সে কবির সাহেবের নিকটে এসে জানান দিলো,
“স্যার, আপনারে মিছা কইছে ওরা। আমি শিওর ওরা কোনো বাঘ দেখতে যাচ্ছে না। অন্য কোথাও যাচ্ছে।”
“অন্য কোথাও আর কোথায় যাবে রুপালি? কারিব কি আর মিথ্যা বলবে আমাকে?”
“আপনি তো কারিবরে চিনেন-ই না। ও হলো শয়তানের ছুডুু ভাই। ওর ভিতরে ভিতরে শয়তানি। আষাঢ়েরে নিয়া অন্য কোথাও যাচ্ছে ও। ও আপনার অনুগামী না, ও আপনার ছেলের অনুগামী।”
রুপালির কথা ভালো লাগলো না কবির সাহেবের। কারিব তাকে মিথ্যা বলবে এটা তার কাছে বিশ্বাস করা কষ্টকর। ছোট বেলা থেকে কারিব তার সব কথা শোনে। সে যেটা করতে নিষেধ করেছে, কারিব সেটাই করা বন্ধ করেছে। দুই ছেলের থেকে কারিব তার বেশি বাধ্য ছিল, এবং এখনও আছে। কবির সাহেব রুপালির কথার কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে রুমের দিকে গেলেন সোজা।
______________
নিজের এমতা অধঃপতন দেখে কারিব মনে মনে লজ্জিত। আষাঢ়ের জন্য সে এরকম মিথ্যা আরও অনেক বলেছে। মাঝে মাঝে তার খুব অবাক লাগে! প্র্যাকটিস ছাড়াই এত সুন্দর মিথ্যা বলতে কী করে শিখলো? প্র্যাকটিস ছাড়াও যে এত সুন্দর করে কিছু আয়ত্ত করা যায়, এটা জানতো না সে।
বৃষ্টি থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে। বৃষ্টি থামার পর প্রকৃতি ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। আকাশের গুরুগম্ভীর ভাব কেটে গিয়ে এখন রূর্যকিরণের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। কারিবদের গাড়িটা এখন মিরপুরের দিকে এগিয়ে চলছে। আষাঢ়ের গার্লফ্রেন্ড সাদিয়া মিরপুরের অধিবাসী। মিরপুরের একটা ক্যাফেতে আজ দেখা করার কথা। সামনা সামনি এর আগে শুধু একবার দেখা হয়েছিল দুজনের। যেদিন প্রথম বাংলাদেশ এসেছিল সেদিন মিরপুরে গিয়ে দেখা করেছিল কারিবকে সাথে নিয়ে। আমেরিকা থাকতে ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল সাদিয়ার সাথে। পরিচয় থেকে ধীরে ধীরে এটা প্রণয়ের দিকে গড়ায়। আজ দ্বিতীয় দেখা সাদিয়ার সাথে, আর এটাই শেষ। সাদিয়া এটা আজ ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না যে তার প্রেমিক আজ শেষ দেখা করতে এসেছে তার সাথে। টেরটা ধীরে ধীরে পাবে। যখন ফোনে পাবে না প্রেমিককে, কোনো খোঁজ থাকবে না প্রেমিকের, তখন দিশেহারা হয়ে পড়বে। প্রেমিকের বাড়িতে এসে যে প্রেমিকের খোঁজ নেবে সেটাও পারবে না। সে পথ খোলা রাখেনি আষাঢ়। সে এত বোকা নয় যে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে বাড়ির ঠিকানা দেবে।
“কক্সবাজারের মেয়েগুলো খুব জ্বালা দিচ্ছে কারিব। কালকে বাসায় ফেরার পর তিন জনের একাধিক বার কল দেওয়া হয়ে গেছে। ওরা এতটা ত্যাদড় জানলে কক্সবাজার পা রাখতাম না আমি। গত রাতে আমার শান্তির ঘুমটাকে বিনষ্ট করেছে ওরা।”
কারিব ঠোঁটে মুচকি হাসি ধরে তাকালো আষাঢ়ের দিকে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সৌভাগ্য হলো না। দ্রুত আবার সামনে দৃষ্টি ফেলতে হলো। বাংলাদেশ আসার পরের দিন আষাঢ়ের কক্সবাজার যাওয়ার মূল কারণ ছিল ‘রাহমা’। ইন্সট্রাগ্রামে প্রথম পরিচয় হয়েছিল রাহমার সাথে। রাহমাকে সামনা সামনি দেখার জন্য কক্সবাজার গিয়েছিল। কক্সবাজার গিয়ে রাহমার পাশাপাশি আরও দুই সুন্দরীকে ভুলিয়েছে নিজের প্রেমে। তিন দিনে রাহমাসহ তিন প্রেমিকা তৈরি করেছে। কিন্তু এখন যে এই তিন প্রেমিকার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে আষাঢ়ের জীবনে, সেটা খুব সহজে ধরতে পারলো কারিব। তবে আষাঢ়ের প্রতি একটা বিষয়ে সে খুব গর্বিত। আষাঢ়ের মেয়েদের প্রতি ঝোঁক থাকলেও কোনো মেয়ের সাথে আজ পর্যন্ত খারাপ কিছু করেনি। ফোনে একটু-আধটু কথা বলা, চ্যাটিং করা, দেখা করা এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কারিব নরম কণ্ঠে জানতে চাইলো,
“এখন কী করবেন? ওই তিন প্রেমিকার জ্বালা থামাবেন কী করে?”
আষাঢ় মোবাইল থেকে সিম কার্ড বের করে দুই আঙুলে সিমটা চাপ দিয়ে মাঝখান থেকে ভেঙে ফেললো। তা লক্ষ্য করে কারিব বললো,
“এতটা রুড সাজা কি ঠিক হলো আষাঢ় ভাই? শত হলেও ওনারা আপনার প্রেমিকা ছিল। ফোন করে আপনাকে না পেলে তো ওনাদের মানসিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।”
“উহ কারিব প্লিজ! ওদের জন্য দরদ দেখিয়ো না তুমি। ওরা আমার ঘুমে ডিস্টার্ব করেছে। জানোই তো, যার তার ডিস্টার্ব আমি সহ্য করতে পারি না। আমার ঘুমে ডিস্টার্ব করার জন্য এই শাস্তিই প্রাপ্য ছিল ওদের।” আষাঢ়ের কণ্ঠে কিছুটা রাগ, কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ পেল।
আষাঢ়ের বিরক্তি মেশানো কথা শুনে কারিব হাসলো। আষাঢ় যখন বিরক্তি নিয়ে কিছু বলে ভালোই লাগে তার।
“আর তাছাড়া তুমি তো জানোই, বাংলাদেশের মেয়েদের বেশিদিন নিজের প্রেমিকা পরিচয়ে রাখা পছন্দ করি না আমি।”
“কিন্তু ওনাদের ক্ষেত্রে সময়টা খুব কম হয়ে গেল না? মাত্র তিনদিন। কম করে হলেও তো পাঁচ দি…”
“নতুন সিম কার্ড দাও আমাকে।” কারিবের কথার মাঝে কথা বলে কারিবকে থামিয়ে দিলো আষাঢ়।
কারিব একহাত স্টিয়ারিংএ রেখে আর একহাত দিয়ে পকেট থেকে একটা ছোট বক্স বের করে আষাঢ়ের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আষাঢ় বক্সটি খুললো। বক্সের ভিতর গ্রামীণ, বাংলালিংক, রবি, এয়ারটেল ইত্যাদি সিম আছে। আষাঢ় একটা রবি সিম তুলে নিলো। সিমটা ঢুকালো মোবাইলে। আষাঢ় বাংলাদেশ আসার আগেই কারিব আষাঢ়ের জন্য একাধিক সিম কার্ড কিনে রাখে। আষাঢ় বাংলাদেশ এসে ক্ষান্ত থাকে না। বিভিন্ন অঞ্চলের মেয়েদের নিজের প্রেমিকা বানানোতে ব্যস্ত হয়। তবে এই প্রেমিকারা আষাঢ়ের জীবনের খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ। প্রেমিকা বানানো, প্রেমিকাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা, এসব তার কাছে টাইম পাসের একটি মাধ্যম ছাড়া আর কিছু না। বাংলাদেশি কোনো প্রেমিকাই আষাঢ়ের দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারো সাথে পাঁচদিন, কারো সাথে দশ দিন, আর যারা একটু বেশি সুন্দরী তাদের সাথে বড়ো জোর পনেরো দিন রিলেশন থাকে তার। এরপর কেউ আর তাকে খুঁজেও পায় না। আষাঢ়ের এ যাবৎ যত গার্লফ্রেন্ড ছিল বা আছে তারা সবাই-ই ঢাকার বাইরের। ঢাকার ভিতর দুই কি তিনজন মেয়ে তার প্রেমিকা লিস্টে আছে। এর ভিতর দুজনের সাথে তার সম্পর্ক গত হয়েছে। বর্তমানে একজন আছে, সাদিয়া। সাদিয়ার সাথেও আজকে সব শেষ।
আষাঢ় ভুল করেও আজ পর্যন্ত কোনো গার্লফ্রেন্ডকে বাড়ির ঠিকানা বলেনি। কোন বিভাগ, কোন জেলা, কোন এলাকা কিছুই না। যারা জানতে চেয়ে একটু বেশিই আগ্রহ দেখিয়েছে তাদের সাথে ওখানেই সম্পর্ক স্থগিত করে দিয়েছে। আমেরিকাতেও আষাঢ়ের গার্লফ্রেন্ডের অভাব নেই। সেসব গার্লফ্রেন্ডদের সাথেও তার সম্পর্ক টিকে অল্প সময়ের জন্য। তবে বাংলাদেশি মেয়েদের থেকে একটু দীর্ঘ সময়। স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ডের পাশাপাশি আষাঢ়ের স্থায়ী গার্লফ্রেন্ডও আছে আমেরিকাতে। খুব বাছাই করে স্থায়ী গার্লফ্রেন্ড তৈরি করেছে সে।
আষাঢ়ের সবচেয়ে বড়ো গুণ হলো সে অল্পতেই মেয়েদেরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। যেসকল মেয়ে আষাঢ়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সেসব মেয়েদেরকে কারিবের কাছে বড্ড বোকা মনে হয়। কারণ, আষাঢ় যেভাবে মেয়েদের সাথে ভাব জমায়, তাতে বোঝাই যায় ওটা প্রকৃত কোনো অনুভূতি থেকে করে না সে। পুরোটাই ফেইক। তবুও মেয়েরা কেমন যেন অবুঝের মতো পটে যায়। ওইসব মেয়েদের জন্য কারিবের খুব আফসোস হয়। এখনই সে মনে মনে একবার আফসোস প্রকাশ করলো। তারপর বললো,
“আপনি তো বলেছিলেন আগের থেকে এবার বেশিদিন থাকবেন বাংলাদেশ। ঠিক কত দিন থাকবেন সেটা বলেননি। কতদিন থাকবেন এবার?”
আষাঢ় স্পষ্ট উত্তর দিলো,
“ছয় মাস।”
কারিবের দু চোখে হঠাৎ বিস্ময় প্রবাহমান হলো। পাশ ফিরে বিস্ময়ান্বিত চোখ দিয়ে আষাঢ়কে দেখে নিলো একবার। আষাঢ় এর আগে বাংলাদেশ এসে তিন মাসের বেশি থাকেনি। কারণ, সে বাংলাদেশ এলে ওদিকে আমেরিকাতে তার গার্লফ্রেন্ডদের হায়-হুতাশ শুরু হয়ে যায়। গার্লফ্রেন্ডদের রেখে বাংলাদেশ এসে বেশিদিন থাকে না তাই।
“আপনি তো বলেন বাংলাদেশ এলে আপনার স্থায়ী গার্লফ্রেন্ডরা আপনাকে খুব মিস করে, পাগল প্রায় হয়ে যায় আপনার জন্য, আপনিও ওনাদের কষ্ট হয় বলে তিন মাসের বেশিদিন থাকেন না বাংলাদেশ। তাহলে এবার ছয়মাসের এত দীর্ঘ মেয়াদে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে?”
“গার্লফ্রেন্ডদের জন্যই তো থাকবো কারিব। আমার ওই পাঁচ স্থায়ী গার্লফ্রেন্ডকে শিক্ষা দেবো আমি।”
কারিব অবাক হয়ে বললো,
“গার্লফ্রেন্ডদের শিক্ষা দেবেন মানে?”
“হ্যাঁ, শিক্ষা দেবো। দুই তিন মাস ধরে আমি লক্ষ্য করছি আমার পাঁচ স্থায়ী গার্লফ্রেন্ড আমার কথার অবাধ্য হয়ে পড়েছে। আমি যেটা বলি তারা কেমন যেন তার বিরুদ্ধে কথা বলে। ঠিক এই কারণে…এই কারণে আমি এবার ছয়মাস থাকবো বাংলাদেশ। ওই পাঁচ প্রেমিকাকে মজা বোঝাবো আমি। ফোন করে যখন আমেরিকা ফিরে যাওয়ার জন্য আকুতি-মিনতি করবে, তখন একটিবার ওদের আকুতি-মিনতিতে সায় দেবো না। দীর্ঘ ছয়মাস আমাকে ছাড়া কাটাক ওরা। তাহলেই একটা শিক্ষা হবে। আমার জন্য কান্নাকাটি করবে ওরা। তবুও ফিরবো না আমি। উচিত একটা শিক্ষা হবে।”
“এতটা কঠিন হবেন আপনি? ওনারা তো আর আপনার স্বল্প সাময়িক প্রেমিকা নয়। স্থায়ী। স্থায়ী প্রেমিকাদের সাথে কি এতটা কঠিন হওয়া উচিত?”
“অবশ্যই উচিত।”
“হোক আপনি তাদের মন থেকে ভালোবাসেন না। কিন্তু এত বছরের রিলেশন…আমার মনে হয় তাদের প্রতি এতটা রুড হওয়া উচিত হবে না আপনার।”
“বলছো?”
“হুম।”
কারিবের কথা আষাঢ়কে ভাবনায় ফেললো। মন থেকে প্রেমিকাদের ভালো না বাসলেও, এই পাঁচ স্থায়ী প্রেমিকাদের প্রতি তার আলাদা মায়া আছে। প্রেমিকাদের কষ্ট দিতে তার নিজেরও কষ্ট হয়। যদিও প্রেমিকাদের সব বাসনা সে পূর্ণ করে না। তাও প্রেমিকাদের টানা একটা দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে সে মানিয়ে ফেলে। কিন্তু এবার কী করবে? যদি ছয় মাসের আগে ফিরে যায় তাহলে তো প্রেমিকারা আবার মাথায় উঠে যাবে। না, সে তো ফিরবে না ছয় মাসের আগে। শুধু ফোনে যতটা রুড ভাবে কথা বলতে চাইছিল, সেটা কমিয়ে দেবে।
_______________
রুমকির সাথে শ্রাবণের সব রকম দেখা সাক্ষাৎ, যোগাযোগের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বাবাকে শ্রাবণের খুব ভয়। ভয়ে পড়ে আজ পর্যন্ত বাবা যা বলেছে সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। কিন্তু এটা পালন করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। সকলের অগোচরে আজ রুমকির সাথে দেখা করতে এসেছে সে। এ ক’দিনে রুমকির সাথে দেখা হয়নি তার। ফোনে কথাও হয়েছে খুব কম। রুমকি ফোন দিতো অনেক, কিন্তু সে বলার মতো পেতো না কিছু। অনেক সময় কল রিসিভও করতো না। এ নিয়ে রুমকি খুব রাগ। শ্রাবণের বিয়ের কথাবার্তা চলছে বাড়িতে এটা এখনও জানে না রুমকি। শ্রাবণ জানানোর সাহস পায়নি। মিহিকের বাড়ি থেকে এখনও সরাসরি কোনো উত্তর আসেনি। তারা ভেবে দেখার জন্য সময় চেয়েছে। মিহিকের ফ্যামিলি হ্যাঁ বলে দিলেই বিয়ে হয়ে যাবে শীঘ্রই। এই বিয়ে বিয়ে নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় শ্রাবণের অবস্থা খুব খারাপ। মানসিক অবস্থা শঙ্কিত। কোনো কিছুতেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না সে। এই তো এখনই, রুমকির সাথে দেখা করতে এসে পাণ্ডুরে মুখ করে, শূন্য দৃষ্টিতে চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে।
শ্রাবণকে এরকম দেখে রুমকি প্রচণ্ড রাগান্বিত। শ্রাবণের ফ্যাকাসে মুখের দিকে কিছুক্ষণ নীরব তাকিয়ে থেকে বললো,
“তোমার হয়েছে কী?”
রুমকির প্রশ্নে শ্রাবণের ভাবনার খুঁটি নড়লো। শুকনো মুখে বললো,
“না, কিছু হয়নি।”
“সত্যি করে বলো কী হয়েছে? কদিন ধরেই দেখছি তোমার এমন অবস্থা। ফোন দিলে ফোন ধরো না, দেখা করো না আমার সাথে। এরকম কেন করছো? আমাকে ভালোবাসার হাউশ কি মিটে গেছে তোমার?”
রুমকির কথায় শ্রাবণ ভীষণ রকম আহত হলো। আহত কণ্ঠে বললো,
“তুমি এমন করে কেন বলছো?”
“তো কী রকম করে বলবো? শোনো, আমার সাথে এরকম ভাবে থাকবে না একদম। গম্ভীর মানুষ আমার দুই চোক্ষের বিষ। কী হয়েছে সেটা খোলাসা করে বলো।”
বলে দেবে না কি রুমকিকে? না, পারবে না। রুমকিকে নিজের বিয়ের কথা বলার সাহস তার নেই। আর তাছাড়া বাবাও নিষেধ করে দিয়েছে। এখন রুমকিকে বলে দিলে রুমকি যদি কোনো ঝামেলা করে, তাহলে রুমকির তো কিছু হবে না। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া তো হবে তাকে। না বলবে না রুমকিকে। রুমকি এটা জানার পর শান্ত থাকবে না। এই বিয়ে ভাঙতে অন্য কোনো পথ অবলম্বন করতে হবে। আর এ পথ একা নিজেরই খুলতে হবে।
“আবার কোন ভাবনায় ডুবে গেছো তুমি?”
রুমকির কণ্ঠ বজ্রপাতের মতো এসে কানে লাগলো। শ্রাবণ অতি কষ্টে মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“না, কিছু না। চলো, বাড়ি ফিরি এখন।”
“পার্কে এসে বসেছি আধ ঘণ্টাও হয়নি। এখনই বাড়ি চলে যাব? বাড়ি নয়, শপিংএ চলো।”
শ্রাবণ এমনিতেই কোনো কিছুতে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না, শপিংএ যাওয়া এখন তার পক্ষে সম্ভব নয়। বললো,
“আমি এখন শপিংএ যেতে পারবো না, আমার জরুরি কাজ আছে। তুমি একা চলে যাও।”
শ্রাবণ রুমকির হাতে শপিং করার টাকা দিয়ে চলে গেল।
________________
মিহিক শ্রাবণকে বিয়ে করতে চায় না, এ কথাটা কালক্রমে এসে লায়লা খানমের কানে পৌঁছেছে। রুপালি তাকে জানিয়েছে কথাটা। রুপালি সবার উপরই নজর রাখে। সব বিষয়ের প্রতি তার আগ্রহ একটু বেশি। মিহিকের বাড়ির উপরও সে নজর রাখছিল। ওই বাড়ির মানুষদের যাচাই করছিল। তাতেই বুঝলো।
কথাটা জেনে লায়লার খারাপ লেগেছে খুব। যদিও মিহিকদের বাড়ি থেকে বিয়ের ব্যাপারে সরাসরি হ্যাঁ অথবা না কোনো উত্তরই আসেনি। তারা ভাবার জন্য সময় চেয়েছে। কিন্তু যেখানে মেয়ে রাজি নয়, সেখানে কি মেয়ের ফ্যামিলি বিয়ে দেবে?
মিহিককে মন থেকেই ঘরের বউ করে আনতে চায় লায়লা। রুমকির হাত থেকে ছেলেকে বাঁচাতে হলে মিহিকের সাথে শ্রাবণের বিয়ে হওয়াটা খুব জরুরি। না, মিহিকের সাথে শ্রাবণের বিয়েটা ভেঙে যেতে দিতে পারে না সে। বোঝাতে হবে। মিহিক শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী মেয়ে। বোঝালে নিশ্চয়ই বুঝবে।
লায়লা বিকেলে একবার মিহিকদের বাড়িতে গেলেন। উদ্দেশ্য, তার ছেলেকে যেন বিয়ে করে সেজন্য মিহিকের কাছে আবদার করবে। রুমকি ভালো মেয়ে নয়। ও মেয়ের সাথে তার ছেলে কোনোদিন সুখী হতে পারবে না। অমন মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে হোক জেনেশুনে এটা কোনো মা-ই চায় না। মিহিককে সে ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করেছে। শ্রাবণের বিয়ে মিহিকের সাথে হোক এটাই তার চাওয়া। কিন্তু মিহিককে বোঝানোটা সহজ হবে কি না এ নিয়ে চিন্তিত সে।
(চলবে)