#নাটাই_ঘুড়ি
।।২০।।
আই এফ সি ব্যাংকের মুরাদনগর শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার নাইমাকে নিজের রুমে ডেকেছেন। প্রাথমিক চা নাস্তা খাওয়ার কুশলবার্তা বিনিময়ের পর স্যার জানতে চাইলেন, “মিস নাইমা, আপনি ঢাকার ব্র্যাঞ্চে ট্রান্সফার নিতে চেষ্টা করছেন?”
“জি স্যার।“
“কিন্তু কেন? আপনার ফ্যামিলির সবাই এখানে না?”
“জি স্যার।“
“তাহলে? আপনার কি এখানে কাজ করতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে?”
“আমি একটু নিজের মত করে থাকতে চাইছি স্যার।“
“ও আচ্ছা আচ্ছা। আমি আবার ভাবলাম কোনো সুখবর কিনা!”
নাইমা যথেষ্ট বিরক্ত হলেও মুখে কিছুই বলল না। মুখটা কঠিন করে বসে রইল শুধু।
আব্বার স্ট্রোক করেছে, ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি আছে। বাসার পরিস্থিতি খুবই খারাপ।
এক মাসের নোটিশ দিয়েছে, এই এক মাসের মধ্যে সব বকেয়া কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারলে বাড়ি ক্রোক করে নেবে। এর মধ্যে আব্বা অসুস্থ, হসপিটালাইজড।
ইমরুলটাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, নীরা মীরা মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়ায়। বড় ভাবীর প্রতাপ খুব বেড়েছে।
বড় ভাইয়া ঢাকায় গিয়েছে আব্বার সাথে, মেজ ভাইয়া ভাবী প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে পরিচিত সবার কাছ থেকে ঋণ ধার করে যেভাবে হোক টাকার জোগাড় করতে। একদিকে আব্বার হাসপাতালের খরচ অন্যদিকে বাসার এই পরিস্থিতি।
তাও ট্রান্সফার তো বললেই হয় না। এখন বলা শুরু করলে কয়েক মাস পর হবে হয়ত।
নাইমার টাকা খুব একটা খরচ হয় না। নিজের খাওয়া থাকার খরচ বাবদ সামান্য টাকাই সে ভাইদের সংসারে দেয়।
বাইরে খাওয়া, জামা জুতো কসমেটিক্স কেনা, পার্লার যাওয়া কিংবা অন্য কোনো খরচের খাত না থাকলে মেয়েদের খুব একটা বাজে খরচ হয় না। স্যানিটারি প্যাড আর যাওয়া আসার ভাড়া বাবদ যেটুকু খরচ।
অবিবাহিত একটা মেয়ে খুব দামী জামাকাপড় পরলেও কিংবা খুব বেশি সাজগোজ করলেও মানুষের চোখ টাটাবে, কেউ নেই তো, কাকে দেখাবার জন্য এইসব সাজপোশাক? নাইমার পার্লার খরচও নেই তাই।
এই কারণে এই কয়েক বছরে নাইমার একাউন্টে লাখ খানেকের কিছু বেশি টাকা জমা হয়ে গেছে। বাড়ির কিস্তি দেওয়ার জন্য সেই টাকা যথেষ্ট না হলেও পুরো টাকাটাই তুলে ফেলেছে নাইমা।
আপাতত আব্বার চিকিৎসার জন্য যখন যা লাগছে দিচ্ছে। নিজের ডেস্কে ফিরে এসে কপাল টিপে ধরে কিছুক্ষণ বসে রইল নাইমা।
ঘোর ভাঙল ফোনটা বেজে ওঠায়। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল আননোন নাম্বার।
রিসিভ করল নাইমা। “হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম!”
“ওয়ালাইকুম সালাম, কেমন আছেন মিস নাইমা?”
“কে বলছেন প্লিজ?”
“আমি, আমি শাহীন!”
নাইমা অন্যমনস্ক গলায় বলল, “কোন শাহীন?”
“আমি, আমি আহনাফের আব্বু!”
নাইমা চমকে উঠে লজ্জিত কণ্ঠে বলল, “ওহ আমি স্যরি, একটু এবসেন্ট মাইণ্ডেড ছিলাম!”
“না না, ইটস অলরাইট! জব্বার সাহেব আজকে আম্মাকে বলছিলেন যে আপনার আব্বা অসুস্থ, এইজন্য আপনারা এখন বিয়ের কথা চালাতে চাচ্ছেন না। তাই ভাবলাম যে একটু খোঁজ খবর নেই আসলে কী হলো!”
‘আব্বার স্ট্রোক করেছে।“
“ভেরি স্যাড। কোথায় ভর্তি আছেন?”
“নিউরোসায়েন্সে।“
“আমি গিয়ে কি একবার দেখে আসব তাকে?”
“এত কষ্ট করবেন?”
“না, আমার বাসার কাছেই তো! আমি তো শ্যামলীতে থাকি।“
নাইমা কিছু বলার আগেই একজন ক্লায়েন্ট এসে চেয়ার টেনে বসল তার সামনে।
“শাহীন সাহেব আমি এখন অফিসে। পরে কথা বলছি।“
“আচ্ছা আপনি ফ্রি হয়ে উনার বেড নাম্বার ডিটেইলস টেক্সট করে দিলেই আমি চলে যাব। আজকেই দেখে আসব।“
“আপনার অফিস নেই? ছুটি পাবেন?”
ফোনের ওই প্রান্ত থেকে শব্দ করে হাসল শাহীন। “আপনার যে আসলেই বিয়েতে আগ্রহ ছিল না এখন পুরোপুরি শিওর হলাম। আপনি আমার সিভিটাও পড়েননি। আমি একটা ছোট খাট ব্যবসা করি, আমার অফিসে আমি নিজেই বস। যাই হোক আপনি কাজ করুন। ফ্রি হয়ে টেক্সট করলেই হবে।“
ক্লায়েন্ট বিদায় করে শাহীনকে টেক্সট করল নাইমা। সারা দিন কেমন আনমনা হয়ে রইল।
সন্ধ্যায় নিজের ঘরে বসে শাহীনকে ফোন করে আব্বার খবর নিল নাইমা। ডাক্তার বলেছেন অপারেশন লাগবে।
খবর নেওয়ার পর ফোন রাখার আগে নেহাত ভদ্রতার খাতিরেই বলল নাইমা, “আহনাফ কেমন আছে?”
“ভালো আছে। ও কিন্তু আপনার কথা খুব বলে।“
“ওর সাথে একটু কথা বলা যাবে?”
শাহীন কঠিন গলায় বলল, “না।“
“এরকম পুলিশের মত করে না বলছেন কেন?”
“কারণ আমি চাই না যে আমার ছেলেটার মধ্যে কোনো রকম এক্সপেক্টেশনস তৈরি হোক। ও একটা ছোট বাচ্চা, এত কিছু বুঝবে না। আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে দেখে ও ধরেই নেবে যে আপনি বিয়েতে রাজি হয়ে গেছেন।“
নাইমা শুকনো গলায় বলল, “ও আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে থাক।“
“ইন ফ্যাক্ট আপনার সাথে দেখা করে আসার পর ভালো রকম ক্রাইসিস ফেস করেছি আমি। বাসার বুয়া ওকে বুঝিয়েছে যে ও চলে গেলেই আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবেন।“
নাইমা হতভম্ব হয়ে বলল, “ও চলে গেলে মানে, কোথায় চলে গেলে?”
“ওর নানুবাড়িতে। আমার বাচ্চাটা নিজে নিজে ব্যাগও গুছিয়ে ফেলেছিল চলে যাওয়ার জন্য, আপনি জানেন?”
“আই এম সো স্যরি। আমি এরকম কিছু বলিনি কিন্তু!”
“আমি জানি আপনি এরকম কিছু বলেননি বা বোঝাননি। আপনার অযথা গিলটি ফিল করারও কোনো দরকার নেই। এই কথাটা আমি এইজন্য বললাম যাতে আপনি বুঝতে পারেন যে আমার বাচ্চাটা আসলে ছোট। ও সব কিছু সোজাভাবে বোঝে। আমাদের ফোনে কথা হচ্ছে এটা দেখলে ও ধরেই নেবে আমাদের বিয়েটাও হতে যাচ্ছে।“
“ঠিক আছে।“
“আপনি কি অন্য কোনো কারণেও একটু আপসেট হয়ে আছেন?”
“কীভাবে বুঝলেন?”
“আমি বুঝতে পারি।“
বলা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেও বলে ফেলল নাইমা, “আপনি কি আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারেন?”
কথাটা বলেই মরমে মরে গেল নাইমা। ছিঃ এটা সে কেন করল?
এত অল্পদিনের পরিচয়ে টাকা ধার চেয়ে বসা, লোকটা কী মনে করে বসবে?
“কিছু টাকা মানে, কত টাকা?”
“যতটা আপনি আমাকে বিশ্বাস করে দিতে পারবেন?”
“তা তো পারিই! কিন্তু তার আগে আমাকে জানতে হবে কী জন্য।“
“এটা বলতে তো একটু সময় লাগবে। আপনি কি ফ্রি আছেন?”
“শুরু করুন কোনো ব্যস্ততা এসে পড়লে আমি জানাব।“
বলতে শুরু করল নাইমা। তাদের কাউকে না জানিয়ে বাড়ি বন্ধক রেখে আব্বার টাকা ধার নেওয়ার কথা, ইনস্টলমেন্ট বাকি পড়ার কথা।
বলতে বলতে আব্বার স্ট্রোক হওয়ার ঘটনা, ইমরুলের হারিয়ে যাওয়ার কথা সবই বলে ফেলল নাইমা। বলতে বলতে তার মনে হলো এসব কাউকে বলতে না পারার কষ্টে সে আসলে ছটফট করছিল ভেতরে ভেতরে।
কথাগুলো যেন জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে ছিল বুকের ভেতরে। সব কথা শোনার পর শাহীন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আচ্ছা আমি দেখছি কী করা যায়।“
ফোন রেখে নিজেকে এক শো একটা গালি দিল নাইমা। এভাবে নিজেকে সস্তা করার কী প্রয়োজন ছিল?
ফোন রেখে শাহীন নিজেও চুপ করে বসে রইল। প্রথম দিন মেয়েটা বেশ কাট কাট করে কথা বলছিল।
আজকে বাবা অসুস্থ বলেই হয়ত কথার ভঙ্গি বেশ নরম ছিল। কিন্তু এত স্বল্প পরিচয়ের একজন মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার চাওয়া কেউ সাধারণত খুব বেশি বিপদে না পড়লে করে না।
কিন্তু সেই বা কেন যে ফোন করতে গেল নাইমাকে? শাহীনের আচমকা মনে হলো সে কি আসলেও খুব নিঃসঙ্গ?
(পরের পর্ব পরশু দিন ইন শা আল্লাহ্)