#ফিঙের_ডানা
পর্ব-৯
আমি এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সোহানের সাথে কথা বলা বন্ধ করলাম৷ প্রতিবার তাকে দূর থেকে দেখলেও এবার তার আশেপাশেও গেলাম না৷ ঘরবন্দি হয়ে রয়ে গেলাম পুরোপুরি। অবশ্য প্রতিমুহূর্তেই যেন নিজের অজান্তেই অপেক্ষায় রইলাম তার। বার বার কারো পদশব্দ পেলেই মনে হয় এই বুঝি সোহান এলো আমার খোঁজে৷ এসেই বলবে, চলো ঘুরে আসি।
আমার ক্লাস শুরু হয়ে গেল এর মধ্যেই। লিলির সাথে মাঝে কয়েকদিন দেখা হয়নি। ওর সাথে দেখা হতেই গল্প জুড়ে দিল৷ এত মিষ্টি একটা মেয়ে, যে ওর আশেপাশে থাকলে মন ভালো হয়ে যায় এমনিতেই৷ প্রথম প্রথম ক্লাস বলে ভালোও লাগছে অনেক। নতুন রকমের পড়াশুনা, নতুন জায়গা, নতুন বই, নতুন বন্ধু সবকিছুর মধ্যে একেবারে ডুবে গেলাম৷ ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে ক্যাফেটেরিয়াতে আড্ডায় বসে যাই। ফিরি শেষ বিকেলে। রাতে কিছু পড়াশুনা করে সারাদিনের ক্লান্ত শরীর ঢেলে দেই বিছানায়। নিজেই নিজেকে বোঝাই, আমি সোহানকে ভুলে গেছি৷ আসলে ভুলেছি কি না সে প্রশ্ন নাহয় থাক!
একদিন শুক্রবার সকালে আমাদের অবাক করে দিয়ে বড়চাচা এসে উপস্থিত হলেন। বড়চাচা হলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমাদের বাড়ি থেকে চলে আসায় সত্যি কষ্ট পেয়েছিলেন। অনেক অনুরোধ করেছিলেন যেন থেকে যাই৷ তার একটাই সমস্যা, বউ এর কথার ওপরে কথা বলতে পারে না। বড়চাচাকে দেখে খুব খুশি হয়ে গেলাম আমি আর মা। দুপুরে চাচা বাজার করে নিয়ে এলেন বিশাল সাইজের রুই মাছ, পাবদা মাছ, গরুর মাংস আর মৌসুমী সব সবজি। মায়ের হাতের রান্না বড়চাচার সবসময়ের পছন্দ। দুপুরে জমিয়ে খেলাম তিনজনে।
চাচা চলে যাবেন বিকেলেই। আমি চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে গেলাম। চা নিয়ে ঘরে ফেরার সময় আড়াল থেকে শুনতে পেলাম চাচা বলছে, “তুমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেইখো শামীমা। শিফা আমার নিজের মেয়ের মতো। ওরে আমি রুমার মতো করে সাজায় গুছায় বিয়া দিব। ভালো ছেলে হাতে আছে, ব্যাংকে চাকরি করতেছে। ওরে দিয়ে দাও। তুমিও আমাদের সাথে আইসা থাকো। মেয়েরে কি আজীবন রাইখা দিবা নাকি?”
মা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “বড়ভাই, আপনি যা ভালো বোঝেন করেন। কিন্তু আমি ওই বাড়িতে যাব না। শিফার জন্য যে ছেলে দেখছেন তার সাথে কথা বইলেন। যদি সবদিক মিলে তো আমি আলহামদুলিল্লাহ রাজি।”
“তারপর তুমি কই থাকবা?”
“আমার এনজিও থেকে বিদেশে লোক নিতেছে। আমাকেও নিতে চাইতেছে। বার বার বলতেছে। আমি মেয়েটার জন্য না করে দিতেছি প্রতিবার। ওর বিয়েশাদি হয়ে গেলে আমিও চলে যাইতে পারব। আর পিছুটান থাকবে না। বিদেশে একা মহিলার এই দেশের মতো সমস্যা হবে না ভাই।”
“আচ্ছা ওইটা পরে দেখা যাবে। আমি ছেলের বায়োডাটা তোমারে দিয়ে গেলাম৷ তুমি শিফার সাথে কথা বইলা আমারে জানাও।”
“আচ্ছা বড়ভাই।”
বড়চাচা চলে গেলেন সন্ধ্যার একটু আগে। আমি মাকে কিছু না বললেও মা আমার মুখ দেখেই বুঝে গেল আমি সব শুনেছি। তখনই কিছু বলল না৷ রাতে শোওয়ার পর যা বলার বলল।
“শোন, বিয়ে তো জীবনে করতেই হয়। সারাজীবন তো তুই আমার আধভাঙা সংসারে পড়ে থাকবি না৷ আমি একা মানুষ যতই তোরে নিয়ে একা থাকতে আসি না কেন, তোর বিয়ের ব্যাপারে তোর বাড়ির মানুষদের সাহায্য আমার লাগবেই। কেউ বাড়ির বউ নেয়ার সময় খোঁজখবর না করে নিবে না। আমি একা তোরে ভালো পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে পারব না। তুই তো ছোট্ট না তাই না? বিয়ের বয়স হয়েই গেছে। তোর বড়চাচা যে তোর ভালো চায় এটা তো জানিস? খারাপ ছেলের কথা কোনোদিন সে বলবে না। তুই রাজি না হইলে কয়দিন দেখি। কিন্তু বিয়ে তো একদিন হবেই রে মা!”
আমার ভীষণ অভিমান জমে ছিল। বিকেল থেকে আটকে রাখা কান্না এবার বাঁধ ভেঙে গেল। হু হু করে কেঁদে ফেললাম। বললাম, “তুমি তো চাও আমি চইলা যাই, তাহলে বিদেশ যাইতে পারবা।”
বলেই মনে হলো কথাটা বলা ঠিক হলো না। মা নিজের কথা কোনোদিন ভাবেনি। আমাকে সে বিদায় করে বিদেশ যেতে চায় না। আমার ভালোটাই চায়। কিন্তু অভিমানে মানুষ কত কিছুই না বলে!
মা আমার কথার কোনো উত্তর দিল না। পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম কখন যেন।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। পাশ ফিরে আবছা আলোয় দেখি মা তখনো জেগে। তার চোখ বেয়ে নিঃশব্দে জল গড়াচ্ছে। আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। কাছে গিয়ে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজে বললাম, “আমি ওইটা বলতে চাই নাই মা। আমার কিছু ভাল্লাগতেছে না!”
মাও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। বাকিটা রাত কাটল ওভাবেই। বোধহয় অনেকদিনের জমিয়ে রাখা কষ্টের কান্না কেঁদে হালকা হলাম দু’জনেই।
ফজরের আজানের পর মা উঠে গেল নামাজ পড়তে। আমাকেও জোর করে ওঠাল। নামাজ শেষে বাইরে নিয়ে গেল আমাকে। ভোরের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে সতেজ বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছে গেলাম সেই নদীর পাড়ে। তখন ভিড় নেই একদম। কী স্নিগ্ধ একটা সকাল! নদীর অপর পাড় যেন কুয়াশায় মাখা৷ নদীর মাঝ দিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে। বাতাসটাও যেন এখানে ভেজা ভেজা। এক জায়গায় বসে মা বলল, “আমিই ভুল ছিলাম রে শিফা। নিজের সাথে এতকিছু হওয়ার পর তোকে এখন বিয়ে দেয়ার কথা ভাবতেছিলাম৷ কই বিয়ে হবে, তারা পড়াশুনা করাবে কি না কিছুই তো জানি না। তোকে আমি পড়ালেখা শিখাব৷ উচ্চশিক্ষিত করে তারপর স্বামীর বাড়ি পাঠাব যাতে কোনোদিন কোথাও আটকাতে না হয়।”
আমার এত ভালো লাগল যে মায়ের হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখলাম। মা দ্রুত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “চল তাড়াতাড়ি। আমার অফিস আছে।”
আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। রাস্তায় দেখি এক হোটেলে কলিজা ভুনা আর পরোটা পাওয়া যাচ্ছে। কলিজা আমার ভীষণ প্রিয়। মা বলল, “খেয়ে যাবি নাকি?”
আমি হ্যাঁ না কিছু বললাম না। মা জানে খেতে চাই কি না! মা বলল, “খেতে গেলে অনেক দেরি হবে কিন্তু। আমি যেয়ে রান্না করতে পারব না। তোর দুপুরের রান্না করা লাগবে।”
আমি খুশিমনে সায় দিলাম৷ তাই হোক! দুজনে বেশ মজা করে খেয়ে বাড়ি ফিরলাম৷ গতরাতের বোঝা নিমেষে হালকা হয়ে গেল। আজ ক্লাস এগারোটায়। আয়েশ করে চা টা খেয়ে রেডি হয়ে বের হলাম। গেটের সামনে এসেই সোহানের সাথে দেখা। আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে বলল, “অমাবস্যার চাঁদ! আমি তো ভাবছিলাম তোমার দেখাই পাব না আর।”
আমি মৃদু হেসে বললাম, “আসলে একটু ব্যস্ত থাকি তো!”
“চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাব আজকে।”
“না না থাক সোহান ভাই, আমি লিলির সাথে যাব। ও অপেক্ষা করছে সামনে।” বলেই দাঁড়ালাম না। সোজা পথ ধরলাম। সোহানকে ভাই বলে কোনোদিনই ওর সামনে ডাকিনি। ভাই ডাকার সময় যা চেহারা হয়েছিল না! ভেবে নিজেই হেসে উঠলাম। অনেকদিন পর ওর মুখটা দেখে কী যে ভালো লাগছে! আজকের দিনটাই ভালো।
(চলবে)