#শেষ_ইচ্ছে
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৬
১৭।
“তুমি না এলে এই শ্রাবণ গাইবে বিরহ গান,
যদি খুব আদরে ডাকি তোমাকে,
ভুলে যেও অভিমান.. হায়!
তুমি না এলে এই শ্রাবণ গাইবে বিরহ গান।
চোখের পাতায়.. স্মৃতি ভেসে যায়.. আনমনে গায়.. তোমার গান।
মনের খাতায়.. রঙিন পাতায়.. শুধু লিখে যায়.. তোমার নাম।”
ভার্সিটির বাগানের এক কোণায় বসে পুকুরের স্থির জলের দিকে তাকিয়ে স্মরণ গানটি গাওয়া শেষ করলো। স্মরণকে গান গাইতে দেখে কয়েকজন সেই জায়গায় এসে বসলো। আর সেই কয়েকজনের মধ্যে ছিল হীরা। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে স্মরণকে দেখছে আর মনে মনে ভাবছে,
“ছেলেটার শুধু হাসিই নয়, কন্ঠটাও দারুণ।”
সেই দিনটি ছিল হীরার কালো অধ্যায়ের উপসংহার আর রঙিন অধ্যায়ের সূচনা।
হীরা অতীত থেকে ফিরে স্মরণের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উজানের মৃত্যুর পর আমি তেমন একটা হাসতে পারি নি। আমার মধ্যে থাকা সেই চঞ্চল হীরার মৃত্যু হয়েছিল। আমার বাবাও কিন্তু উজানের মতো রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি নিজ চোখে সেই এক্সিডেন্ট হতে দেখি নি। উজান আমার কাছে বাবার চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল না। অথচ আমি সবচেয়ে বেশি কেঁদেছি উজানের মৃত্যুতে। কারণ আমি সেদিন তাকে আইসক্রিম খাওয়ার আবদারটা না করলে এভাবে একটা মিনি বাস এসে উজানকে আমার চোখের সামনে পিষে দিতে পারতো না। আমি সেদিন প্রথম কাউকে মরতে দেখেছিলাম। এরপর থেকেই আমি কখনো কাউকে কোনো আবদার করার সাহস পাই নি। আমার মনে হতো, আমার আবদারের মাঝে কোনো অভিশাপ আছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি একটা অভিশাপ!”
স্মরণ করুণ দৃষ্টিতে হীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি বলছো এসব? এমন কথা বলা উচিত নয়।”
হীরা বলল,
“প্রথমে বড় আপার ক্যান্সার ধরা পড়ে, তারপর বাবার মৃত্যু, আর তারপর উজানের। আর এখন তোমার জীবনটাও হয়তো আমার সংস্পর্শে নষ্ট হয়ে গেছে।”
স্মরণ হীরার গালের দুই পাশে তার দুই হাত রেখে বলল,
“আমার জীবনটা কখনই ভালো ছিল না, হীরা। বরং তুমি আমার নষ্ট জীবনটা শান্তিতে ভরিয়ে দিয়েছো। আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা মিসেস রোজাকে বিয়ে করে আনেন। তারপর আমার দুই ভাই জান আর জারিফের জন্ম হয়। আর তখনই আমি বাবাকে প্রথম বাবা হতে দেখেছি। বাবা জান আর জারিফকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। আর আমি ছিলাম তাদের কাছে নগন্য। ভাই দুইটা হয়তো বাবার মতো হয় নি। তাই তারা আমাকে প্রচুর সম্মান করতো। আর আজ তাদের জন্যই আমি শেষবার তোমার সাথে দেখা করার অনুমতি পেয়েছি। যদিও আমি যা করেছি, তার জন্য তারা আমাকে এখন খুব ঘৃণা করে। কিন্তু হীরা, ওরাও তো বড় হয়েছে, ওরাও তো জানে আমি যা করেছি ভুল হলেও শুদ্ধ। তাই হয়তো আজ আমার উপর তাদের দয়া হয়েছে। কিন্তু তুমি কখনোই আমার জীবনের অভিশাপ ছিলে না। বরং সমাজটাই অভিশপ্ত।”
হীরা স্মরণের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“উজানের মৃত্যুর পর তুমি আমার জীবনে না এলে আমার কি হতো স্মরণ? তুমি আমাকে অনেকটাই গুছিয়ে দিয়েছো। আর এখন আবার আমায় একলা করে চলে যাচ্ছো। এরপর আমি কি করবো? রাতে আমার ঘুম হয় না। চোখের সামনে সেই লাল দিনটি ভেসে উঠে। আর তুমি যেদিন পুরোপুরি আমার হয়েছিলে, আমি আর খারাপ স্বপ্ন দেখি নি। তোমাকে নিয়ে এতোটা ভাবতাম যে প্রতি রাতের স্বপ্নে তুমি আমার বর হয়ে আসতে। লাল পাঞ্জাবি পরে বিয়ের আসরে বসতে। আর আমি লাল বেনারসি পড়ে, পর্দার আড়ালে বসে কবুল বলতাম। আর তুমি আলহামদুলিল্লাহ বলে সেই ভুবন ভোলানো হাসিটা দিতে।”
হীরার কথাগুলো শুনে স্মরণ চুপ করে বসে রইল। সে জানে না কিভাবে তার প্রেয়সীকে শান্ত করবে। কারণ আজ তার মনে হাজারো ভাষা ঘুরপাক খেলেও সেই ভাষার নির্দিষ্ট কোনো গতি নেই, নেই কোনো দিক। তাই শব্দগুলো ভাষায় পরিণত হয়েও মনেই গেঁথে আছে। মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।
এদিকে হীরা বলতে লাগলো,
“কেন দেখেছি আমি সেই স্বপ্নটা? তুমি যেহেতু আমার হবেই না, তাহলে কেন এসেছিলে আমার স্বপ্নে?”
স্মরণ বলল,
“কারণ স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না। তাই স্বপ্ন দেখা মানেই তা নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। আমিও দেখেছি। অনেক স্বপ্ন দেখেছি। তোমার সাথে বাঁচতে চেয়েছি। কিন্তু কে জানতো আমাদের পথ ভিন্ন হবে? আর এখন এই মিথ্যে স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।”
“আমি কি তোমার কাছে আমার সেই স্বপ্নটা পূরণের আবদার করতে পারি না?”
“এই আবদার পূরণের কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আমি তোমার এতো বড় ক্ষতি করে যেতে পারবো না। তুমি সুন্দর মানুষের অপেক্ষায় থেকো। তোমাকে আমি ভালোবাসতে বাধ্য করবো না, তবে চেষ্টা করতে পারো। একদিন তুমি আবার ভালোবাসবে। আমাকে জীবনে জড়িয়ে তুমি তোমার সুন্দর জীবনে এতো বড় দাগ লাগিয়ে দিও না। তোমাকে নিজের করে নেওয়া যদি আমার নাগালের মধ্যে থাকতো, তাহলে আমি তোমাকে নিয়ে একটা ঘর বাঁধতাম।”
কথাগুলো বলেই স্মরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আর হীরা মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্মরণের দিকে।
১৮।
ভার্সিটিতে সেদিন স্মরণের গান শুনার পর থেকেই হীরার মনে স্মরণের প্রতি মায়া জন্মে যায়। এরপর থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে স্মরণকে দেখা যেন তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। মনের অজান্তেই হীরা ভালোবেসে ফেলেছিলো স্মরণকে। কিন্তু মেয়েরা কি মুখে ভালোবাসি বলতে পারে? আর ভালোবাসলেও কি এতো সহজে ধরা দেয়? আর তাই স্মরণও হীরাকে নিজের ভালো লাগার কথাটি বলতে পারছিলো না। কারণ স্মরণ কাছে আসলেই হীরা পালিয়ে যেতো। সে দূর থেকে দেখতো, তবুও কাছে আসতো না। হীরার এসব পাগলামো স্মরণ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু কাছে না এলে সে হীরাকে ভালোবাসি বলবে কিভাবে?
অনেক ভেবে স্মরণ সিদ্ধান্ত নিলো সে হীরাকে তার মনের কথাটা আলাদা ভাবে জানাবে। যেখানে সে হীরাকে কাছেও পাবে, আর ধীরেসুস্থে তার মনের কথাটা জানাতেও পারবে। আর সেই দিনটি চলেও এলো।
সময়টা ছিলো বছরের শেষ সপ্তাহ। আর মুহূর্তটা ছিল শীতের সকাল। পুরো ক্যাম্পাস তখন কুয়াশায় ঢাকা।
শীতকাল হীরার অনেক পছন্দের ঋতু। সে প্রতিদিন সকালের বাস ধরে ক্যাম্পাসে পৌঁছে যেতো। যেখানে অন্য সব ছাত্র-ছাত্রীরা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতো, সেখানে হীরা একটা পাতলা শাল গায়ে জড়িয়ে ক্যাম্পাসের পিচ ঢালা রাস্তায় একা একা হাঁটতো। আর স্মরণ ক্যাম্পাসের হোস্টেলে থাকাতো বিধায় হীরার এই প্রিয় মুহূর্তটার সাক্ষী হতো। সে প্রথম কয়েকবার হীরাকে দেখে বুঝতে পারে নি, হীরা কেন এতো তাড়াতাড়ি চলে আসতো। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন সে বুঝতে পেরেছিলো হীরার এই নিরব পরিবেশটা ভালো লাগতো, তখনই সেই সুযোগটা স্মরণ লুফে নেয়। সে হীরাকে তার ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য এই সুন্দর মুহূর্তটাই বেছে নেয়, যেই মুহূর্তটা হীরার ভীষণ প্রিয়।
কিন্তু স্মরণকে দেখলেই যে হীরা পালিয়ে যায়! এখন কিভাবে হীরাকে আটকাবে সে? জোর করে পথ আটকানো স্মরণের স্বভাবে নেই। তাই সে চাইতো, হীরা নিজ থেকে স্থির হয়ে দাঁড়াক, বা শান্তভাবে বসুক। যাতে স্মরণ ধীরস্থির ভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি তাকে জানাতে পারে।
আর সেই মিষ্টি দিনটিই ছিলো বছরের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন, যেদিন কুয়াশায় সব ধোঁয়াশা মনে হচ্ছিলো। আর হীরা প্রতিদিনের মতো ক্যাম্পাসে একা একা হাঁটছিল। হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো সেই মায়া জড়ানো কন্ঠস্বর। হীরা কন্ঠ অনুসরণ করে ক্যাম্পাসের সেই পুকুর ঘাটের সামনে এসে দাঁড়ালো। দেখলো একটা ক্যানভাসের আড়ালে কেউ একজন বসে গান গাইছে। কন্ঠটি যে স্মরণের তা বুঝতে দেরী হলো না তার৷ কিন্তু ক্যানভাসটির কারণে যে মানুষটির চেহারা দেখা যাচ্ছে না।
হীরা মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“স্মরণ কি তাহলে ছবিও আঁকতে জানে? বাহ! বেশ তো।”
হীরার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ক্যানভাসে আঁকা ছবিটা দেখতে। কারণ ক্যানভাসটি উলটো দিকে তাকায় সে দেখতে পারছিলো না স্মরণ কি আঁকছে। এরপর ছবিটি ও সাথে স্মরণকেও দেখার তীব্র ইচ্ছে নিয়ে হীরা এক কোণায় চুপচাপ বসে পড়লো।
স্মরণ যখন বুঝতে পারলো হীরা স্থিরভাবে বসেছে, তখনই একটা গান ধরলো কন্ঠে।
“কেন দূরে থাকো
শুধু আড়াল রাখো।
কে তুমি, কে তুমি আমায় ডাকো?
.
মনে হয় তবু বারে বারে,
এই বুঝি এলে মোর দ্বারে
সে মধুর স্বপ্ন ভেঙ্গো না কো!
.
কেন দূরে থাকো
শুধু আড়াল রাখো
কে তুমি, কে তুমি আমায় ডাকো?
কেন দূরে থাকো।
.
তোমারই ধ্যায়ানে ক্ষণে ক্ষণে
কত কথা জাগে মোর মনে
চোখে মোর ফাগুনের ছবিটি আঁকো
.
কেন দূরে থাকো
শুধু আড়াল রাখো
কে তুমি, কে তুমি আমায় ডাকো?
কেন দূরে থাকো।
গান শেষ করেই স্মরণ ক্যানভাসটি হীরার দিকে ফিরিয়ে দিলো। হীরা এতোক্ষণ চোখ বন্ধ করেই স্মরণের গানটি শুনছিল। চোখ খুলে ক্যানভাসে নিজের স্ক্যাচ দেখে হীরা অবাক হয়ে গেলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আরেকটু কাছে আসতেই স্মরণের কন্ঠ শুনে সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলো হীরা।
স্মরণ বলল,
“হঠাৎ এক ফাগুনের হাওয়ায় তাকে দেখেছি,
এক বৈশাখে তার প্রেমে পড়েছি,
এক শ্রাবণ বেলায় তার হাসির মায়ায় জড়িয়েছি,
আর এক শীতের সকালকে আমার ভালোবাসার সাক্ষী বানিয়েছি।
হীরা, তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি৷ আমাকে ফিরিয়ে দেবে না তো?”
কথাগুলো বলেই স্মরণ একটা বক্স ক্যানভাসের উপরে তুলে ধরলো। হীরা যদিও স্মরণকে এখনো দেখে নি। তবুও সে বুঝে ফেলেছে এই ছেলেটিই স্মরণ। সেদিন হীরার খুশি যেন অশ্রু হয়ে ঝরে পড়েছিল।
স্মরণ হীরার সামনাসামনি এসে হীরাকে কাঁদতে দেখে বলল,
“আমি কারো কান্না সহ্য করতে পারি না। আজ প্রথমবার কাঁদছো, তাই বকলাম না। পরেরবার কিন্তু ভীষণ বকবো।”
হীরা লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল,
“ছবিটা আপনি এঁকেছেন?”
“কিছু মনে করো না। আসলে আমি ছবি আঁকতে পারি না। আমি ছবিটা চারুকলা অনুষদের একটা মেয়েকে দিয়ে আঁকিয়েছিলাম।”
হীরা স্মরণের চোখের দিকে তাকালো। স্মরণ হীরার দিকে বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তবে গানটা আমি তোমাকে নিয়েই গেয়েছি, আর এইটাও তোমার জন্যই কিনেছি।”
হীরা লজ্জায় একেবারে নুইয়ে পড়ছিল। বক্স হাতে নেওয়ার মতো সাহস তার হচ্ছিলো না। স্মরণ হীরার ইতস্তত ভাব দেখে নিজেই বক্সটা খুলল। তারপর হীরার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি কি পরিয়ে দিতে পারি?”
হীরা চুপচাপ হাত এগিয়ে দিলো। আর স্মরণ হীরার হাতে একটা বেল্ট ঘড়ি পরিয়ে দিয়ে বলল,
“বেশিরভাগ মেয়েদের কিন্তু প্রেমিকের হাতে চুড়ি পরার ইচ্ছে থাকে। তবে আমি একটু ব্যতিক্রম। তাই তোমাকে ঘড়ি পরিয়ে দিলাম। আমার আসলে চুড়ির শব্দ ভালো লাগে না। আমার নিরবতা বেশি পছন্দ। তাই শব্দহীন সবকিছুই আমি খুব ভালোবাসি। যেমন তোমার শব্দহীন অনুভূতিটা আমার খুব ভালো লেগেছে।”
স্মরণের কথায় হীরা একটা মিষ্টি হাসি তাকে উপহার দিলো। এরপর? এরপরই তো শুরু হলো তাদের মিষ্টি প্রেমের গল্পটি। শুরু হলো একটা রঙিন অধ্যায়।
চলবে–