#নাটাই_ঘুড়ি
।।১৮।।
সন্ধ্যা মিলিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। পড়তে বসেছে মীরা।
এমন সময় ফোন বেজে উঠল মীরার। শিহাব ভাইয়া ফোন করেছে।
ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতে কল রিসিভ করে ফেলল মীরা। ফোন ধরতেই শিহাব উত্তেজিত গলায় বলল, “হ্যালো মীরু? তুমি আমাকে যে লোকটার ছবি দেখিয়েছিলে না? ওই যে যার সাথে নীরার বিয়ের কথা হচ্ছে? সেই লোকটাকে দেখি আজকে মার্কেট থেকে বের হচ্ছে নাইমা আন্টির সাথে। সাথে আবার একটা বাচ্চাও ছিল!”
মীরা সন্তর্পণে বলল, “ও আচ্ছা, তাই নাকি?”
“হ্যাঁ, ব্যাপার কী বল তো?”
“আচ্ছা, আমি জিজ্ঞেস করব ফুপিকে!”
“নীরা যে অনেকদিন আসে না এদিকে?”
“বিয়ের কথা চলছে না, এখন একটু কম বেরোনোই তো ভালো!”
“ও আচ্ছা আচ্ছা। সেদিন বাজারগুলো ভালো ছিল তো?”
“হ্যাঁ ছিল, সেটা তো সেদিনই বলে আসলাম!”
“আচ্ছা ঠিক আছে।“
শিহাব আর বলার মত কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে ফোন রেখে দিল। ফোন রেখে কুটকুট করে হাসতে লাগল মীরা।
নীরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইলে স্ক্রল করছিল। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “কার সাথে কথা বলিস মীরু?”
“কারো সাথে না আপু।“
“আমাকে না বললে আমিও সবাইকে বলে দেব মীরা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলে, আবার ফোন রেখে কিট কিট করে হাসতে থাকে!”
“তুমি কি আমাকে সব কথা বল? আমি কেন তোমাকে আমার সব কথা বলব?”
“ওমা, আমি আবার কবে কী বললাম না তোকে?”
“তাহলে তুমি আমাকে বলবে তোমার ঘটনাটা কী?”
“আমার? আমার আবার কী ঘটনা?”
“তুমি যে সেদিন আমাকে ছাদে বসিয়ে রেখে শিহাব ভাইয়ের দোকানে গেলে, সেটার ঘটনা কী আপু?”
নীরা আপু হকচকিয়ে গেল। সে আসলে গিয়েছিল চকোলেটের লোভে।
মীরাকে তো আর সেই কথা বলা যায় না। কাজেই সে চুপ মেরে গেল।
তবে বলার মত কিংবা না বলে গোপন করে রাখার মত একটা ঘটনা ইদানীং নীরার সাথে হচ্ছে বটে। নীরার একজন অচেনা ফেসবুক ফ্রেণ্ড হয়েছে।
নীরা নিশ্চিত সে তার আশেপাশেই থাকে। প্রায়ই এমন সব মেসেজ করে যাতে বোঝা যায় সে নীরার প্রতিদিনের সব কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে।
যেমন সেদিন লিখল, “এরপর আকাশী জামার সাথে আকাশী ওড়না পরবে না, সাদা পরবে, তাহলে শরতের আকাশের মত লাগবে।“ আইডিতে আসল নাম, ছবি কিছুই দেওয়া নেই।
নাম “দিকভ্রান্ত নাবিক”। বায়োর লেখাটা দেখে পছন্দ হয়েছিল তাই রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করে নিয়েছিল।
বায়োতে লেখা ছিল,
“আমি ভীষণ ছন্নছাড়া মানুষ
ছাড়া পেলেই আকাশ জুড়ে উড়ি,
দিনের শেষে আবার ফিরে আসি
নাটাই যেমন আটকে রাখে ঘুড়ি।“
আজকে প্রোফাইলে লিখে রেখেছে,
“তুমি আমার ভীষণ আপন,
কাছে থাকো কিংবা দূরে,
আর কেউ নেই মনের ঘরে,
তুমিই আছ সবটা জুড়ে।“
এই ছেলেটা কখনো তার সম্পর্কে কিছুই পোস্ট করে না। তার পুরো পরিচয়, ঠিকানা কিছুই জানে না নীরা।
শুধু জানে এক জোড়া চোখ তাকে অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে সব সময়। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগলেও বেশিরভাগ সময় ভালোই লাগে নীরার।
আর এই সময়টা, এই বয়সটাই তো ভালো লাগার। কোন সপ্তদশীর ভালো লাগবে না এমন নীরব গোপন অনুসারী পেতে?
তাই নীরা নিজের অজান্তেই এখন সবসময় ফিটফাট হয়ে চলে। মীরার চোখ এড়ায় না এসব।
একবার ভাবে, শিহাব ভাইয়ের কথাটা বলে দেবে নাকি? নীরা আপু যদি অন্য কোথাও জড়ায়, তাহলে তো শিহাব ভাইয়া ভীষণ কষ্ট পাবে।
তারপর আবার কী ভেবে চুপ করে থাকে। আসলে বলে দিলেই তো মজা শেষ হয়ে যাবে।
শিহাব ভাইকে এতদিন ধরে বোকা বানানোর অপরাধে কপালে কিছু উত্তম মধ্যমও জুটতে পারে।
নীরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “তোর সাথে ছোট চাচার কথা হয় নাকি রে?”
মীরা চমকে উঠে বলল, “কই না তো!”
কথা হয় না কথাটা মিথ্যা। কথা হয়, নিয়মিতই কথা হয়।
ছোট চাচার নাম্বার জোগাড় করতে বহু সাধ্য সাধনা করতে হয়েছে তাকে। অবশেষে তার স্যারের কাছ থেকে নাম্বারটা পেয়েছে মীরা।
ছোট চাচা যদিও স্যারকে নিষেধ করে দিয়েছিল কাউকে তার নাম্বার দিতে। বহু কাকুতি মিনতি করতে হয়েছে মীরার।
একটা শোরুমে চাকরি নিয়েছে ছোট চাচা। কেন যে তার সবার কাছ থেকে এমন আত্মগোপনের শখ হলো কে জানে।
এর মাঝে এক ফাঁকে লুকিয়ে ছোট চাচার তিথিমণির সাথে দেখাও করে এসেছে মীরা। ছোট চাচার নতুন নাম্বার দিয়ে এসেছে।
তিথিমণিও পড়েছে বেকায়দায়, বাসায় বলতে পারছে না কিছু। হয়ত আর বেশিদিন বিয়েটা আটকে রাখতে পারবে না তিথি।
সেজন্যই বোধ হয় ছোট চাচা নিজের ঘাড়ে সব দোষ তুলে নিয়ে তাকে দায় থেকে মুক্ত করে দিতে হারিয়ে যেতে চেয়েছিল, কে জানে? মীরা ভালো বুঝতে পারে না।
বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে। এই ভর সন্ধ্যায় কে এল?
মীরা খুব একটা গা করল না। ফুলি আছে, সেই দরজা খুলবে।
একটু পরই ফুলি ছুটতে ছুটতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আপু তাড়াতাড়ি আসেন, নানাজান কেমন জানি করতেছে!”
মীরা নীরা ছুটে গিয়ে দেখল দাদার শরীর থর থর করে কাঁপছে। বসার ঘরে একজন মধ্যবয়সী কালো ফ্রেমের চশমা আর ব্লেজার পরা কেতাদুরস্ত লোক বসে আছে।
লোকটি শান্ত মুখে ঠাণ্ডা গলায় বলছে, “আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? এই তো এগ্রিমেন্টের কাগজ। আপনি তো স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে স্বাক্ষর করেছিলেন যে এই বাড়ি বন্ধক রেখে পঞ্চাশ লাখ টাকা নিচ্ছেন। প্রতি মাসে তিরিশ হাজার টাকা করে শোধ করতে হবে। ছয় মাস ধরে কিস্তি দিতে না পারলে বাড়ি দখল হয়ে যাবে। পাঁচ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর তো আপনার ছেলেকে জানানো হয়েছিল সেটা। উনি আপনাকে জানান নাই?”
দাদার শরীর ঝড়ের মুখে পড়া বাঁশপাতার মত কাঁপছে। মেজ চাচা এগিয়ে গিয়ে বলল, “ভাই আপনি এখন যান। আমরা পরে আপনার সাথে যোগাযোগ করব।“
লোকটা বেরিয়ে যেতেই ধরতে পারার আগে দাদা উত্তেজিত কন্ঠে বললেন, “নাইমুল কোথায়, ওকে যে মাসে মাসে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছি সেগুলো কোথায় গেল?”
ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে বড় চাচাও। বড় চাচা আমতা আমতা করে বলল, “আমি তো সেগুলো ইমরুলকে দিয়ে ব্যাংকে পাঠাতাম!”
“ইমরুলকে দিয়ে পাঠাতি মানে কী, আমি কি তোকে বলিনি যে নিজের হাতে টাকাগুলো ব্যাংকে জমা করে আসবি?”
“সে কথা পরে, তার আগে বলেন যে আপনি তো এর আগে কখনো আমাদের বলেন নাই যে আপনি এই বাড়ি বন্ধক রেখেছেন?”
“তাহলে কি ইমরুল টাকাগুলো নিয়ে…”
বড় চাচী পেছন থেকে বলে উঠল, “যেতেই পারে। বাজারের টাকা মারার অভ্যাস তো আছেই আগে থেকে! এইজন্যই চুরি করে পালিয়ে গেছে আর আমাদের কারো সাথে যোগাযোগও করছে না।”
মীরার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তার খুব মন চাচ্ছে প্রতিবাদ করতে।
সে তো খুব ভালো করেই জানে তার ছোট চাচা কত কম বেতনে শো রুমে কত কষ্টের চাকরি করছে। তার সাথে তো ছোট চাচার নিয়মিত কথা হয়।
এই পরিস্থিতিতে এই কথাটা বলা উচিত হবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে। ছোট চাচা পই পই করে নিষেধ করে দিয়েছে কাউকে তার বর্তমান অবস্থান ঠিকানা কাজকর্মের কথা কিছুই না জানাতে।
দাদি চিৎকার করে কেঁদে উঠে বললেন, “আমি বিশ্বাস করি না! আমার ইমরুল এই কাজ করে নাই!”
কেউ এগিয়ে গিয়ে ধরতে পারার আগেই আচমকা মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলেন দাদা। চারিদিকে হইচই পড়ে গেল।
বড় রাস্তার ওপরে পাটোয়ারি ডায়াগনোস্টিক এণ্ড ডক্টরস চেম্বার থেকে দাদার চেক আপ করার মাসকাবারি ডাক্তারকে ডেকে আনা হলো। সে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে দাদার জ্ঞান ফেরানোর পর দেখা গেল তাঁর শরীরের ডানপাশ অবশ হয়ে গেছে, কথা বলতেও পারছেন না, পানি খাওয়াতে গেলে মুখের পাশ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে।
সেই রাতেই এম্বুলেন্স দিয়ে দাদাকে ঢাকার হসপিটালে নিয়ে গেল সবাই মিলে।
(পরের পর্ব পরশু দিন সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্)