বিবর্ণ জলধর পর্ব:১১

0
1124

#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১১
_____________

“পনেরো বছর বয়সে আমার চেহারা যেমন ছিল, এখন কি তেমন নেই? খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে কি আমার চেহারায়?”

প্রশ্নটা করতে করতে এক টুকরো পরোটা মুখে পুরলো আষাঢ়।

কারিব জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো,
“চেহারা পরিবর্তন হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। চোখ, কান, নাক চেহারার গঠন সবই তো আগের মতো।”

“এক্সাক্টলি, সবই তো আগের মতো। পরিবর্তন হলে একটু আধটু হয়েছে। তাই বলে কি আমাকে চেনা যাবে না? আমার যখন পনেরো বছর বয়স সে সময় যদি তুমি আমাকে দেখে থাকো, আর এতগুলো বছরে যদি আমাদের আর দেখা না হয়, তাহলে তুমি কি আমাকে চিনতে পারতে না?”

“হ্যাঁ, চিনতাম না কেন? অবশ্যই চিনতাম। আপনার চেহারার তো খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। পনেরো বছর বয়সে যেমন ছিলেন, এখনও তো তেমনই ছাপ আছে আপনার চেহারায়। কিন্তু হঠাৎ করে এরকম একটা প্রশ্ন কেন করলেন?”

আষাঢ় জবাব দিলো না। স্থিরভাবে ভাবতে লাগলো। তার থেকেও নোয়ানার চেহারায় বেশি পরিবর্তন হয়েছে। এমনকি নোয়ানা আগে ফর্সা ছিল। এখন একটু কালো হয়েছে। এত পরিবর্তনের পরও সে চিনে গেল, অথচ নোয়ানা চিনতে পারলো না? আসল কথা হলো নোয়ানা চিনেও না চেনার ভাণ করছে। দারুণ অভিনেত্রী!

“আমিও দেখবো তুমি কতটা ভালো অভিনয় করতে পারো!” মুখে বিড়বিড় করে আরেক টুকরো পরোটা মুখে পুরলো আষাঢ়।

কারিব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কোনো একটা ঘাপলা উপলব্ধি করছে সে আষাঢ়ের মাঝে। আষাঢ় তার থেকে কোনো কথা গোপন রাখে না। অথচ এই ঘাপলাটা সম্পর্কে সে জানে না।

ডাইনিং টেবিলে এখন শুধু আষাঢ় আর কারিব আছে। বাকিদের নাস্তা শেষ। তারা দুজন একটু লেট করেই ব্রেকফাস্ট করে। আষাঢ় আসলে কারিবের ক্ষেত্রে এই লেট ব্যাপারটা হয়। এমনিতে সে তাড়াতাড়িই ব্রেকফাস্ট করে সকলের সাথে।
কিছুক্ষণের নীরবতা কাটিয়ে আষাঢ় প্রথমে বললো,
“বুঝলে কারিব, ভাবছি ঢাকার ভিতরই কিছু মেয়েদের সাথে কন্টাক্ট করবো। দূরে দূরে গিয়ে মেয়েদের সাথে দেখা করতে ভালো লাগছে না আর। দুই তিন দিন গিয়ে সেখানে থাকা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

“কিন্তু এই রিক্স নেওয়া কি ঠিক হবে? আপনার মুখে তো আগে জীবনেও এরকম কথা শুনিনি। নিজের সেইফটি নিয়ে তো আপনি বেশ সচেতন।”

“আমাদের থানাটা লিস্টে না থাকলেই হলো। অন্য থানার মেয়েদের সাথে দেখা করলে সমস্যা হবে না। আজকে রাতে মতিঝিলের একটা মেয়ের সাথে চ্যাটিং হয়েছে ইন্সট্রাগ্রামে। ভাবছি কয়েকদিন পর ওর সাথে মতিঝিল গিয়ে দেখা করবো।”

“ঠিক আছে, আপনি যা চান।” আষাঢ়ের কথায় অমত করার জো পেল না কারিব।

_________________

শ্রাবণ রুমকির বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করছে চল্লিশ মিনিট হলো প্রায়। রুমকি কি এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি? কল দিলো, তাও রুমকির ফোন বন্ধ। শ্রাবণের একটু ভয় ভয় করছে। রুমকিকে কী বলে বোঝাবে? মনে মনে সবটা ঠিক করে সাজিয়ে নিতে চাইলেও পারেনি। খুব দুর্বিষহ অবস্থায় আছে সে। চিন্তায় চিন্তায় মস্তিষ্কে যন্ত্রণা ধরে আছে। রুমকিকে গেট থেকে বের হতে দেখে শ্রাবণের অপেক্ষার অবসান ঘটলো। সে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ফেললো।

রুমকি শ্রাবণকে দেখতে পেয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে বসলো। শ্রাবণ প্রথমে কী বলবে বুঝতে পারলো না। তোতলাতে তোতলাতে এক সময় বললো,
“তো…তোমার ফোন বন্ধ কেন?”

রুমকি স্পষ্ট উত্তর দিলো,
“নষ্ট হয়ে গেছে।”

“নষ্ট হয়ে গেছে সেটা তো আমি জানি। সে জন্যই তো তোমাকে নতুন একটা মোবাইল কিনে দিয়েছি। সেটার কী হলো?”

“সেটাই নষ্ট হয়ে গেছে।”

“সেটা কী করে নষ্ট হতে পারে? মাত্র পাঁচদিন আগেই তো কিনে দিলাম।”

“কাল রাতে এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলাম যে, মোবাইলটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মেরেছিলাম, তারপর থেকেই নষ্ট। তবে মেকানিকে দিলে ঠিক হয়ে যাবে।”

রুমকি ফ্লোরে মোবাইল ছুঁড়ে মেরেছে শুনে শ্রাবণের একটু ভয় হলো। সেটা অপ্রকাশ্য রেখে বললো,
“কয়দিন লাগবে ঠিক হতে?”

“বেশি না, পাঁচ ছয়দিন।”

“পাঁচ ছয় দিন?” কেমন লম্বা করে টেনে বললো শ্রাবণ।
তার পক্ষে এতদিন রুমকির সাথে কথা না বলে থাকা পসিবল নয়। সে বললো,
“মোবাইল আর মেকানিকে দিয়ে ঠিক করার দরকার নেই, একটা নতুন মোবাইল কিনে দেবো আমি।”

রুমকির ভিতরটা প্রশান্তি পেল। শ্রাবণের কাছ থেকে এরকম কথাই আশা করেছিল সে।

“রাতে কোথায় ছিলে?” গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে রুমকি।

“কেন বাড়িতে।”

“গাধা! কোথায় ঘুমিয়েছো সেটা জিজ্ঞেস করেছি?”

“আমার রুমে।” খুব স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো শ্রাবণ।
তবে তার এই স্বাভাবিক কণ্ঠের জবাবে রুমকির চোখ কপালে উঠলো,
“তুমি নিজের রুমে ওই ডাইনিটার সাথে ছিলে?”

মিহিককে ‘ডাইনি’ ডাকার ব্যাপারটা শ্রাবণের ভালো লাগলো না।
“তুমি ওকে ডাইনি বলছো কেন?”

“ডাইনি নয়তো ও কী? একদম সহ্য হয় না আমার ওকে। বদ একটা! ডাইনিটা আমার বয়ফ্রেন্ডের বউ, ভাবতেও গা জ্বলে যাচ্ছে। তোমার বাবা কি আর কোনো মেয়ে খুঁজে পায়নি তোমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য? ওকেই কেন পছন্দ করতে হলো?”

শ্রাবণ এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাইলো না। কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট করলো। রুমকি বললো,
“এক খাটে ঘুমিয়েছিলে মিহিকের সাথে?”

“অবশ্যই না, একটা মেয়ের সাথে কী করে আমি এক খাটে ঘুমাবো? ফ্লোরে…”

“ফ্লোরে ঘুমিয়েছো সারারাত? তুমি কেন ফ্লোরে ঘুমাবে? মিহিককে ফ্লোরে ঘুমাতে বলতে পারলে না?”

“মিহিকই ফ্লোরে বিছানা পেতে ঘুমিয়েছে, নিজ ইচ্ছায়। আমি খাটে শুয়েছি।”

“ও। এই একটা ব্যাপার তো অন্তত ভালো করেছে ডাইনিটা। তা কদিন নিজের বউ পরিচয়ে রাখবে ওকে? ডিভোর্স দেবে না?”

শ্রাবণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ডিভোর্স নিয়ে সে এখনও ভাবেনি কিছু। তবুও বললো,
“দেখি, কবে ডিভোর্স দেওয়া যায়!”

শ্রাবণ এ নিয়ে মোটেই কথা এগোতে চাইলো না আর, সে জন্য দ্রুত সং প্লে করে দিলো।
মার্কেটে নিয়ে এসে রুমকিকে নতুন একটা মোবাইল কিনে দিলো শ্রাবণ। দামি মোবাইল-ই কিনে দিয়েছে। আগেরটার থেকেও বেশি দামি। রুমকির সাথে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর সোজা বাড়ি ফিরলো সে। বাড়িতে যে তার নতুন বউ আছে সেটা ভুলেই গিয়েছিল। মনে ছিল না যে গতকাল তার বিয়ে হয়েছে। মনে পড়লো রুমে প্রবেশ করার পর। যখন মিহিককে বসা দেখলো জানালার কাছে টুলে। শ্রাবণের মনে পড়লো এই মিহিক মেয়েটা এখন তার বউ। শ্রাবণের হঠাৎই অপরাধ বোধ হলো। ঘরে তার বউ অথচ সে গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করে এসেছে? শ্রাবণের মনটা বড্ড অপরাধী বনে গেল।

দরজা খোলার শব্দে মিহিক তাকিয়েছিল শ্রাবণের দিকে। এখনও তার দৃষ্টি শ্রাবণের উপর নিবদ্ধ। শ্রাবণের এটা খেয়াল ছিল না। খেয়াল হতে সে চোখ সরিয়ে নিলো। হেঁটে রুমে ঢুকে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘড়ি খুলে রাখলো হাত থেকে। নিজের অপরাধ বোধকে কাটিয়ে নিলো। বোঝাতে লাগলো নিজেকে, না কোনো অপরাধ সে করছে না। রুমকি তার ভালোবাসা! পুরোনো ভালোবাসা। অনেক আগে থেকে তার মনে রুমকির জন্য প্রেম জমাট। মিহিকের সাথে তার বিয়েটা অনিচ্ছা সত্ত্বে হয়েছে। এখন মিহিককে রেখে রুমকির সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা নিশ্চয়ই অন্যায় বলে গণ্য হবে না। শ্রাবণ মনে মনে নিজেকে এসব বুঝ দিতে লাগলেও, তার মন ঠিক মানছে না। তার অপরাধ বোধ স্থায়ী। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। আড় চোখে একবার মিহিকের দিকে তাকালো। মিহিক জানালা দিয়ে এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কেমন গম্ভীরতা, কেমন কষ্ট, কেমন অভিমানের ছাপ দেখা যাচ্ছে। শ্রাবণ বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না ওই মুখে। অপরাধ বোধ আরও বেড়ে যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিলো। আয়নাতে তাকিয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখলো। কী পাপি একটা মুখ!

________________

সকাল থেকে এ যাবৎ মিহিককে অসংখ্য বার কল দিয়েছে তার মা, বোনেরা। মিহিক কারো কল রিসিভ করেনি। বুকে তার অভিমানের গাঢ় কালি লেপ্টে আছে। বার বার মনে হচ্ছে জীবনে খুব বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছে। এ ভুলের চিহ্নটা আজীবন থেকে যাবে। বিয়ের আগে থেকে জানতো শ্রাবণের মনে রুমকির বসবাস। তাই বলে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও শ্রাবণ রুমকির জন্য এত দিওয়ানা থাকবে ভাবেনি। বউয়ের সামনে প্রেমিকার সাথে কথা বলছে, বিয়ের পরদিন প্রেমিকার সাথে বাইরে থেকে ঘুরে এসেছে, কতটা নীচ হলে কেউ এমন করতে পারে! ছি! এমন একটা লোককে বিয়ে করেছে ভাবতেও ঘৃণায় বুক ভেসে যাচ্ছে।

মিহিক এখন শ্রাবণদের বাড়ির বিশাল ছাদটার দোলনাতে বসে আছে। তার পরনে ডার্ক ব্লু রঙের একটা শাড়ি। শাড়িটা ব্রেকফাস্টের পর তার শাশুড়ি রুমে এসে দিয়ে গিয়েছিল। শুধু একটা শাড়ি না। ছয়টা শাড়ি এবং ছয়টা থ্রি পিস দিয়ে গেছে। এগুলো আগেই কিনে রেখেছিল তারা মিহিকের জন্য। শাড়ি-থ্রি পিস যখন যা ইচ্ছা হবে তখন তা পরতে বলেছে। মিহিকের মনে হয়েছে আজকে থ্রি পিসের থেকে শাড়ি পরলে ভালো হবে। তাই শাড়ি পরলো। শ্বশুর-শাশুড়ি হিসেবে যে লায়লা খানম এবং কবির সাহেব খুব ভালো সেটা মিহিক একটুতেই বুঝে গেছে। তারা দুজন যে সব সময় এমন ভালো শ্বশুর-শাশুড়ির পরিচয় দেবে এটা একেবারে নিশ্চিত। কিন্তু আসল সমস্যা হলো স্বামী। শ্রাবণের কর্ম কাণ্ডে মিহিকের ইচ্ছা করছে এখান খুব দূরে কোথাও চলে যেতে। কাল থেকেই এমনটা ইচ্ছা হচ্ছে তার। চলে তো যেতেই হবে। শ্রাবণের যে কর্ম কাণ্ড তাতে কি আর এখানে থাকা যাবে? এসব সহ্য করে থাকা তার পক্ষে দুষ্কর। শ্রাবণের সাথে সকাল থেকে একটা কথা হয়নি তার। শ্রাবণ একটা কথা বলেনি, আর সেও ফিরে তাকায়নি শ্রাবণের দিকে। ভালোই হয়েছে! শ্রাবণের সাথে কথা বললেই ঝগড়া লাগতে পারে তার।

রুফটপে কারো পদধ্বনির শব্দ শুনতে পেয়ে মিহিক সেদিকে দৃষ্টি দিলো। বিকেলের আলো মেখে শ্যামবর্ণের একটা ছেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। মিহিকের সব কিছুই বিতৃষ্ণা লাগছে। এই মুহূর্তে আষাঢ়ের আগমনও তার কাছে বিতৃষ্ণার কারণ ছাড়া আর কিছু হলো না। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে বসে রইল। আষাঢ় এসে তার পাশে দূরত্ব রেখে দোলনায় বসে বললো,
“কেমন আছেন ভাবি সাহেবা?”

‘ভাবি সাহেবা’ ডাকটা মিহিকের কাছে বিষের মতন ঠেকলো। এই ছেলেটা তাকে সকালেও একবর ভাবি সাহেবা বলে ডেকেছে। ডাকটা এমন ছিল,
‘ব্রেকফাস্ট করেছেন ভাবি সাহেবা?’
বিরক্তিকর!

“তুমি আমার বড়ো ভাবি হলেও বয়সে আমার থেকে প্রায় এক বছরের ছোট। আমার কাউকে আবার আপনি করে সম্মোধন করার অভ্যাস নেই। আমার থেকে বয়সে ছোটদের তো নয়ই। তাই তোমাকেও তুমি করে বলছি। তুমি আবার মাইন্ড করো না!”

“মাইন্ড করিনি। তবে যেহেতু আমি সম্পর্কের দিক থেকে তোমার বড়ো, সেহেতু আপনি করে বললে বেশি খুশি হতাম।” গুরু গম্ভীর কণ্ঠে আষাঢ়ের কথার প্রত্যুত্তর করে মিহিক।

“ওহ স্যরি! ভাবির খুশিটা ধরে রাখতে পারলাম না।”

মিহিক বিরক্ত। বললো,
“তুমি কি কিছু বলবে?”

“বলবো বলেই তো এসেছি, তাই না? কিছু বলার না থাকলে কি আসতাম?”

আষাঢ়ের এমন প্যাঁচানো কথা শুনতে ধৈর্য হচ্ছে না মিহিকের, সে সরাসরি বললো,
“যা বলবে দ্রুত বলো। আমি বিরক্ত বোধ করছি।”

আষাঢ় স্পষ্টভাষী মিহিকের কথা শুনে হেসে বললো,
“এই তোমার মতো মেয়েদের আমার খুব ভালো লাগে। ওরা সবকিছু স্ট্রেইট বলে দেয়। আমি খুব পছন্দ করি মেয়েদের এই স্বভাব। তবে তোমার মেজো বোনটাকে মোটেই তোমার মতো লাগে না।”

“আমার বোনদের সম্পর্কে আমার খুব ভালো জ্ঞান আছে। তোমাকে নতুন করে কিছু বলতে হবে না।” কিছুটা রাগই হলো মিহিকের।

আষাঢ় আবারও হেসে বললো,
“তুমি সত্যিই মনোমুগ্ধকর একটা মেয়ে। তবে আমার ভাই’ও কিন্তু কম না। আমার ভাই হলো নম্র একটা মানুষ। কতটা ভালো সেটা বললে বুঝবে না। তার সাথে থাকতে থাকতে টের পাবে এটা। সে হলো অমায়িক, একজন উদারশীল ব্যক্তি! তার মনটা একেবারে তুলোর মতন নরম। ওই মনের যত গভীরে যাবে, ততোই কোমলতা দেখতে পাবে।”

আষাঢ়ের মুখে শ্রাবণের সম্পর্কে এরকম শুনতে মিহিকের পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। শ্রাবণের মতো খারাপ একটা মানুষকে তার কাছে প্রশংসায় ভাসানো হচ্ছে! মিহিকের বলতে ইচ্ছা করছে,
‘তোর ভাইকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। শালা বদের হাড্ডি! পৃথিবীতে খারাপ মানুষদের ভিড়ে তোর ভাইকে খুঁজলে সেরা দশের মধ্যেই সন্ধান পাবি নিশ্চিত।’
কিন্তু মিহিকের মনের কথা মনে রইল।

আষাঢ় বলে চললো,
“আর আমিও কিন্তু কম ভালো না। খুব নিষ্পাপ একটা ছেলে আমি। আমি বিদেশের মাটিতে বড়ো হলেও, দেশি কালচারে বেড়ে উঠেছি। আমেরিকাতে তো ছেলে-মেয়েদের একসাথে চলাচল কোনো ব্যাপারই না। তবে আমি মেয়েদের সংস্পর্শ একদম পছন্দ করি না। মেয়েদের সাথে ঘোরাঘুরি জাস্ট বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। এমনকি মেয়েদের সাথে হ্যান্ডশেক পর্যন্ত করি না আমি। আমার এই হাত যে কতটা পবিত্র সেটা তুমি বুঝবে না। আমি আর কী ভালো? আমার ভাই এর থেকে আরও বেশি ভালো। এক টুকরো সাদা কাগজের মতো নিষ্পাপ সে। আমার ভাইকে বিয়ে করে তুমি অনেক লাকি!”

মিহিকের কাছে আর সহ্য তুল্য হলো না। সে বিরক্তি ঝরিয়ে বলে উঠলো,
“তোমার আর তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে বায়োডাটা বলা কি হয়ে গেছে?”

“হয়নি। বললে তো আজকে রাতের ভিতরও শেষ করতে পারবো না। ঠিক আছে, তুমি যখন বোরিং ফিল করছো তখন আর না বলি কিছু।”

আষাঢ় বসা থেকে উঠে বললো,
“যাচ্ছি ভাবি সাহেবা।”

আষাঢ় হাঁটা দিলো। হঠাৎ করে একটা বিষয় মনে পড়াতে আবার দাঁড়ালো। পিছন ফিরে বললো,
“ওহ, আরেকটা কথা ভাবি সাহেবা। তোমরা কি আমেরিকাতে গিয়েছিলে কখনো?”

আষাঢ়ের এই প্রশ্ন মিহিককে অবাক করে দিলো।
“এটা কেন জানতে চাইছো?”

“যদি তুমি আমেরিকাতে থাকতে তাহলে তো টিউলিপ ফুলের পাশাপাশি তোমাকেও দেখতে পেতাম। কিন্তু তোমাকে তো কখনো দেখিনি আমি।”

মিহিকের ভ্রু কুঁচকে গিয়ে চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে গেল। সে কণ্ঠে ভারী বিস্ময় ধরে বললো,
“টিউলিপ ফুল, আমেরিকা কীসব বলছো তুমি?”

মিহিকের প্রশ্নের উত্তর দিলো না আষাঢ়, নিজের মতো করে বললো,
“ডোন্ট ও্যরি, সকল প্রশ্নের উত্তরই জেনে নেবো আমি। শুধু লাভলী বার্ডকে একবার ক্যাচ করে নিই। সবকিছুই জানবো আমি।”

আষাঢ় ঘুরে দাঁড়ালো। অনেক ভাবনাই তার এলোমেলো। সবচেয়ে ভাবনার বিষয় নোয়ানার ফ্যামিলি। নোয়ানার ফ্যামিলিতে থাকা ইদ্রিস খান, হাফিজা, মিহিক, তিন্নি এদের কাউকেই আমেরিকা দেখেনি কখনও। একবারের জন্যও না, এক সেকেন্ডের জন্যও না। একই এলাকায় থাকার সুবাদে অন্তত নোয়ানার বাবাকে তো একবার হলেও দেখা উচিত ছিল। নোয়ানাকে দেখতে পাওয়া গেলেও তাদের কেন দেখতে পায়নি? আর আগে কেন নোয়ানার মুখে অত গাঢ় বিষণ্ন, বিষাদের ছাপ দেখা যেত? নোয়ানার হাতের ওই ক্ষত…
আষাঢ়ের চোখে পুরোনো দিনের একটা ছবি ভেসে উঠছে।
আমেরিকার সামারের কোনো এক বিকেল বেলা। সে পনেরো বছরের এক কিশোর ছেলে তখন। উষ্ণতম দিন হওয়ার কারণে তেমন পুরু কিছু নেই পরনে। একটা টি-শার্ট আর জিন্স শুধু। তার শান্তময় দৃষ্টি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দশ বছর বয়সী এক ভীতু মেয়ের উপর। মেয়েটা তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার চেহারা ভীতগ্রস্ত। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভিতর যে মেয়েটার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে ভয়ে সেটা না চাইতেও টের পাওয়া যায়। মেয়েটার একটা হাত আটক। একটা ব্যাগ দেখা যাচ্ছে হাতে। এই মাত্র গ্রোসারি শপ থেকে বের হয়ে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল, কিন্তু মাঝ পথেই তাকে আটকে দিলো পনেরো বছর বয়সী চঞ্চল আষাঢ়। আষাঢ়ের চোখ মেয়েটার মুখ থেকে নেমে মেয়েটার বাম হাতের উপর নিবদ্ধ হলো। মেয়েটার হাতে ব্যান্ডেজ। আষাঢ়ের মন খচখচ করছে। তার মনে হচ্ছে এটা স্বাভাবিক কোনো এক্সিডেন্ট থেকে পাওয়া ক্ষত নয়। সে হঠাৎ মেয়েটার আহত হাতটা আলতো করে নিজের হাতে নিলো। মেয়েটা শিউরে উঠলো অকস্মাৎ। চোখ তুলে তাকালো একবার। লাল দুটি আঁখি। ব্যান্ডেজ কব্জির ঠিক নিচে। আষাঢ় টানা টানা ইংলিশে মেয়েটিকে বললো,
“হেই, আঘাত পেয়েছো কীভাবে?”

মেয়েটা ভীতগ্রস্ত চোখ নামিয়ে ফেললো। চোখ জলে থলথল করে উঠলো। সে অশ্রু চেপে রেখে কাঁপা কাঁপা স্বরে আষাঢ়ের মতো ইংলিশে উত্তর দিলো,
“প…পড়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই আঘাত পেয়েছি।”
কথাটা বলেই মেয়েটা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর দ্রুত পা ফেলে হেঁটে যেতে লাগলো ওয়াকওয়ে ধরে। আষাঢ় পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললো,
“ইউ’আর লাইয়িং টিউলিপ! আমি জানি তুমি পড়ে গিয়ে আঘাত পাওনি। কীভাবে আঘাত পেয়েছো বলো আমাকে। কেউ তোমাকে মেরেছে?”

মেয়েটির কোনো হেরফের হলো না। সে দ্রুতগামী পা ফেলে চলে গেল।
আষাঢ়ের চোখ থেকে পুরোনো স্মৃতিটা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে উঠলো। বেরিয়ে এলো সে অতীতের খোলস ছেড়ে। মেয়েটার হাতে সেই ক্ষতর চিহ্ন এখনও খুব ভালো করে ফুঁটে আছে। সে দেখেছে সেই দাগ স্পষ্ট। আষাঢ়ের এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো মেয়েটার হাতের ওই ক্ষত মেয়েটা নিজেই সৃষ্টি করেনি তো?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here