আয়নামতি পর্ব-১৩

0
1920

#আয়নামতী
#পর্ব_১৩
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ছাপাখানার ভীড় কমে এল ধীরে ধীরে। আয়নার তখন বাড়ি ফেরার পালা। ভাইয়ের কাজে টুকটাক সাহায্য করে সে। কম্পিউটার শিখছে, ফটোশপের কাজটা শিখে নেবে ধীরে ধীরে। ছাপানোর কাজটা সে এখন পারে। তার বাগান পুড়ে ছাই হওয়ার পর সে আর বাগান নিয়ে আর স্বপ্ন দেখেনা। যেখানে তার ফুলের বাগান ছিল সেখানে ইট সিমেন্টের কারখানা উঠছে। আয়ান বুঝতে পারে বোনের মনের অবস্থা। কিন্তু কি আর করার? অতবড় বাগানবাড়িটা তো তাদের না। ফজলু মিয়ার। সেখানে আয়নারই বা কি বলার আছে?
আয়না উঠে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। আয়ান দোকান থেকে টুকটাক বাজার করে এনে আয়নার হাতে দিল। বলল, আম্মাকে দিস, বাকিগুলো আমি যাওয়ার সময় নিয়ে যাব।
আয়না মাথা দুলালো। রিকশা ডেকে রিকশায় উঠে বসলো। আনমনা হয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে রিকশার ছুটলো তড়িৎ গতিতে। কিছুদূর গিয়েই রিকশাওয়ালা খুকখুক করে কাশলো। বিদঘুটে গন্ধ আসলো যেন। আয়না ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। বলল
‘ মামা থামেন। আপনি কি মদ খেয়েছেন? কি গন্ধ আসছে। আল্লাহ!
রিকশাওয়ালা থামলো না। তড়িৎ গতিতে রিকশা চালাতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলল। টেম্পোগাড়ির সামনে গিয়ে উল্টে গেল রিকশা। বাজারের থলে ছিটকে পড়লো দূরে। আয়না চাপা পড়লো রিকশার নিচে। সাথে সাথেই জ্ঞান হারালো। লোকজন এসে তাকে সরাতেই দেখলো রক্তের ছাপ বসে গেছে পিচঢালা রাস্তায়। রিকশাওয়ালা ও গুরুতর আহত। আশেপাশের কয়েকটা লোকজন ছুটে এল। তাড়াতাড়ি হসপিটাল পাঠালো আয়না আর রিকশাওয়ালাকে। আয়নার কাছে কোনো তথ্য না থাকায় তার বাড়ির কেউ জানতে পারলো না।

তবে দুপুরে আয়ান বাড়ি ফিরতেই দেখলো আয়না নাকি আসেনি। নামিরা বলল
‘ আমি আরও ভাবলাম আয়না তোমার সাথে ফিরবে।
আয়শা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আজহার সাহেবকে শোনাতে না চাইলে ও শুনে ফেললেন তিনি। আয়ানকে বললেন
‘ মেয়েটাকে একা ছাড়লি কেন? মাথা গরম মেয়ে, কাকে কখন কি বলে ফেলে? একা ফেলে ক্ষতি করবে না? যুগ খারাপ।
আয়ান চলে গেল বাইরে। কোথায় গেল তার বোনটা? রহমত মিয়াকে আসতে দেখলো আয়ান। রহমত মিয়া এগিয়ে এল লম্বা পা ফেলে। বলল
‘ কিতা হইছে ভাই?
আয়ান বলল
‘ আয়না বাড়ি আসেনি।
রহমত মিয়া বলল
‘ কোথায় গেছে?
‘ জানিনা।
‘ আপনে কোথায় যাইতেছেন?
‘ দেখি কি করা যায়? নয়ত পুলিশকে গিয়ে বলব।
রহমত মিয়া বলল
‘ আমি ও যাব আপনার লগে।
আয়ান তাকে সাথে করে নিয়ে গেল।

___________

হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিরক্ত লেগে গেল অনুরাগের। হাত চেপে সামনে এগোতে একজন নার্স এসে বলল
‘ স্যার আপনি বসুন। রক্ত দিয়েছেন, আপনার এখন রেস্ট দরকার।
অনুরাগ বলল
‘ রোগী কেমন আছে? আই মিন তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে তো। রক্ত কি আর ও লাগবে? ডক্টর যে বললো।
নার্স বলল
‘ না স্যার। আপাতত রক্ত লাগবে না। তবে পেশেন্ট হাতে আর মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছে। অনেকদিন বেড রেস্ট এন্ড প্রপার ট্রিটমেন্ট দরকার। বাই দ্য ওয়ে স্যার, উনি আপনার কে হয়?
অনুরাগ ভড়কে গেল। নার্স বলল
‘ কে হয় স্যার? পেশেন্টের নাম?
‘ পেশেন্টের নাম আয়নামতী।
নার্স লিখতে গিয়ে থেমে গেল। বলল
‘ আয়নামতী?
‘ জ্বি। হসপিটালের বিলটা দিন। আমাকে যেতে হবে।
‘ কিন্তু স্যার। পেশেন্ট?
অনুরাগ বলল
‘ ওনার ভাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে খবর পেয়ে গেছে। চলে ও আসছেন বোধহয়। আপনারা রোগীর অবহেলা করবেন না। আমি যাচ্ছি। আর হ্যা বিলটা?
নার্স বিল দিল। বলল
‘ আর মেডিসিন?
অনুরাগ বলল
‘ আমি মেডিসিন কিনে নিয়ে আসছি। বিলটা ও দিয়ে যাচ্ছি।
নার্স মাথা দুলালো। অনুরাগের যাওয়া থামিয়ে দিয়ে আবার ডাকলো।
‘ স্যার আয়নামতী কে হয় আপনার? বললেন না যে,,,
অনুরাগ ফিরলো। বলল
‘ কিছু হওয়া লাগেনা। মানুষ মানুষের জন্য। এটুকু সাহায্য করতেই পারি। ভালো মেয়ে। চিনতাম, জানতাম। দেখলাম রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। চুপ থাকতে পারিনি। এগিয়ে গেলাম। ভাগ্যবশত রক্ত ও ম্যাচ পড়লো। নইলে আমাকে আবার রক্ত যোগাড় করতে যেতে হতো। আমাকে একটা কাজে যেতে হবে। ভালোই হয়েছে মিলে গেছে।
নার্স হাসলো। বলল
‘ ধন্যবাদ স্যার। আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য।
অনুরাগ বলল
‘ ঠিক আছে। তবে পেশেন্টের কাছ থেকে এসব আড়ালে থাকাই ভালো। পেশেন্ট কারো সাহায্য নেওয়া কম পছন্দ করে। দেখা যাবে, আমি সাহায্য করেছি শুনে আর ও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। বুঝেছেন নিশ্চয়ই?
নার্স প্রসন্ন হেসে বলল
‘ ডোন্ট ওয়ারি স্যার। আই উইল ম্যানেজ।
অনুরাগ মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।

আয়ান দোকানের দিকে আসতেই মাঝপথে শুনতে পেল একটা রিকশার ঘন্টা খানেক আগে এক্সিডেন্ট হয়েছে। রিকশাওয়ালার অবস্থা খারাপ। একটা মেয়ে ও ছিল। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। আয়ানের মনে কু ডাকলো। এ নিশ্চয়ই তার বোন হবে। সে ও তো রিকশায় উঠেছিল। তারমানে?
দুরুদুরু বুকে আয়ান রহমত মিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। নার্সকে ডেকে বলল
‘ এখানে আয়না নামের কাউকে ভর্তি করা হয়েছে? এক্সিডেন্ট হয়েছে?
নার্স বলল
‘ আয়না নয়, আয়নামতী হবে নিশ্চয়ই।
আয়ান বলল
‘ নাহ নাহ।
রহমত বলল
‘ হ্যা হ্যা। আয়নামতীই। কোথায় আছে আপা?
আয়ান রহমতের দিকে তাকালো। সে কিছুই বুঝলো না। তবে দৌড়ে গেল নার্সের পিছু পিছু। নার্স বলল
‘ জনৈক ভদ্রলোক ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছেন। রক্ত ও দিয়েছেন। ভাগ্যিস ম্যাচ পড়ে ছিল।
আয়ান বলল
‘ উনি এখনো আছেন?
‘ নাহ চলে গিয়েছে। উনার জরুরী কাজ আছে, নইলে থাকতেন৷
আয়ান আয়নার কাছে ছুটে গেল। ব্যান্ডেজ মোড়ানো বোনকে দেখে চোখ ভিজে উঠলো। সুস্থ সবল মেয়েটা রিকশায় উঠেছিল। এরকম হলে সে কখনোই ছাড়ত না বোনটাকে। আয়নার জ্ঞান ছিল। আয়ানকে দেখে নরম গলায় বহুকষ্টে বলল
‘ ভাইয়া ফুল বেঁচার টাকা পাশের বাড়ির চাচীকে দিইনি। ওগুলো হাসপাতালে দিয়ে দিও। আমি চাচীকে বুঝিয়ে বলব।
আয়ান ধমক দিয়ে বলল
‘ ওসব তোর চিন্তা করতে হবে না। আমি দেব।
‘ তোমার কাছে অত টাকা কোথায়? কত হাজার লাগে হিসেব নেই।
আয়ান বলল
‘ বিল তো কে যেন দিয়ে গেল। সে যাইহোক আমি ভদ্রলোককে খুঁজে পেলে টাকাগুলো দিয়ে দেব।
আয়না বলল
‘ কে দিল? কেন দিল?
আয়ান বলল
‘ উত্তেজিত হোস না তো। দিয়ে দেব বলছি তো। তুই ভেঙে পড়িস না। আব্বা আম্মাকে সামলাবো কি করে আমি?
আয়না বলল
‘ আমি কি আব্বার মতো হাঁটতে পারব না?
আয়ান বোনের চোখের কোণায় লেগে থাকা জল মুছে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যান্ডেজের উপর আদর দিয়ে বলল
‘ টুনি হাঁটবে না৷ উড়বে ডানা মেলে।
আয়না বলল
‘ কেন মজা করো? আমার ভয় লাগছে।
আয়ান বলল
‘ কেন হাঁটতে পারবি না। পারবি।
আয়না চোখ বন্ধ করলো। সাথে দুফোটা জল গড়ালো। আচমকা ডুকরে কেঁদে উঠে সে বলল
‘ আমাদের সাথে কেন সব খারাপ হয় ভাইয়া? আমরা কি দোষ করেছি?
আয়ান সাথে সাথে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল
‘ আরেহ নাহ। কোনো দোষ না। এগুলো উপরওয়ালার পরীক্ষা। আমি আছি বোনটা। তুই একদম সুস্থ হয়ে যাবি।

____________

অনুরাগ চটগ্রামের মেইন থানার ওসি আবুল কাশিমের সাথে থানায়। আবুল কাশিম সম্পর্কে তার মায়ের জেঠাত ভাই। তার মামা লাগে। অনুরাগ বিশেষ কারণেই তার মামার কাছে এসেছে।
গরাদে কাছে কারো চিৎকারের চেঁচামেচি কানে আসছে। কাকে যেন রিমান্ডে রেখেছে। উরুধুরা পেটানোর আওয়াজ আসছে। অনুরাগ কৌতুহল নিয়ে বলল
‘মামা এই আসামিটা কে? কেন এভাবে মারছেন?
আবুল কাশিম হেসে ফেলল। দাড়িয়ে বলল,
‘ চলো দেখে আসি। সারপ্রাইজ?
অনুরাগ পিছু পিছু গেল। গরাদের ভেতর চেয়ারে বসা হাত পা বাঁধা মহিবুলকে দেখলো। অনুরাগের কপাল কুঞ্চন হলো। বলল
‘ আমি এমনটা চাইনি।
আবুল কাশিম বলল।
‘ ও সত্যটা স্বীকার না করা পর্যন্ত এভাবে মাইর চলবে।
অনুরাগ বলল
‘ তাহলে তো কুহেলীকে ও এখানে রাখা উচিত। শুধু ওর গর্ভে সন্তান আছে বলে, নইলে।
আবুল কাশিম বলল
‘ চিন্তা করো না। ওই মেয়েকে আমি জব্দ করব। এ আগে সত্যটা স্বীকার করুক।

অনুরাগ সামনে গেল। মহিবুল চিৎকার করে বলল
‘ মিঃ চৌধুরীআপনি ভুল করছেন? কুহেলীর গর্ভে আমার বাচ্চা নয়।
অনুরাগ বলল
‘ তাহলে বাচ্চা কি উড়ে উড়ে এসেছে? কুহেলীর সাথে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি এখনো। কুহেলীর সাথে তুমি ঘনিষ্ঠ হয়েছ। প্রমাণ ও আছে আমার কাছে, পুলিশের কাছে। তারপর ও সত্যটা স্বীকার করছো না কেন? বাচ্চার দায়িত্ব নিতে হবে বলে?
মহিবুল কেঁদে বলল
‘ আমাকে ছেড়ে দিতে বলেন। নইলে আমি।
পুলিশ জোরে লাঠির বাড়ি দিল। মহিবুল চেঁচিয়ে বলল
‘ আমাকে মারবেন না। প্লিজ মারবেন না।
অনুরাগ বলল
‘ সত্যটা স্বীকার করো। কুহেলীর বাচ্চাকে স্বীকার করো। নইলে ছবিগুলো আমি সাংবাদিকের হাতে তুলে দেব। তোমার ক্যারিয়ার ও নষ্ট হবে।
মহিবুল বলল
‘ নাহ নাহ এমন করবেন না। করবেন না। অনুরাগ বলল
‘ তাহলে স্বীকার করো। কুহেলীর গর্ভে তোমার বাচ্চা। বলো।
মহিবুল বলল না। পুলিশ উরুধুরা পেটালো। একপর্যায়ে এসে মহিবুল আর না পারতে সব স্বীকার করলো। অনুরাগ হাত ঝাড়লো। ভাবলো
‘ কুহেলীর বিয়েটা কি ধুমধাম করে দেওয়া দরকার? নাকি চুপিচুপি?

চৌধুরী বাড়িতে ফিরে গেল অনুরাগ। কুহেলী সোফায় বসা ছিল। শায়লা বেগম নিজ হাতে এটা ওটা বানিয়ে খাওয়াচ্ছে ছেলের বউকে। কাল কুহেলীর মা বাবা ও দেখে গেল। অনুরাগকে ফিরতে দেখে কুহেলী চলে গেল ঘরে। অনুরাগ শার্ট পাল্টে অন্য শার্ট গায়ে দিতেই পারলো না। কুহেলী দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো। বলল
‘ আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আপনার প্রতি।
অনুরাগ হাতের আঙুল ছাড়াছাড়া করে রাখলো কুহেলীর স্পর্শে। জোরে ধাক্কা দিতেই কুহেলী সরে পড়লো। ভয়ার্ত চোখে নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ পড়ে গেলে কি হতো? এমন করলেন কেন?
অনুরাগ ফিরে যেতে চাইলো। কুহেলী আবার দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো। অনুরাগের মুখে গলায় ঠোঁট ছুঁয়াতেই অনুরাগ আরেক ধাক্কা দিল। কুহেলী তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে অনুরাগ আবার ধরে ফেলল। সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল
‘ বাড়াবাড়ি করো না। আমি তোমার আর মহিবুলের সন্তানের মৃত্যুর কারণ হতে চাইছি না। মহিবুল আসছে। তৈরি হয়ে নাও যাওয়ার জন্য।
কুহেলী শাড়ির আঁচল টেনে মুখে গুঁজলো। পা আঁকড়ে ধরলো অনুরাগের। বলল
‘ নাহ নাহ এমন করবেন না। অনুরাগ পা সরিয়ে নিল। বলল
‘ তালাকনামা রেডি। তোমাকে আমি তালাক দিলাম। এক, দুই তিন তালাক। তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই,ছিল না। তুমি ক্ষণিকের জন্য আমার জীবনে এসেছ অভিশাপ হয়ে। এবার দূর হও। তোমার মতো মেয়েগুলোকে আমি ঘেন্না করি। বের হও। যদি এক্ষুণি আমার সামনে থেকে না যাও, তাহলে চড় মেরে মেরে বের করব। দূর হও। কুহেলী আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি দূর হও।

কুহেলী এলোমেলো কেঁদে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আনহিতার কাছে গিয়ে পা ধরে কেঁদে বলল
‘ মা আমি যাব না। কোথাও যাব না। আপনার ছেলেকে বুঝান না? আমার বাবা এসব শুনলে মরেই যাবে। মা,আমি যাব না।
আনহিতা চরম অবাকের পর্যায়ে। অনুরাগ আসলো। কুহেলীর হাত ধরে টেনে তুললো। টেনে ঘরের বাহিরে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ চুপচাপ চলো কুহেলী। নইলে তোমারে বাবার কানে যাবে।
কুহেলী চুপ হয়ে গেল। অনুরাগ গাড়িতে তুললো তাকে। কুহেলী কাঁদতে কাঁদতে গেল পুরোটা রাস্তা। অনুরাগ কিছু বললো না। কাজী অফিস দেখে হাউমাউ করে কাঁদলো অনুরাগ। আধমরা মহীবুলকে দেখে কুহেলী চেঁচিয়ে কাঁদলো আর ও। বলল
‘ নাহ নাহ। এমনটা করবেন না। আমাকে মেরে ফেলুন কিন্তু এমনটা করবেন না।
অনুরাগ টেনে নিয়ে গেল তাকে। কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে ফিরিয়ে দিল তার লাল শাড়ি,গয়না সমস্ত জিনিসপত্র। যা ড্রাইভার নিয়ে এসেছিল। কুহেলী কাঁদছে। পুলিশ, উকিল আর অনুরাগের সামনে মহীবুলকে মেনে নিতে হলো কুহেলীকে। কুহেলী না কবুল বললো, না স্বাক্ষর করলো। না অনুরাগের তালাকনামায় স্বাক্ষর বসালো। কিছুই করলো না। অনুরাগ তাকে মহীবুলের দিকে ঠেলে দিয়ে তালাকনামা ছুঁড়ে দিয়ে রক্তচোখে বলল
‘ খবরদার কুহেলী। আর কখনো যদি আমার সামনে আসো, তোমাকে খুন করতে দুবার ভাববো না আমি। তোমার মতো বিশ্বাসঘাতককে বেঁচে থাকার সুযোগ দিয়েছি এই বেশি। তোমার এই সন্তানের জন্য বেঁচে গেছ তুমি। নইলে,,
কুহেলী জ্ঞান হারালো সাথে সাথেই। পুলিশ অফিসার মহীবুলকে বলল
‘ যাহ তোর বউকে নিয়ে। সব জানাজানি হওয়ার আগে ম্যানেজ কর নইলে সব শেষ। পথে বসে বসে ভিক্ষা করতে হবে।
মহীবুল বাধ্য হয়ে নিয়ে গেল কুহেলীকে। অনুরাগ কুহেলীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জোরে লাতি বসালো কাজীর টেবিলে। ছোটখাটো কাগজপেপারে ভর্তি টেবিলটা অনায়াসে এমন জোড়ালো লাতি সহ্য করতে না পেরে উল্টে পড়ে গেল। সবাই বিস্ফোরিত চোখে তাকালো অনুরাগের দিকে। কথা বলার সাহস পেল না। অনুরাগের মাথার চুল খামচে ধরলো একহাতে। অন্য হাতে চেয়ার তুলে ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ এরকম কুহেলীর মৃত্যু হোক। মৃত্যু হোক।
আবুল কাশিম গিয়ে হাত রাখলো অনুরাগের মাথায়। অনুরাগ হাতটা ঝেড়ে ফেলে দিল। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল কাজী অফিস থেকে।

আনহিতা আর শায়লা বেগম এদিকওদিক পায়চারি করছেন শুধু। কি হয়ে গেল সব তাদের মাথার উপরে। অনিমার সাথে মুঠোফোনে কিছু আগেই কথা হলো। সে বলল
‘ আমি বলেছিলাম এই মেয়ের মধ্যে কোনো ঘাপলা আছে। নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা হয়েছে।
শায়খ চৌধুরী এসে সবটা শুনে চিন্তায় পড়লেন। অনুরাগ তো এখনো ফিরলো না।

হসপিটালের করিডোরে বসা অনুরাগকে দেখে নার্স ছুটে এল। বলল
‘ স্যার পেশেন্টকে দেখতে এসেছেন?
অনুরাগকে খিটখিটে মেজাজে বলল
‘ কোন পেশেন্ট? আমি ট্রিটমেন্ট নিতে এসেছি। আমি অসুস্থ। খারাপ লাগছে।
নার্স ভয় পেয়ে গেল। অনুরাগ বলল
‘ তাড়াতাড়ি মেডিসিন দিন। যাতে গত এক সপ্তাহের সবকিছু আমি ভুলে যেতে পারি। কুহেলী নামটা ভুলে যেতে পারি।
নার্স বলল
‘ স্যার এনি প্রবলেম?
অনুরাগ রেগে গেল। বলল
‘ যা বলেছি তাই করেন। আর দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন আমার সাথে, মেয়ে মানুষ মানেই প্রতারক।
নার্স ভড়কে গেল। এই লোকটা তো দুপুরে ঠিকঠাক কথা বললো। এখন কি হলো? নার্স ডাক্তার ডেকে আনতে চলে গেল।
অনুরাগের হাতের ভর দিয়ে বেঞ্চে বসে থাকলো। আয়না পা টিপে টিপে আসলো। পায়ে তেমন শক্তি নেই, তবে অনুরাগের গলার আওয়াজ শুনেই আসলো। ধপাস করে বেঞ্চের কোণায় বসে পড়ে বলল
‘ টাকা আপনি দিয়েছেন?
অনুরাগ ফিরে আয়নাকে চাইলো। তারপর চোখ আবার নিচে নামিয়ে ফেলে বলল
‘ আয়নামতী যে! ভারী শক্তপোক্ত মেয়ে তুমি। অন্য মেয়ে হলে কেউ হাত পা ও নাড়াতো না। তুমি তো উঠে দাঁড়িয়ে গেলে।
হাসলো আয়না। বলল
‘ আমার লড়াই অনেক বড় কিছুর সাথে । এই সামান্য ব্যাথা বেদনার কাছে হেরে গেলে তো চলবে না।
অনুরাগ মাথা দুলাতে দুলাতে বলল
‘ তা ঠিক। তা ঠিক।
‘ আপনি কি অসুস্থ? কেমন যেন মনে হচ্ছে?
অনুরাগ হেসে ফেলল আচমকা। বলল
‘ আরেহ না। তুমি নিজে অসুস্থ তাই আমাকে ও অসুস্থ মনে হচ্ছে। আমি এতদিন অসুস্থ ছিলাম বুঝলে, এখন সুস্থ আছি। একদম ফিট।
আয়না বলল
‘ বুঝলাম। একটা কথা বলি, আপনি কত টাকা দিয়েছেন? মানে বিলের কথা বলছি।
অনুরাগ গর্জে বলল
‘ আরেহ আমি কি জানি? মনে নেই ওসব ফালতু কথা । মাথা খারাপ করো না। যাও। আমার সাথে কথা বলতে এসো না। তোমার সাথে আমার কিসের কথা? হ্যা? কিসের কথা? যাও৷ সব মেয়েরাই বিশ্বাসঘাতক,প্রতারক, মিথ্যেবাদী। শুধু উপরে সতীসাধ্বী ভালো সাজার নাটক করে। ভালো অভিনয় পারো তোমরা। যত্তসব।

অনুরাগ উঠে চলে গেল। আয়না মাথায় হাত চাপলো। ভাবলো, এই প্রফেসরের বউ পালালো টালালো নাকি? নাহলে এরকম পাগলামি করছে কেন? পালালে ভালো। না পালালে আর ও ভালো।
আয়ান ঔষধের দোকানে গিয়েছে। এসে দেখলো আয়নাকে পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। আয়ান দৌড়ে আসলো। বোনকে ধরে বলল
‘ কি হচ্ছে টুনি? হাঁটতে নেমে গেছিস?
আয়না বলল
‘ আমি বাড়ি যাব ভাইয়া।
আয়ান বলল
‘এখন নাহ। কাল। কালই নিয়ে যাব তোকে। আম্মা আসছে তো। আব্বাকে মিরা দেখবে।
আয়না বলল
‘ আম্মা কি কাঁদছে?
আয়ান চুপসে গেল। বলল
‘ হ্যা।
আয়না বলল
‘ আম্মা তো আমায় দেখতে পায় না। আমি তো কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। তাহলে কাঁদবে কেন?
আয়ান বলল
‘ ধুরর পাগলী, আম্মা তোকে অনেক দেখতে পায়। দেখায় না আর কি। মায়েরা এমনি হয়। মায়ের ভালোবাসা শাসনে প্রকাশ পায়।

__________

অনুরাগকে ঘরে আসতে দেখে আনহিতা ছুটে গেল। বলল
‘ বউ কোথায় সোহাগ? কি হয়েছে তোমার? এলোমেলো লাগছে কেন? চেহারার এই হাল কেন?
অনুরাগ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
‘ কিছু হয়নি। সরো। তোমাদের সবার কথা আমি আর শুনব না। এবার থেকে নিজের জীবনের প্রতিটা সিদ্ধান্ত নিজেই নেব। নিজের কথা নিজে শুনবো। নিজের যা মনে হয় তাই করব।
আনহিতা কিছুই বুঝলেন না। অনুরাগ আবার বলল
‘ কুহেলী তার বাপের বাড়ি। আমি না বলা পর্যন্ত কেউ ওর সাথে কথা বলার, যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। যদি করো, তাহলে এই বাড়িতে আমার সেদিনই শেষ দিন হবে।
আনহিতা ভয়ে ভয়ে বললেন
‘ ঠিক আছে। কখনোই বলব না আব্বা। তুমি যা বলো তাই হবে।
অনুরাগ উপরে চলে গেল। পুরো ঘরটা এলোমেলো করে ফেলল। বিছানার বেডশীট,বালিশের কভার সব নামিয়ে দিল একটানে। সব এলোমেলো করে দিয়ে বললো
‘ কুহেলীর কোনো অস্তিত্বই রাখবো না আমি। বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক।
আনহিতা বাইরে থেকে ছেলের গর্জন শুনে ভড়কে গেলেন। মাথায় হাত চাপড়ে বললেন
‘ হে খোদা কি হলো এটা? কুহেলী কি করলো আবার?
অনুরাগ ঘর থেকে বের হয়ে এল। সব বেডশিট, কুহেলীর তোয়ালে,শাড়ি বাকি সব নিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল। বাগানের কাছে সব রাখলো। কেরোসিন ঢেলে দিল। আগুন ধরিয়ে দিল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। আনহিতা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলেম, আগুনের পাশে দাঁড়ানো অনুরাগকে। তার চোখের ধারালো দৃষ্টি আগুনের চাইতে ও উত্তপ্ত। যেন রক্ত ঝড়বে কিছু পরেই।
আনহিতা কিছু ভালো করে জানতে ও পারলো না। অনুরাগ বাড়ি ছেড়ে চলে গেল ব্যাগপত্র গুছিয়ে। সে আর থাকবেনা এই নরকে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here