#আয়নামতী
#পর্ব_২৭
#পুষ্পিতা_প্রিমা
বাড়িতে পা রাখতেই আয়নাকে মুখোমুখি পড়তে হলো অনিমার। ক্রোধান্বিত চেহারা তার। আয়নাকে বলল
‘ ভাই রেগে গিয়েছে কেন? কি হয়েছে তোমাদের?
আয়না বলল
‘ সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার । আপনি আর কিছু জানতে না চাইলে খুশি হব।
অনিমা আর কিছু বলতে পারলো না। আসলে আয়না তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই ঘরে চলে গেল। দেখলো গোছানো ব্যাগ থেকে এক এক করে কাপড়চোপড় বের করছে অনুরাগ। আয়না বলল
‘ আপনার না কক্সবাজার যাওয়ার কথা। আবার কাপড়চোপড় নামিয়ে রাখছেন কেন?
অনুরাগ উত্তর দিল না। চোয়াল শক্ত তার। আয়না বলল
‘ আপনি এত কম কথা বলা শুরু করেছেন কখন থেকে?
তীর্যক চোখে তাকালো অনুরাগ। হাতটা ও থেমে গেছে সাথে। রোষানলে দগ্ধ হয়ে বলল
‘ এমন না যে তুমি আমাকে চেনো না। আমার সম্বন্ধে কিছুই জানো না। তারপরও কার কাছ থেকে কি শুনে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করে বসছো । আমি তোমাকে চিনি। যে কারো কথায় নাচার মেয়ে তুমি নও। তুমি এসব এই কারণেই করছো, কারণ তুমি সবসময় আমার দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছ। কোথায় আমার খুঁত সেটা খুঁজে বের করে খোঁচাচ্ছ আমাকে। তোমাকে অচেনা লাগছে আয়নামতী। তোমাকে মানাচ্ছ না এসব। আমার দোষত্রুটি ওই একটাই। কুহেলীকে বিয়ে করা, ওই একটাই দোষ আমার। নাহলে আমার প্রতি অভিযোগ আসার কোনো পথ আমি খোলা রাখিনি। অন্য কোনো অপবাদ তুমি আমাকে আন্দাজে দিতে পারো না।
‘ আপনাকে বিশ্বাস করিনা আমি। আপনার কোনো কথা আমার বিশ্বাস হয় না। আপনি একজন ঠক, মিথ্যেবাদী। বোকা বোকা চেহারার পেছনে চতুরচালাক, ধূর্ত একজন মানুষ। আপনাকে আমার সহ্য হয় না। আপনি আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠকিয়েছেন আমাকে৷ মিথ্যে বলে বাড়ি থেকে বের করে, জোর করে বিয়ে করেছেন৷ আপনার কি মনে হচ্ছে আমি মেনে নিচ্ছি আপনাকে? অন্যায় করে আপনি পার পাবেন? আমি ঘেন্না করি আপনাকে, আপনার পরিবারকে। আপনার পরিবার আজ ভালো সাজছে, দুই বছর আগের সেই দিনটা আমার এখনো মনে আছে। টাকা ছাড়া তারা বিয়ে না পড়ানোর আদেশ দিয়েছিল কাজীকে। আমার আব্বা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল শুধু আপনাদের জন্য। আমার পরিবারে অশান্তি, দুর্দশা নেমেছিল শুধু আপনাদের জন্য। আমার পরিবারকে লোকমুখে খোঁটা শুনতে হয়েছে শুধুই আপনাদের জন্য। কিচ্ছু ভুলিনি আমি।
‘ মনে রেখেছ কেন? শাস্তি দেবে?
‘ শাস্তি? আমার জানা নেই কোন শাস্তিটা ঠিক আপনাদের জন্য প্রযোজ্য। নাহলে আজই দিয়ে দিতাম। এক্ষুণি।
‘ চাবিটা দাও।
আয়না চমকালো। বলল
‘ কিসের চাবি?
‘ কুটিবাড়ির আর বাগানের।
‘ কি করবেন? ওনারা মাত্র কয়েকদিন থাকবেন।
অনুরাগ চাপাস্বরে বলল
‘ চাবিটা দাও। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব শালাদের। নাটক ফাটক জাহান্নামে গিয়ে করুক। আমার কি? চাবি দাও।
আয়না সরে গেল। বলল
‘ চাবি নেই। আপনি আমার সামনে থেকে যান তো।
অনুরাগ গর্জন করলো। বলল
‘ চাবি দাও বলছি। কোথায় চাবি?
আয়না ভড়কে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল
‘ দেব না বলেছি আমি।
অনুরাগ তেড়ে গেল। শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো। আয়না ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল
‘ কি করছেন?
অনুরাগ চাবি খুলে নিয়ে আঁচলটা ছুঁড়ে মারলো। বলল
‘ গলা ধাক্কা দিয়ে বের করব। না গেলে উত্তমমধ্যম দিয়ে বের করে দেব।
আয়না ছুটলো অনুরাগের পিছু পিছু। বেশিদূর যেতে পারলো না। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল অনুরাগ। চলে গেল বাগান বাড়িতে।
কুহেলী এখনো সেখান থেকে যায়নি। ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে বিছিয়ে ফেলেছে। দারোয়ান চেঁচামেচি করলে ও শুনছে না। ডিরেক্টর আজমল খয়রাত এসে মাথা চাপড়ে বলল
‘ এসব কি করেছ কুহেলী? বাগানের মালিকীন দেখলে কি বলবেন? কি করেছ তুমি?
হনহন পায়ে হেঁটে এল অনুরাগ ঠিক তখুনি। আজমল খয়রাত বলল
‘ আরেহ মিঃ চৌধুরী যে, কি সৌভাগ্য আমাদের!
বাকিটুকু বলতে না দিয়ে অনুরাগ বলল
‘ দুর্ভাগ্য তখুনি হবে, যখন আপনারা এই বাগানবাড়ি না ছাড়বেন। তাড়াতাড়ি দলবল নিয়ে এখান থেকে আউট হন। নোংরা মানুষ নিয়ে আমাদের এই বাগান বাড়িতে আসবেন না। এটা ফুলবাগান। ফুল মানেই পবিত্র। আর পবিত্র জায়গায় অপবিত্র মানুষের আনাগোনায় দেখছেন কি অবস্থা চারপাশে? এভাবে ফুল ছিঁড়েছে কে?
আজমল খয়রাত তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করলো। আয়নামতী ম্যাডামের কাছে ফোন পাঠাতে হবে। কেন বাগান বাড়ি ছাড়তে হবে? এমনটা কথা ছিল না।
আজমল খয়রাত সরতেই অনুরাগ দারোয়ানকে বলল
‘ সবাইকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করো মামা। তুমি নোংরা মানুষজনকে এখানে ঢুকতে দাও কেন? কেন দিয়েছ?
দারোয়ান ভয়ে ভয়ে বলল
‘ ম্যাডাম?
‘ কে ম্যাডাম?
কুহেলী বলল
‘ বাহ আমি তো রীতিমতো অবাক হচ্ছি, ইনি আসলেই অনুরাগ চৌধুরী তো? গলার আওয়াজ এত বড়? কখন হলো এত উন্নতি?
অনুরাগ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো। বলল
‘ চুপ। হীন, নিচ জঘন্য মেয়েমানুষ লজ্জা করেনা? আমার অতীত নষ্ট করেছ তুমি। যার ফল আমি এখনো ভুগছি। এখনো অন্ধকার কাটছে না। আর এখন আমার বর্তমান নষ্ট করতে এসেছ? চরিত্রহীনা!
কুহেলীর চোখে আগুন। থরথর করে কেঁপে উঠলো তার পা জোড়া। আঙুল তুললো বেশ নিয়ম করে। অনুরাগের দিকে বাড়িয়ে বলল
‘ খবরদার। আমি সেই কুহেলী আর নেই, যে আপনার ধমকে কেঁদে দেবে। আজকের এই অপমানের জন্য পোহাতে হবে আপনাকে। দেখে নেব আমি।
অনুরাগ বলল
‘ দূর হও। যাও। আরেকবার আমার চোখের সামনে পড়লে খবর ছাড়া গুম করে দেব। বেয়াদব মেয়েমানুষ। নষ্টা। লোভী। ঠক।
কুহেলী একমুহূর্ত ও দাঁড়ালো না। কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো অন্য খবর।
নাটকদলের সবাইকে নিয়ে রাতারাতি গ্রাম ছাড়তে হলো আজমল খয়রাতকে। অনুরাগ লোক লাগিয়ে দিয়েছে। বলেছে আজ রাতেই গ্রাম ছাড়তে নইলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এত বড় ঘটনা ঘটায় কুহেলী এমনিতেও থাকতো না। কুহেলী না থাকলে শুট হবে কি করে? তাই সবাই চলে গেল। আয়নাকে তীব্র তিরস্কার করলো আজমল খয়রাত। তার মতে আয়না কথা দিয়ে কথা রাখেনি। এবং স্বামীর অমত থাকা স্বত্বে ও কেন বাগানবাড়ি ভাড়া দিল? সেসব শুনে আয়নার মেজাজ খারাপ হলো।
রাত করে ফিরলো অনুরাগ। সব চুকিয়ে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে। ভেবেছে আয়না হয়ত ঘুম। সে আরামে ঘুমটা দিতে পারবে। কিন্তু না। সে ঘরে পা রাখতেই নাগিনী রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে এগিয়ে এল। যেন এক ছোবলে শেষ করে দেবে অনুরাগকে। রাগের চোটে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে গেল নাক আর কপালে। রেগেমেগে বলল,
‘ আমি থাকব না আপনার সাথে। মরে যাব তবু ও এমন মানুষের সাথে থাকব না। কোনো মানুষ আমাকে কখনো এত কথা শোনায়নি৷ আপনার জন্য শোনালো।
অনুরাগের ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি। এক হাত বাড়িয়ে কোমর টেনে নিজের কাছে আনলো আয়নাকে। দূরত্ব কমিয়ে ফেলতেই আয়না হাত দুটোর ভর প্রয়োগ করলো তার বুকে। কিন্তু বলিষ্ঠ হাতের কাছে তার শক্তি নিতান্তই তুচ্ছ। চিৎকার করতে গিয়ে ও চেঁচালো না আয়না। অনুরাগ আঙুল দিয়ে ছুঁলো তার নাক। বলল
‘ নাকটা কি দিয়ে বানাইলো আল্লাহ। বাপরে বাপ আমার বাপের জন্মে এত রাগ দেখিনি আমি। নাকের ডগায় এত রাগ কেমনে থাকে ভাই?
আয়না দাঁতে দাঁত চেপে বলল
‘ মেরে ফেলব একদম। ছাড়ুন।
অনুরাগ ছাড়বে কেন? কত মেহনত গেল এই হাতের বাঁধনে বন্দী করার পেছনে। ছাড়লো না। ধস্তাধস্তির চোটে মুখের সামনে চলে আসা এলোমেলো চুলগুলো গুঁজে দিতে দিতে বলল
‘ এই যে এত লড়াই করে এলাম, এত রাগ দেখিয়ে গেলাম সবকিছু কারণ কিন্তু তুমি আয়নামতী। আমাকে যদি একটু বুঝার চেষ্টা করতে তাহলে আমার লড়াইটা স্বার্থক হতো। কিন্তু তুমি তো আমাকে না বুঝার লড়াইয়ে নেমেছ৷ কি আর করার!
কথা বলা শেষে হুট করে ছেড়ে দিল অনুরাগ। আয়না একটু তড়াক খেয়ে গেল। বলল
‘ ছাড়লেন কেন? আশ্চর্য!
অনুরাগ চোখ কপালে তুলে বলল
‘ ধরে রাখতে বলছো?
আয়না থতমত খেয়ে বলল
‘ ওভাবে ছাড়লেন কেন বলেছি? আমি পড়ে যেতে পারতাম।
‘ আমি পড়তেই দিতাম না।
__________
সকাল সকাল আয়নার অপ্রত্যাশিত বায়নায় রাগ উঠলো অনুরাগের। বাড়ি যাবে মানে কি? কালকের জন্য কি কোনোভাবে রাগ দেখাচ্ছে? যা ভাবলো তাই। আয়না ফটাফট বলল
‘ আমি বাড়ি যাব। খবরদার আমাকে আনতে যাবেন না।
অনুরাগ কোনোকিছু বলতেই পারলো না। রহমত মিয়াকে দেখা গেল নিচে রিকশা দাঁড় করিয়েছে। অনুরাগ বলল
‘ আমি দুঃখিত কালকের জন্য। এভাবে যেওনা। আমি দিয়ে আসব তোমায়।
আয়না বলল
‘ থাকব না আমি। আপনি আমাকে ছুঁয়েছেন কালকে। দেখা৷ যাবে রোজ রোজ একটু একটু করে ছুঁবেন। আমি সহ্য করব না ওসব বেয়াদবি। আমি থাকব না আপনার সাথে।
অনুরাগ জিহ্বায় কামড় দিল। বলল
‘ তুমি এজন্যই বাচ্চা। ঠিক আছে আমি আর ছুঁবো না ভুলেও। আমি দিয়ে আসব তোমায়।
আয়নার রাগ কমলো। গেল না। অনুরাগ সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে গেল। আয়শা বেগম আর আজহার সাহেব মেয়েকে দেখে কেঁদেই ফেললেন। নামিরা আর আয়ান খুশি হলো। আর ছোট্ট দুটো মানুষ।
আয়শা বেগম এই প্রথম অনুরাগের সাথে কথা বলল দূরে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে।
‘ শোনো চৌধুরীর ছেলে আজকে আমাদের গরিবের বাড়িতে থাকো একদিন। বিয়ের পর একদিন শ্বশুরবাড়ি থাকা লাগে।
অনুরাগ বলল
‘ অন্য একদিন। আপনাদের মেয়ে যেদিন বলবে সেদিন। আজ আসি।
আয়না মুখ ফিরিয়ে নিল৷ সে কখনোই বলবে না। সবাই চলে যেতেই অনুরাগ আয়নার কাছে এল। ফিসফিসিয়ে বলল
‘ রাগ কমলে ফিরে এসো।
‘ আমার রাগ কমবে না।
‘ রাগ না কমলেও ফিরে এসো। আমি কমিয়ে দেব।
‘ আসব না।
‘ আমি আসব, নিয়ে যেতে।
‘ আপনি আমার পিছু ছাড়েন এবার। নিজের কাজে মন দেন।
‘ ছাড়ছি না। ছাড়ব না। ভুলে ও ভেবো না তুমি আমার কাছ থেকে ছাড়া পাবে। যাওয়ার আগে একটা কথা বলি?
‘ আবার কি?
‘ পারলে আমার উপর থেকে সব অভিযোগ গুলো তুলে নিও। মনে পড়লে খোঁজ নিও আর একটু দরকার পড়লেই ডেকে নিও। কথা বলতে ইচ্ছে হলে চিঠি লিখো।
চলবে,
রিচেইক করা হয়নি।