#নাটাই_ঘুড়ি
।।১৬।।
রূম্পার কল্যাণে আজকে ইন্টারভিউ দিতে বেরিয়েছে ইমরুল। পোস্ট সেলস এণ্ড মার্কেটিং।
ইন্টার্ভিউ খুব বেশি ভালো হলো না। ইমরুল ইন্টারভিউ দিতে ঢুকেছিল মৃদু খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
ইন্টারভিউ বোর্ডে একজন জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার পায়ে কী সমস্যা?”
“পায়ে কোনো সমস্যা নেই স্যার। কয়েক দিন আগে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।“
“কীভাবে?”
“রাস্তা পার হতে গিয়ে।“
“আমাদের এখানে অনেক জায়গায় যেতে হবে, অনেক ছোটাছুটি করতে হবে, পারবেন?”
ইমরুলের হয়ত বলা উচিত ছিল, “পারব।“ তা না বলে সে বলে ফেলল, “চেষ্টা করব স্যার।“
ইন্টারভিউ এরপর আর জমল না। সবাই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল।
বের হয়ে বেশ মন খারাপ হলো ইমরুলের। রূম্পা আশা করে পাঠিয়েছিল।
বের হয়ে রাস্তার মাঝখানে আইল্যাণ্ডে গিয়ে দাঁড়াতেই সিগন্যাল ছেড়ে দিল। চতুর্দিক থেকে গাড়ী ছুটে আসছে।
এর মধ্যে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। ইমরুল চুপচাপ আইল্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে রইল।
আশেপাশে ট্রাফিক পুলিশ দেখা যাচ্ছে না। একটু দূরে একটা লোহার শিকের ছাতা বসিয়ে এক লোক পান বিড়ী আর বিকাশের দোকান দিয়ে বসেছে।
ট্রাফিক পুলিশ সেখানে বসে আরাম করে সিগারেট টানছে। এই সুযোগে কিছুক্ষণ ট্রাফিক কন্ট্রোল করে নিলে কেমন হয়?
ইমরুল নিজের পাগলামি চিন্তায় নিজেই হেসে ফেলল।
রূম্পা উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “আপনি ইচ্ছা করেই আউলা বাধায়ে দিয়ে আসছেন, ঠিক না? আপনার আসলে দৌড়াদৌড়ির কাজ পছন্দ না, ঠিক না?”
ইমরুল বিব্রত মুখে বলল, “কী জানো রূম্পা, আসলে সেরকম কিছু না…”
রূম্পা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “অলস পুরুষ মানুষ আমি দুই চোখে দেখতে পারি না!”
ইমরুল বলল, “তুমি বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছা করে কিছুই করিনি!”
রূম্পা বেজার মুখে উঠে গেল। ইমরুল এতদিনে এই মেয়েটিকে একটু একটু ভয় পেতে শুরু করেছে।
ইমরুলের প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কিন্তু খাবার চাইতে সাহস হচ্ছে না।
কামরানের আসতে আরো দুই ঘন্টা বাকি, এই দুই ঘন্টা তাকে অপেক্ষা করতে হবে। বাচ্চাটা সারা রাত খুব বিরক্ত করে।
পেট ব্যথায় কান্না করে, কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়। শুইয়ে দিলেই ঘুম ভেঙে কাঁদতে শুরু করে।
সারা রাত পালা করে তিনজন বাচ্চা কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে। শেষ রাতে মাটিতে পাতা বিছানায় শুয়ে মরার মত ঘুমায় কামরান।
বিছানার ওপরে ঘুমায় শম্পা। রূম্পা সার্ভিস দেয় একাই।
কামরান আর শম্পা দুজনেরই ঘুম গভীর হলে মাঝে মাঝে রূম্পা এই ঘরে আসে। ঢুলু ঢুলু চোখে বলে, “একটু নেন দেখি, বাথরুমে যাব!”
বাচ্চাটা কোল বদল করতে গিয়ে রুম্পার সাথে আঙুল ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায় ইমরুলের। রুম্পার গায়ে জড়ানো ওড়না শিথিল হয়ে আসে শেষ রাতের নির্জনতায়।
ইমরুলের ভয় ভয় লাগে। গা ছম ছম করে।
বাচ্চাটা কোলে নিয়েই অকারণেই তিথিকে ফোন করে ইমরুল। তিথি ঘুম ভেঙে উঠে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, “কী হয়েছে তোমার? খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?”
“না, কেমন অস্থির লাগছিল। তিথিমণি, তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?”
ফোনের ওপাশে হাসে তিথি, হাসিটা কেমন মলিন শোনায় আজকাল। “আমি তো ফিরিয়ে রেখেছি, জানি না আর কতদিন ফিরিয়ে রাখতে পারব…”
বাথরুমের প্রয়োজন সেরে ফিরে আসে রূম্পা। অপেক্ষা করে ইমরুলের ফোনালাপ ফুরোবার।
ইমরুল ফোন রাখলে বাঁকা হাসি হেসে বলে, “ভীতু পুরুষ মানুষের জীবনে কিছুই হয় না, বুঝলেন!”
ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে যায় রাতের শেষ প্রহরে আকাশের কোণে জ্বল জ্বল করতে থাকা শুকতারা। কেমন গলা শুকিয়ে আসে ইমরুলের।
ওর দিকে প্রয়োজনের চেয়ে কিছুটা বেশিই ঝুঁকে এসে কোল থেকে বাচ্চাটা ফিরিয়ে নিয়ে যায় রূম্পা। চোখ বন্ধ করে ইমরুল।
ওদের এক্সট্রা মশারি নেই, মশার খুব উৎপাত। কয়েলটা সারা রাত জ্বলে এ সময়ে নিভে যায়, মশারা ঘিরে ধরে ইমরুলকে।
কয়েলটা ফের জ্বালিয়ে দিতে বলবে রুম্পাকে কিংবা নিজেই উঠে জ্বালিয়ে নেবে, অদ্ভুত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে ইমরুল। ক্যাম্প খাটের বিছানায় শুয়ে কানের পাশে গুন গুন করতে থাকা মশার দলকে চটাস চটাস শব্দে মারতে মারতে আর আকাশের গায়ে টিম টিম করে জ্বলতে থাকা শুকতারা দেখতে দেখতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে ইমরুল।
এ সময়ে সবার ঘুম গাঢ় হয়। ঘুমের মধ্যে ঘটে আরেকটি অস্বস্তিকর ঘটনা।
প্রতিটি সক্ষম যুবা পুরুষের জীবনে কিছু নিষিদ্ধ স্বপ্ন আসে। যে স্বপ্নে সাধারণত কারো মুখ থাকে না, শুধু নারী শরীর থাকে কিংবা ধরা ছোঁয়ার বাইরে কোনো পরম আকাঙ্খিত নারীর মুখ বসানো থাকে।
ইমরুলের এই তিন দশকের জীবনে এমন নিষিদ্ধ গোপন স্বপ্নের বয়স দুই দশকের বেশি। এতদিন এই স্বপ্নে আসা নারীদের কারো শরীরে কোনো মুখ বসানো ছিল না।
ইদানীং সেই সব শরীরে প্রায়ই বসানো থাকছে রুম্পার মুখ, ওই পাথরে কুঁদে তৈরি করা শরীরে ওই তেজীয়ান মুখ। সকালে ঘুম থেকে উঠে অস্বস্তির সীমা থাকে না ইমরুলের।
ওই ছোট্ট বাথরুমে মগের পর মগ পানি গায়ে মাথায় ঢেলেও মনে হয় মাথা দিয়ে আগুনের হলকা বের হচ্ছে। রুম্পার সাথে কোনো মিষ্টি প্রেমের স্বপ্ন আসে না, শুধু শরীরী অভিলাষ খুঁজে ফেরে প্রকাশের নিজস্ব ভাষা।
কি লজ্জার কথা!
অথচ সংসারের কল্পনায়, নিভৃত গৃহ কোণে একটি ভাতের পাতিলে ভাতের চামচ হাতে মন তিথিকেই ভেবে নেয়। রুম্পার অস্তিত্ব শুধু ঘুমের গহীনে উদ্দাম বাসনায়, জাগ্রত মনের যার ওপরে কোনো হাত নেই।
অথচ মেয়েটা কি ভালো! নিজেই ঠেলে ঠেলে তাকে কত জায়গায় পাঠাচ্ছে, কত মানুষকে ফোনে অনুরোধ করছে তাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে।
কামরানের এত সময় ছিল না, রুম্পাই না সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনেছে। এই হিসাবের সংসারে মুরগি রান্না হলে রুম্পাই না তাকে লুকিয়ে দু এক টুকরো বেশি দিয়ে যায়।
তাকে নিয়ে এমন অশ্লীল কল্পনা, ছিঃ! নিজের বিবেকের কাছেই অপরাধী লাগে ইমরুলের।
রুম্পার উঁচু করে বাঁধা হাতখোঁপা, রাঁধতে রাঁধতে ভিজে ওঠা বগলের কাছটা, নাকের নিচে জমে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘাম সবই কি ভীষণভাবে টানে ইমরুলকে! মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার পরক্ষণেই কান গরম হয়ে ওঠে।
অথচ এই রুম্পার ঘরের মানুষটি ছিল পরনারীতে আসক্ত। কোনো মানে হয়!
এত ভালো একটা মেয়ে, অথচ, অথচ…
রাতের পর রাত ঘরে ফিরত না রুম্পার বর। অন্যদিকে রুম্পার ভাশুরের মতি গতি সুবিধার ঠেকছিল না।
সারা ক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখতে রাখতে রুম্পার জায়ের হচ্ছিল প্রাণান্ত। ওদিকে রুম্পাও লুকিয়ে থাকতে থাকতে হয়ে পড়ছিল বিরক্ত।
বাড়াবাড়ি সীমা ছাড়িয়েছিল যেদিন বাসার সবাই গিয়েছিল এক বিয়ের দাওয়াতে। রূম্পা একাই যায়নি।
যথারীতি ওর বর বাসায় ছিল না, সবাই তো তার কীর্তি কাহিনী জানে, বর ছাড়া বিয়ে বাড়িতে গেলে সবাই আহা উহু করবে, তাই ভেবেই যায়নি। এসব ওর ঠিক সহ্য হয় না।
বাসায় একাই ছিল রূম্পা, আচমকা ফিরে এল ওর ভাশুর। তার নাকি বিয়ে বাড়িতে শরীর খারাপ লাগছিল।
চা দিতে বলেছিল রুম্পাকে। আর সেই চা দিতে গেলেই রুম্পার হাত চেপে ধরেছিল কাপশুদ্ধ।
কাপ ভর্তি গরম চা গায়ের ওপরে ঢেলে ফেলে ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছিল রূম্পা। আর সেদিন রাতে সবাই বিয়ে বাড়ি থেকে বাসায় ফিরে এলে তার ভাশুর নির্লজ্জের মত দোষ চাপিয়ে দিয়েছিল রুম্পার ওপরেই।
শরীরের জ্বালায় রূম্পা যখন বাঁচতেই পারছে না, আবার জামাইকেও ধরে রাখতে জানে না, তাহলে অন্যের ঘর না ভেঙে বাজারে ঘর দিয়ে বসে না কেন, জায়ের ইত্যাদি মধু বাক্য পাড়ার কারো শুনতে বাকি ছিল না সেদিন রাতে।
পরের দিন সকালেই তল্পিতল্পা নিয়ে বড় বোনের বাসায় এসে উঠেছিল রূম্পা। বাপের বাড়ি যাবার উপায় নেই, বুড়ো মা বাবাকে নিয়ে ভাবি এমনিতেই যথেষ্ট গঞ্জনা দেয় ভাইকে, তার ওপরে আবার বিবাহিত বোন গিয়ে উঠলে অবস্থাটা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, দুবেলা ভাত আর একটু শোয়ার জায়গাটুকু জুটবে কিনা, তাই নিয়ে সন্দেহে ছিল রূম্পা।
কামরান মাথায় তুলে রেখেছে রুম্পাকে, সে কাউকে ফেলে না। শালীকেও না, বন্ধুকেও না।
শম্পা শুধু সতর্ক করে রেখেছে, কামরানের সামনে ঢাকাঢুকি দিয়ে চলতে। কামরানের নজর যেন রুম্পার আঁটসাঁট শরীরের ওপরে না পড়ে।
শরীর, এই শরীরটাই সব নষ্টের মূল, অথচ যার জন্য এই শরীর বরাদ্দ ছিল সেই ফিরে তাকাল না। বলতে বলতে খুব গা দুলিয়ে হেসেছিল রূম্পা।
আর অপরাধবোধে শেষ হয়ে গিয়েছিল ইমরুল।
(আগামী পর্ব পরশু দিন ইন শা আল্লাহ্)