ভুলবশত পর্ব-১৭

0
1630

#ভুলবশত♥
#PART_17(SUSPENCE)
#FABIYAH_MOMO

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। চারপাশ আরো সুনশান হয়ে নিস্তব্ধ আকার ধারন করলো। কেমন তব্দা লাগানো নিরব!! গা শিউরে উঠবে ছমছম।। সাগ্রত হেভি স্পিডে নিরিবিলি পাকা রাস্তায় গাড়ি তুলে হাইওয়ে ধরেছে। দুধারে ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে গাছের বিশালতায় সূর্যের আলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কি বিশাল বিশাল প্রকাণ্ড গাছ! মনে হয় দম্ভ নিয়ে ভয় দেখাতে দাড়িয়ে আছে বহুকাল! গাড়িতে টোটালি এসি বন্ধ। জানালা দুই সাইডের খুলে দেওয়া হয়েছে, তাতেই ঠান্ডা হাওয়ায় মাদকতা লাগছে।। বেশ সময় ধরে ড্রাইভ করছে সাগ্রত। মনটা আমার আনচান করছে কথা বলার জন্য। পেটে কথা রাখাটা বিরাট এক সমস্যা! কথা কাউকে শেয়ার না করলে পেটের ভেতর জটলা পাকাবে।। ছটছট করতে থাকবো আমি। সাগ্রতের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম, একটু কথা বলার চেষ্টা করি।। তাতেই বা ক্ষতি কি? গলার স্বর ইংরেজি মাস্টারের মতো নরম করে বললাম-

–একটা কথা বলা যাবে সাগ্রত? যদি অনুমতি থাকে তবে বলবো।
সাগ্রত ড্রাইভিং হুইলে হাত রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
–হু,
–আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
–কিছু কথা অজানা থাকুক। গেলে তবেই জানতে পারবে। আপাতত সিক্রেট থাকুক।
–তুমি জেনে হয়তো বিরক্ত হবে আমার তোমার সাথে একচুল কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা। তুমি শুধু শুধু তোমার এবং আমার মূল্যবান সময় খরচ করছো!
–তাহলে কি করতে ইচ্ছে করছে জানা যাবে? এনোদার প্ল্যান?
–কেন! তুমি জেনে কোন্ চুলোয় রান্না বসাবে!
–রান্না বসাবো কি না সেটা সম্পূর্ণ আমার ডিশিসন। তুমি বলো তোমার অন্য কোন প্লান ডিসাইড ছিলো।
–সাফা আপুকে খুজবো!
সাগ্রত ড্রাইভ করতে করতে খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। হাসার গতি দেখে বোঝা যাচ্ছে, গাড়িতে কেউ লাফিং স্প্রে ছড়িয়ে দিয়েছে।। সাগ্রত স্প্রের স্মেলের কারনে পেটব্যাথা করে হো হো শব্দে হাসছে। আমি চোখমুখ শক্ত করে তাকালে সে হাসি থামিয়ে সেধিয়ে যায়।। চুপচাপ আবার আগের মতো ড্রাইভ করতে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাগ্রত আবার বলে উঠে-

–স্নেহময়ী আমি কিছু জিজ্ঞেস করি? প্লিজ সুযোগটা দিও?
গলায় কঠোর বজায় রেখে আস্তে করে বললাম-
–হুম।
সাগ্রত বাকা দাঁতে হেসে দিয়ে স্পিড একটু স্লো করলো।। গাড়ির গতি কমে আসতেই সাগ্রত বলে উঠলো-
–সমুদ্র নাকি পাহাড়??
–উদ্ভট প্রশ্ন কেন করছেন?
–উদ্ভট না; প্লিজ বলো।।
–পাহাড়।
–রেল নাকি নৌকা?
–নৌকা।
–সূর্যদয় নাকি সূর্যাস্ত?
–সূর্যদয়।
–তুমি নাকি আপনি?
–তুমি…না মানে ক্ষেত্রবিশেষে তুমি বা আপনি বলি।
–ওকে নো প্রবলেম।। গান শুনবে? পুরোনো কোনো গান ছাড়ি?
–আমার গানটান একদম পছন্দ নাহ্! ইটস রাবিশ!
–একটা বার শুনে দেখো? পুরোনো একটা গান ছাড়বো।।
–বললাম না গান শুনতে ভালো লাগেনা!
–ভালো লাগতে হবেনা। জাস্ট শুনবে। কি শুনতে তো পারবে?? প্লিজ ফর ওয়ান টাইম??
আমি বিরক্তির শ্বাস ছেড়ে বললাম,
–এজ ইউর উইস!

সাগ্রত গাড়ির মধ্যে গান প্লে করলো। গান বাতাসের দোটানায় পুরোপুরি শোনা যাবেনা। তবুও সাগ্রত গানের লিস্ট থেকে বেছে একটা গান সিলেক্ট করলো।। সাইন্ড ফুল করে দিলো।। কি গান বলা যায় না।। ফাউলও হতে পারে। কিন্তু দেখা গেল গানটা অসম্ভব প্রাণদোলানো সুরে শুরু হলো, গান বাজতে লাগলো,

“দুঃখটাকে দিলাম ছুটি আসবেনা ফিরে,
একপৃথিবী ভালোবাসা রয়েছে ঘিরে,
মনটা যেনো আজ পাখির ডানা…
হারিয়ে যেতে তাই নেই তো মানা,

চুপিচুপি স্বপ্ন ডাকে হাত বারিয়ে…

মন চায় মন চায় যেখানে চোখ যায়
সেখানে যাবো হারিয়ে,
মন চায় মন চায় যেখানে চোখ যায়
সেখায় যাবো হারিয়ে,

……………………………………………..”

গান শুনতে শুনতে মুখে এবং মনে অজান্তেই কেন যেন হাসি চলে আসলো। এই বুঝি দুনিয়াবি পিছুটান সব শেষ হলো।। চারপাশ, আশপাশ, সবপাশ মিলে রয়েছে শান্তির আনাগোনা।। শান্তি নিকেতন নামে নতুন কোনো দিনের পাওয়া।। সাগ্রত হালকা হেসে গাড়ি চালাচ্ছে। মৃদ্যু ভঙ্গিতে তার শরীর দুলছে, বাইরের ঠান্ডা স্পর্শ শরীরে শিহরন জাগাচ্ছে। তার বাম ভ্রু’র কাটা দাগটা তাকে সুর্দশন করছে!! সুন্দর কি হতে হয়??চুলগুলো কেমন ছুটোছুটি করছে!! কার আগে কে কপালে টাচ করবে…এমন খেলায় মেতে উঠেছে।। চুলগুলো বাতাসের বেগে হেলেদুলে উড়ছে।। ঠোঁট প্রসারিত হয়ে হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।। তার ঠোঁটের কোণে কোণঠাসা হয়ে বেরুনোর চেষ্টা চালাচ্ছে বাকা চোখা দাতঁটি! দাতটিও কি আশ্চর্যের সাথে সুন্দর লাগছে।। আচ্ছা আজ কি সুন্দর লাগার দিন? সবই চোখের সামনে অসাধারণ দৃষ্টিতে ফুটে উঠছে?? সাগ্রতের সাদা শার্টটা কি অসম্ভব লাগছে! যেন শার্টটা ওর জন্যই তৈরী হয়েছে।।এক্সিলেটরে পা বসানো অবস্থায় তাকে সিনেমার হিরোর চেয়ে কম লাগছে?? অবশ্যই নাহ্! বেশিই লাগছে!! ফোল্ডেড হাতার কারনে হাতের উপর লোমস্তর গুলো কি অদ্ভুতদর্শনে মোহনীয় করছে!! পাশে কোনো মানবী বসলে একে একে হাজারবার ঘায়েল করে ছাড়বে! উফ! হাতটা একবার ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। ছুয়ে দেখলে কি সে হাসবে? নাকি তাচ্ছিল্যের সুরে বলবে, “উফ! স্নেহময়ী তুমিও না!! একটা কিস দিবে প্লিজ, তোমার উষ্ণ ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে হাতটি একবার ধন্য করো না প্লিজজ!!!”।পরিবেশের সজীবতা মনেপ্রাণে উজ্জীবিত হচ্ছে। এ যেন এক নতুন পরিবেশে পথচলা।। সবই কত সুন্দর!! কত পরিপাটি!! কত মাধুরী মেশানো জায়গা!! “সেই মন চায় মন চায়, যেখানে চোখ যায়….”গান!! আর কি লাগে মনে দুঃখ ভুলে কালো দিনের ঘুচাতে?? থাকুক না স্মৃতিগুলো যত্নময়ের সাথে!! স্মৃতির সিন্দুকে রাজ্যত্ব করুক শেষ দমের পূর্বে!! দম গেলেই তো স্মৃতি শেষ, তখন না হয় ভুলে যাব।।। সবুজ পাতার সতেজার সুভাষ বাতাসে বাতাসে জানান দিচ্ছে।। ধূলোবালি ছাড়া পরিস্কার বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে বুকে প্রাণোচ্ছল অনুভব হচ্ছে।।

হঠাৎ আমাদের গাড়িতে বিকট একটা শব্দ হলো! সাগ্রত আরেকটুর জন্য এক্সিডেন্ট করতে যেয়ে ব্রেক চাপলো! হুট করে ব্রেক কষাতে আমি গাড়ির সামনে ঝুকে পড়ি! সজোরে একটা ধাক্কা খাই! সাগ্রত ড্রাইভিং হুইলের সাথে বারি খেয়ে কপালে আঘাত পেলো।। আমার চোখের সামনে সব ঘোলাটে হতে লাগলো। তবুও শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে চোখ খুলে মাথা তুলে তাকালাম। শেষে সিটে হেলান দিয়ে মাথা ছেড়ে দিলাম।। সাগ্রতের মাথার সাইডে গাড়ির এক টুকরো কাচ ভেঙ্গে প্রচণ্ডরূপে লেগেছে।। অনেকখানি কেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরছে। সাদা শার্টে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়তে লাগলো।। মাথার বাম সাইড থেকে কানের পাশ দিয়ে লম্বা হয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বাম দিকের শার্ট পুরোটা রক্তে ভিজে যাচ্ছে।। অস্পষ্ট সুরে সাগ্রত বলছে,

–এ্যাটাক…গড হেল্প….এ্যাটাক।। সস্নেহহময়ী আর ইউ…আর ইউ ওকে…? তোতোমমার মমামা জেজেনে গেলো কিকিভাবে…? আহহ…

সাগ্রত মাথায় হাত চেপে বিড়বিড় করছে।। ওর বিড়বিড়ানি কথাগুলো আমি সব কান দিয়ে শুনলেও শরীরের এনার্জি লেভেল জিরোতে গিয়ে থমকে আছি।। মাথা ঘুরছিলো প্রচুর।। আমি জ্ঞানে ছিলাম। সাগ্রত টালমাটাল অবস্থায় এলোমেলো হাতে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ায় লেগে পড়েছে। গাড়ি স্টার্ট হচ্ছেনা।। সাগ্রত মাথায় হাত চেপে ঢোক গিলে পেছনের সিটে তাকালো।। আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও সাগ্রতের চোখেমুখে প্রথমবারের মতো ভয়ে সন্ঞ্চার দেখতে পেলাম। ও একেবারেই অস্থির হয়ে পড়লো।। আমাদের গাড়িতে কেউ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে।। পেছনের অবস্থা দুমড়ে মুচড়ে কাচ ভেঙ্গে পেছনের সিটে ছড়িয়ে পড়েছে।। হুড়োহুড়ি টাইপ পায়ের শব্দ পাচ্ছিলাম।। দলবল নিয়ে আমাদের দিকে পেছন থেকে কেউ এগিয়ে আসছিলো। শব্দটা আরো নিকটবর্তী হতেই সাগ্রত সামনে ঘুরে ঠোট ঠোট চেপে সর্বস্ব শক্তি খাটিয়ে গাড়ি স্টার্ট করতে সফল হলো।।রক্তাক্ত হাত দিয়েই গাড়ি চালাতে শুরু করলো।।

চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি।। আমি সিটে হেলান দিয়ে সাগ্রতের পানে আধো আধো চোখে পিটপিট করছি। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে সাগ্রতের।। মাথার আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে বাম হাত চেপে যত স্পিডে সম্ভব গাড়ি চালাচ্ছে।। স্পিডের কারনে আমারস শরীর হেলে গিয়ে জানালার উপর পড়লো।। মাথাটা জানালার উপর ছেড়ে দিতেই কেউ ভেজা হাতে আমার কবজি চেপে ধরলো।। তরল কিছুতে তার হাতের সাথে আমার হাতেও চিটচিটে অনুভূতি হচ্ছে।। সম্ভবত রক্ত! সাগ্রতের মাথায় চেপে ধরা হাতটিতে লেগে থাকা রক্ত! সেই রক্ত মাখা হাত দিয়েই আমাকে টেনে ধরেছে। শক্তি শূন্য দেহ নিয়ে মাথাটা ঠিক করতে ঠাই পাচ্ছিনা। কানে শুধু চিৎকার চেচামেচি বাজছিলো

— চোখ খোলা রাখো স্নেহময়ী! তোমাকে আমি কিচ্ছু হতে দিবো না!! তোমার মামাকে আমি সাকসেস হতে দিবো না স্নেহময়ী! নেভার ! ওপেন ইউর আইস স্নেহময়ী! ফর মি! প্লিজ ওপেন ইউর আইস !

-চলবে

-Fabiyah_Momo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here