#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৩
_____________
রাগ, অপমান, কষ্ট! এই তিনটা জিনিস আষাঢ়ের ভিতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে। চূর্ণ-বিচূর্ণ করছে হৃদয়কে। হৃদয়ের এমন অবস্থার সাথে কভু সাক্ষাৎ ঘটেনি আগে। মন বার বার একটা কথা জানান দিচ্ছে, ‘নোয়ানা হার্টলেস’! কথাটা তো মিথ্যা নয়। মেয়েটা তো হার্টলেসই। নিজের হৃদয় দিয়ে একটু বোঝার চেষ্টা করে না তাকে। একটুও বোঝে না।
আষাঢ়ের বন্ধ আঁখির কোণ বেয়ে সুনিপুণ ভাবে একটা কষ্টের অশ্রুধারা নেমে যায়। মনে পড়ে নোয়ানার বলা কথা,
‘পাগল আপনি হতে পারেন, আমি না। আপনার পাগলামির সাথে সামিল হলে জীবন চলবে না আমার।’
আষাঢ় নিজ মনে বিড়বিড় করে ওঠে,
“তুমি পাগলই করে দিচ্ছ আমায়। ভালোবাসায় পাগল হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি কষ্টে পাগল করে দিচ্ছ। তুমি নির্দয়, হৃদয় বোঝো না।”
আষাঢ়ের বিড়বিড় থেমে গেলে রুম হয়ে ওঠে আবারও নিষ্প্রাণ, নিস্তব্ধতা ঘেরা। কেটে যায় কয়েকটা মুহূর্ত। আষাঢ় রুমে উপস্থিত মানুষটার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“আমি এত কষ্ট অনুভব করছি কেন কারিব? টিউলিপ একটুও বোঝে না আমাকে, একটুও না!”
আষাঢ়ের শেষের কথাটা মর্মঘাতিক, অভিমান আবিষ্ট। যা শুনতে কারিবের মনে কষ্টের একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। সে নীরব রইল।
নীরবতার জাল চিরে আষাঢ়ই ফের বললো,
“আমি একটা পাগল, বদ্ধ উন্মাদ, তাই না? সত্যি করে বলো, আমি কি তাই?”
কারিব বিপাকে পড়ে যায়। আষাঢ়ের এমন ব্যক্তিত্ব সে আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। মানুষটাকে আজ বড্ড দুঃখী দেখাচ্ছে। আষাঢ় কিছুটা পাগলাটে এটা ঠিক, কিন্তু এই পাগলামি তো আর সেরকম নয়। আষাঢ়ের সব কিছু পাগলামি হতে পারে, কিন্তু নোয়ানার প্রতি ভালোবাসা পাগলামি নয়। নোয়ানাকে সত্যি মন থেকে ভালোবাসে। এটা কারিব উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে কণ্ঠে জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করলো,
“আপনি উন্মাদ হতে যাবেন কেন? আপনি মোটেই তা নন।”
আষাঢ় সহসা হাসে। এটা সুখের কোনো হাসি নয়। দুর্বোধ্য এই হাসি দেখলে অজান্তেই একটা কষ্টের সূচ ফুঁটে ওঠে বুকে। হাসিটা ক্ষণিকেই বিদায় নিয়ে পলায়ন করলো। বৈশাখের ধূসর আকাশের মতো রূপ তার মুখে। বললো,
“নোয়ানা খুব সুন্দরভাবে হৃদয়ে আঘাত করতে শিখেছে। এটা তার কত দিনের প্র্যাকটিসের ফল জানি না আমি। আমি ভেবেছিলাম সে খুশি হবে, কিন্তু সে খুশি হওয়ার পরিবর্তে আমার হৃদয়ে খুব কঠিনভাবে আঘাত করেছে। এত কঠিনভাবে আমাকে আঘাত করা উচিত হয়নি তার। আমি জোরপূর্বক তার হাতে রিং পরিয়ে দিয়েছিলাম। আমি কি এমন ভাবে পরাতে চেয়েছিলাম? চাইনি তো। তাও যখন পরালাম, তখন সে এটার মান রাখলো না। কঠিন অপমান করলো আমায়! রিং খুলে ফেলে দিলো! সে সব সময় আমার সাথে এত রুড কেন?”
কারিব বলতে পারলো না কিছু। আষাঢ়ের কষ্টে তার নিজের বুকও ব্যথিত হয়ে আছে। মানুষটা যে তার বড্ড প্রিয়!
“তার এই রুড আচরণ কোনোদিনও শুধরাবে না। আমার সাথে রুড আচরণ করেই যেন সে শান্তি অনুভব করে। কিন্তু সে কি বুঝতে পারছে না শান্তির থেকেও সে কষ্টই বেশি পায়? তার হয়তো কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আছে। ওই বিষণ্ন মুখ অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারে, কিন্তু আমি? আমার হৃদয় তো এত কষ্ট ধারণ করতে পারে না। তবুও কেন কষ্ট দিচ্ছে সে এরকম?”
আষাঢ়ের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এ অশ্রু দৃষ্টির অগোচর। শুধু যার চোখ থেকে বিসর্জন হলো সেই অনুভব করতে পারলো। হৃদয়ে আসলেই খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রত্যাখ্যান কি এতটা কষ্টের হয়? না কি ভালোবাসার কষ্ট এমনই? হৃদয়ে খরসান হাওয়া বইছে। এই হাওয়া যদি আজকের স্মৃতিটুকু উড়িয়ে নিয়ে যেত! আষাঢ় খুব করে চাইছে এই হাওয়া তার জীবন থেকে এই প্রত্যাখ্যানের স্মৃতিটুকু উড়িয়ে নিয়ে যাক, মুছে দিক হৃদয় থেকে একটা ক্লেশের গল্প।
তার মতো এমনই চাওয়া মনে সংগোপন করছে আরেকটি মেয়ে। ঘুমহীন সে মেয়েটিও চাইছে আজকের এই স্মৃতিটুকু বিলীন হয়ে যাক স্মৃতির পাতা থেকে।
_________________
বিকেলের নরম আলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। নদীর প্রবাহমান পানির কলকল ধ্বনি মুখর করে রাখছে প্রকৃতি। বয়ে আসছে মৃদু হাওয়া। বাইরের এমন প্রকৃতির মাঝে বহুদিন পর আসা হলো মিহিকের। সাথে আজ আবার প্রিয় মানুষটিও আছে। একটু থমকালো মিহিক। আচ্ছা, শ্রাবণ কি তার প্রিয় মানুষ? বিষয়টা কঠিন লাগলো। পাশে দণ্ডায়মান শ্রাবণের দিকে তাকালো। শ্রাবণের মনোযোগ তার দিকে নেই। ব্রিজের রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দূরে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি গিয়ে কোথায় মিলেছে ঠাহর করা যায় না। মিহিক রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল। ঘুরে শ্রাবণের মতো রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। না, শ্রাবণ একবারও তাকালো না। মিহিক বললো,
“কাল রাতে আপনি আপনার ফ্রেন্ড হাসিবের বাসায় ছিলেন এটা আমার একদম বিশ্বাস হচ্ছে না শ্রাবণ! সত্যি করে বলুন, আপনি ঠিক কোথায় ছিলেন?”
মিহিকের সন্দেহপ্রবণ কণ্ঠ শ্রাবণের মনোযোগ তার উপর নিয়ে এলো। শ্রাবণ কপালে ঈষৎ ভাঁজ ফেলে বললো,
“বিশ্বাস হবে না কেন আপনার? আমি হাসিবের বাসাতেই ছিলাম। আপনার কাছে কেন মিথ্যা বলতে হবে আমার?”
“কিন্তু আপনার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, আপনি দ্বিতীয় বিবাহ করেননি তো?”
শ্রাবণ চমকে ওঠে, হৃদয় ধাক্কা খায় কঠিন শিলা খণ্ডের সাথে। যারপনাই অবাক কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এসব কী বলছেন মিহিক? দি…দ্বিতীয় বিয়ে…মাথা ঠিক আছে আপনার?”
“মাথা ঠিক রেখেই বলছি। এটাই সন্দেহ হচ্ছে আমার। হঠাৎ করে কাল কেন আপনি ফ্রেন্ডের বাসায় থাকতে যাবেন? নিশ্চয়ই দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এবং কাল দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে ছিলেন।”
শ্রাবণ অপমানে রিক্ত হয়ে উঠছে। মেয়েটা শুধু শুধু মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে তার নামে! দ্বিতীয় বিয়ে? এটা তো সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারবে না।
“দেখুন মিহিক, আপনি আর একটাও আজেবাজে কথা বলবেন না। দ্বিতীয় বিয়ে এটা ভাবলেন কী করে? বিয়ে করা বউ থাকতে কেন আমি আবার দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাব? আপনি প্লিজ এটা নিয়ে আর একটা কথাও বলবেন না, একটাও না।”
মিহিক নিজের হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছিল, কিন্তু হাসি বাঁধ মানলো না। ফিক করে হেসে ফেলে বললো,
“আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম, এত হাইপার হওয়ার কিছু নেই। আমি বেশ ভালো করেই জানি আপনার পক্ষে দ্বিতীয় বিয়ে করা সম্ভব নয়। এক বউকেই ঠিকঠাক ভাবে দেখভাল করতে পারেন না, আবার এক বিয়ে করলে তো আপনাকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। হাওয়াতেই মিলিয়ে যাবেন।”
কথাটা বলে মিহিক হাসতে থাকে।
শ্রাবণ ভারি লজ্জা পায়। লজ্জায় মস্তক নত হয়ে আসে। একটু পর তাকায় আবার। মিহিক এখনও হাসছে। ওই হাসিতেই আটকে যায় দু চোখ। মেয়েটাকে হাসতে দেখলে এত কেন ভালো লাগে তার? ইচ্ছা হয় অপলক তাকিয়ে থাকে এই হাসি মুখটার দিকে। কিন্তু আবার বাধা আসে। নির্লজ্জের মতো একটা মেয়ের দিকে তো সে অপলক তাকিয়ে থাকতে পারে না। মিহিক তো তাকে নির্লজ্জ, বেহায়া মনে করবে। শ্রাবণ চোখ সরিয়ে নেয়।
কানে এলো মিহিকের কণ্ঠ,
“কী হলো চোখ সরিয়ে নিলেন কেন? দেখার ইচ্ছা হলে দেখুন। আমি আপনার স্ত্রী, যত খুশি তত তাকিয়ে থাকতে পারেন আমার দিকে। এটুকু দেখে নিশ্চয়ই আপনার মন ভরেনি? মন ভরে দেখুন, কোনো সমস্যা নেই।”
মিহিকের প্রতিটা কথা শ্রাবণের লজ্জা দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণতর করে দিলো। মেয়েটাও তো দেখছে কম নির্লজ্জ নয়। এমন সব কথা বিনা সংকোচে, চটাং চটাং করে কীভাবে বলে দিলো? মেয়েটা রাগী, জেদি, ভালোর সাথে সাথে নির্লজ্জও হয়ে উঠছে। শ্রাবণ অন্যদিকে দৃষ্টি রেখেই জবাব দিলো,
“আপনাকে দেখার কোনো ইচ্ছা নেই আমার, আর আপনার দিকে তাকিয়েও ছিলাম না আমি।”
মিহিক হাসে,
“তাই?”
শ্রাবণ জবাব দিতে পারলো না।
মিহিক হাত বাড়িয়ে শ্রাবণের অন্যদিকে দৃষ্টি রাখা মুখটা নিজের দিকে ফেরালো।
শ্রাবণ হকচকিয়ে গেল। মিহিকের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিত হলেই হৃদয় থমকে যায়।
মিহিক শ্রাবণের কালো আঁখি জোড়ায় বিচলিতভাব লক্ষ্য করছে, লক্ষ্য করছে লজ্জাও। মানুষটা এমন কেন? এমন বলেই হয়তো তাকে প্রেমে ফেলতে পেরেছে তাড়াতাড়ি। মিহিক শ্রাবণের দিকে শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“আমি সুন্দর না?”
শ্রাবণের হৃদয় কম্পমান। হৃদয়ের টালমাটাল অবস্থা সামলে উঠতে পারছে না। কোনোরকমে জবাব দিলো,
“পৃথিবীর প্রতিটা মানুষই সুন্দর।”
“কিন্তু আমি আপনার স্ত্রী, আমাকে আলাদাভাবে সৌন্দর্যে রাখা উচিত আপনার।”
শ্রাবণের বিচলিত মুখখানি আরও বিচলিত দেখালো। আত্মগ্লানির গাঢ় রং ছুঁয়ে গেল মুখে। আবারও মস্তক নত হয়ে এলো। নত মস্তকে অস্ফুটে উচ্চারণ করলো,
“স্যরি!”
মিহিক শ্রাবণের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো। রেলিংয়ের দিকে ঘুরে বিস্তীর্ণ নদী জলে দৃষ্টি রেখে বললো,
“আর কোথায় ঘুরতে যাব আমরা?”
“এক জায়গায় তো ঘুরতে এসেছেন, আরও অন্য জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার কী দরকার?”
মিহিক স্ফুলিঙ্গ চোখে তাকালো,
“বিয়ের পর বউকে নিয়ে এই প্রথম বাইরে ঘুরতে এসেছেন, এক জায়গাতেই ঘোরাঘুরি স্টপ করতে চান?”
শ্রাবণের চেহারা চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো হয়ে গেল। মিহিক প্রতি কথা দিয়ে তাকে দমিয়ে ফেলছে। মেয়েটা কি জাদু বিদ্যা জানে? নম্র গলায় বললো,
“আর কোথায় যেতে চান?”
মিহিকের মুখে হাসি ফুঁটলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
“চলুন, হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করি কোথায় যাওয়া যায়।”
শ্রাবণ সম্মত জানালো।
দুজনে হাঁটতে লাগলো ব্রিজের পাশের ওয়াকওয়ে দিয়ে। মিহিক ভাবতে লাগলো, আজকের আবহাওয়া এত মিষ্টি কেন? মৃদু শীতল হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে। হাওয়ার স্তর মাড়িয়ে নরম আলতো রোদ পরশ আঁকছে গায়ে। নদীর কলকল ধ্বনির কী দারুণ সুর! প্রিয় মানুষটি সঙ্গী বেশে পাশে হাঁটছে। সবকিছুই ঠিকঠাক, শুধু হাত ধরার ব্যাপারটা উহ্য। চাইলে ধরা যায় শ্রাবণের হাত। ওই হাত তো এখন নিজস্ব। অনেক আগেই নিজস্ব পদ পেলেও আগে ধরতে সংশয় হতো। এখন মনে সংশয় নেই। তবুও ধরবে না। সব কিছু একসাথেই এত তাড়াতাড়ি পাওয়ার দরকার নেই। একটা বিষয়ই তো, ধীরে সুস্থে আসুক। সে নয়, শ্রাবণ নিজ থেকেই একদিন এমন পরিবেশের মাঝে তার হাতটা আলতো করে ধরুক!
মিহিক হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“আজকের দিনটা আমার কাছে অন্যরকম লাগছে।”
“যেমন?”
“মনে হচ্ছে আমি প্রেম করে বেড়াচ্ছি আপনার সাথে। আজ প্রথম ডেট আমাদের। মিষ্টি এক অনুভূতি হচ্ছে আমার।”
শ্রাবণ মনে মনে থমকে যায়। পা চলছে ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ের দিক দিয়ে সে থমকানো। মিষ্টি প্রেমানুভূতি জাগ্রত হয় মনে, জাগ্রত হয় লজ্জার উপরে আরেক বিরাট লজ্জা। মন লজ্জা মেশালো অনুভূতিতে বলে ওঠে,
‘মেয়েটা আসলেই নির্লজ্জ হয়ে উঠছে!’
তবে মিহিকের কথা খুব একটা ভুল নয়। তার নিজেরও মনে হচ্ছে সে মিহিকের সাথে ডেটে বের হয়েছে।
শ্রাবণ একটা ব্যাপার খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারলো, আজকের এই ক্ষণটি যতটা মিষ্টি মনে হচ্ছে, রুমকির সাথে কাটানো কোনো সময়ই এমন ছিল না। মিষ্টি মনে হতো না মুহূর্তগুলো। শ্রাবণ কিছু না বলে নীরব হাঁটতে থাকলো। মিহিকের গলা শোনা গেল আবার,
“আজকের দিনটা আসলেই অন্যরকম। যাই হোক, আজকে রাতে কোথায় থাকবি তুই?”
শেষ শব্দটা কানে আসতেই শ্রাবণের পা নিশ্চল হয়ে গেল, জায়গাতেই স্থির হলো সে। মিহিক এক পা সামনে হেঁটে থামলো তার দেখাদেখি। শ্রাবণ বিস্ময়ে জর্জরিত হয়ে বললো,
“কী বললেন? তুই…তুই বললেন এই মাত্র?”
মিহিক নির্বিকার বললো,
“হ্যাঁ, বললাম। কোনো সমস্যা তোর?”
শ্রাবণের মুখ ঈষৎ হা হলো,
“আপনি আবারও তুই করে বললেন!”
মিহিকের হাসি পাচ্ছে। শ্রাবণ এমন ভাবে কথা বললে ভালো লাগে। অতি কষ্টে হাসি আটকে রাখলো সে, ক্ষণকাল নীরব রয়ে বললো,
“আপনার মুখে ‘আপনি’ সম্মোধনটা আমার পছন্দ নয় শ্রাবণ। আপনি শুনতে বিরক্ত লাগে।”
শ্রাবণ অবাক হয়ে বললো,
“আপনাকে আপনি না ডাকলে ডাকবো কী?”
“আপনি সম্মোধন ছাড়া আর কি কিছু নেই পৃথিবীতে?”
শ্রাবণ চিন্তায় পড়লো, দোটানায় পড়লো। আপনি ছাড়া আর কী আছে? তুই?
শ্রাবণ বিস্ময় ত্বরান্বিত চোখে তাকালো। মিহিক নিজেকে তুই বলে সম্মোধন করতে বলছে? ব্যাপারটা কেমন ঠেকলো শ্রাবণের কাছে! মিহিক তাকে যতই সহজভাবে তুই বলে ডাকুক, কিন্তু তার কাছে মিহিককে তুই বলে ডাকাটা সহজ কোনো বিষয় না। সে বিভ্রান্ত কণ্ঠে বললো,
“আপনাকে কি তাহলে তুই বলে ডাকবো?”
অকস্মাৎ মিহিকের মাথায় রাগ চড়ে গেল। রাগের মাথায় বলে উঠলো,
“বোকার সর্দার! আপনি, তুই ছাড়া আর কিছু নেই?”
শ্রাবণ আরেক চিন্তায় তলিয়ে গেল। মনে মনে খোঁজ চালালো। আপনি, তুই ছাড়া আর কী আছে? কিছুই তো নেই। অন্য কিছু তো মনে পড়ছে না তার। শ্রাবণকে ভাবনায় বেশিদূর যেতে হলো না। টুপ করে তৃতীয় সম্মোধনটা মাথায় এসে গেল। লজ্জা লজ্জা পেল তার। সেই থেকে শুধু লজ্জাই পেয়ে যাচ্ছে। ছেলে হয়ে একটা মেয়ের সামনে এরকম লজ্জা পাওয়া কি উচিত কাজ? মোটেই না। ছেলে সম্মান নষ্ট হচ্ছে এতে। কিন্তু কী করবে? লজ্জা যে দমন হচ্ছে না তার। উল্টো মুখে সলজ্জ হাস্য আভা ফুঁটে উঠলো।
মিহিকের কিঞ্চিৎ বিরক্তি লাগছে। সে শ্রাবণের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে রইল না। লজ্জাভাবকে কোনো রকমে দমন করে মিহিকের সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করলো। আপনি থেকে তুমি সম্মোধন করা তুইয়ের থেকেও কঠিন কাজ। এটা কিছুতেই সম্ভব না। শ্রাবণের হৃদয় কেমন কেমন করছে। দিশেহারা হৃদয় যেন ছটফট করে মরছে। এমনই লাগছে তার।
চলতে চলতে মিহিক আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আজকে রাতে কোথায় থাকবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? বাড়িতে? না বন্ধুর বাড়িতে?”
শ্রাবণ পাশে চলতে থাকা মিহিককে আড়চোখে দেখতে লাগলো। না চাইতেও কথাগুলো মনে জেগে উঠছে,
‘আপনার পাশে শুয়ে ঘুমানো কতটা বিব্রতকর আপনি জানেন না মিহিক। এতটুকু ঘুম আসবে না আমার। রোজ তো আর ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমানো সম্ভব না। ফ্লোর বিছানাও যে ত্যাগ করেছি। পারলে বন্ধুর বাসাতেই থাকতাম আমি।’
মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে নরমভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার কাছে কোনটা ভালো মনে হচ্ছে?”
“যার নিজ বাড়িতে এত জায়গা পড়ে আছে, সে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে থাকলে গাধা ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্যই নিজ বাড়িতে থাকা উচিত আপনার। নিজ বাড়িতে, নিজ রুমেই থাকবেন।”
শ্রাবণ জানতো মিহিক এমনই কিছু বলবে। উত্তরে সে খুশি। যদিও নিজ বাড়িতে থাকতে বিব্রত বোধ ঘিরে রাখবে তাকে। তাও এটা শান্তিপূর্ণ। সে এবার আড় চোখে না তাকিয়ে সরাসরিই পাশ ফিরে তাকালো।
মিহিক টের পাচ্ছে পাশের মানুষটি তার দিকে তাকানো। কিন্তু সে তাকালো না। মানুষটা শান্তি মতো একটু ভালো করে নিজের বউকে দেখুক। তাকালে হয়তো আবার লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নেবে।
শ্রাবণ মিহিকের দিকে তাকিয়ে থেকেই প্রতি পদক্ষেপ ফেলছে। সম্পর্কটা কি স্বাভাবিক হয়ে আসছে না? অস্বাভাবিকতার মেঘ কেটে স্বাভাবিকতার রোদ হাসছে যেন একটু একটু করে। শ্রাবণের ওষ্ঠ্যকোণে হাসির রেখাপাত ঘটলো। আনমনে বললো,
“প্রত্যেক স্বামীর উচিত তার স্ত্রীকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে হিসেবে দেখা। আমিও আপনাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে হিসেবে দেখছি মিহিক। আপনি আমার কাছে আলাদাভাবে সৌন্দর্যে গুণান্বিত!”
শ্রাবণের কথা শুনে মিহিক পাশ ফিরে চাইলো। এক টুকরো নরম হাসি ফুঁটিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলো। বললো,
“এতক্ষণ আপনি লজ্জা পাচ্ছিলেন, এখন আমাকেও লজ্জায় ফেলার চেষ্টা করবেন না। একই সাথে দুজনে লজ্জা পেলে ব্যাপারটা ভালো হবে না।”
মিহিকের কথায় শ্রাবণের আনমনা কেটে যায়। সচকিত হয়ে ওঠে সে। চকিতে চোখ সরিয়ে নিয়ে দমবন্ধ একটা নিঃশ্বাস ফেলে। কী বলতে কী বলে ফেলেছে? তবে বিবেচনার দিক থেকে দেখলে স্বামী হিসেবে কথাটা খুব একটা খারাপ বলেনি। শ্রাবণের মনে অজান্তেই একটা গর্ববোধ হলো।
মিহিক এখনকার পরিবেশকে পরিবর্তন করার জন্য বললো,
“আপনার ভাইয়ের খবর জানেন কিছু?”
শ্রাবণ আবার তাকালো। তবে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। মন্থর কণ্ঠে বললো,
“কী খবর ওর?”
“জানি না, দিনে তিন চারবার দেখা হয় ওর সাথে আমার। কিন্তু আজকে একবারও দেখা হয়নি। ব্রেকফাস্ট করেনি। দুপুরেও নিচে খেতে নামেনি। কারিব রুমে খাবার নিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ হয়েছে কী ওর? সাদিয়া মেয়েটা বাড়িতে আসার পরদিনই এমন করছে কেন? মেয়েটা নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ডই ছিল।”
শ্রাবণের কাছে ব্যাপারটা এরকম মনে হলো না। আষাঢ় যেরকম তাতে গার্লফ্রেন্ডের জন্য এমন করার পাত্র সে নয়। আসল ঘটনাটা কী?
_________________
নির্জন দ্বি-প্রহরের মতো অনুভূতি নোয়ানার। এটা শব্দহীন এবং একাকী। কারো কাছে এ অনুভূতি প্রকাশের মতো নয়। নীরবে শুধু হৃদয় ভাঙন হয়। হৃদয় গুটি কয়েক ভগ্নাংশে পরিণত হলেও এই অনুভূতি মুখে ব্যক্ত করা যেন পাপ। কঠিন পাপ!
সেদিনের ঘটনা আজও স্পষ্ট মনে গেঁথে আছে। মুছে যায় না কেন মন থেকে? কষ্টের স্মৃতি এত গাঢ় ভাবে কেন হৃদয়ে গেঁথে থাকে? মনুষ্য জীবন এত কেন কষ্টের এবং কঠিন? আষাঢ়ের সাথে দেখা হয়নি আজ কয়েক দিন হলো। বেহায়া মনের কথা সে বলতে চায় না, তবুও বলতে হয়, আষাঢ়কে একবার দেখার জন্য তার মন আকুল হয়ে আছে। জানে এটা অন্যায়। যে মানুষটার সাথে সে নির্দয়, যে মানুষটা তার নয়, সে মানুষটাকে দেখতে চাওয়া বড়ো একটা অন্যায়। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে খুব কঠিনভাবে লড়তে হচ্ছে তাকে। সকল দিক বিবেচনা করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হবে। আবেগে নেতিয়ে পড়লে চলবে না তার। কারণ এই বাস্তব জগতে সে এক ঠুনকো প্রাণ। নয় বছর বয়সেই তার জীবন ঠুনকো হয়ে গিয়েছিল।
পিছনে দরজা খোলার শব্দে নোয়ানার ভাবনায় ছেদ পড়ে। তাকিয়ে চাচিকে দেখতে পায়। সে বসে আছে বাড়ির পিছনে সিঁড়িতে। কষ্টের কোনো ভাবনা ভাবার জন্য এই স্থানটাই যেন উপযুক্ত। নোয়ানা চাচিকে স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কিছু প্রয়োজন?”
হাফিজা দ্বিধায় আছে। কথাটা বলতে কেন যেন সংকোচ হচ্ছে তার।
নোয়ানা চাচির দোনা-মোনা ভাব লক্ষ্য করে বেশ অবাক হলো। বুঝতে পারলো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথাই বলতে এসেছে। কিন্তু কী? যা বলতে চাচিকে এমন অবস্থায় পড়তে হচ্ছে? নোয়ানার মাথা চিন্তায় গাঁট হয়ে আসছে। তবুও সে স্বাভাবিক বলার চেষ্টা করলো,
“কী বলবে বলো।”
“আসলে নোয়ানা…” কথাটা বলতে গিয়ে আবার থামলো হাফিজা।
নোয়ানার কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগলো না। অধিক চিন্তা হচ্ছে। তবুও উপরিপৃষ্ঠে সে স্বাভাবিক। চাচিকে আশ্বস্ত করে বললো,
“তুমি বলো চাচি, কোনো সমস্যা নেই।”
(চলবে)