#আয়নামতী
#পর্ব_২১
#পুষ্পিতা_প্রিমা
আয়শা বেগম এতদিন শুনে এসেছেন মেয়ের ইয়া বড় বিশাল একটা বাগান আছে। হ্যান আছে, ত্যান আছে। কিন্তু দুচোখে একবারও দেখেননি। এই প্রথমবার দেখামাত্রই চোখ কপালে উঠলো ওনার। আয়না ভুরু উঁচিয়ে মাকে বলল
‘ সুন্দর নাহ আম্মা?
আয়শা বেগম হা করা মুখ বন্ধ করলেন। গালে হাত দিয়ে বললেন
‘ ওমা, মেলা বড় এই বাগানবাড়ি। এইটা তোর?
আয়না বলল
‘ হ্যা। ওই যে দেয়াল দেখছ ইটের। ওইটুকু পর্যন্ত কাকুর জমির সীমানা। যা রূপার নামে দিয়ে গেছেন। ওতটুকু পর্যন্ত যদি বাগান করে ফেলি তাহলে কতবড় হবে ভাবতে পারছো আম্মা?
আয়শা বেগম বলল
‘ হ, অনেক বড়। অনেক মানুষ কাম করে নাহ?
‘ হ্যা, আমি কি একা পারব নাকি? এবার থেকে ফুল আর কোথাও যাবে না আম্মা। ওই দোকানেই ফুল বিক্রি হবে এবার। পাইকারি বিক্রি করব৷ ফুল বিক্রেতারা এসে কিনে নিয়ে যাবে। সুলভ মূল্যে বেঁচতে পারব।
আয়শা বেগম বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলেন
‘ এখন বুঝছি সংসারে টাকা কোত্থেকে দিতি তুই। আল্লাহ অনেক বড় করুক৷ ওই ছোট্ট হাতে করা এত বড় বাগান। আল্লাহ আমার তো এখনো বিশ্বাস করবার মন চাইতেছে না।
আয়না হেসে ফেলল। বলল
‘ আমার হাত কি ছোট আম্মা?
‘ হ ছোডই তো। এইদিন হলো তুই হলি। কত খুশি হলো তোর বাপ ভাই। বাবু তো খুশিতে একসপ্তাহ স্কুল কামাই করলো৷ পড়ালেখা বাদ দিয়া টুনি টুনি করে পাগল হলো।
আয়না শুনে হাসতে লাগলো। শেষে বলল,
‘ ভাইয়া ভাবি কোথায়? বাবু কার কাছে?
আয়শা বেগম এদিকওদিক চোখ বুলালেন। দূরে আঙুল দেখিয়ে বললেন
‘ ওই তো রূপুর কাছে৷ কোল থেকে পড়ে গেলে শেষ আমার ভাই৷ ওরে কে কোলে দিছে?
আয়না গিয়ে কোলে নিয়ে নিল সায়ানকে। রূপা গাল ফুলিয়ে বলল
‘ থাকুক না আমার কাছে।
সায়ান ও হাত পা নেড়ে কেঁদে উঠলো। আয়না আবার দিয়ে দিল রূপার কোলে। ছোট্ট গাল দুটো দু আঙুল দিয়ে টিপে দিয়ে বলল
‘ বাব্বা এখন রূপাকে মনে ধরেছে পঁচা ছেলে?
সায়ান কি বুঝলো কে জানে? কান্না থামিয়ে দন্তহীন গালে হাসলো। আয়না বলল
‘ কি সুন্দর করে হাসে আব্বা?
সায়ান হাসতেই থাকলো৷ রূপা বলল
‘ পুরা পাগল৷ এমনি এমনি হাসে৷ এমনি এমনি কাঁদে।
আয়না চুমু দিল সায়ানের দু গালে। নাক টেনে দিয়ে বলল
‘ আমাল আব্বা চুন্দল। গুলুমুলু।
সায়ান খেউমেউ করে মেতে উঠলো। আয়না বলল
‘ ধুর পাজি ছেলে খেউ মেউ ছাড়া কিছু বলতে জানেনা।
____________
বাগান থেকে একটি জারবেরা ছিঁড়ে নিল আয়ান। নামিরার কানে গুঁজে দিল।
নামিরার ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি। ফুলটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলল
‘ বাগানের মালিনী তো রাগ করবে ফুল ছিঁড়েছ দেখলে। এটা ভালো হয়নি শ্বশুরের ছেলে।
আয়ান একগাল হাসলো। বলল
‘ মালিনী তোমার শ্বশুরের মেয়ে। সো চাপ নেওয়ার দরকার নেই।
নামিরা আবার ও হাসলো। হাত দুটো বাড়িয়ে শক্ত করে ধরলো আয়ানকে। বুকে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে রইলো অনেক্ক্ষণ। তারপর মাথা তুলে এদিকওদিক তাকিয়ে বলল
‘ কেউ দেখেনি তো?
আয়ান হেসে ফেলে বলল
‘ দেখেছে হয়ত। দেখুক সমস্যা কি? আমরা কি লুকিয়ে প্রেম করছি নাকি? যে ধরা পড়ার ভয় থাকবে?
নামিরা আলতো করে হাত চাপড়ে দিল বুকে৷ বলল
‘ যেতে দাও। আম্মা ডাকবে।
‘ ডাকেনি এখনো৷
বলেই আয়ান মুখ নিয়ে গেল ওই কানে গুঁজে দেওয়া ফুলের কাছে৷ গন্ধ শুঁকে বলল
‘ এই ফুলের চাইতে আমার তুমিটা বেশি সুবাস মিরা।
নামিরা একদম নতুন প্রেমে পড়া প্রেমিকার মতো লজ্জায় রাঙা হলো। আয়ান তার রাঙা মুখখানা দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
নামিরা নাকফুলিয়ে বলল
‘ ধ্যাত।
********
দুপুরের ঠা ঠা রোদ। উঠোনে রোদ এসে পড়েছে। আয়শা বেগম সায়ানকে রোদে বসিয়েছেন যাতে একটু রোদ গায়ে লাগে। সরিষার তেল ফর্সা পিঠটাতে মালিশ করেছেন। রোদ পড়ায় চকচক করছে পিঠ। আজহার সাহেব কোনোমতে খুঁড়িয়ে হেঁটে উঠোনে পা রাখলেন। সাদা চটের উপর নাতিকে বসে থাকতে দেখে বললেন
‘ ওরে একটা জামা পড়ায় দাও। উদাম রাখছো কেন?
আয়শা বেগম কোলে নিয়ে নিলেন। সায়ান দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসাসূচক শব্দ করে
‘ এঃ?
আয়শা বেগম কোলে তুলে নেন। উঠোন থেকে বাড়িতে পা রাখার আগেই গাড়ির হর্নের আওয়াজ শোনা যায় বাইরে। আয়না আর নামিরা বের হয়ে আসে। গাড়িটা এসে থামে উঠোনে। সাদা খয়েরী মিশেল রঙের সেলোয়ার কামিজ আর মাথায় ওড়না পরিহিত একটা অল্পবয়স্কা মেয়ে বেরিয়ে আসে। সাথে একজন মধ্যবয়স্কা আর মধ্যবয়স্ক পুরুষ।
আয়না খুশি হয়। নামিরা তাকিয়ে রইলো।
আয়না এসে সালাম করলো সেলিনা বেগম আর আমিন সাহেবকে। হীরাকে বলল
‘ কেমন আছেন আপু? ভাইয়া এক্ষুনি বের হয়েছে। পইপই করে বলে গিয়েছে আপনারা আসবেন তা যেন মাথায় রাখি।
হীরা হাসলো। আয়শা বেগমের পা ছুঁয়ে সালাম করলো। আজহার সাহেবকে করতে গেলে তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন
‘ অনেক বছর বেঁচে থাকো।
হীরা নামিরার দিকে তাকালো। নামিরা ঘরে চলে গেল। হীরার চেহারাটা খানিকটা নিভে গেল। আয়না দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো হীরার পাশে। বলল
‘ আপু ঘরে আসেন। আঙ্কেল আন্টি আপনারা ও আসেন। ভাইয়া এক্ষুণি চলে আসবে।
হীরা মা বাবাকে যেতে বলল। সায়ানের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। বলল
‘ কেমন আছেন সায়ান বাবু?
সায়ান দাঁত খেলিয়ে হাসলো। হীরা কোলে নিয়ে বলল
‘ ওরেবাবা চিনতে পেরেছে আন্টিকে।
নামিরা কোথা থেকে যেন এল। সায়ানকে কোলে নিয়ে ফেলল। আয়শা বেগমদের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ ওর খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
আয়শা বেগম হাসলো হীরার সাথে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
‘ আসো আম্মা তোমার সাথে কথা কয়। আমার বাবুটারে বাঁচাইছো তুমি।
হীরা বলল
‘ আমি বাঁচাইনি। উপরওয়ালার বাঁচিয়েছেন। আমি তো শুধু উছিলা। অর্ক কোথায় গেছেন?
‘ অর্ক?
হীরা বলল
‘ ওই মানে আপনার ছেলে, আয়ান। ওনাকে তো আমরা অর্কই ডাকি। আগের নামটা তো জানতাম না।
‘ ওই বাজারে গেছে। অনেকদিন পর বাজারে গেল। কে জানে কি করে?
হীরা এদিকওদিক তাকিয়ে চারপাশটা দেখলো। ইট,কাঠ,টিনের ঘর। রুমগুলো আসবাবপত্রে ঠাঁসা। গোছানো। অনেক সুন্দর। হীরা বলল
‘ আঙ্কেল আগে কি করতেন?
‘ পেঁয়াজ রসুনের ব্যবসা করতো। এখন তো কিছুই পারেনা। মেয়েটাই সব সামলায়। বাবু হারানোর পর তো মেয়েটাই সব দায়ভার নিল। বাগান আছে। ওখান থেকেই পয়সা আসে তা দিয়ে যা হয় আর কি। বাবু চাকরির খোঁজ লাগাবো এইবার। আগের বার তো ছাপাখানা দিল কিছুর কিছুই হলোনা। আমার বাবুটা কত দুঃখ পেল।
চোখে ভিজে আসলো আয়শা বেগমের। হীরা বলল
‘ কাঁদবেন না আন্টি। আর অর্ককে চাকরি খুঁজতে হবে কেন? বাবা তো বলেছে আমাদের কোম্পানিতে সিনিয়র ম্যানাজার পদে ঢুকতে। উনি তো অনেককিছু পারেন, ভালো গ্রাফিক্স ডিজাইন পারেন,অফিসিয়াল সমস্ত কাজ বুঝেন। আমার বাবার একজন বিশ্বস্ত মানুষ দরকার। অর্ক কথাও দিয়েছিল, উনি কখনো বাবার কথা কখনো অমান্য করবেন না।
আয়শা বেগম বলল
‘ ওখানে মারপিট হয়?
হীরা হেসে বলল
‘ নাহ নাহ। মারপিট কেন হবে? একদম নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন আপনি।
‘ কিন্তু ওগুলা তো শহরে। আমার বাবুরে শহরে রাইখা ঘুমামু কেমনে? আমার একটাই ছেলে । আর হারাইতে চাই না।
হীরা বলল
‘ আন্টি আপনারা সবাই ও শহরে চলেন। সায়ান আর সায়ানের আম্মু ও যাবে। আয়না ও। আঙ্কেল ও।
আয়শা বেগম চোখ বড় বড় করে তাকায়। বলে
‘ ভিটেমাটি ছাইড়া শহরে?
হীরা বলল
‘ সপ্তাহে সপ্তাহে দেখতে আসবেন।
আয়না নাশতার ট্রে নিয়ে এসে বলল
‘ রূপার স্কুল এখানে। আর আমার বাগান ও।
হীরা বলল
‘ ওহহ।
আয়না বলল
‘ ভাইয়া সপ্তাহে সপ্তাহে আসবে আর কি। সমস্যা হবে না আম্মা।
আয়শা বেগম চুপ করে থাকেন। তখনি বাজারের থলে হাতে আয়ান আসলো বাজার থেকে। কপালে ঘাম জমেছে। হীরাকে দেখে বলল
‘ আঙ্কেল আন্টি এসেছে?
হীরা বলল
‘ জ্বি, আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। মা বাবা ওই ঘরে। আয়ান সেদিকে চলে গেল। সেলিনা বেগম আর আমিন সাহেব খুশি হয় আয়ানকে দেখে। অনেক গল্পগুজব হয়। সেলিনা বেগম কথার ফাঁকে বললেন
‘ সায়ানের আম্মু কোথায়? আর তো দেখা গেল না। আয়ান একবার ডাকলো নামিরাকে। এল না নামিরা। পরে আয়নাকে ইশারায় বলল যাতে ডেকে নিয়ে আসে।
আয়না ডাকলো, নামিরা এল না তারপরও।
আয়ান নিজেই ডাকতে গেল। ব্যাপারটা হীরার চোখ এড়ালো না। নামিরা বোধহয় কোনো কারণে রেগে আছে। হয়ত সত্যিটা না বলায়। কি আর করার? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে হীরা।
আয়ানকে আসতে দেখে ঘর থেকে বের হয়ে যায় নামিরা। মাথায় কাপড় দিতে দিতে বলল
‘ আমি যাচ্ছিলাম। তোমার আসার প্রয়োজন ছিল না।
আয়ান গেল তার পিছুপিছু।
__________
মাসখানেক পার হতেই শোনা গেল হীরার বিয়ের কথা অনেকদূর এগিয়েছে এমনকি বিয়ের দিনতারিখ ও ঠিক হয়েছে। দাওয়াত পড়লো। আয়ান শহর থেকে এসে জানালো সেলিনা বেগম একসপ্তাহ আগে চলে যেতে বলেছে সবাইকে। নামিরা যেতে চাইলো না। আয়ান জোর করে নিয়ে গেল৷ আয়না আর রূপা ভারী খুশি। আয়না রহমত মিয়াকে বাগানের সমস্ত কাজ দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল শহরে। বিয়ের সব ঝামেলা চুকিয়ে ফিরতে প্রায় সপ্তাহ লেগে গেল। আয়না ফিরে এসে লেগে পড়লো বাগানের কাজে। ফুলের দোকানে মানুষ রাখলো৷ ফুল কাটা থেকে শুরু করে বিক্রি অব্দি প্রায় দশজন মানুষ কাজ করে তার হয়ে। সবই গ্রামের বেকার মানুষগুলো। তারা কত যে কৃতজ্ঞ আয়নার প্রতি।
এই প্রথম অনেক বড় এমাউন্টের টাকা হাতে এল আয়নার। বেশ অর্ধেক ফুল পঁচে ও গেল হিমাগারের অভাবে। তবে শুধু লাভ চাইলে তো আর হবে না।
আয়না যখন বাগানে আসে তখন চৌধুরী বাড়ির ছাদে স্পষ্ট দেখতে পায় অনিমাকে। অমি মাঝেমাঝে ঘুরতে আসে বাগানে। রূপার সাথে বেশ ভাবসাব। রূপা পালিয়ে থাকে, অমি টের পেলে রেগে খুন৷ কেন মেয়েটা তাকে ভয় পাবে? সে কি বাঘ নাকি ভাল্লুক?
___________
হীরার বিয়ে যেতেই আয়নার বিয়ের কথা মাথায় আসলো আয়ানের। আয়শা বেগম ও তাল মিলালেন। এইবার ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়া দরকার মেয়েটাকে। এতদিনে বাচ্চার মা হয়ে যেত বিয়ে হলে। আয়ান বলল, আমিন আঙ্কেলের হাতে একটা ভালো পাত্র আছে, বলেছিলেন আমায়। ছেলের বাবার গার্মেন্টস আছে শহরে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসা আছে। ছেলে ও বাবার সাথে ব্যবসা সামলায়। একটা মাত্র ছেলে। কিছুদিন হলো গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে।
আয়শা বেগম বলল
‘ তোর ভালো লাগলে কথা আগা ।
‘ কিন্তু আম্মা টুনি?
‘ ও আর কি বলবে? কিচ্ছু বলবে না। তুই ওসব ভাবিস না।
রূপার চোখজোড়া ছলছল করে উঠে। আপা ছাড়া সে নিঃস্ব।
______
লাখ দুই আড়াই লাখ টাকার মতো ফুল বিক্রি হয়েছে। আয়নার কাছে এটাই অনেক। তার উপার্জন। নিজের। মজুরী খরচ,কর্মচারীদের বেতন আর বাকিসব খরচ হিসাব করে দেখলো লাভ এসেছে একলাখের মতো। কারণ এইবার বেশ টাকা ধারদেনা হয়েছে। কিস্তির টাকা পরিশোধ করা লেগেছে। সংসারটা ও তার টাকায় চলেছে।
আয়নার মনে পড়লো তার আর ও বড় ধরণের একটা ঋণ বাকি আছে। প্রফেসরের কাছে তার অনেক দেনা।
আয়না তার হিসেবের খাতা বের করে অনুরাগের কাছ থেকে নেওয়া সব টাকা যোগ করলো। প্রথমেই চার হাজার টাকার চারা, তারপর আট হাজার, তারপর পুরো একটা বাগান, মজুরী খরচসহ এসেছে বিশ হাজারের মতো । আর কত খরচ যে করা লেগেছে প্রফেসর তো মুখ ফুটে তেমন বলেনি।
এভাবে সব টাকা একে একে যোগ দিতে দিতে এমাউন্ট এসে দাঁড়ালো প্রায় চল্লিশের হাজারের কাছাকাছি।
আয়না ভাবলো এইবারের পনের হাজার টাকা তার কাছে থাকলেই হবে। বাকিটা দিয়ে নামিরাকে একটা গহনা কিনে দেবে। তার সব গহনা বন্ধক যে দিল আর ছাড়াতে পারলো কই? সব গেল। ভাইয়ার চাকরিতে জয়ন করলে পরে বাকিগুলো দেখা যাবে।
অনুরাগের কাছে চল্লিশ হাজার টাকার চেক এল রহমত মিয়ার হাত ধরে। সে এতদিন কক্সবাজার ছিল। কাজ শেষে ফিরলো মাত্র দুদিন হয়েছে। হঠাৎ এমন একটা চেক পেয়ে ভীষণ রকম অবাক হলো অনুরাগ। আয়নামতী তো একেবারে ঋণ শোধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে৷ নিল অনুরাগ। রহমত মিয়া আর ও একটি কাগজ দিল অনুরাগকে৷ অনুরাগ দোতলার বারান্দায় চেয়ারে বসে খুললো কাগজটা। সেখানে লিখা
‘ এই সামান্যটা গ্রহণ করুন প্রফেসর । যারা বিপদের সময় এগিয়ে আসে তাদের ঋণ শোধ করা যায় না টাকা দিয়ে। তাই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার। তবে কখনো যদি মনে হয় আমার সাহায্য আপনার ভীষণ প্রয়োজন, সেদিন নিশ্চয়ই আমাকে ডাকবেন, আমি অবশ্যই আসব ।
অনুরাগের চেহারায় কাঠিন্যেতা। খসখস করে সে কাগজের উল্টোপিঠে লিখল
‘ তোমার ডাক পড়ে বিপদে পড়লে, আমার ডাক ও বিপদের দিনে পড়বে সেটা ভাবলে কি করে আয়নামতী? নিশ্চিন্তে থাকো আমি আর সেই বেকুব পুরুষটা নেই। বুঝতে শিখেছি। বাস্তবতা অনেক শিখিয়েছে আমায়। বিপদের বিরুদ্ধে এখন রুখে দাঁড়াতে শিখেছি আমি। তোমার সাহায্য দরকার নেই।
লিখে আবার ছিঁড়ে ফেলল অনুরাগ। মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে রইলো চেয়ারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা এবার ছাড়ার দরকার। রাজনীতি আর শিক্ষকতা দুইটা একসাথে চালানো যায় না। কিন্তু সে দোটানায় ভুগছে। কোন পথটা সঠিক? শিক্ষকতা তার পছন্দের পেশা। অন্যদিকে সে মানুষের সেবা করার ব্রত নিয়েছে।
ওই অশিক্ষিত, সুদখোর, গাঁজাখোর খালিদুজ্জামান গদিতে বসে থাকা মানেই অসহায় দুঃস্থ মানুষদের সর্বনাশ। কিছুতেই আর বসে থাকা যাবেনা। দেখা যাক কি হয়? ডিপার্টমেন্ট থেকে ডাক আসলে চাকরি ছাড়ার কথা ভাবা যাবে।
আনহিতা অনেকদিন পর ছেলেকে পেয়ে বারবার কোনো একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে যাচ্ছে। অনুরাগ সেটা পরখ করেছে। আজকাল মাকে সময় কম দেওয়া হচ্ছে। গ্রামে না থাকার দরুন।
অনুরাগ ভাবলো মাকে এইবার শহরে নিয়ে যাবে সে৷ কিন্তু মা তো যেতেই চায় না।
চেয়ার থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালো অনুরাগ। আনহিতা বেগমকে বলল
‘ কিছু বলবে মা?
আনহিতা কাঁচুমাচু করে বলল,
‘ হ্যা। আসলে তোমার আপার ছোট ননদটার কথা বলছিলাম। ঢাকায় পড়ে। শিক্ষিত মেয়ে। অনিমা নাকি আশরাফের সাথে কথা বলেছে। আশরাফ বলেছে তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে কথা আগানো যেতে পারে।
অনুরাগ আঁড়চোখে মায়ের দিকে তাকালো। আনহিতা বলল
‘ দেখো আব্বা, কালকের খবরের কাগজে তোমার নামে কিসব কিসব লেখা উঠেছে। তোমার নাকি বউ পালিয়েছে, প্রতারণা করেছে। যে মানুষের কাছে বউ থাকেনা সে কেমন মানুষ হবে? নিশ্চয়ই খারাপ কিছু দেখেছে। কুহেলী কি করেছে সেটা তো আর কেউ জানেনা।
অনুরাগ হেসে ফেলল৷ বলল
‘ মা এসব ওই লম্পট সাংবাদিকদের কাজ। দুমুঠো ভাতের জন্য এরা এসব করে। বাদ দাও৷ । আরও কত কি বলবে এরা
আনহিতা বলল
‘ কিন্তু বিষয়টা ভেবে দেখো। এভাবে তো চলে না আব্বা। তোমার সবকিছু পার্ফেক্ট থাকা চায় নইলে পাবলিক আঙুল তুলে কথা বলবে৷ আমার কথা ও ভাবো। কোনদিন মরে যাই, নাতি নাতনি যদি না দেখে যাই। আমার একটাই তো ছেলে। তোমার সংসারটা গুছিয়ে দিতে পারলে মরেও শান্তি পাব।
অনুরাগ প্রচন্ড বিরক্ত হলো। শায়খ চৌধুরী একই গান গাইলেন। অনিমা ও। শায়লা বেগম ও।
অনুরাগ ভেবে পেলনা এদের মাথায় এসব বিয়ের ভূত হুটহাট আসে কোথা থেকে। সে কি আদৌ কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করে উঠতে পারবে? বিশ্বাসঘাতক, প্রতারকের দল সব। এদের বিশ্বাস করা আর বিড়ালকে মাছ পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া একই কথা।
আনহিতা কোনো না উত্তর না শুনে ভেবেই নিলেন অনুরাগের সায় আছে এই বিয়েতে। এইবার আর ছোটখাটো কোনো অনুষ্ঠান হবেনা। বিরাট আয়োজন হবে। সাংবাদিক এসে মিডিয়ায় তুলবে এই খবর। পুরো গ্রামের মানুষের দুমচে খাওয়াবেন। দোয়া নেবেন। অনিমা ও প্রচন্ড খুশি। যাক লুবনার সাথে অনুরাগের বিয়ে হলে আর কোনো সমস্যাই থাকলো না। তার ভাইটা ভালো থাকলেই হলো।
জরুরি কাজে অনুরাগকে আবার শহরে ফিরে যেতে হলো। এসে দেখলো বিয়ে বিয়ে রব সারাবাড়িতে। অনিমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আরও কতজন! এমনকি যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা সেই মেয়ে। ওই মেয়েটা অনেকবার এই বাড়িতে এসেছে। দেখতে চিকনচাকন গড়নের মেয়েটি অনুরাগের মতে একদম বেয়াদব। কারণ অনুরাগ তার অনেক সিনিয়র হলেও মেয়েটি সোজা অনুরাগ বলেই ডাকে অনুরাগকে। অনুরাগের এই কারণে মেয়েটাকে অসহ্য লাগে।
বাড়িতে কি হচ্ছে তা ভালোভাবে জানার চেষ্টা করতেই অনুরাগ জানতে পারলো আজকে একদম সমাপনী কথাবার্তা চলবে। নিশানা হিসাবে আংটি পড়িয়ে দেওয়া হবে লুবনাকে।
আগামী সপ্তাহের দিকে বিয়ের দিনতারিখ।
অনুরাগ চেঁচিয়ে পুরো বাড়ি এক করলো। নিজের ঘরে গিয়ে চেঁচালো ইচ্ছেমত। একবার যে ভুল সে করেছে সে ভুল সে আর করবেনা। আনহিতা এসে বললেন
‘ তোমার বোনের অসম্মান হবে ওর শ্বশুরবাড়িতে। এমন করোনা। লুবনা ভালো মেয়ে। বুঝো আব্বা।
অনুরাগ চেঁচালো৷ রক্ত যেন মাথায় উঠলো। রাগে দিকদিশা হারিয়ে ফেলল সে।
অনিমা এসে এটা ওটা বলে নাকিসুরে কাঁদতেই গর্জে উঠে সে লাতি বসালো বেডসাইড টেবিলে। কুহেলী ছলনাময়ীর মুখ ভেসে উঠছে বারবার। সে আর ঠকতে পারবেনা। । আর না ।
আনহিতা কেঁদে দিলেন ছেলের এমন রূপ দেখে। অনুরাগ ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে নিয়ে বলল
‘ জীবনে ও আর এই বাড়িতে আসব না আমি। কেউ বুঝে না আমায়। কেউ মরলে ও আসব না। আমি মরলে ও কেউ খোঁজ নেবেনা। কাউকেই দরকার নেই আমার।
সেই যে গেল, আর ফিরলো না অনুরাগ। এদিকে ছেলের শোকে দিনের পর দিন অসুস্থ হতে লাগলো আনহিতা। শায়খ চৌধুরী একদিন মুঠো ফোন করে ছেলেকে জানালেন
‘ মায়ের মরা মুখ দেখার জন্য প্রস্তুত হও অনু। তোমার মায়ের কিছু হলে তুমি দায়ী।
অনুরাগ দিশেহারা হয়ে পড়লো। কি করবে সে? যখন মাকে দেখতে এল পুরো বাড়িটা তখন খালি। হসপিটাল থেকে ফোন করলো শায়খ চৌধুরী। অনুরাগ শুনলো আনহিতা নাকি বাথরুমে পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙে ফেলেছেন, শারিরীক অসুস্থতা তো আছেই। সাথে অন্যান্য রোগব্যাধি।
অসুস্থ মায়ের শিয়রে বসে কথা জড়িয়ে আসলো অনুরাগের। মা নিশ্চয়ই তার ভালোটা চায়। আনহিতা বললেন
‘ সোহাগ আমি মরার আগে তোমার পাশে কাউকে দেখতে চাই। আমি চাই তুমি ভালো থাকো। খুব ভালো থেকো আমার বাচ্চা।
অনুরাগ মায়ের চোখের জল মুছে দিল। বলল
‘ আমি তোমার কথা রাখব কিন্তু তোমাকেও রাখতে হবে আমার কথা। আমাকে একা করে কোথাও যাবে না মা।
আনহিতা চোখের কোণা বেয়ে শুধু জল গড়ায়। অনুরাগ সেই জল পড়ার আগেই নিজেই মুছে দেয়। মায়ের কপালে চুমু এঁকে বের হয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যে।
টাইপিং মিসেটক হতে পারে। খুব তাড়াহুড়ো করে লিখেছি।