আয়নামতি পর্ব-২২

0
1934

#আয়নামতী
#পর্ব_২২
#পুষ্পিতা_প্রিমা

সকাল থেকে বাড়িতে রান্নার তোড়জোড় চলছে। আয়না কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা কি হচ্ছে? ভাইয়া এত টাকার বাজার কেন এনেছে। কারা আসবে বেড়াতে?
সায়ানকে কোলে নিয়ে নামিরার কাছে গেল আয়না। বলল
‘ বাড়িতে কি হচ্ছে কেউ আমাকে কিছু বলবে?
‘ যা আন্দাজ করছ তাই৷ এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারব না।
আয়না যা বুঝার বুঝে নিল।
সায়ান মাকে দেখে কোলে যেতে চাইলো। আয়নার কোলে ধস্তাধস্তি লাগালো। নামিরা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ আপনাকে কোলে নিয়ে বসে থাকলে চলবে? কত কাজ আজ!
আয়না বলল
‘ নাও। ওর খিদে পেয়েছে। কখন দিয়েছ আমার কোলে। খাওয়ানোর নামগন্ধ নেই আর। নাও নাও।
আয়শা বেগম পাতিলে পেঁয়াজ ছেড়ে বললেন
‘ ওই বাটিতে একটা সিদ্ধ ডিম আছে। ওটার কুসুম দিয়ে দুটো ভাত মেখে আমার ভাইকে খাওয়া। শুধু দুধ খেলে হবেনা। এখন খাওয়া শেখাতে হবে। নাহলে শরীর শুকিয়ে যাবে।
আয়না নাকতুলে বলল
‘ আমি পারব না আম্মা। তোমার ভাইকে ভাত খাওয়ানো আর এভারেস্ট জয় করতে যাওয়া একই কথা।
আয়শা বেগম চেঁচিয়ে বললেন
‘ তাইলে, ধুর হ হারামজাদি। কোনো কাম পারেনা সে। শ্বশুরবাড়িতে যা। কেলানি খেলে বুঝবি।
‘ কেলানি দিলে আমি চলে আসব আম্মা।
নামিরা হেসে উঠলো।
আয়শা বেগম গলার স্বর টেনে বললেন
‘ আহারে ঢং কত? চলে আসব আম্মা!
আয়না মন খারাপ করে চলে গেল। কি হচ্ছে এসব কিছু বুঝতে পারছে না সে। সব গোলমাল লাগছে। আবার কোন বেকুবের পাল্লায় পড়তে যাচ্ছে সে কে জানে?
সায়ান তাকিয়ে থাকলো তার মুখের দিকে। আয়না বলল
‘ কি দেখে আব্বা?
‘ বাহহ?
‘ কি বাহ? পাগল নাকি ছেলেটা। ধুরর।
‘ বাহ।
আয়না টুপুস করে চুমু বসালো গালে । তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ছোট্ট বাটিতে ভাত মেখে নিল৷ খাওয়ানোর জন্য পুরো উঠোন ঘুরলো। কাক দেখালো, বিড়াল দেখালো, ময়না দেখালো। সায়ান খেল দুটো দুটো করে।
আয়ান আসতেই হাত পা ছুঁড়তে লাগলো সায়ান। আয়না আয়ানকে বলল
‘ দেখো তোমার ছেলে কি অবস্থা করছে। কোলে নাও। আমার কোমর গেল।
আয়ান হেসে দিল। নিজেকে দেখিয়ে বলল
‘ বাইরে থেকে এসেছি নাহ। ফ্রেশ হয়ে আসি। আরেকটু থাকো আব্বা।
সায়ান ঠোঁট টানলো। আয়না ঠোঁটটা টেনে দিয়ে বলল
‘ বাবারে বাবা বাপকে দেখলেই তার কান্না বেড়ে যায়। কি সোহাগা?
আয়ান যেতে যেতে বলল
‘ এক্ষুনি আসছি। ২ মিনিট।
আয়ান যেতেই সায়ান কেঁদে উঠলো চেঁচিয়ে। আয়নার চুল ধরলো শক্ত করে। আয়না নাকিসুরে কাঁদার ভান করে বলল
‘ ও আব্বা দেখে যাও, এই বুইজ্জা আমাকে কিভাবে মারে। আল্লাহ এই চুল খাওয়া রাক্ষস কোত্থেকে হলো?

______________

রূপা স্কুল থেকে ফিরলো দুপুর দুইটার দিকে। আজ বৃহস্পতি বার। হাফ ছুটি আজ। আয়নার ঘরে গিয়ে দেখলো আয়না ঘুমাচ্ছে। বুকে সায়ান। রূপা পা টিপ টিপে ঘরে ঢুকে স্কুলের ড্রেস বদলালো। গোসল সেড়ে আসলো। আয়শা বেগমরে ডাক পড়লো খেতে যাওয়ার জন্য। রূপা আয়নাকে ছাড়া খায় না। তাই আয়নার পাশে গিয়ে পেট জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। আয়নার ঘুম ছুটে গেল রূপার হাতের স্পর্শ পেয়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
‘ খেয়েছিস?
‘ নাহ জেম্মা ডাকছে। তুমিও খাবা চলো।
আয়না উঠলো। চুল বাঁধলো। বলল
‘ সায়ান ঘুমিয়েছে। চল এখন খেয়ে আসি। ভাবি বোধহয় এখনো গোসল সাড়েনি। কি কাজ করে আল্লায় জানে। মা আর তার কাজের শেষ নাই।
রূপা বলল
‘ তুমি চলে গেলে আমি একা হয়ে যাব আপা।
আয়না তাকালো রূপার দিকে। কিছু একটা ভেবে বলল
‘ আমি আমার সাথে তোকে নিয়ে যাব।
খুশি হতে পারলো না রূপা। মন খারাপ গেল না। আয়না গিয়ে শক্ত করে তাকে বুকের সাথে জড়ালো। কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল
‘ আমি তোর সবকিছু এখন। তাই আমি যেদিকে যাব তোকে ও সেদিকে নিয়ে যাব।
‘ তোমার বর যদি আমাকে না নিতে চায়?
আয়না চমকে গেল এমন কথায়। কিসব বলছে রূপা? ওরকম মনমানসিকতার মানুষ হলে আয়না সংসার করতে পারবে ওই লোকের সাথে?
রূপা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। বলল
‘ আমাকে রেখে যেওনা আপা। তোমাকে ছাড়া আমার কিচ্ছু ভালা লাগেনা।
আয়না বলল
‘ আচ্ছা দেখা যাবে।

_______________

খেয়েদেয়ে একটুখানি শুয়েছিল আয়না। রহমত মিয়া আসায় ঘুমটা পাকা হয়নি। রহমত মিয়ার হাতে একটি কাগজ। মুখটা পাংশুটে। আয়না বলল
‘ কি ব্যাপার? কাগজ কেন?
রহমত মিয়া বলল
‘ কাগজটা পড়েন। ছোটসাহেব পাঠিয়েছে।
আয়না সেখানেই দাঁড়িয়ে কাগজটা খুললো। লিখাটা পড়ে বলল

‘ প্রফেসর সাহেব হঠাৎ বাগানবাড়িতে ডাকলো কেন আমায়? কোনো সমস্যা কি?

রহমত মিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল

‘ আমি কিচ্ছু জানিনা। কাগজটা দিয়ে বলল আয়নামতীকে তোমার সাথে করে নিয়ে আসবে।

আয়না বলল
‘কিন্তু আজ তো আমি বেরোতে পারব না। মেহমান আসবে বাড়িতে। আম্মা বকবে।

রহমত মিয়া বলল

‘ আপনি নাকি বলছিলেন ওনি যখন ডাকবেন তখন গিয়া হাজির হবেন। আমাকে নিয়া যেতে বলছে,আমি নিয়া যামু।

আয়না পড়লো মহাঝামেলায়। বলল
‘ দেখুন ওনার সাথে আমাকে দেখলে লোকজন খারাপ কথা রটাবে। আমি যেতে পারব না এখন। ওনাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন।

রহমত মিয়া গেল না। বলল
‘ কি বলে দেখে আসেন। তারপর না হয় চলে আসবেন। চলেন।
আয়না বলল
‘ আচ্ছা দাঁড়ান আমি যাব আর আসব। বোরকাটা পড়ে আসি।
রহমত মিয়া মাথা নাড়ালো। বোরকা পড়ে বের হওয়ার সময় আয়শা বেগম বললেন
‘ কই যাস?
‘ একটু বাগানো যাচ্ছি আম্মা। চলে আসব।
‘ এখন বাগানে কিসের কাম?
রহমত মিয়া বলল
‘ খালাম্মা কত কাজ থাকে। আপারে আমি লইয়্যা আসুম তাড়াতাড়ি।
আয়শা বেগম বললেন
‘ আছরের আযান পড়ার আগে ফিরবি।
আয়না বলল
‘ আর পাঁচ মিনিট পর আযান দেবে। এত তাড়াতাড়ি কেমনে ফিরব আম্মা। ওখানে যাইতে ও তো দশ মিনিট লাগবে।
‘ তাড়াতাড়ি আসবি তাইলে। মনে রাখিস আজ কি।
আয়না বলল
‘ মনে রাখব আম্মা। যাই?
আয়শা বেগম চলে গেলেন। নামিরা সায়ানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আয়শা বেগমকে বলল
‘ আপনার ছেলে বলেছে আয়নাকে রেডি হয়ে থাকতে। কখন না কখন ওনারা এসে পড়েন।
আয়শা বেগম বলল
‘ চলে আসবে কইতাছে। আসুক গে। চলেই তো যাবে।

______________

বাগানবাড়িতে পৌঁছে আয়না দেখলো অনুরাগ কোথাও নেই। রহমত মিয়ার দিকে রেগে তাকালো আয়না। বলল
‘ কোথাও ওনি ভাইজান?
রহমত মিয়া উসখুস করলো। মাথা নামিয়ে রাখলো। খয়েরী রঙের শার্ট পড়া চিকনচাকন একটা ছেলে এসে বলল
‘ ম্যাডাম অনুরাগ ভাই বলছে একটু কষ্ট করে উপজেলার দিকে যাইতে।
আয়না রেগে গেল। তেজগলায় বলল
‘ কি হচ্ছে এসব? কতক্ষণ এখানে কতক্ষণ ওখানে। ওনাকে ফোন করতে বলেন। আমি যেতে পারব না।
ছেলেটি বলল
‘ ফোনে নাকি বলা সম্ভব না। সেজন্য সরাসরি যেতে বলছে। ভাই বলছে আপনাকে নাকি পৌঁছে দেবে বাড়িতে।
আয়না বলল
‘ উফফ কেউ বুঝতে পারছেন না। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।

ছেলেটি বলল
‘ বেশি না দশ মিনিটের পথ ম্যাডাম। আসুন গাড়ি দাঁড় করানো আছে। যাবেন আর আসবেন।

আয়না বলল
‘ কি হয়েছে সেটা আমাকে বলে দিলেই তো হয়। আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। আমি যেতে পারব না।

বলেই হনহনিয়ে রাস্তায় গিয়ে উঠলো আয়না। গাড়ির কাছে গিয়ে বলল
‘ তাড়াতাড়ি করুন। আমি কিন্তু দেরী হলে খুব চেঁচাবো।
ছেলেটি হাসলো। বলল
‘ আচ্ছা চেঁচাইয়েন৷ সমস্যা নেই।

__________

আছরের আযান পড়ে গেছে। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে শুরু করেছে । পাখিরা তাদের নীড়ে ফেরার প্রস্তুতি নিয়েছে। গাড়ি এসে থামলো উপজেলার মোড়ে কোন একটা ছোটখাটো রিসোর্টের সামনে। সুন্দর একটি বাগান করা বাড়িটার সামনে। আয়না বাগান দেখে খুশি হলো। পরক্ষনেই কপাল ভাঁজ করে বলল
‘ আমি কেন এখানে এলাম?
ছেলেটি গাড়ি থামিয়ে বলল
‘ নামেন। ওখানে অনুরাগ ভাই আছে। জরুরি কথা আছে আপনার সাথে।
আয়না তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এল। ছুটতে ছুটতে হাজির হলো বাড়িটার দরজার কাছে। কিন্তু বাগানের পানি দেওয়া লোকটাকে দেখে পা থেমে গেল। আয়না এগিয়ে গেল। নাকফুলিয়ে বলল
‘ কেন ডেকেছেন প্রফেসর? তাড়াতাড়ি বলুন। প্রফেসর?
অনুরাগ পানির জারটা ফেরালো আয়নার দিকে। আয়না হতভম্ব। অনুরাগ ইচ্ছে করে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। রাগে দুঃখে নিজের মাথা নিজের ফাটতে ইচ্ছে হলো আয়নার। সে সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে বলল
‘ মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার? কি করলেন এটা? পুরো ভিজে গেলাম।
অস্বস্তি লাগতে শুরু হলো আয়নার। অনুরাগ হেসে ফেলল। পানির জারটা রেখে বলল
‘ রিল্যাক্স আয়নামতী। তোমার নাকের ডগায় সারাক্ষণ এত কিসের রাগ ভাই?
আয়না রাগে ফোঁসফোঁস করে বলল
‘ আমি আপনাকে খুন করে ফেলব, একদম হাসবেন না।
অনুরাগ হাসি থামিয়ে জারটা রেখে দিল। হাত ঝেড়ে বলল
‘ যে কথা বলার জন্য ডেকেছি। আচ্ছা বাড়িতে যাওয়া যাক। আমার বাড়ি। সুন্দর নাহ?
আয়না বলল
‘ আপনার অনেককিছু থাকতে পারে, আমার জানার দরকার নেই। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমাকে ফিরতে হবে।
অনুরাগ বলল
‘ যেটা বলার জন্য ডেকেছি।
‘ কেন ডেকেছেন?
‘ বলে ফেললে তো তুমি চলে যেতে চাইবে। না বললে আর ও বেশি করে চলে যেতে চাইবে। বলেই ফেলি।
আয়না কৌতুহল নিয়ে ভুরু কুঁচকে চাইলো। অনুরাগ বলল না। এগিয়ে গিয়ে ধরলো আয়নার হাত। আয়না নিজেকে গুটিয়ে নিতেই অনুরাগ বলল
‘ আরেহ চিন্তা নেই। এর পরের বার থেকে অধিকার নিয়েই ধরবো, এই প্রথমবার আর শেষবার ভুল করলাম। এসো।
আয়না শুকনো ঢোক গিললো। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল
‘ আমার বাড়িতে আজ মেহমান আসবে প্রফেসর। আমাকে ফিরতে হবে। আপনি এমনটা করতে পারেন না। অন্যায় হচ্ছে আমার সাথে।
অনুরাগের হাতের বাঁধন আর ও শক্ত হলো। আয়না ব্যাথায় খেঁকিয়ে উঠে বলল
‘ লাগছে প্রফেসর। আপনি কেন এমন করছেন আমার সাথে। আমার এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে।
অনুরাগ কোনো কথা ছাড়াই টেনে নিয়ে গেল তাকে। আয়না হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে বের হয়ে যেতে চাইলো৷ কে যেন দরজা বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে৷ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলো অনুরাগ।
আয়নার চোখজোড়া অজানা আশঙ্কায় ভিজে উঠতে চাইলো। অনুরাগ হেসে বলল
‘ আরেহ চিন্তার কারণ নেই৷ অনেকে আছে এই বাড়িতে।
আয়না বিশ্বাস করলো না। অনুরাগ ডাকলো সবাইকে। অনেকেই এসে দাঁড়ালো৷ মেয়ে ও আছে, ছেলে ও আছে। সবার গায়ে একইরকম হলুদ রঙের ড্রেস পড়া।
আয়না বলল
‘ আমার কি কাজ এখানে?
অনুরাগ বলল
‘ দোতলায় যাও। ওখানে শুরুর ঘরটাতে গিয়ে বোরকা পাল্টে এসো। ভিজে গেছ।
আয়না নিজের দিকে তাকালো। তাকে জঘন্য লাগছে ভেজা কাপড়ে। উপরে চলে গেল সে। তাকে কি বোরকা দেবে? নাহ ওখানে যে দুটো মেয়ে ছিল তারা আয়নাকে একা ছাড়লো না। লাল টকটকে একটি শাড়ি বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ শাড়ি আছে। অন্য কিছু নেই ম্যাডাম। শাড়ি পড়ুন।
আয়না দৌড়ে নিচে চলে এল। অনুরাগের কাছে ছুটে এসে ফুলের টব ছুঁড়ে মারলো। বলল
‘ আপনি কি করতে চাইছেন আমার সাথে? আমি কি বাচ্চা? কিছুই বুঝিনা? আপনার প্রতি যে শ্রদ্ধা ছিল সবটুকু নষ্ট হয়ে গেল। ঘেন্না করি আপনাকে।
অনুরাগ নির্বিকার চেয়ে রইলো। বলল
‘ তাহলে বুঝেছ? ভালো।
তাকে এমন নির্বিকার দেখতে গা জ্বলে উঠলো আয়নার। দাঁতে দাঁত চেপে সে ডাকলো
‘ অমানুষ,জানোয়া,,,,,
আর ও বেশি কিছু বলার আগে পেছনে থেকে কেউ একজন সাদা কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে দিল আয়নার। দুহাত বেঁধে দিল। অনুরাগ বলল
‘ খুলে দেওয়া হবে। সীমিত সময়ের জন্য।
রাগে দুঃখে চোখ ফেটে জল বের হলো আয়নার। অনুরাগ বলল
‘ দেখো আয়নামতী তুমি যাই ভাবো না কেন আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই। আমি অন্য কোথাও তোমার বিয়ে হোক সেটা কখনোই চাইব না। আমি নিজেও অন্য কোনো মেয়েকে আর নিজের সাথে জড়াতে পারব না। মায়ের ইচ্ছেটাও পূরণ করা জরুরী। তোমার পরিবারের অমত হবে না। তারা আমাকে তোমার জন্য সেই দুই বছর আগে বেছে নিয়েছিল, আর আমার পরিবার তোমাকে। যেটা দুইবছর আগে হওয়ার কথা ছিল সেটা এখন হচ্ছে কিচ্ছু খারাপ হচ্ছেনা।

আয়না ঘনঘন মাথা নাড়লো।
অনুরাগ পকেট থেকে চেক বের করলো। বলল
‘ তোমার টাকা তোমার কাছে থাকুক। সাহায্যর প্রতিদান যেটা চাইছি সেটা দাও আপাতত। তোমার আর তোমার পরিবারের অসম্মানি হবে না। পাত্রপক্ষ আসবে না তোমাদের বাড়ি। আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি ওনাদের।
আয়না মুখ নাড়তে লাগলো। ছটপট করতে লাগলো। অনুরাগ ইশারা করলো মেয়েগুলোকে। বলল,
‘ রুমে নিয়ে গিয়ে হাত মুখ খুলে দেবেন। মেয়েগুলো মাথা নাড়ালো। আয়নাকে নিয়ে চলে গেল। মুখ হাত খোলার পর আয়না পালাতে চাইলো। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে বলল
‘ আমি এই বিয়ে কিছুতেই করব না। প্রফেসর আপনি অন্যায় করছেন আমার সাথে। পাগল হয়ে গেছেন আপনি।
মেয়েগুলো ধরে রাখলো আয়নাকে। বলল
‘ কাপড় পাল্টানো দরকার। আমরা কি সাহায্য করব,?
আয়না চেঁচিয়ে কান ফাটিয়ে দিল তাদের। এদিকওদিক তাকিয়ে খুঁজে নিল চেয়ার। তুলে বলল
‘ মাথা ফাটিয়ে দেব একদম। আমাকে যেতে দাও।
মেয়ে দুটো ভয়ে ভয়ে দরজা খুললো। সুযোগ পেয়ে পালালো একছুটে। বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল দরজা। আয়না আটকে পড়লো। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো।

অনুরাগ এল কিছুক্ষণ পর। বলল
‘ শাড়ি পড়ার দরকার নেই। ভেজা বোরকা গায়ে বিয়ে হতে পারে।
আয়না কাঁদার জন্য কথা বলতে পারলো না৷
অনুরাগ বলল
‘ পাগল হয়ে গেছ তুমি? এভাবে কাঁদছ কেন? আশ্চর্য!
আয়না কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো। জড়ানো গলায় বলল
‘ ঘেন্না করি আপনাকে।
অনুরাগ গিয়ে বসলো তার সামনে। ডাকল
‘ আয়নামতী?
আয়না চোখ তুলে চাইলো। অনুরাগ বলল
‘ এই মুহূর্তে তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন আয়নামতী। তুমি বলেছিলে আমার সাহায্য লাগলে আমি যেন তোমায় বলি। আমার আজকে তোমার সাহায্য ভীষণ প্রয়োজন। তুমি তো বিয়ে করবেই অন্য কাউকে। তাহলে আমাকে করতে সমস্যা কোথায়? আমি একটা বিয়ে করেছি বলে? নাকি অন্য কোথাও?
আয়না গর্জে বলল
‘ আমি ঘেন্না,,
অনুরাগ হেসেই ফেলল। বলল
‘ সে যাইহোক শাড়িটা পড়ে নাও। নিচে কাজী এসেছেন। আর সাক্ষীরা।
আয়না লুটিয়ে বসে থাকলো মাটিতে। সেকেন্ড পরপর হেঁচকি উঠলো৷

মিনিট দশেক পর অনুরাগ এসে দেখলো সেই একই অবস্থায় আয়না বসে রয়েছে। অনুরাগের মেজাজ চটে গেল। সে এসে বসলো আয়নার সামনে। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল
‘ আয়নামতী আমি জোর করতে পারি তোমার উপর।
‘ বাকি রেখেছেন কি?
অনুরাগ উঠে দাঁড়ালো। বলল
‘ সম্পর্ক বৈধতা পাওয়ার আগে আমি তোমাকে ছুঁতে চাইছিনা। কিন্তু শাড়িটা না পড়ে তুমি বাধ্য করছ আমায়।
আয়না না বলে চেঁচিয়ে উঠলো। অনুরাগ বলল
‘ ঠিক আছে, তাহলে শাড়িটা পড়ে নাও তাড়াতাড়ি।

________________

রাশেদ হতভম্ব, বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
‘ কি করছিস অনু? অন্যায় হয়ে যাচ্ছেনা?
অনুরাগ ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল
‘ অন্যায় আমার সাথে হয়েছে। দুই বছর আগে একটিবার সুযোগ যদি সে আমায় দিত তাহলে কুহেলী নামক কালো অধ্যায়টা থাকতো না আমার জীবনে। আমাকে নরকে রেখে আবার অন্য জনের সাথে ঘর করার স্বপ্ন দেখছে? চুপ করে দেখছিলাম শুধু কি কি করতে পারে। চোখ কান খোলা রেখে চলি আমি।
রাশেদ মাথায় হাত চেপে বসে পড়লো।
‘ বাড়িতে কে জানে?
‘ শুধু মা। মা বলেছে আয়নামতীর কথা।
রাশেদ অবাকচোখে চাইলো। বলল
‘ কিন্তু খালামণি তো পছন্দ করেনা আয়নাকে।
‘ করেছিল। করতো। করে। করবে। রাগে মানুষ অনেক কিছু বলে। আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ায় মায়ের রাগ হয়েছিল।
রাশেদ বলল
‘ ওকে ঘরে তুলবি?
‘ আপাতত না। এখানে রাখব। মাকে এখানে নিয়ে আসব।
রাশেদ বলল
‘ যা করার তাড়াতাড়ি কর তাহলে। আমি আর কিচ্ছু জানিনা।
অনুরাগ আবার পা বাড়ালো। তার আগেই হাজির হলো আয়না। গায়ে লাল টকটকে শাড়ি। ভেজা খোলা চুল। পাগলের মতো ছুটে আসছে।
দ্রুত পায়ে ছুটে গেল অনুরাগ। টেনে নিয়ে গেল আয়নাকে। শাড়ির আঁচল টেনে ঢেকে দিল মাথা। মেয়েগুলোকে বলল
‘ শাড়ির সাথে আনা ওড়নাটা নিয়ে এসো দ্রুত।
আয়না ধস্তাধস্তি লাগালো। অনুরাগ শক্ত করে ধরে রেখে বলল
‘ নিচে অনেক মানুষ। মাথা না ঢেকে চলে যাচ্ছিলে তুমি। পাগলামি বন্ধ করো আয়নামতী। কেউ তোমার পাগলামিতে গলবেনা।
আয়নার কান্না থেমে গেল। সোফায় বসা প্রত্যেকটা লোককে সে দেখলো। এরা সবাই এতবড় অন্যায়কে কেন মেনে নিচ্ছে? কেন কেউ কিছু বলছেনা? রহমত মিয়াকে দেখে একেবারে থেমে গেল আয়না? এত বড় বিশ্বাসঘাতক? এতবড়?
হাল ছেড়ে দিল আয়না। অনুরাগকে জোরে ধাক্কা মারলো। অনুরাগ দু পা পিছু সরলো শুধু। আয়না আঙুল দেখিয়ে বলল
‘ আপনাকে বিয়ে করব আমি৷ তবে কুহেলী নয় কুহেলীর চাইতে জঘন্য কিছু করে শাস্তি দেব আপনাকে। আপনি হারে হারে টের পাবেন কার সাথে নিজেকে জড়াচ্ছেন।
চমৎকার করে হাসলো অনুরাগ। বলল
‘ যথাআজ্ঞা বিবিসাহেবা।
ওড়নাটা আনতেই পড়িয়ে দিল অনুরাগ।

বিয়ে পড়ালো কাজী। অনুরাগ থেকে কবুল স্বীকারোক্তি শেষে আয়নামতীর দিকে পান বাড়িয়ে দেওয়া হলো। জেদ,রাগ,দুঃখে হাত নাড়লো না আয়নামতী।
অনেকক্ষণ বলার পরেও কেউ পান ছুঁয়ে দিতে পারলো না। শেষমেশ অনুরাগ উঠে এল। আয়নার হাত ধরে হাতটা রাখলো পানের উপর। বলল
‘ এবার ঠিক আছে কাজী সাহেব?
কাজী আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।
অনুরাগের ঠোঁটের কোণায় বিশ্বজয়ের হাসি। আয়নার চোখের কোণায় বিষাক্ত জল। দুমড়েমুচড়ে গেল আয়না৷ সবটা শেষ হয়ে গেল। লোকসম্মুখে আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো আয়না। রহমত মিয়া রাগে হনহনিয়ে বের হয়ে গেল। ছোটসাহেব কি করলো এটা? আপারে কষ্ট দিল। আপা কত উপকার করে তার? সে নিজেই তো আপার বিশ্বাস ভেঙে দিল। কি করে সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? আদৌ কি পারবে?

লোকজন কমে আসলো ধীরে ধীরে। অনুরাগ বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। আয়না তাকালো এদিকওদিক। অনুরাগের ভাড়া করা মেয়েদুটো এসে নাকে ছোট্ট একটা ফুল পড়িয়ে দিল। হাতে চুড়ি। গলার হার। মাথার উপর টিকলি। আয়না শক্ত পাথুরে মূর্তি হয়ে বসে রইলো।

বাইরের কাজ সেড়ে বাড়িতে পা রাখতেই জবুথবু হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বসে থাকা একটি জীবন্ত রাগান্বিত পুতুল চোখে পড়লো অনুরাগের। হাসি পেল খুব। এই মেয়েটা বরাবর দশ বছরের ছোট তার। কিন্তু রাগ গুলো আকাশ সমান। এর সাথে কিভাবে সংসার হবে তার?
অনুরাগকে আসতে দেখে হিংস্র চোখে তাকালো আয়না। অনুরাগের ঠোঁটের কোণায় হাসি। রাগে পিত্তি জ্বলে উঠলো আয়নার।
অনুরাগ বলল
‘ বিয়ের দিন মেয়েদের লাজুকলতা সাজতে হয়। ঠোঁটের কোণায় মিটিমিটি হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয়। মাথাটা নিচু করে ঘোমটার আড়ালে রাখতে হয়।
কিন্তু আমার বিয়ে করা বউয়ের বেলায় সব একেবারে উল্টো কেন ভাই?

দূরে দাঁড়ানো দুটো ছেলে আর মেয়ে হেসে উঠলো অনুরাগের কথায়।
আয়না চোখের রক্তাক্ত চাহনি আরও দৃঢ় হলো। অনুরাগ এসেই পাঁজাখোলা করে তুলে নিল তাকে । বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল
‘ তোমার শ্বাশুড়ির মায়ের পরাণটা শান্তি হোক ছেলেবউ দেখে।
আয়না শুধু রক্তাভ চোখে চেয়ে রইলো। অনুরাগ ফিসফিস করে বলল

‘ ওভাবে চোখে চোখ রেখোনা৷
প্রেমে পড়ে যাবে।
ওভাবে আকুল হয়ে দেখোনা।
সর্বনাশ হয়ে যাবে।

আয়না কাঠ কাঠ গলায় বলল
‘ ভালোই উড়ছেন। উড়তে থাকুন। আমি ও দেখতে থাকি কত উড়তে পারেন। ডানা ছাটার সময় ও আসবে।
অনুরাগ এবার ও হাসলো। মাথা নামিয়ে আনলো খানিকটা। নাকে নাক ছুঁয়ে বলল
‘ সম্পর্ক বৈধতা পেয়েছ বলেই কি ছুঁতে ইচ্ছে করছে আয়নামতী? এতদিন তো মনে হয়নি। বৈধতাই ও দোষ আছে দেখলে?
আয়না নাকটা মুছে বলল
‘ অভদ্রদের কাছে বৈধতা অবৈধতা বলতে কিছু হয়না।
অনুরাগ বলল
‘ সেটা ও ঠিক৷ আরো আগে ছোঁয়া উচিত ছিল, একদম চুপচাপ বিয়ের পিড়িতে বসে যেতে। অভদ্র তখন ও ডাকতে, যেভাবে এখন ডাকছো। ইশশ ভুল হয়ে গেল না?
ধস্তাধস্তি লাগালো আয়না। অনুরাগ গাড়িতে বসিয়ে দিল তাকে। বলল
‘ একদম চুপচাপ বসে থাকো। মাকে দেখিয়ে আবার নিয়ে আসব। তোমার বাড়িতে খবর চলে গেছে ইতোমধ্যে। চিন্তা নেই। যোগ্য পাত্র বিয়ে করেছে তাদের মেয়েকে৷
মুখ ফিরিয়ে নিল আয়না। অনুরাগ এসে বসলো পাশে। ড্রাইভারকে বলল
‘ চলেন।
আয়না ডুকরে ডুকরে কাঁদলো থেকে থেকে। সব মানসম্মান শেষ। গ্রামের সবাই ছিঃ ছিঃ করবে আম্মা আব্বা আর ভাইয়াকে দেখলে।

রহমত মিয়া খবর নিয়ে এল আয়শা বেগমের কাছে। তিনি সবটা শুনে বসে পড়লেন মাথায় হাত দিয়ে। রহমত মিয়া বললেন
‘ বড় সাহেবা অসুস্থ। ওনি আপাকে ছেলের বউ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন তাই ছোটসাহেব এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপার কোনো দোষ নেই। তাছাড়া ছোটসাহেবের মধ্যে ও তো কোনো খুঁত নাই। আপনারা তো আগে তারে পছন্দ করছিলেন আপার জন্য।
কেউ কিছু বলেনা। থমথমে পরিবেশ। খুশি হয় রূপা। হাত তালি দিয়ে বলে উঠে
‘ আমি আপারে কত করে বলছি আপার লগে ছোটসাহেবরে মানায় বেশি। আমি খুব খুশি।
বলেই অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল রূপা। আয়শা বেগম কপাল চাপড়ে বললেন
‘ কই গেলি রূপা? মর না দুই হারামজাদি। মর। শান্তি দিলি না দুইটা। আমি এসব শোনার আগে মইরা গেলাম না ক্যান?
নামিরা এসে বসলো আয়শা বেগমের পাশে। বলল
‘ আম্মা আপনিই তো বলেন। উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তাহলে কেন এমন করছেন? বিশ্বাস রাখুন আল্লাহর উপর। উনি আয়নাকে ভালো রাখবেন। খুব ভালো মেয়ে আয়না।

চলবে,,,
পুরোনো অনেক পাঠকের দেখাসাক্ষাৎ নাই ক্যান ভাই?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here