#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব-৯)
#জয়া_চক্রবর্তী
বসন্ত এসে থামে আমার চোখে,
যখনই তোমায় দেখি,
যেন পূর্নিমা তুমি,
আমি চন্দ্রাহত একলা পথিক।
তিতিরের দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই আওড়ালো শব্দগুলো।একটু আগেই তারা মানালির হোটেলে চেকইন করেছে।
সিমলা থেকে মানালি এই ২৫০কিমি পথ অতিক্রম করতে তিতিরদের প্রায় ১০ ঘন্টা লেগে গেলো।
রাস্তার ধকলে দুজনেরই ক্লান্ত হওয়ার কথা ,কিন্তু রাস্তার সৌন্দর্য সঙ্গে ভয়াবহতা তাদের সকল ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছে।
পাহাড়ের বুক চিরে রাস্তা। কখনো মাথার ওপরেই বিশাল পাথরের খন্ড,কখনো বা রাস্তার মাঝেই পরে আছে বড় বড় পাথরের চাঁই।
মাঝে মাঝে তো তিতিরের মনে হচ্ছিলো ওপর থেকে পাথরের চাঁই পরে থেঁতলে যাবে গাড়ি,নয়তো খাদই হবে তাদের অন্তিম গন্তব্য।
প্রতিবার গাড়ি বাঁক নেওয়ার সময় চোখ বুজে সে সুদর্শনের হাত চেপে ধরছিলো।আর সুদর্শন প্রতিবারই তার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে আশ্বস্ত করছিলো।
ড্রাইভার ছেলেটি পুরো সময়টাই আঞ্চলিক ভাষায় গান চালিয়ে রেখেছিলো।কিছু না বুঝলেও গানের সুরের অদ্ভুত মাদকতা গ্রাস করছিলো তিতিরদের।একটা ঝিম ধরা ভালো লাগায় হারিয়ে যাচ্ছিল মন।
গাড়ি কখনো বা মনে হচ্ছিলো পাহাড়ের পদতলে এসে পরেছে,কখনো বা মনে হচ্ছিলো পাহাড়ের চুড়োয় এসে গেছে।এক অসাধারণ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য,পাহাড়ের গায়ে দুধ সাদা বরফের আলপনা,কোথাও বা পাহাড়ি ঝর্না, গাছেরাও যেন আবহমান কাল ধরে নীরব সঙ্গী হয়ে পাহাড়ের সাথে দাঁড়িয়ে।
রুমে ঢুকেই সুদর্শন কাঁচের জানলার ভারি পর্দাগুলো একপাশে সরিয়ে দিলো।
আজ সেই পূর্নিমা।নির্জন সন্ধ্যায় বুনো চাঁদের রুপালী আবেশ শ্বেতশুভ্র বরফের পাহাড়কে আরো মোহময় করে তুলেছে।
তিতির হাঁ করে শুধু পাহাড়ের রূপসুধা পান করে চলেছে। সুদর্শন কিন্তু পাহাড়ের সাথে সাথে তিতিরের ভালো লাগার উত্তেজনাকেও তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে।
কারন সুদর্শন জানে প্রথম বার সমুদ্র বা প্রথম বার পাহাড় দর্শনের রোমাঞ্চ অবর্ণনীয়।
সময় বয়ে যেতে লাগলো।একসময় সুদর্শন বললো,’চেঞ্জ করে নাও পাখি,আমি বাইরে যাচ্ছি’।সুদর্শন বেড়িয়ে যেতেই তিতির একটা একটা করে পোশাক ছাড়তে শুরু করলো।ঠান্ডাটা এবার যেন আরো সূঁচের মতো বিঁধছে তিতিরের শরীরে।
একটা ব্যাগি টি-সার্ট মাথা দিয়ে গলিয়ে, ফেসওয়াশ হাতে মুখে লাগিয়ে তিতির চোখ বুজেই টয়লেট গেলো, হাতড়ে হাতড়ে কল ঘোরাতেই বরফ ঠান্ডা জলের বৃষ্টি তিতিরকে ভিজিয়ে দিলো।চোখ বুজে ভুল করে শাওয়ারের কল চালিয়েছে সে।
কোনরকমে বন্ধ করে বাইরে এলো তিতির,টপ টপ করে জল পরছে গা থেকে।টাওয়াল টা ব্যাগ থেকে কোনরকমে নিয়ে কাঁপা হাতে ওপর ওপর জল মুছে সোজা কম্বলের ভিতর।
কিছু সময়ের মধ্যেই সুদর্শন খাওয়ার নিয়ে রুমে এলো।তিতিরকে দুবার ডাকলো।শুনতে পেলেও তিতিরের কথা বলার কোন ক্ষমতা নেই।আধভেজা টি-সার্টে সে তখন আরো ঠকঠক করে কাঁপছে।সুদর্শন খাটের পাশে দাঁড়িয়ে মুখের দিকের কম্বলটা নামালো।
তিতিরকে দেখে সুদর্শন অবাক।চোখ বোজা,মুখ লাল,ভেজা চুল।থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা।
টয়লেটের দিকে তাকিয়েই চিত্রটা পরিস্কার হয়ে গেলো।দ্রুত হাতে টাওয়ালটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে তিতিরের চুল মুছতে শুরু করলো।
সার্ভিসিং এ ফোন করে আরো একটা কম্বল আনিয়ে ওর ওপর দিয়েই চাপা দিয়ে দিলো কিন্তু তিতিরের কাঁপুনি থামবার কোন লক্ষণই দেখা গেলোনা।এমনকি অনেকবার ডাকার পরেও মেয়েটা চোখ খুলে তাকাচ্ছে না।
কি যে করে সুদর্শন!!
কয়েকবার একা একাই ঘরে পায়চারি করলো সে।তারপর কি মনে হতে কম্বলের ভিতরে নিজেও ঢুকে তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো।বুঝলো তিতিরের পরনের ড্রেসটা ভেজা।দুএকবার ইতস্তত করে আবরণ মুক্ত করে তিতিরের বরফ ঠাণ্ডা তুলতুলে শরীরটা নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।
তিতিরের তিরতির করে কাঁপা অল্প ফাঁক হওয়া বরফ ঠাণ্ডা ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে নিলো।একসময় সুদর্শনের উষ্ণতায় তিতিরের শরীর উষ্ণ হতে শুরু করলো।
কিন্তু তিতিরের আবরণহীন শরীরের সংস্পর্শে এসে সুদর্শনের হার্টবিট ততক্ষনে প্রচন্ডই বেড়ে গেছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পরছে,প্রবল উত্তেজনায় সুদর্শন ঘামছে।
এভাবে সত্যিই সে পেতে চায়নি তিতিরকে,কিন্তু পরিস্থিতি আজ তার হাতের নাগালের বাইরে।সুদর্শনের উপোষী ঠোঁট এলোপাথাড়ি চুমুতে পাগল করে দিতে থাকে তিতিরকে।আজ সুদর্শনের সংযমের বাঁধ ভেঙে গেছে।ভালো লাগার তুষারপাতে ভিজতে ভিজতে তিতিরকে পূর্ন ভাবে গ্রহন করলো সুদর্শন ।সাক্ষ্মী রইলো বুনো চাঁদ,শৈতালি চাদরে মোড়া পাহাড়,ভেসে বেড়ানো মেঘ।
সুদর্শনের বায়নায় রাতের খাওয়ারটা খেতেই হলো তিতিরকে।কিন্তু আজ আর সুদর্শনের চোখে চোখ রাখতে পারছেনা তিতির।প্রচণ্ড লজ্জায় আচ্ছন্ন শরীর আর মন।এখনো সারা শরীরে সুদর্শনের আদরের রেশ।সুদর্শন বিছানাতেই তিতিরের মুখ রুমাল ভিজিয়ে মুছিয়ে দিলো।তারপর তিতিরকে ঘুমিয়ে পরতে বলে নিজে গিয়ে চেয়ার টেনে জানলার সামনে বসলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় সুদর্শন নিজেও কিছুটা বিহ্বল।নিজেকে গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় চাই সুদর্শনের।
চাঁদের আলোয় ভিজতে ভিজতে একসময় চোখ জুড়িয়ে আসলো তিতিরের।ঘুমের কোলে হারিয়ে গেলো তিতির।
ঘুমন্ত তিতিরের দিকে তাকিয়ে আছে সুদর্শন,মনে মনে বললো,
তুমি ছিলে আমার অসংখ্য ঘুমহীন রাত হয়ে,
সেসব রাতের নাম না জানা তারা হয়ে,
কিংবা কোজাগরী রাতে নিভু নিভু ফানুসের ভিড়ে,
ছিলে অনেক যত্নে-আলতো আদরে গড়া প্রেম,
উড়িয়ে দেওয়া নীল আকাশে।
তৃষ্ণার্ত চোখে শুধু চেয়েছিলাম,আকাশের মায়া ভুলে মাটির দেহের প্রেমে আছড়ে পরবে বলে।
আজ অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান তুমি,তোমাকে পেয়েছি আমি অজানার পথ ধরে।
কিন্তু সত্যিই কি সে তিতিরকে পেয়েছে?এভাবে পাওয়াকে কি পাওয়া বলা যায় ?তিতির কি আদৌ শুনতে পেলো, সুদর্শনের বুকের পায়রাগুলোর ঝটপটানি?
না উত্তর জানা নেই।তবু সাদা কালো চোখ দুটো রঙিন স্বপ্নে ভেসে যেতে চায়।
বিছানায় শুতে এসে, সুদর্শনের ইচ্ছেরা আবার বাঁধভাঙা হয়ে তিতিরকে আদরে ভরিয়ে দিতে চাইলো।কম্বলের ভিতরে গিয়ে তিতিরের ঠোঁটে আবার ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে হারিয়ে গেলো সুদর্শন সব পেয়েছির দেশে।(চলবে)