ছায়াকরী পর্বঃ১৪

0
519

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ১৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

প্রভাতের শুভ্র নভোলোক! পেঁজা তুলোর মতো অরঞ্জিত, স্নিগ্ধ নীরধরের অবশীভূত উড়া উড়ি। বাতায়নে মিহি সুর। পত্রপল্লবে সতেজতা।

সিঁড়ি ভেঙে নামছে জেহেন। তার কুণ্ঠিত চাহনি খাবার টেবিলে। আজ কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নিচে এসে দাড়াল জেহেন। সন্দিহান গলায় ডেকে উঠল—

“অনিতা! অনিতা!”

অনিতা বিড়ালপায়ে এসে দাড়াল। প্রশ্ন ছুড়ল জেহেন—

“নুয়ায়াম কোথায়?”

মাথা নত করে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক উত্তর দেয় অনিতা—

“তিনি বেরিয়েছেন?”

জেহেন ভ্রূকুটি করে বলল—

“কখন?”

“সকালে।”

“তেহজীব কোথায়?”

“তিনি খাবেন না বলেছেন।”

জেহেন শ্বাস ফেলল। অসহিষ্ণু চোখ তাকাল টেবিলের দিকে। তার চেয়ারের সামনেই খাবার রাখা। জেহেনের পেলব কপালে পূনরায় ভাবনার রেখা ফুটে উঠল। সে নিরুত্তাপ গলায় বলল—

“তোভিয়া কোথায়?”

“তিনি শয়নকক্ষে?”

জেহেন আস্ত নজরে তাকাল অনিতার দিকে। কণ্ঠে নমনীয়তা নিয়ে বলল—

“খেয়েছে ও?”

“না। আপনার খাবার বানিয়ে রেখেছেন। আপনাকে খেয়ে নিতে বলেছন।”

অসহ্য যন্ত্রণায় বুঁদ হয়ে গেল জেহেন। সে দাড়াল না। তোভিয়ার কক্ষের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। অনিতা চেয়ে রইল গম্ভীর চোখে।
,
,
,
তোভিয়ার কক্ষের দরজা ভেজানো। কপাটে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে জেহেন। শান্ত, ধীরপায়ে জানালার কাছে এগিয়ে যায়। সটান করে দুই হাতের সাহায্যে পর্দা সরিয়ে দেয়। চটপট করে এক ঝাঁক কুসুম রঙের রোদ ঢুকে গেল তোভিয়ার কক্ষে। হেসে হেসে বেড়াতে লাগল তা মেঝে জুড়ে। জেহেন এগিয়ে এলো বিছানার কাছে। হালকা গলায় প্রশ্ন করলো—

“খাওনি কেন?”

তোভিয়া নিজেকে আরও সংকুচিত করে নিল। নিজেকে জড়িয়ে রাখল চাদরে। চোখের স্মিত ধারায় তার বালিশ ভিজে আছে। সন্তর্পণে চোখের জল মুছে নিয়ে কণ্ঠের জড়তা দূর করে বলল—

“আজ আপনার আমার খাওয়া নিয়ে চিন্তা হচ্ছে! কোনোদিন তো জিজ্ঞেস করেননি?

কান্নার তোড়ে গলা বসে এলো তোভিয়ার। ঠোঁট কামড়ে কান্না গিলে নেওয়ার অব্যর্থ চেষ্টা!
জেহেন দম ফেলল। নিরুত্তেজ কণ্ঠে বলল–

“খাবে, এসো।”

“কেন এসেছেন আপনি?”

“চলে যাব?”

“হ্যাঁ, চলে যান।”

“আমি চলে গেলে তুমি আনন্দিত হবে?”

“হবো।”

জেহেন গূঢ় হেসে তোভিয়ার পাশে বসল। তোভিয়া টের পেল তা। চট করে উঠে বসে ফুঁসলে উঠে বলল—

“যাচ্ছেন না কেন আপনি? আমাকে কাঁদতে দেখতে আপনার ভালো লাগে?”

“কান্নার জীবন কেন বেছে নিচ্ছ?”

তোভিয়া নরম স্বরে বলল—

“জেহেন! কেন এমন করছেন?”

জেহেন শীতল চোখে তাকাল। তোভিয়ার অশ্রুঝরা চোখে পলকহীন চেয়ে রইল। যেন মনে হচ্ছে শুভ্র মেঘের ভাঁজ গলিয়ে কৃষ্ণ গহ্বরের ধারা ঝরছে! লাস্যময়ীর হৃদয়ের আর্তনাদ জেহেনের কর্ণকুহর হলো না। জেহেন হিম কণ্ঠে বলল—

” যার চোখে আমি ভালাবাসা দেখেছি, যার চোখে আমি স্নিগ্ধ পৃথিবী দেখেছি, যার চোখে ধ্বংসাত্মক জীবনের এক চিলতে আশা দেখেছি; তাকে কী অশ্রুজলে ভেজাই? ক্ষমা করে দাও আমাকে তোভিয়া। তুমি কখনো পুরোপুরি আমার হতে পারবে না।”

তোভিয়া তেঁতে উঠে বলল—

“তাহলে বসে আছেন কেন? চলে যান, চলে যান এখান থেকে।”

তোভিয়া কাত হলো। বালিশের নিচ থেকে কিছু একটা বের করে মেঝেতে ছুড়ে মারল। জেহেন সরব চোখে তাকাল। একটা ব্রেসলেট !
অনেক বছর আগে তোভিয়াকে দিয়েছিল জেহেন। ধাতব পদার্থের নয়, বিশেষ কাঠের তৈরি। সুক্ষ্ম কারুকাজ করা। তোভিয়া কখনো পরেনি। কারণ, অবুঝ জেহেন তোভিয়ার হাতের মাপ ঠিক করে নিতে পারেনি। জেহেন ভাবতে পারেনি, মেয়েটা এখনো তা যত্ন করে রেখে দিয়েছে!
তপ্ত শ্বাস ফেলল জেহেন। উঠে দাড়াল সে। নির্বিকার গলায় বলল—

“ওই ব্রেসলেটের মতো আমাকেও ছুড়ে ফেলে দাও নিজের জীবন থেকে। ভালো থাকবে তুমি।”

জেহেন পা বাড়াতেই খপ করে তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তোভিয়া। কপালের সাথে জেহেনের পুরুষালী হাত চেপে ধরে ঝরা কান্নায় হেঁচকি তুলে বলল—

“যাবেন না জেহেন। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনার সব রূপকে আমি স্বীকার করে নিলাম। ফিরিয়ে দেবেন না আমাকে। যদি আপনার হিংস্রতাই আমাদের পরিণয়ের পরিণতি হয়, তাহলে আমি তা আনন্দের সাথে গ্রহন করে নিলাম। কোনো অভিযোগ, অনুযোগ নেই আমার।”

জেহেন তীব্র বিতৃষ্ণায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তার অন্তঃপুরে ব্যাত্যার সৃষ্টি হলো। দুর্দমনীয়, অবাধ্য, নিষ্করুণ ঝড়!
,
,
,
মহলে প্রবেশ করেই বসারকক্ষের কাউচে ধপ করে বসে পড়ে নুয়ায়াম। তার কপালের কোণ বেয়ে রক্ত ঝরছে। অনিতা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে নুয়ায়ামের এই অবস্থা দেখে চমকে উঠল। ত্রস্তে এগিয়ে এসে ভয়ভীত কণ্ঠে বলল—

“কী হয়েছে আপনার? এই চোট কী করে লাগল?”

নুয়ায়াম ব্যথামিশ্রিত কণ্ঠে বলল—

“তেমন কিছু নয়।”

যন্ত্রণায় কাতর মাথাটা হেলিয়ে দিলো কাউচে। করিডোর দিয়ে যাচ্ছিল জেহেন। ওপর থেকে নুয়ায়ামকে দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে। উদ্বিগ্ন গলায় বলল—

“এসব হলো কী করে নুয়ায়াম? কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

নুয়ায়াম শ্বাস ভারী করে বলল–

“ছোটো অ্যাকসিডেন্ট। আমি ঠিক আছি।”

সহসা জেহেনের ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে একটা খুশবু এসে কড়া নাড়ল। সে সোজা হয়ে পেছনে ফিরে তাকাল। জেহেনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল মেহেক। মেহেক সারাক্ষণ তার দেহে অদ্ভুত রকম সুগন্ধি মেখে রাখে। তার সারা অঙ্গের বৈচিত্র্যময় রঙের সাথে এই সুগন্ধ যে কাউকে ঘোর লাগিয়ে দেবে। জেহেনের ভাবান্তর হলো না। সে দ্রুতপায়ে নিজের কক্ষের উদ্দেশ্য যেতে শুরু করে। মেহেক আকুঞ্চিত ভ্রূয়ে তাকিয়ে রইল জেহেনের দিকে। মেহেকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার অধরের নিগূঢ় হাসি অবলোকন করল জেহেন। তেহজীব শশব্যস্ত হয়ে দৌড়ে এসে বলল—

“ভাইয়া! ঠিক আছ তুমি? সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলে?”

নুয়ায়াম শ্বাস ফেলে বলল—

“তেমন কোথাও না। এমনি বের হয়েছিলাম। ভাবিনি এমনটা হবে। গাড়ি ব্রেক ফেল করেছে। শুকরিয়া! জানি না কী করে গাড়ির গর্তে পড়ে যেতে যেতে থমকে গেল!”

সকলের চমকিত দৃষ্টি। নুয়ায়াম যখন ব্রেক কষার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, তখন তার গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক ছেড়ে খাদে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু কোনো এক অজানা শক্তির বলেই তার গাড়ি নিচে পড়েনি। নুয়ায়ামের মনে হলো, কেউ পেছন থেকে তার গাড়ি টেনে ধরেছে।
এমনটাই ব্যক্ত করল নুয়ায়াম। সকলের বিস্ময়ে বশীভূত চোখ সচল হলো জেহেনের প্রশ্নে—

“ছায়াকরী কোথায়? ও তোমার সাথে ছিল না?”

নুয়ায়াম সরল গলায় বলল–

“না, ছায়াকরী মহলে ছিল।”

ছায়াকরীর কথা শুনতেই মেহেক চিন্তিত হলো। চোখের ইশারা করল তেহজীবকে। তেহজীব এখন চুপ থাকার ইঙ্গিত করল। নুয়ায়ামকে কক্ষে নেওয়ার জন্য তেহজীব সাহায্য করতে চাইলে নিষেধ করে জেহেন। সে একাই তাকে নিয়ে যেতে পারবে বলে আশ্বাস দিলো।
,
,
,
নুয়ায়ামের মাথায়, হাতের কনুইতে জেহেন তার নিজের তৈরি করা ঔষধের প্রলেপ লাগিয়ে দেয়। অতি দ্রুত ক্ষত সারাতে ভীষণ কার্যকরী এই বনজ ঔষধ। নুয়ায়াম গাঢ় চোখে দেখে জেহেনকে। আলতো গলায় প্রশ্ন করল—

“বিবাহের জন্য তোমার সম্মতি নেই?”

জেহেন নির্মল গলায় বলল—

“এখন এসব থাক। পরে কথা হবে এই বিষয়ে।”

“তোভিয়াকে মেনে নেওয়াতে তোমার এত সংকোচ কেন? আমি জানি, তুমিও তাকে ভালোবাসো!”

জেহেন বিভ্রম নিয়ে বলল—

“তোমাকে এসব কে বলেছে?”

“কাল সারারাত ওর কক্ষের বাইরে কেন দাঁড়িয়ে ছিলে?”

জেহেন ছোট্ট শ্বাস ফেলল। লুকিয়ে পড়া হরিণ ছানার মতো চোখে লুকিয়ে বলল—

“তেমন কিছু নয়। আসি আমি।”

“দাড়াও।”

রুখে গেল জেহেনের পদযুগল। নুয়ায়াম পিঠ সোজা করে বসে বলল—

“আমি কী ভেবে নেব? বেগমরাণির আদেশ তুমি অমান্য করবে?”

জেহেন দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ধরে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সত্যকে আড়ালে রেখে বলল—

“বিবাহের আয়োজন করো। আমার আপত্তি নেই।”

বদ্ধশ্বাস ফেলল জেহেন। তার বুকে পাথর যেন এক নিমিষে মেঘের মতো উড়ে গেল! নুয়ায়াম প্রসন্ন হাসল।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here