অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-২২

0
719

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ২২

ভেতরে ভেতরে এত খুশি লাগছে আমার৷ তাও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম,
“আর তোমার পাবজি?”
“হবে না। পাবজিও ছেড়ে দিতে হবে।”
“আলহামদুলিল্লাহ। সবচেয়ে বড় গুড নিউজ হচ্ছে এটাই।”
“আমি পাবজি ছাড়লে তুমি এত খুশি?”
“হ্যাঁ, আমি অনেক খুশি। কারণ এই পাবজিটাই তোমাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। সারাক্ষণ যে বৃদ্ধাঙ্গুল দুটো দিয়ে ঠাস ঠাস মানুষ মারো এরা তো স্বাক্ষী দিবে হাশরের ময়দানে। তারপর চোখজোড়া যে সারাক্ষন ফোনের কার্টুনগুলোতে নিবদ্ধ রাখো তারা তো স্বাক্ষী দিবে। বলবে, হে আমার রব! আপনার অকৃতজ্ঞ বান্দা আপনার দেওয়া অমূল্য চোখ দুটোর যত্ন নেয়নি। সে এই চোখজোড়া দিয়ে আপনার সৃষ্টির দিকে নজর দেয়নি। এই চোখ দিয়ে আপনার জন্য একফোটা অশ্রু ঝরায়নি। অথচ চক্ষুদ্বয় কত বড়ই না নেয়ামত। অন্তর স্বাক্ষী দিবে, হে আমার রব! আপনার বান্দার অন্তর সদা গেইমস নিয়ে চিন্তিত ছিল। কবে সব কাজ শেষ করে গেইমস নিয়ে বসবে সেই চিন্তায় মশগুল ছিল। তার আপনাকে নিয়ে ভাবার ফুরসত ছিলো না। অথচ আপনিই তার অন্তর, চোখ এবং তার পুরো শরীরের স্রষ্টা। তখন কি তোমার আর কিছু বলার থাকবে?”

“বাহ! এত গুছিয়ে বইয়ের ভাষায় কথা বলা কবে শিখলে?”
আমি জবাব দিলাম না। রাফিন মৃদুস্বরে বললো,
“বললামই তো ছেড়ে দিবো। এতবড় লেকচারটা না দিলেও চলতো। জানোই তো, মাদরাসা লাইফ কেমন? ওখানে মোবাইল-ই ধরা নিষেধ, পাবজি তো দূরের কথা।”

“হুম৷”
“আচ্ছা তুমি কি যেন বলবে বলছিলে?”
”আমার না বলা কথাগুলো বলা হয়ে গেছে।”
“কি সেগুলো?”

বেশ কিছুটা সময় নিয়ে আমি বললাম,
“আমি চাইছিলাম আমরা আর চ্যাট না করি। এমনিতেই তো আমাদের তেমন কথা হচ্ছে না। এটা যদি একেবারেই না হয়… না মানে তুমি তো চলেই যাবে। তখন তো আর আমাদের কথা হবে না টানা দুই বছর। এরচেয়ে ভালো না আমরা নিজেরাই আল্লাহকে ভালোবেসে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই হারাম সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসি।”

রাফিন বোধহয় পানি খাচ্ছিলো। আমার কথা শুনে বিষম খেয়ে পানিগুলো মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
“কথাটা তুমি বলছো?”
“হু। কেন বলতে পারি না?”
“আমি আজ এই কথাটাই বলতে ফোন দিয়েছিলাম। অনেকদিন ধরে বলতে চাইছি। তুমি কিভাবে নাও ব্যাপারটা.. এজন্য বলিনি। ইনফ্যাক্ট, তুমি মানতে পারবে কিনা ভয় হচ্ছিল।”

“আমি মানতে পারবো৷ আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও ভরসা করে আমি তোমাকে ছাড়লাম। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, কেউ যদি আল্লাহর জন্য কোনোকিছু ত্যাগ করে আল্লাহ তাকে তারচেয়েও উত্তম প্রতিদান দিবেন। তোমাকে যদি আমার জন্যই সৃষ্টি করা হয়ে থাকে, তুমি যদি আমার জন্য কল্যাণকর হও তবে তুমি আমারই হবে। আমি সেই দোয়াই করি।”

“না, তুমি সেই দোয়া করবে না। তুমি সরাসরি আমাকে চাইবে কেন? তুমি বলবে, যার সাথে থাকলে তোমার এবং তার কল্যাণ হবে তাকেই যেন তুমি পাও।”
“তোমাকে চাইলে ক্ষতি কি?”
“ক্ষতি আছে। ধরো, আমি তোমার জন্য না। তখন যাকে আল্লাহ তোমার জন্য ঠিক করে রেখেছেন তার কি হবে?”
“তার কি হবে সেটা আমি ভাববো কেন? সেটা আল্লাহর ভাবনা। আল্লাহ বলেছেন দোয়া করতে, দোয়া ভাগ্য বদলাতে পারে। সুতরাং, আমি দোয়া করে যাবো৷ বাকি সিদ্ধান্ত আল্লাহর। আল্লাহ আমার দোয়ায় আমার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারলে তার ভাগ্যও পরিবর্তন করতে পারবে।”
রাফিন হো হো করে হাসলো খানিকক্ষণ। তারপর বললো,
“আচ্ছা ঠিক আছে দোয়া করো, যা ইচ্ছে করো। কিন্তু আরেকটা আমল তুমি করবে। সেটা হলো সূরা ফোরকানের ৭৪ নং আয়াত। ব্যস! এটুকু করলেই হবে।”
“কি আছে ঐ আয়াতে?” পাল্টা প্রশ্ন করলাম।

রাফিন আমাকে আয়াতটা পড়ে শোনালো।

وَ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ اَزۡوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّۃَ اَعۡیُنٍ وَّ اجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِیۡنَ اِمَامًا ﴿۷۴﴾

“আর যারা প্রার্থনা করে, হে আমাদের রাব্ব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন যারা আমাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শ স্বরূপ করুন।”

“এটা পড়লেই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে।”
“আচ্ছা।”
“ঠিক আছে তাহলে রাখি? আর হ্যাঁ, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কখনো জেনে, কখনো না জেনে। ক্ষমা করে দিও কেমন?”
“ওসব আমি মাথায় রেখে বসে নেই। তুমি কথা বলার সাথে সাথেই সব ভুলে গিয়েছি। তুমি বরং আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাকে অনেক বেশি জ্বালিয়েছি।”

“আরে না। তুমি অনেক শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে। তুমি বলেই আমাকে এতকিছুর পরও সহ্য করেছো। অন্য কেউ হলে কবেই চলে যেত। দেখোনি কতজন ছেড়ে গেছে?”

আমি মৃদু কন্ঠে বললাম, “হু।”
“রাখছি তাহলে। অনেক রাত হলো তো। যাও ঘুমাও।”
”পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ো কিন্তু। নামাজ কখনো ছাড়বে না৷ ছাড়তে হলে গেইমস ছেড়ে দিবে, দুনিয়া ছেড়ে দিবে বুঝলে?”
“বুঝলাম ম্যাম। এখন ফোনটা রাখি?
“শিউর।”

ফোন রাখতে গিয়ে রাফিন আবার বললো,
“হেই শোনো, শোনো।”
“হু বলো।”
”তুমি কখনো আমার জন্য কাঁদবে না। কাঁদলে কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিয়েও কোনো ফায়দা হবে না। যেই গুনাহ সেই গুনাহ-ই থেকে যাবে। বুঝলে?”
“হু।” আমার কন্ঠ ম্লান হয়ে এলো।
“কাঁদবে না প্রমিস করো?”
“কাঁদবো না তো। দেখছো না, আমি কত সাহসী হয়ে গেছি। গত পাঁচদিন তোমার সাথে কোনো যোগাযোগ না করে থাকতে পেরেছি, ফার্স্ট টাইম। এখনও ছেড়ে যাচ্ছি অথচ কত স্বাভাবিক আমি দেখো।” বলতেই টুপ করে একফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো চোখ দিয়ে।

“হুম গুড গার্ল। এবার মুচকি হেসে ফােন রাখো। মুচকি হাসা সুন্নাত।”
আমি চোখের পানিটাকে দূরে সরিয়ে মুচকি হাসলাম।

এরপর ফোন রেখে দিলাম। ফোন রাখতেই আমার বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। রাফিনের সাথে আর কোনোদিন কথা হবে না, কোনোদিন দেখা হবে না ভাবতেই ঢুকরে কান্না আসছে।

রাত দেড়টা বাজে। ওযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার সেন্সে কুলোচ্ছে না। অনেকটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছি আমি৷ জায়নামাজে দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেললাম। কি আশ্চর্য! এখন কেন কষ্ট হচ্ছে? কথা বলার সময় তো কি সুন্দর করে সবকিছু সামাল দিলাম। এখন কেন বুক ফেটে কান্না আসছে? আমি হুট করে সিজদায় পড়ে গেলাম। দীর্ঘ সময় নিয়ে কাঁদলাম জায়নামাজে। একটাই চাওয়া, রাফিন। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ মনে হলো আমি জায়নামাজ বিছিয়েছি আল্লাহর সাথে কথা বলবো বলে, আল্লাহর সামনে কাঁদবো বলে। এতদিনের করা পাপ মোছন করবো বলে। অথচ..অথচ আমি এ কি করছি? এই কান্না তো আল্লাহর জন্য না। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে একজন পরপুরুষের জন্য চোখের জল ফেলছি? ছি!

তৎক্ষনাৎ দু’রাকাত তাওবার নামাজ পড়লাম। আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কখনো কাঁদবো না রাফিনের জন্য৷ রাফিনও তো তাই বলেছিলো। নামাজ শেষে খেয়াল করলাম, আমার আর একটুও কষ্ট হচ্ছে না৷ সব কষ্ট আল্লাহ লাঘব করে দিয়েছেন। সেই থেকে আল্লাহর প্রতি আমার প্রেমের শুরু৷ দুনিয়া ভুলে আমি লেগে পড়লাম সুন্দর আখেরাত গড়ার কাজে।

সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে পৃথিবীর কোলজুড়ে। অথচ আকাশ ফকফকা সাদা। গাছের পাতাগুলো মৃদু নড়ছে। সারারাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে বোধহয়। রাস্তায় কিছু কিছু জায়গায় পানি জমে আছে। সেখানে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে। মাথায় কচুপাতার ছাতা। আশ্চর্য! এই মফস্বল শহরে ওরা কচু পাতা পেলো কোথায়? হয়তো কাশবনের ধারে কাছে কোথাও জন্মেছে। ছেলেগুলোকে দেখে আমারও কচু পাতার ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। ইস!

নাকীব এসে কখন পেছনে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি৷ রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“অন্য জগতে চলে গিয়েছো মনে হচ্ছে?”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। এরপর আবার ছেলেগুলোর দিকে নজর দিলাম। আমার দিকে একবার তাকিয়ে পরক্ষনেই ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে নাকীব বললো,
“কচু পাতার ছাতা মাথায় ভিজতে ইচ্ছে করছে তাই না আপু?”

আমি চট করে ওর দিকে তাকালাম। তারপর উপর-নীচ মাথা নাড়ালাম। ও বললো,
“তোমার কি মন খারাপ আপু?”
“নাহ, মন ভালো বরং।”
“তাহলে চোখগুলো এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“কেমন দেখাচ্ছে? দেখি আই টু আই তাকা। তাকিয়ে বলে ফেল তো দেখি কি হয়েছে আমার?”

নাকীব তাকালো না। না তাকিয়েই বললো,
“তোমার হারাম সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটেছে আপু।”
আমি ভীষণ চমকে ওর দিকে তাকালাম। ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“তুই আগে আগে কিভাবে জানিস? আমি তো তোর কিচ্ছু জানি না৷ তুই কেন জানিস আমারগুলো?”
“কারণ আমি সামনের মানুষটা কি ভাবছে সেটা ঝট করে ধরে ফেলতে পারি। আগে থেকেই মানুষের মন বুঝে ফেলতে পারি।”
“ধুৎ! সবার মন বুঝে ফেলিস তো, দেখবি তোর মানুষের মনই তুই বুঝবি না।”
“আমার মনের মানুষের মন তো আমি ঝট করে বুঝে ফেলতে চাই না৷ আমি তো তাকে আজীবন অল্প অল্প করে বুঝতে চাই।”

“আহা! মানে তার কথা ভেবে এখন থেকেই আহ্লাদে আটখানা।”
“সত্যিটাই বলেছি। হুহ! এখন তোমার ঘটনা বিস্তারিত বলো।”
“কেন মন পড়ে নে আমার, নিজে নিজে বুঝে ফ্যাল কি হয়েছে?” ভেংচি দিয়ে সামনে তাকালাম।
“মন পড়া ব্যাপারটা হলো তোমার কি হয়েছে, মানে কি নিয়ে তোমার মনে উথাল-পাতাল হচ্ছে সেটা আমি আন্দাজ করতে পারি। তাই বলে তুমি সারারাত কি কথা বলেছো, কিভাবে সমাপ্তি ঘটিয়েছো সেটা তো আমি বলতে পারবো না৷ সেরকম হলে তো আমি মানুষের অতি গোপনীয় বিষয়ও মুহুর্তেই জেনে যেতাম। তখন তোমার মতো বোকা মেয়ের সাথে এই ঘরে থাকতাম না৷”
“আমি বোকা?”
“হু, বোকা বলেই এখন বোকা বলেছি বলে ক্ষেপে যাবে। অথচ আমাকে দেখো প্রথম থেকেই শান্ত আমি।”

ধুম করে একটা কিল দিলাম ওর পিঠে। কিল খেয়ে কিছুক্ষণ পিঠে হাত বুলিয়ে বললো, “এবার কি বিস্তারিত শুনতে পারি? নাকি পায়ে ধরা লাগবে?”
“ধর না, নিষেধ করছে কে?”

নাকীব কিছু বললো না। আমি নিজেকে কিছুটা সময় নিয়ে প্রস্তুত করলাম। এরপর রাফিনের সাথে বলা প্রতিটা কথা নাকীবকে বিস্তারিত বললাম। সব শোনার পর নাকীব বললো,
“এত সুন্দর সমাপ্তি যে সম্পর্কের সেটা ঠুনকো হতে পারে না আপু। তোমরা দুজনই দুজনকে অসম্ভব ভালো বুঝো। দুজনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং আমাকে জাস্ট মুগ্ধ করেছে। তুমি ধৈর্য ধরো। ভরসা রাখো আল্লাহর ওপর। দেখবে সব ভালো হবে ইন শা আল্লাহ।”

“ইন শা আল্লাহ।”

[ Note: এত বড় বড় একেকটা পর্ব পড়ে কি কারও মনে মন্তব্য করার মতো কোনো ভাষাই থাকে না? ]

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here