ভুলবশত পর্ব-১৫

0
1534

#ভুলবশত♥
#PART_15
#FABIYAH_MOMO🍁

–ওহহো স্নেহময়ী! জড়িয়ে প্লিজ ধরো না!! আমি তোমার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছিনা!! দূরে যাওয়ার পাব্লিক অন্তত আমি সাগ্রত না!!বুঝলেন?

আমার পিঠের উপর তার শক্ত-কোমল হাতের পরশ পেলাম। শরীরে শীতের কনকনে ভাবের মতো কাপুনি দিতে চাচ্ছে। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছি! ও আমার রুমে কিভাবে আসলো? কেন আসলো? জানালা বাদে সব রাস্তা বন্ধ! কোন্ পথ দিয়ে রুমে ঢুকলো? তার আবদ্ধ হাতের বেস্টনী আরো শক্ত হয়ে আসছে। এতোটাই জোরে চেপে ধরেছে যে শরীরের হাড্ডিগুলো একীভূত হয়ে গলে যাবে মনেহয়! উনিশ থেকে বিশ হলেই আমি রোলার কোস্টারের মতো দ্রুতগতিতে পিষে যাবো! নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো! দম আটকে হাপানি রোগীর মতো শ্বাস উঠানামা করছিলো! হঠাৎ মনে হলো তার একটা হাত আমার পিঠের উপর দিয়ে ছোয়াতে ছোয়াতে খোলাচুলের নিচ দিয়ে ঘাড়ের কাছে পৌছালো। ঘাড়ে পাচ আঙুলে হালকা ডাবিয়ে চেপে ধরলো!শরীরে কাপুনি দিয়ে উঠলো! সে খুবই তীক্ষ্ম ভাবে আমার পিঠের উপর থাকা অপর হাতের নখ বসিয়ে খামচে ধরলো! চোখ কুচকে এলো! মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো আমার! আমি তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে চারপাশে তাকালাম! কেউ নেই! রুমে কেউ নেই! আমার শরীরের উপর কারো কাবু নেই। কেউ আমাকে জাপটে ধরেনি! পিঠে খামচে ধরেনি! ঘাড়ে পাচঁ আঙ্গুল দ্বারা চেপে ধরেনি! দৌড়ে জানালা দিয়ে বাইরে উকি দিলাম। নিচে ঝুকে দেখলাম, বাড়ির পেছন সাইডের জঙ্গল। কোনো রাস্তা নেই আমার রুমে আসার! তিনতলা ফ্ল্যাটের বামপাশের রুমে জানালা দিয়ে কোনো প্রবেশপথ নেই! সাফা আপুর রুমেও কোনো উটকো রাস্তা নেই। যদি কেউ আমাদের রুমে মই দিয়ে চোরের মতো আসার চেষ্টা করে, তবুও বিফল! মই ওতো উচুতে উঠবে না! বুকের ধকধকনি স্পিড স্বাভাবিক হচ্ছেনা। খুব দ্রুত বুলেট ট্রেনের মতো উপর-নিচ করছে হৃদপিন্ডটা।। আমার কপালে, নাকে, ঘাড়ে সহ সমস্ত শরীরে ঘামের কণা ঝেকে বসেছে। আমি ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে হাতের তালু দিয়ে কপাল মুছে নিলাম। ঘাড়ের উপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছার চেষ্টা করলাম। এখনো বুকের ভেতর তীব্রভাবে ধকধক করছে।। বিছানায় গিয়ে দুই হাতের তালুতে ভর দিয়ে বসে আছি। একটু আগে যা দেখলাম তা কি কল্পনা ছিলো, চিন্তা মাথানষ্ট হচ্ছে!! কল্পনা কি বাস্তবের মতো রূপ ধারন করে? নাকি আমার অবচেতন মন সাগ্রতকে নিয়ে ছিনিমিনি শুরু করেছে!! কি হচ্ছে আমার সাথে? কোনো কল্প দুনিয়ার খেলা? নাকি চাপা কোনো অনুভূতির মেলা? আমি কি সত্যিই সাগ্রতকে নিয়ে কল্পনার রাজ্য সাজাচ্ছি? সাজালেও আমি সাগ্রতকে নিয়ে এতো স্ট্রংলি ফিল করছি?? আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা। সাগ্রতকে নিয়ে অদ্ভুতকাণ্ড দেখার মানে হয়না!! সাফা আপুর খোঁজ না মিলা পযর্ন্ত কোনো রহস্যভেদ হবেনা! আপুকে আমার খোজা প্রয়োজন! না খুজলে রাতের ঘুম শান্তিপূর্ণ হবেনা!

সকালে চা-বিস্কুট গিলে কোনো রকমে গলায় ওড়না মেলে সাইডব্যাগ নিয়ে বাইরে বেরিয়েছি। উদ্দেশ্য ইফরাকে নিয়ে সাফা আপুর খোঁজ করা! আপু কোথায়, কে কিডন্যাপ করেছে, মোটিভ কি, সব জানার জন্য এখন নিজেই কালো-অন্ধকারের প্যাঁচানো ফাদে পা দিতে চাচ্ছি। রিকশা করে ‘পুকুরপাড়’ এরিয়ায় যাচ্ছি। ইফরাকে কল করতেই ওর নাম্বারে ডায়াল করলাম। দুতিনটা ফোনের ঘন্টা ওপাশে যেতেই ইফরা রিসিভ করে ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলে উঠলো-

–হ্যা…বেবি, বলো…
–ইফু সকাল দশটা বিশ বাজে তুই এখনো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিস? শালা বজ্জাত! উঠ্ এক্ষুনি! ফ্রেশ হয়ে ড্রেস পাল্টে এক্ষুনি পুকুরপাড় আয়! আমি জামাল মামার বিল্ডিংয়ের নিচে দাড়িয়ে আছি!
–বেবি টেন মিনিটস…(ঢুলুঢুলু কন্ঠে)
–দশ মিনিটের এক সেকেন্ডও দেরি যদি করোস! চড় খাবি! তাড়াতাড়ি আয়!
–কামিং জানু…
–শালা! লেট খালি করিস! এমন কষিয়ে চড় দিবো না জানু ভুলে জানুয়ারি বলবি! উঠ্ বলছি! চড় খেতে না চাইলে বের হ !
–আরে ভাই আসতেছি তো!! চেতিস কেন? আসতেছি আসতেছি!!
–আয় রাখি।

ইফরা ফোন কেটে দিলে আমি পুকুরপাড়ের কাছে যেয়ে ফুলের বাগানে ঢুকে পড়লাম।। হরেক রকমের ফুল লাগানো গাদা গাদা টব।। মিষ্টি সুভাষের বাতাসটা জানান দিচ্ছে প্রকৃতির মাঝে ফুলের স্পর্শতা।। নারায়ণগঞ্জ শহরের কোলাহলপূর্ণ কলেজ রোডের কাছেই অবস্থিত শান্ত-ঠান্ডা পরিবেশ বান্ধব জায়গা ‘পুকুরপাড়’। ‘সরকারি তোলারাম কলেজ’–এর সম্মূখ রাস্তা ধরে পাচঁ মিনিট হাটলেই, বামদিকে চলে আসে… সবুজে ঘেরা, নিরিবিলি ঠান্ডা, কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। গোলাকার একটা পুকুরের চারপাশে গাছগাছালির সমাবেশ। পুকুরটার চারিদিকে শত শত দালানকোঠা দাড়িয়ে পড়লেও পুকুরের নিস্তব্ধতা এখনো আগের মতোই নিরব বনে আছে। ঠিক একটা আবাসিক এলাকা। ঠান্ডা শীতল মন জুড়ানো বাতাস, পরিপাটি সুন্দর ইট বাধানো পাকা রাস্তা, পুকুরের চর্তুপাশে বেন্ঞ্চি সিস্টেম করে বসার জায়গা। স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পড়ুয়া অনেক স্টুডেন্ট দেখি ক্লাস বাঙ্ক মেরে প্রেমিক-প্রেমিকার হাত ধরে ঘুরছে।। তাদের কাপেল হিসেবে বসে থাকা একান্ত মুহূর্তগুলো আরো রোমান্ঞ্চকর করার জন্য সঙ্গ দিচ্ছে একদল বাদামওয়ালা, ফুচকা-চটপটির ভ্যান ও ঝালমুড়ি মামা। জুটি জুটি আকারে বসেছে পুকুরপাড়ের বেন্ঞ্চি জুড়ে কাপেলগুলো। আমি যেয়ে বসার সিট এভেইএবেল পাইনি।বাগানে থাকতে ইচ্ছে করলেও চলে এসেছি, বাগানে কোনো বসার জায়গা নেই।। ইফরার অপেক্ষায় একটা বিল্ডিংয়ের নিচে দাড়িয়ে হাতঘড়ি দেখছি। দশমিনিটের জায়গায় আধঘন্টা পেরুলো! বিরক্তির লেভেল হিংস্র রূপে রূপান্তরিত হলো।। অপেক্ষা নামক জিনিস কতটা ভয়ানক কারবার!!যে অপেক্ষায় থাকে সেই বুঝে! সময় আরো পাচঁমিনিট যেতেই আমার নাম ধরে কোথা থেকে জানি ডাক পড়লো! আশেপাশে তাকিয়ে দেখতেই পিছনে ঘুরে তাকালাম! ইফরা এসে উপস্থিত হয়ে পানির বোতলে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে দাড়ানো অবস্থায় পানি খাচ্ছে। ‘এ্যা থ্রাস্টি ক্রো’ — স্টোরিটার হুবহু ছবি যেন আমি ইফরার পানি খাওয়ার দৃশ্যে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছি! স্টোরিতে বেচারা কাকটা পানি খেয়ে যেভাবে তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলো ঠিক ইফরার পানি খাওয়ার কর্মকান্ডে সেরূপ কিছু অবলোকন করছি।ইফরার পানি খাওয়া শেষ হলে বোতলের মুখ লাগাতে লাগাতে আমার নিকটে এসে দাড়ালো। হাটুতে দুহাত রেখে নিচু ঝুকে হাফাচ্ছে ইফরা। দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষন দৌড়ঝাঁপ করেছে, তাই পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে শুকিয়ে গেছে। ইফরা হো হো করে দুটো শ্বাস ছেড়ে, কোমরে দুহাত রেখে মৃদ্যু কন্ঠে বলে উঠলো-

–জানিস তোর জন্য আমি বাসা থেকে না খেয়ে বেরিয়েছি!! মা আমাকে পেছন থেকে চিরুনি ছুড়ে মেরেছে!! পিঠটা কি যে জলছে রে!! আগুনের মতো জলছে বেব!

মনটা চাচ্ছিলো পায়ের জুতাটা খুলে কয়েকটা চাবুক মারি! এখন পাবলিক প্লেসে আছি ভেবে আশেপাশের মতিগতি দেখে ডোজ আর এপ্লাই করলাম না! চুপ করে অগ্নি দৃষ্টি ছুড়লাম। ইফরা আমার দৃষ্টি পেয়ে ঠোট ঠেলে বত্রিশ দাতের কেলানি হাসি দিলো! তাতে আমার মেজাজ ফুটন্ত পানির মতো টগবগ করে উঠলো! ফ্রেন্ডলিস্টে এমন হাদারাম বান্ধুবী থাকাটা দুষ্কর টাইপের কষ্ট!গালে গুণে গুণে একশোটা চড় দিতে পারলে মনটা আচ্ছা ফুরফুরে থাকতো!! এই বজ্জাতের দাত কেলানি ছুটে যেতো! আমি হাত ভাজ করে ওর দিকে দাত কটমট করে তাকালাম। ইফরা এবার কাদোকাদো হয়ে বলে উঠলো-

–আব্বে ইয়ার! আমি রাত চারটার সময় ঘুমাইছি!সকালে উঠতে হইছে দেরি!! তার উপর বাপ বাসায়! দেরিতে উঠছি বাপ দিছে কান ডলা মার্কা মশলা! আবার নাস্তা করিনি! মা দিছে চিরুনি দিয়ে বারি! তোর জন্য আমি সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার করে আসছি বন্ধু!! তুমি মোরে চিনলা না!! ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও!!! আহা এ গান আমার!! ওহো এ গান আমার!!!

থাপড়ায়া!চড়ায়া! বত্রিশ দাত ফেলে হাতে ধরিয়ে দিলে…দাতগুলো আমার দিকে তাকিয়ে খুশি হবে!কারন, ওর মতো ব্রেনলেস মেয়ের কাছে সুন্দর বত্রিশটা দাতের থাকাটা কোনো মানে হয়না।। ও কিভাবে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সেক্টরে চাকরি নেওয়ার থট আনে !!আমার তো মাথায় ঢুকেনা!! আমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না।। আমি সেই যে শক্ত হয়ে তাকিয়ে আছি, ওভাবেই আছি।। ইফরা হাসি উড়িয়ে মাথা নিচু করে বলে উঠলো-

–আরে ভাই সরি বলতেছি তো!! দশ মিনিটের জায়গায় পয়ঁত্রিশ মিনিট লাগাইছি!! তুই জানোস না আমরা মেয়ে মানুষ!! সাজুম গুজুম করুম না বল? না সাজলে কবে সাজুম?বুড়া বয়সে?আমাদেরই তো টাইম লাগবে নয়তো কারা টাইম নিবে? ছেলেরা? ওরা তো লিপস্টিক ছাড়া কিচ্ছু চিনে না!!

বুকভরে শ্বাস ছাড়লাম। নিশ্বাসের সাথে যেন সব বিরক্তিগুলো ঝেড়ে যায়।। কিন্তু আফসোস এমন সিস্টেম নেই। বিরক্তি একপ্রকার বিমারি যাকে একবার ধরে সহজে হাতছাড়া করেনা!! আমি স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলাম-

–বাজে পেচাল শুনতে চাইনা। তোর হেল্প দরকার তাই তোকে দশটায় কল করে আসতে বলেছি। সাফা আপুর মিসিং কেস নিয়ে পুলিশ কোনো কাজ করছেনা। গতকাল ফুপাজি কুমিল্লা থেকে থানায় কল করেছিলো কোনো লাভ হয়নি। তারা অজুহাত দেখিয়েছে এবং আপুর রিপোর্টে কিছুই বলেনি। শুধু বলছে, আমাদের ধৈর্য্য ধরতে এবং তাদের উপর ভরসা রাখতে। আমি আর ধৈর্য্য কুলাতে পারছিনা ইফু। আপুকে ছাড়া আমার একদিন কাটতো না! সেই আপু কিনা বহুদিন ধরে নিখোঁজ! আমি জাস্ট নিতে পারছিনা ইফরা! আমার হেল্প দরকার!

ইফরা আমার দু’বাহুতে ওর দুহাত রেখে বিনয়ী কন্ঠে অভয় দিয়ে বলে উঠলো-
–তুই টেনশন করছিস কেন? টেনশন করলে কোনো রাস্তা খুজে পাবি? না স্নেহা।। আর হেল্পের কথা তুই র্ফমালিটি দেখিয়ে বলছিস কেন? তোর জন্য আমি ২৪/৭ এভেইএবেল! আমি থাকতে তুই টেনশন করবি তা তো চলবে না ইয়ার! ওয়েট!

‘ওয়েট’ বলেই আমাকে দাড় করিয়ে ওর সাইডে ঝুলন্ত লম্বা ফিতার ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। কাকে যেনো করে বলে উঠলো-

–হ্যালো নিজাম আঙ্কেল! আঙ্কেল আমার একটা হেল্প দরকার! জরুরী এখন দেখা করতে পারবেন?
–………………………………………….
–অসংখ্য ধন্যবাদ আঙ্কেল!! আমি এক্ষুনি আপনার অফিসে আসছি। একটা রিকুয়েস্ট ছিলো! বাবাকে প্লিজ হেল্পের ব্যাপারে বলবেন না, উনি খামোখা মাথা ঘামাবেন।। জানেনই তো, বয়স হয়েছে।। আবার রিসেন্ট হাই প্রেসারের সিম্পটমস দেখা দিচ্ছে।। আমি চাই না কিছু জানুক।
–…………………………………………..
–আচ্ছা আঙ্কেল!! আমি আসছি!! থ্যাংকস।।।

ফোনটা কেটেই ইফরা খুব তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে আমার কবজি আকড়ে বললো-
–স্নেহা লেট করিস না!! চল চল… বাবার সহকারী অফিসার মিস্টার নিজাম শেখ, আমাদের কাজে হেল্প করতে রাজি আছেন! আমরা খোলামেলা আলোচনা করলেই সাফা আপুর মিসিং কেস নিয়ে রহস্য উৎখাত করতে পারবো!!

.
.

কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করছি নিজাম শেখ আঙ্কেলের জন্য। আঙ্কেল লাইট ফুড খাচ্ছিলেন, আমরা পনের-বিশ মিনিটের মাথায় আঙ্কেলের অফিসে পৌছলে একটু অপেক্ষার সময় গুণতে হয়।। উনার খাওয়া শেষ হলেই ভেতর থেকে কলিংবেলের ডাক পড়বে ঠিক এমনটাই বলেছেন গ্রাউন্ডফ্লোরে থাকা রিসেপশনিস্ট মেয়ে! দশ কি বারো মিনিটের মাথায় ‘ক্রিং ক্রং’ আওয়াজে কলিংবেল বেজে উঠলো। ইফরা আমাকে ইশারা করে ভেতরে আগে ঢুকলো!দরজার নব্ ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে অনুমতিজ্ঞাপন করে বললো-

–নিজাম আঙ্কেল, আসতে পারি?
স্বাগত সূচকে সৌজন্যতা দেখিয়ে কেউ বলে উঠলো-
–ইয়াহ্ সিউর!!কাম কাম ইফরা!!

ইফরা দরজার নব্ ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। আমিও পিছুপিছু যেয়ে কেবিনে উপস্থিত হলাম। সাদা রঙের চারকোনা টেবিল এবং কালো রঙের আরামদায়ক চেয়ারে বসা চল্লিশ-পন্ঞ্চাশ বৎসরের এক পুরুষ সামনে। বয়সের ছোপ চোখের নিচে এবং মুখের হালকা কুচকা আভায় বেশ স্পষ্ট। ভদ্রলোক এসির নিচে যথেস্ট হিম পরিবেশে বসে আছেন। টেবিলের উপর কলমদানি, কয়েকটা মোটা ফাইল, একটা বড় মগ, একটা কোয়াটার্জের টেবিল ক্লক, লো পাওয়ারের গ্লাস বসানো চশমার ফ্রেম। আমাদের দেখে ভদ্রলোক সামনে সাজানো দুটি চেয়ারে আসন গ্রহণ করতে বললো। ইফরা এবং আমি দুজনেই চেয়ারে বসলাম। ভদ্রলোক টেবিলের উপর থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে পড়লেন। আমাদের দিকে চশমার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলেন-

–ইফরা এভ্রিথিং ইজ অলরাইট? কি নিয়ে যেনো ডিসকাস করতে চেয়েছিলে?
–জ্বি আঙ্কেল। বাট প্লিজ বাবা যেন এ বিষয়ে কিচ্ছু জানতে না পারে।। আসলে, ও হচ্ছে আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড, নাম স্নেহা। ওর ফুপাতো বোন অনেকদিন ধরে নিখোঁজ। পুলিশে মিসিং ডায়েরী করার পরও তার কোনো হদিস মিলছেনা। এমনেতেই মেয়ে মানুষ, তার মধ্যে কেউ কিডন্যাপ করলে আত্মায় শান্তি থাকার কথা না।।। আঙ্কেল এখন আপনি ভরসা!! কিছু করুন!!

নিজাম আঙ্কেল অন্যমনষ্ক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা রিং বসানো খাতা এবং নীল কলম বের করলেন। পরিস্কার সাদা মসৃন পৃষ্ঠার খাতা খুলে বের করলেন। কলমের ক্যাপ খুলতেই বলে উঠলেন-
— তোমার নাম স্নেহা রাইট? আচ্ছা তোমার ফুপাতো বোনের ব্যাপারে সব ডিটেলস বলো তো। দেখো পয়েন্ট টু পয়েন্ট এভ্রি কাইন্ড অফ ক্লু আমাকে বলবে। কোথাও কিছু ঘটেছে কিনা, কেউ আগে হুমকি বা শাসিয়েছে কিনা, সব বলবে। ওকে?
–জ্বী আঙ্কেল অবশ্যই।
–আচ্ছা তোমার আপুর নাম কি,কলেজ নাকি ভার্সিটিতে পড়ে?
–আমার আপুর নাম সাফা। আপু ভার্সিটি স্টুডেন্ট।। আপু উড়নচন্ডী টাইপের মেয়ে, খুব ফ্রাঙ্কলি কথা বলতে পছন্দ করে। কোনো কারনে কাউকে সহ্য না হলে মুখের উপর ঠাস গলায় কথা বলে ফেলে। একবার আমি আর আপু ক্যাম্পাসের বাস থেকে এলাকায় একটা রিকশাতে উঠেছিলাম। তখন কোত্থেকে একদল মুখোশধারী মানুষ আসলো, আমাদের দুবোনকে জেরা করে ঘিরে ধরলো। আমি ভীত হয়ে চুপ থাকলেও আপু ঠাট বজায় রেখে শক্ত হয়ে থাকে। ওরা বলেছিলো, মৃত্যু খুব নিকটে। যেকোনো মূহুর্তে, যেকোনো সময়ে,যেকোনো দিনে ‘স’ নামধারী কাউকে মেরে ফেলবে। আপু ওদের হুমকিধামকিতে ভয় পায়নি, বরং জানেন…আপু চিল্লাচিল্লি করে পাব্লিক একত্র করে। পাব্লিকের একত্র হওয়া দেখে ওরা হুড়োহুড়ি করে পালিয়ে যায়। আমার ধারনা ওরা আমার মামার পাঠানো লোক ছিলো!!
–তুমি বলছো তোমার মামা? তোমার মামা কেন এমনটা করবে? কি লাভ তার?
–আঙ্কেল আমার নামে যেই জায়গাটা লিখা সেটার জন্য মামার ক্ষোভ। আমার নানাভাই চালাকি করে মামার নামে না দিয়ে আমার মায়ের নামে দিয়েছেন, মায়ের পর আমি সেসব পেয়েছি!! আর তাই…
–আর তাই তোমার মামা সম্পত্তির লোভে খুন করতে চাচ্ছেন? স্ট্রেন্জ! কি জেনারেশন চলে আসলো!! একজন মামা সম্পত্তির লোভে তার ভাগনিকে মার্ডার করতে চাচ্ছে!! ছিঃ!
–আপুকে খোজার অনেক ট্রায়ই আমরা করেছি কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। যা-ই করি সব পানিতে যাচ্ছে। আপুর খোজ মিলছে না।।

আমি নিজাম আঙ্কেলকে সব খুলে বললাম। আঙ্কেল সব শুনলেন। আপুর রিলেশন, পার্সনাল লাইফ, আউট লাইফ সব বিষয়ে আমি আঙ্কেলকে বলে দিয়েছি। আঙ্কেল বলেছেন উনি আজই কেসটা নিয়ে স্টাডি করবেন। বাকিটা আল্লাহ্’র ভরসা!! ইফরা আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ওর বাসার দিকে চলে যায়।। আমি বাসায় ঢুকে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে দরজায় বেল দেই। কাজের বুয়া শর্মিলা খালা দরজা খুলে দিলেন। আমি ভেতরে ঢুকে আমার রুমে আসতেই একবার ফুপির রুমের দিকে ঢু মারলাম। ফুপি ঘুমিয়ে আছেন, চোখের নিচে কয়লার কালি, চোখ মুখ কেমন শুকনো ফ্যাকাশে।। দেখতে একদম রোগা রোগা হয়ে গেছে!! বুকভরা ভারী নিশ্বাস ছাড়লাম। চলে আসলাম আমার রুমে। কাধের সাইড ব্যাগটা বিছানায় রেখে গলার ওড়না খুলে রাখতেই কেউ আমার রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো।। আমি দ্রুত পিছনে ঘুরে তাকালাম। রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে হাতভাজ করে দরজায় ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে সাগ্রত। ভয়ে আবারো ইনিয়ে বিনিয়ে চলে আসলো!! সাগ্রত কেন? কি উদ্দেশ্য? আমি একপা একপা করে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। ধীরে ধীরে রুমের খোলা জানালার কাছে যেতে লাগলাম। একসময় পেছনে জানালার উপস্থিতি বুঝতে পেরে থমকে দাড়ালাম। স্পষ্ট চোখে দেখছি, সাগ্রত হাতভাজ করে গম্ভীর মুখ করে দাড়িয়ে আছে! হাতে যেন সাদা কাপড়ের রুমাল!! রুমালে কি ক্লোরোফর্ম? আমাকে কি রুমাল শুকিয়ে অজ্ঞান করবে??আমি একবার সাগ্রতের দিকে তাকালাম! আরেকবার মাথা ঘুরিয়ে পিছন ফিরে জানালার বাইরে তাকালাম। উপায় যে আমার হাতে নেই তা বেশ জানি! কিন্তু সাগ্রত কি আবারো আমার কল্পনার মধ্যে এসে পড়েছে? ধরতে পারছিনা!! সাগ্রত হাত সোজা করলো। লম্বা লম্বা পা ফেলে আমার কাছে আসতে লাগলো!! আমার শরীরের টেম্পারেচার বুঝি বাড়তে লাগলো! গা কাপা শুরু হলো! সমস্ত শরীর ঘামতে লাগলো!! আমি জানালার পাশ থেকে সরে সরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বাদিকে চাপতে লাগলাম। লাভ হলো না! সাগ্রত আমার একদম কাছে এসে হুট করে দেয়ালে হাত রেখে দিলো। আমার মুখের দিকে ঝুকে আসলো। আমি ডানপাশে খালি পেয়ে পালাতে নিলে সাগ্রত দেয়াল থেকে বা হাত সরিয়ে আমার চুলের মুঠি আকড়ে ধরলো। আমি ব্যথা না পেলেও চোখমুখ কুচকে খিচ মেরে থাকি।। অনুভব হচ্ছিলো কেউ গালে লাগাতার ঠোট ছুয়িয়ে চলছে। উষ্ণ স্পর্শ গালের দিক থেকে যেতে যেতে চোয়ালে অনুভব হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে থুতনিতে উষ্ণ ছোয়া বসাচ্ছে। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে তার ঠোট ছোয়া।। কানের পাশে চুল সরিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো-

–স্নেহময়ী আমি থাকতে তুমি কষ্ট করছো কেন? আমার উপর কি বিশ্বাস নেই? বিশ্বাস করতে কষ্ট কেন স্নেহময়ী! আমি কি তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছি? বলো স্নেহময়ী, বলো প্লিজ!! তুমি একটা বারো আমায় স্মরন করো না!! তোমার মতো আশ্চর্য মেয়ে যে আমি আর দ্বিতীয়টা দেখিনা! সাফার জন্য পাগল হয়ে আছো? ওই সাফার জন্য? সাফা! যে তোমাকে কাজের বুয়ার মতো সারাটাদিন খাটায়! মনে নেই তোমার! কে তোমার খোঁজ রাখে? কে?? তোমার জন্য কিভাবে রুমে এসেছি জানো? তুমি কি জানো! কেন জানবে তুমি! কেন! আমি তো তোমার লাইফে এগজিস্ট লিস্টে নাই! ঠিক না!

-চলবে

-Fabiyah_Momo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here