#আয়নামতী
#পর্ব_৩২
#পুষ্পিতা_প্রিমা
সকাল সাতটা কিংবা আটটা তখন। অনুরাগ চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সেলোয়ার-কামিজ পড়া একজন মহিলা পেছন পেছন এসে বলল
‘ সাহেব বৌরাণিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি চলে এসেছে।
‘ আমি যাচ্ছি। তুমি যাও।
মহিলাটি চলেই যাচ্ছিল। অনুরাগ আবার ডাক দিল
‘ কালকে তোমরা সবাই কোথায় ছিলে? একটা মানুষ ওভাবে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাচ্ছিল আর তোমরা কি তখন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছিলে?
মেয়েটি ভালো করে মুখটা ঢেকে নিয়ে বলল,
‘ আমরা মেয়েরা সবাই তো রান্নাঘরে ছিলাম সাহেব।
‘ তোমরা কয়জন যেন?
‘ ছয়জন।
‘ চারজন মহিলা দুজন পুরুষ?
‘ জ্বি সাহেব।
‘ তাহলে তোমাদের তিনজন ছাড়া আরেকজনকে দেখিনা কেন?
‘ বুড়িমা ছাড়া সবাই একরঙের কাপড় পড়ি তাই হয়ত বুঝেন না সাহেব।
‘ গতবার যখন এসেছি তখন তো অন্য দুজন ভদ্রলোক ছিল। করিম আর বাবলু। ওদেরকে কাজ থেকে আউট করে দিয়েছে নাকি?
‘ জ্বি সাহেব।
‘ আরেকটা কথা বলো,, আয়নামতী কেন বলল তোমরা ওকে মেরেছ?
‘ বৌরাণির মাথা খারাপ হয়ে গেছে সাহেব।
বলেই মেয়েটি জিভে কামড়ে দিল। সাথে সাথে বলল
‘ দুঃখিত সাহেব ওরকমভাবে বলতে চাইনি। আসলে বৌরাণির বোধহয় আছরের সমস্যা টমস্যা আছে।
‘ ওসব কিচ্ছু নেই। এখানে কোনো গোলমাল আছে। ছয়জন মানুষ থাকতে একটা মানুষ ওভাবে সিঁড়ির নিচে পড়ে থাকে কি করে?
ঠিকঠাক কাজ করো নয়ত এই বাড়ি কেনার সাথেসাথে তোমাদের এখান থেকে আউট করে দেব। কাজের মানুুষের অভাব হয় না টাকা দিলে।
‘ না না সাহেব মন দিয়ে কাজ করব। কাজ কেড়ে নিবেন না। আমরা ছয়জনের তো অনেক কাজের দায়িত্ব সাহেব। বুড়িমা তো কোনো কাজই করেনা। এইবার থেকে মন দিয়ে কাজ করব।
‘ ঠিক আছে যাও। তোমাদের মালিক আসছে এই সপ্তাহে। এই মাসের বেতন উনিই দেবেন। আগামী মাস থেকে আমি। ঠিক আছে?
‘ ঠিক আছে সাহেব।
‘ যাও আর আয়নামতীকে জোর করে হলেও কিচ্ছু খাওয়াও। ঔষধ খেতে হবে ওর। তারপর চলে যেতে হবে।
‘ বেয়াদবি মাফ করবেন সাহেব। কাজটা আপনি করলে ভালো হতো। ওনি আমাদের সহ্য করতে পারেন না।
‘ ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।
____________
আয়না তখনও বিছানার সাথে লেপ্টে। গা ছেড়ে দেওয়া। প্রচন্ড ব্যাথা পুরো শরীরে। ডান হাতটা ব্যান্ডেজে মোড়ানো গলার সাথে। কপালটা ও ঢাকা সাদা ব্যান্ডেজে। এলোমেলো ঢিলে হয়ে আসা মাথার লম্বা বেণুনিটা অবহেলা হয়ে পড়ে আছে আয়নার পাশে। চেহারার উজ্জ্বলতা ফ্যাকাশে রঙে ঢাকা পড়েছে। চোখের নিচে কালো দাগ বসে গেছে।
খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অনুরাগ ভাবলো আয়নাকে এই অবস্থায় দেখলে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে সবার। অনেক সেবাযত্ন দরকার আয়নার। কিছু মুখে ও নিতে চাচ্ছেনা। এভাবে চলতে পারেনা। আয়নাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। সে এখানে থেকে যাবে। কাজ শেষ হলেই চলে যাবে।
কিন্তু আয়না চোখ মেলার সাথে সাথে বলে উঠলো প্রফেসর আপনি আমাকে কোথায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন? আমি কোথাও যাব না।
অনুরাগ বলল
‘ আগে খাওয়া, কথা পরে।
‘ না আমি যাব না প্রফেসর।
‘ যেতে হবে না। খেয়ে নাও। ঔষধ খেতে হবে।
নাক টানলো আয়না । নিজেকে আগাগোড়াই দেখে ফুঁপিয়ে উঠলো। বলল
‘ ব্যান্ডেজ রশি এগুলো খুলে দিন। আমি এভাবে থাকতে পারব না। আমার কষ্ট হচ্ছে।
‘ তোমার হাতের পেশিতে আঘাত লেগেছে। হাত ভেঙে গেছে তোমার। বুঝতে পারছ? একদম মাথা খারাপ করবে না। চুপচাপ বসো। খাইয়ে দেই।
‘ না খাব না। এগুলো খুলে দিন আগে। পায়ের আঙুলের গুলো খুলে দিন। তাহলে খাব।
অনুরাগ আর না পেরে গর্জে বলল
‘ একদম চুপ। আরেকটা কথা বললে খুব খারাপ হবে।
আয়না ফোঁপাতে থাকলো। অনুরাগ প্লেট নিয়ে গিয়ে আয়নার পাশে বসলো। ভাত মেখে খাইয়ে দিতে গেল। আয়না মুখ ফিরিয়ে রাখলো।
‘ বাড়িতে পাঠিয়ে দেব নইলে।
রেগে তাকালো আয়না। অনুরাগ চোখ তুলে তাকালো না। লোকমা মুখ বরাবর তুলে দিয়ে বলল
‘ তাহলে খেয়ে নাও।
আয়না বহুকষ্টে খেয়ে নিল। ঔষধ খাওয়ালো অনুরাগ। আয়না খাওয়ার পরপরই ঘুমে ঢলে পড়লো। অনুরাগ তার গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিল। চলে যাওয়ার সময় কপালের ব্যান্ডেজের উপর আলতোকরে চুমু বসালো। বলল
‘ আমি তোমার এমন পরিণতি কখনো চাইনি আয়নামতী।
তারপর দ্রুত পায়ে নিচে বারান্দায় চলে গেল। সগিরকে গিয়ে বলল
‘ ঘুমন্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে। আমি সন্ধ্যায় ফিরে আসব আবার।
‘ আচ্ছা সাহেব।
টান টান উত্তেজনা তখন অনুরাগ ছাড়া আর সবার মধ্যে।
সব ঠিকঠাক কিন্তু বিপত্তি ঘটলো যখন আয়নাকে গাড়িতে বসানো হলো। অনুরাগের কাঁধে মাথা রাখতেই আয়নার চোখ ছুটে গেল। চারপাশটা চোখ বুলিয়ে সে বলল
‘ আমি গাড়িতে কেন?
অনুরাগ কিছু না বলে ড্রাইভারকে গাড়ি ছাড়তে বলল। কিন্তু আয়নার জন্য পারলো না। সে চেঁচিয়ে উঠলো।
‘ আপনি আমাকে রেখে আবার চলে আসবেন?
‘ হ্যা। আমার অনেক কাজ এখানে। গ্রাম থেকে শহরে আসা যাওয়া করতে পারব না আমি। আর এখানে সবাই আমাকে ভালোবাসে। আমি মাসের পর মাস এই বাড়িতে থেকেছি। তুমি চুপ থাকো।
আয়না অনুরাগের হাত থেকে ছুটে গিয়ে গাড়ির কাচের সাথে বাড়ি খেল মাথায়। বলল
‘ এক্ষুণি দরজা খুলুন৷ এক্ষুনি। আমি যাব না। খোদার কছম আমি সব শেষ করে দেব। আমাকে নিয়ে যাবেন না। আমি এখন যাব না। যদি যাই আপনি আর এখানে আসতে পারবেন না।
‘ এগুলো কেমন শর্ত আয়নামতী? পাগল হয়ে গেছ তুমি। ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ো।
আয়না জোরে কামড়ে ধরলো অনুরাগের হাতের বাহু। ছাড়লো বেশ সময় ধরে। অনুরাগ স্তব্ধ হয়ে গেল। ড্রাইভারকে বলল
‘ তাড়াতাড়ি নামো। পানি আনো। কামড়ে শেষ করে দিল। এতই যখন জামাই দরদী তখন হাত পা ভাঙলে কেন? আশ্চর্য মেয়েমানুষ।
আয়না বারবার নাক টানলো। বাম হাতটা দিয়ে গাল মুছতে মুছতে বলল
‘ আপনাকে মেরে ফেলব আমি।
‘ সেজন্যই তো থেকে যাচ্ছ। তোমার হাতে আমি মরতে ও রাজী আছি আয়নামতী।
আয়না বলল
‘ তাহলে আমাকে ঘরে নিয়ে যান।
‘ আমি কেন নিয়ে যাব? তোমার যেতে ইচ্ছে হলে যাও।
‘ গাড়ির দরজা খুলে দেন তাহলে। আমি যেতে পারব, হাঁটতে পারি আমি।
অনুরাগ কোলে নিয়ে নিল চট করে। এগিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ জামাই থাকতে হাঁটতে হবে কেন?
‘ মানিনা জামাই-টামাই। এমন একটা বেকুব মানুষ কখনোই আমার অর্ধাঙ্গ হতে পারেনা।
আমি মানিনা আপনাকে। ভালোবাসা বহুদূর, আপনাকে ঘেন্না করি আমি। আপনার প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান সব ধুলোয় মিশে গেছে আমার। ফিরিয়ে দিন সেসব। মেনে নেব সবটা।
‘ সত্যি? কথা দিচ্ছ তো ?
আয়না চোখটা সরিয়ে নিল। বলল
‘ আমাকে তাড়াতাড়ি দিয়ে আসুন। আপনার কোলে থাকতে ভালো লাগছেনা।
‘ ঠিক আছে।
_______________
বাম হাতটা দিয়ে কোনোমতে পায়ের আঙুলের ব্যান্ডেজগুলো খুলে নিল আয়না। ঠনঠনে ব্যাথা সেখানে। তারপর পা নামিয়ে জুতোজোড়া পড়ে নিল। বুড়ো আঙুলে ভর না পড়ে মতো হেঁটে চলে গেল দরজার কাছে। অনুরাগ বাইরে থেকে দরজা লক করে কাজে চলে গেছে। আয়না অনেক ধাক্কাধাক্কি করলো। অবাক হলো মাত্র তিনবার ধাক্কা দেওয়ার সাথে কে যেন এসে দরজা খুলে দিল। দরজা খোলামাত্রই বুড়িটাকে দেখতে পেল আয়না। ভয় পেল না। বলল
‘ ওনি আপনাকে শ্রদ্ধা করেন। আর আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন?
‘ আমার সাথে সাথে এসো।
‘ কিছু বললেন না যে,,,,
‘ যেটা বলেছি সেটাই করো।
আয়না পিছু পিছু চলে গেল। বুড়ি ওই কালো দরজাটির কাছে গিয়ে থেমে গেল। চাবি দিয়ে তালা খুললো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা ঘরটিতে কোনো আলো নেই। আয়না বলল
‘ আমি ওখানে যাব না। আপনার উদ্দেশ্য কি? যাব না মানে যাব না।
সাথেসাথে ঘরটিতে আলো জ্বলে উঠলো। লাল রঙের বাল্বটি। লালচে আভা ঘরটির কোণায় কোণায়। আয়না তাড়াতাড়ি পা রাখলো ঘরটিতে। চোখে তখন অপার বিস্ময়। ডান হাতটা কাঁপা শুরু করে দিয়েছে। মুখ, হাত, পা বাঁধা তিনজন মহিলা, আর দুজন ভদ্রলোক। আয়নাকে দেখে ছটপটানি আর ও বেড়ে গিয়েছে তাদের। আয়না শুকনো ঢোক গিলে তাকালো বুড়িটার দিকে। রাগে, আক্রোশে বলল
‘ কি করছেন আপনি? ওনাদের এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন? আপনার মায়া দয়া হয় না? কষ্ট হচ্ছে ওনাদের। কি চান আপনি?
বুড়ি জোরো লাঠির করাঘাত করলো আয়নার ভাঙা হাতে। নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল আয়নার। গালটা ভিজে গেল। আর্তনাদে মুখ ফুটে বের হলো
‘ প্রফেসর?
‘ কোথাও নেই তোর প্রফেসর। বেশি কথা বলবি মাইর খাবি। চুপচাপ আমার কথা শোন।
আয়না বাম হাতটা ডান হাতে বুলাতে বুলাতে বলল
‘ অমানুষ। আজ ওনি আসুক। আমি সব বলে দেব।
বলেই আয়না বের হয়ে যেতেই যাচ্ছিল। ধপ করে দরজা বন্ধ করে দিল একটি মহিলা এসে। বুড়ি হেসে উঠলো। আয়না বুড়ির লাঠিটা কেড়ে নিল। জোরে আঘাত করলো পিঠে। ঢলে পড়লো বুড়ি। আয়না বলল
‘ এদের সবার বাঁধন খুলে দিন। নইলে মেরে ফেলব। দিন।
বুড়ি রক্তাক্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো। আয়না বামহাতের সাহায্য জোরে আরেকটা করাঘাত করলো। বুড়ি একেবারে লুটিয়ে পড়লো। আয়না লাঠিটা রাখলো একটা লোকের পাশে। বামহাতটা দিয়ে কোনোমতে মুখ খুলে দিল। তারপর ধীরে ধীরে হাতটা খুলে দিল। হাত খুলে দেওয়ায় বাবলু নিজে নিজে পায়ের বাঁধন খুললো। বাকিদের খুলতে সাহায্য করলো। বুড়ি উঠতে চাইলো আয়না বলল
‘ উনাকে বেঁধে দিন তাড়াতাড়ি। আমি আর মারতে পারব না। তাড়াতাড়ি করুন। সবাই মিলে তাড়াতাড়ি করে বুড়িকে রশিগুলো দিয়ে বেঁধে ফেলল। মুখ খোলা রাখলো। আয়না বলল
‘ এইবার ওদেরকে বলুন দরজা খুলে দিতে। তাড়াতাড়ি বলুন।
বুড়ি কাঁপতে কাঁপতে বলল
‘ তোর স্বামীর মরার পথ তুই সহজ করে দিয়েছিস। বাইরে যতগুলো কাজের মানুষ আছে সবগুলো তোর স্বামীর শত্রু। আমাকে এভাবে বেঁধে রেখে ভালো করিসনি। কত বড় বড় শত্রু আছে তোর স্বামীর তুই ভাবতে ও পারছিস না। আমাকে খুলে দে।
পাশ থেকে একজন হ্যাংলা পাতলা মহিলা বলে উঠলো
‘ তুমি এত লোভী হলে কবে থেকে? সাহেবকে মারার জন্য তাদের হাতে হাত মিলিয়েছ? শুধু টাকার জন্য? ছিঃ।
আয়না বলল
‘ তারমানে আপনাদের ছদ্মবেশে ওই পাঁচজন ছিল। আমাকে ও ওরাই আঘাত করেছে। এত বড় ষড়যন্ত্র? আমি এখন কি করব?
বুড়ি মাথা কাত করে পড়ে রইলো। আয়না বলল
‘ আপনি এভাবে চুপ থাকবেন না। ওনার সাথে এমন করবেন না। ওনার মা বাবা পাগল হয়ে যাবেন। দেখুন ওনি তো আপনার কোনো ক্ষতি করেনি তাহলে আপনি কেন অমন করছেন? টাকা আমি আপনাকে দেব। কত টাকা চাই আমার? কত? দরজা খুলে দিতে বলুন।
বুড়ি মাথা নিচু করে ঝুলে থাকলো। কিছুক্ষণ পর দরজা আপনাআপনি খুলে গেল। তবে চকচকে ধারালো ছুরি নিয়ে প্রবেশ করলো কালো বোরকা পড়া একজন। মুখ বাঁধা। আয়না বুঝে ফেলল এইটা পুরুষ লোক। তবে কিছু বুঝে উঠার আগেই লোকটা বুড়ির কাছে গিয়ে খপখপ ছুরিকাঘাত করলো পরপর দুইবার। মুখ দিয়ে টকটকে লাল রক্ত বের হয়ে এল বুড়ির সাথে সাথেই মারা গেল বুড়ি। আয়না টের ও পেল না বাকিরা পালিয়েছে। আয়না লুটিয়ে পড়লো মাটিতে এমন ভয়ংকর হত্যাকান্ড দেখে। বাকিরা ও বন্দী হলো মুহূর্তেই।
আয়না যখন নিজেকে আবিষ্কার করলো তখন দেখলো সুসজ্জিত একটা ঘরে সে বন্দী। রঙবেরঙের আলোয় আর গোলাপি রঙের পর্দা ঝুলছে ঘরটাতে। হাতের ব্যাথা যেন মগজ ছুঁলো। যন্ত্রণায় কাঁদলো আয়না। প্রফেসর তাকে ফেলে কোথায় গেল? বুড়িটাকেই বা কেন মেরে ফেলল ওই লোকটা? বাকিরা কি বেঁচে আছে? সে কোথায় এখন?
সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে হাজির হলো লাল টকটকে হালকা পাতলা সিল্কের শাড়ি পড়া একজন মেয়ে। আয়নার চিনতে অসুবিধে হলো না কুহেলী সরকারকে । ভালো করে চিনতে পারলো এইবার। টিভিতে কুহেলীকে দেখাতেই টিভি বন্ধ করে দিয়েছিল শায়খ চৌধুরী।
গতবার যিনি তার বাগানের ফুল ছিঁড়েছেন। আর এজন্যই প্রফেসর তার উপর এত রেগে গিয়েছিলেন। আয়না তেড়ে গেল। বলল
‘ আপনার সাথে উনার তো কোনো শত্রুতা ছিল না। তাহলে আপনি কেন এমন করছেন? কেন কতগুলো প্রাণ নিয়ে এইভাবে খেলা করছেন। বুড়ির কথা বাদ দিলাম ওই মহিলাগুলো আর লোকগুলোকে মুক্তি দিন। অনেকে ওনাদের পথ চেয়ে বসে আছেন। স্ত্রী, স্বামী কিংবা সন্তান।
‘ এত দরদ?
রসিকতা করে বলল কুহেলী।
‘ হ্যা। দরদ। মুক্তি দিন।
‘ আর তোমার স্বামী। আমি তো ভালোবাসিনি, তুমি কি খুব ভালোবাসো নাকি? শুনেছি সেইরকমের বউ পাগলা অনুরাগ চৌধুরী। একেবারে চোখে হারায়। লাইলির মজনু।
আয়না দাঁতে দাঁত চাপলো। বলল
‘ কি চাচ্ছেন আপনি?
শাড়ির আঁচলটা হাতে নিল কুহেলী। উদরের অর্ধেকাংশ উন্মুক্ত। আয়নাকে ভালো করে দেখে বলল
‘ তোমাকে এই শাড়িতে ঠিক মানাচ্ছে না। তোমার ওই হাবাগোবা স্বামী তোমাকে দিয়েছে না?
‘ আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন কেন? আশ্চর্য! আমাকে ওনার কাছে যেতে দিন।
‘ মেরে ফেলেছি।
গলা কেঁপে উঠলো আয়নার। কুহেলী নিজের হাতের ব্যাগটা থেকে একটা সাদা শাড়ি বের করলো। ছুঁড়ে মারলো আয়নার দিকে। বলল
‘ পড়তে সাহায্য করব নাকি পড়ে নিতে পারবে। স্বামীর মঙ্গলের জন্য পড়ে নাও। বেচারা বিদায় জানিয়েছে পৃথিবীকে।
আয়না কেঁপেকেঁপে বলল
‘ আমাকে ছেড়ে দিন। খুব খারাপ হবে আপনাদের সাথে।
কুহেলী এগিয়ে এল। এল টান দিয়ে শাড়ি টেনে ধরলো আয়নার। টেনে হিঁচড়ে যেভাবে শাড়িটা ছাড়িয়ে নিল। আয়না ভাঙা হাত নিয়ে পারলো না কুহেলীর সাথে। কুহেলী সাদা শাড়ি পড়িয়ে দিল। নাকের ফুল টেনে খুলে নিল। বলল
‘ আমাকে না দিলে লোক পাঠাতাম। ভাগ্যিস হাতটা ভেঙে দিয়েছিলাম। বেচারি বুড়ি। শেষমেশ মরতে হলো।
‘ জঘন্য কাজের জঘন্যরকম শাস্তি পাবেন আপনি। আমি এখন বুঝতে পারছি ওই বুড়িটাকে ব্যবহার করেছেন আপনি। কাজ শেষ হওয়ায় মেরে দিয়েছেন। সত্যি করে বলুন প্রফেসর কোথায়?
কুহেলী বলল
‘ তোমার গায়ের সাদা শাড়ির দিকে ভালো করে তাকাও। বুঝে যাবে। দেখছ না আমি লাল শাড়ি পড়েছি। আজ আমার খুব খুব খুশির দিন। ওই চৌধুরীদের যদি আমি পথে না বসায় আমার নাম ও কুহেলী সরকার নয়।
‘ এত অমানুষ আমি এই প্রথম দেখছি। এতটা খারাপ মানুষ আমি কখনো দেখিনি। আমি তো ভেবেছি সবচাইতে খারাপ মানুষটা শুধু আমি। নাহ। আমার চাইতে খারাপ মানুষ ও তাহলে আছে? ছিঃ।
কুহেলী হেসে ফেলল। বলল
‘ তোমার স্বামী তো পরপারে। এবার দেখি একা একা লড়ো তো। তোমাকে কি নামে ডাকতো যেন? ও হ্যা, আয়নামতী। এইবার তাহলে অনুরাগ চৌধুরীর আয়নামতী হয়ে দেখাও তো। তোমাকে সাদাই বেশি মানাচ্ছে আয়না। বলি কি আমার সাথে সিনেমার জগতে চলে আসো। এই বোকা হাঁদারাম গেছে তো গেছে।
‘ আপনি সবটা মিথ্যে বলছেন। আমি আপনার কথা কিচ্ছু বিশ্বাস করছিনা। কোথায় ওনি? দয়া করে মিথ্যে বলবেন না। সৎ সাহস যদি থেকে থাকে সত্যিটা বলুন।
‘ বললাম তো মারা গেছে। তোমার স্বামীকে আটক করে রাখা হয়েছে খালেকুজ্জামানের এই গোপন আস্তানার কালো কুঠুরিতে । ওর সহচরদের সহ। বাকিদের ডাবল টাকা খাইয়ে কিনে নেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই মৃত্যুর সংবাদ এসেছে তোমার স্বামীর । চিন্তা নেই তোমার ও মৃত্যু হবে যদি আমাদের কথা অনুযায়ী না চলো।
আয়না দু পা পিছিয়ে গিয়ে খাটের উপর বসলো। গায়ে ধবধবে ঝকঝকে সাদা শাড়ি। শাড়িটার উপর ফোঁটা ফোঁটা জল গড়ালো। প্রফেসর তার কথাগুলো কেন বিশ্বাস করলো না। নিজের শত্রুদের অত হেলাফেলা করাটা ঠিক নয়। এখন কি করবে সে?
কুহেলী চলে গেল হেসেহেসে। আয়না দরজা খোলা পেয়ে বের হয়ে গেল পিছুপিছু। দেখলো সে অন্য একটা বাড়িতে। তারমানে এটাই খালেকুজ্জামানের গোপন আস্তানা। তার ও মৃত্যু হবে কিছুক্ষণ পর? কিন্তু কেউ তাকে বন্দী করছেনা কেন? কিছুটাদূরে মিটমিট করে মোমবাতি জ্বলছে। আশেপাশে অনেকগুলো মোমবাতি আর দেশলাই। আয়না কতগুলো নিয়ে নিল সে। অন্ধকার ঘরগুলোতে কি কি আছে তার দেখতে হবে। তখন তার কাজে লাগতে পারে। তবে বেশি নিয়ে নেওয়ার আগেই তার ঘাড় ধরে কেউ একজন টেনে নিয়ে গেল তাকে। চোখ বেঁধে দিল। তারপর ঢুকিয়ে দিল অন্ধকার কুঠুরিতে। তারপর চোখ খুলে দিল। মিটমিট করে একটা লাল রঙের আলো জ্বলছে। চারদিকে কেমন শূন্য শূন্য। তবে কুঠুরির এককোনায় আধমরা হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল একটা লোককে। ভয়ে অন্তরআত্মা শুকিয়ে গেল আয়নার। চোখে বৃষ্টি নামলো ভয়ংকরভাবে। দৌড়ে গেল আয়না। মেঝেত লুটিয়ে থাকা মানুষটার মাথা তুলে রাখলো তার কোলে। ঘনঘন ডাকল
‘ প্রফেসর? শুনছেন? একবার চোখ খুলুন৷ এভাবে আমাকে ভয় দেখাবেন না।
চারপাশে আঘাতের দাগ অনুরাগের মুখে,কপালে,গলায়,হাতে, বুকে। গায়ের সাদা শার্টটি হালকা রক্তেভেজা। আয়না অনেক ডাকলো। অনুরাগ পানি খুঁজলো। আয়না পানি পানি বলে অনেকক্ষণ চিৎকার করলে ও কেউ পানি দিল না৷ তবে অনুরাগ নিজ থেকেই আয়নার দিকে তাকালো। উঠে বসার চেষ্টা করলো। আয়না হাত ধরে বসালো। বলল
‘ প্রফেসর ওই বুড়িটা মরে গেছে। ওই লোকগুলো আর মহিলাগুলো। সবটা সাজানো ছিল। ওরা আপনার শত্রু।
‘ আর আমি তোমার। তাই না?
‘ প্রফেসর এখন সেসব কথা বলার সময় না।
‘ আমি তোমাকে বোধহয় ভালো রাখতে পারব না। আমার সবকিছু শেষ আয়নামতী। তুমি ঠিকই আমাকে বেকুব বলো। বেকুবদের জন্য সমাজসেবা আসেনি আয়নামতী। মানুষের ভালো করতে গেলে যে শত্রুতা বাড়ে সেটা জানতাম না। গুপ্তচর রেখে যে শত্রু পাহাড়া দিতে হয় সেটা ও জানতাম না। আমি তো তোমার অপছন্দের হবোই। আমাকে ক্ষমা করো আয়নামতী। তোমাকে আর ভালো রাখা হলো না।
আয়না বলল
‘ প্রফেসর এখন এসব কথা থাক না। কি করে এখান থেকে,,,
‘ এখান থেকে আর মুক্তি নেই আয়নামতী। সবটা শেষ। আমাকে শুধু কথা দাও, যদি আমার কিছু হয়ে যায় আমার পরিবারকে তুমি দেখে রাখবে। কথা দাও।
‘ কি বলছেন এসব?
‘ কথা দাও। কেন কথা দিচ্ছ না?
‘ কথা দিলাম।
অনুরাগ ঢলে পড়লো আয়নার দিকে। আয়না তার মাথা কাঁধে রাখলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। অনুরাগ হেলে পড়ে বলল
‘ আয়নামতী একটা কথা বলো।
‘ আপনার তেষ্টা পেয়েছে। কম কথা বলেন। আমাকে ভাবতে দিন।
‘ আমার কিছু হলে তুমি কি অন্য কাউকে বিয়ে করবে আয়নামতী?
আয়না চুপ করে থাকলো।
‘ আচ্ছা বিয়ে করো। ভালো ও বেসো। কিন্তু আয়নামতী ডাকতে দিওনা। দেবে?
‘ আপনি বেশি কথা বলছেন।
অনুরাগ শক্ত করে ধরলো তাকে। বলল
‘ আয়নামতী আমি তোমার কাছে মূল্যবান কবে হবো বলতে পারো?
‘ তার জন্য আপনাকে থেকে যেতে হবে।
এত যন্ত্রণার মাঝে ও অনুরাগ হাসলো। বন্ধ চোখ, শুকনো ঠোঁট বিদ্ধ হলো আয়নার কাঁধে। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেল। মুখ তুলে অনুরাগ বলল
‘ আমার এখন তোমার সাথে বহুবছর বাঁচতে ইচ্ছে করছে আয়নামতী। নিজের জায়গাটা ছেড়ে অন্যকে দেওয়া খুব কষ্টের। এপাড়ে কিংবা ওপাড়ে থাকি তোমাকে অন্যের হতে দেখলে খুব কষ্ট হবে আমার। আমি বাঁচতে চাই। আমাকে বাঁচাও প্রাণোমোহিনী।
চলবে
তাড়াহুড়ো করে লিখেছি। ভুলত্রুটি মাফ করবেন।