ছায়াকরী পর্বঃ৪০

0
567

# ছায়াকরী
# পর্বঃ৪০
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি

হা হা করে হেসে উঠল জেহেন। তোভিয়াকে অপ্রস্তুত করতে পেরে তার চোখে খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। তোভিয়া নাক কুঁচকে বলল–

” এসব কী ধরনের রসিকতা?”

জেহেন শব্দ করে হাসছে। মুখচ্ছবি ভর্তি প্রাণাবেগ। তোভিয়াকে আদুরে স্পর্শের পরিবর্তে একরাশ অস্বস্তি মেখে দিলো। তার স্পর্শকাতর অঙ্গে সুড়সুড়ি দিতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে তোভিয়া। দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রাণখোলা হাসিতে ডুবে গেল জেহেন। নিজের অস্বস্তিকে চাপা দিয়ে জেহেনের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে রইল তোভিয়া। জেহেন পিঁপড়ে গতিতে তোভিয়ার কাছে এসে দাঁড়ায়। মায়াময় গলায় বলল–

“রাগ কমেনি পদ্মকুমারীর?”

জেহেনের চোখে সরল দৃষ্টিতে চাইল তোভিয়া। মুখে কথা না বলে চোখের ইশারায় রাগ প্রকাশ করল। জেহেন হাসল। তোভিয়াকে আলতো করে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল—

“ক্ষমা করো।”

তোভিয়ার সমস্ত রাগ এই গম্ভীর আননের মুক্ত, ঝিলমিল হাসিতেই উবে গেল। দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জেহেনকে।”

দুই মানব-মানবী একে অন্যের উষ্ণতায় বিগলিত হতেই জেহেন বলল—

“চলো আমার সাথে। আজ তোমাকে কিছু দেখাব।”

তোভিয়া আবিষ্ট গলায় বলল—-

“কী?”

তোভিয়াকে বুক থেকে আলগা করল জেহেন। তার হাতটা ধরে সহজ গলায় বলল—

“এসো।”

তোভিয়া কিছু ভাবল না। তার ভালো লাগছে, ভীষণ ভালো লাগছে। জেহেন তোভিয়াকে নিয়ে তার আলমিরার কাছে দাঁড় করাল। আলমিরার একপাশের কপাট খুলে ভেতরকার সব কাপড় হাতে নিয়ে ছুড়ে ফেলল বিছানায়। তোভিয়া বিস্ময় নিয়ে বলল—

“কী করছন এসব?”

“শিষষষ! প্রশ্ন নয়।”

জেহেন তার কাপড় রাখার পাশটাই খুলেছে। তোভিয়া অবাক হয়ে দেখল আলমিরার সেই পাশে ভেতরে দুটো পার্টিশন। যেখানে কাপড় রাখা ছিল তার কাপড় সরাতেই, বাম পাশে একটা লাল সুইচ ছিল। জেহেন তা চাপ দিতেই পার্টিশন সরে যায়। ওষ্ঠাধর ফাঁক হয়ে যায় তোভিয়ার। জেহেন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। তোভিয়া কিছু বলতে যাবে তখনই জেহেন বলল—

“চুপ! প্রশ্ন নয়। এসো আমার সাথে।”

ভেতরে প্রবেশ করল জেহেন। টানদিয়ে তোভিয়াকে নিয়ে নিল।

আলমিরার ভেতর থেকে বের হতেই গাঢ় অন্ধকার ঘিরে ধরল তাদের। তোভিয়া ভয়ে আড়ষ্ট গলায় ডেকে উঠে—

“জেহেন!”

জেহেন আবার আলমিরাতে ঢুকে প্রথম দরজাটা ভেজিয়ে দিলো, যেন বাইরে থেকে তা খোলা কি না বোঝা না যায়। তোভিয়া ভীতসন্ত্রস্ত। সে দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারে। জেহেন এসেই অন্ধকার হাতড়ে বাতি জ্বালাল। ঝলমলে আলোতে সব স্পষ্ট হলো অচিরেই। তোভিয়া বিস্ফোরিত নেত্রে দেখতে পেল একটা লম্বা, সরু সিঁড়ি। যা নিচের দিকে নেমে গেছে। তোভিয়া আলো পেয়েই এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। এখান থেকে বের হওয়ার জন্য এই একটাই রাস্তা। আর তা হলো জেহেনের আলমিরার একপাশ। তোভিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তা দেয়ালের সাথে লাগোয়া একটা পাটাতন। একটা লম্বা বাক্স আকৃতির তৈরি করা। যার ভেতরে তারা দুইজন দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে সোজা সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে। ভয়ানক বিষয় এটাই যে, সিঁড়িগুলো ঢালু নয়, খাড়া। যা পাতালে নেমে যাচ্ছে। তোভিয়া ওপর থেকে নিচে তাকাতেই তার কলিজা লাফ দিয়ে উঠল। কাঁপতে লাগল সে। জেহেন তার হাত নিজের মুষ্টিতে নিয়ে বলল—

“ভয় পেয়ো না। আমি আছি তো।”

‘আমি আছি তো’ তিনটি শব্দে এক আকাশ ভরসা পেল তোভিয়া। তবুও ভয়ে হৃৎকম্পন বেড়ে যাচ্ছে তার। জেহেন আলতো গলায় বলল–

“শান্ত হও। কিছু হবে না। একটু নামলেই ঢালু সিঁড়ি পাবে। ”

তোভিয়ার পা কাঁপছে। খাড়া সিঁড়ির দিকে তাকাতেই ঘাম বেরিয়ে গেল তার। তরতর করে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত অঙ্গে। সে ঘনঘন শ্বাস ফেলতে লাগল। চকিতে কোলে তুলে নিল তাকে জেহেন। তোভিয়া চিৎকার করে উঠে নিজেই মুখ চেপে ধরল। জেহেন শ্বাস ভার করে বলল—

“এত ভারী কেন তুমি?”

লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠল তোভিয়া গাল। সে দ্রুত বলল—

“নামিয়ে দিন আমাকে।”

“পদ্মকুমারীর এত ভয়ে পেলে হবে?”

“আমি তো ভারী!”

“আমার চেয়ে নও। সামলে নেব।”

সরু সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নামছে জেহেন। এক একটা ধাপ পাড় হতেই তোভিয়ার মনে হচ্ছে সে কোনো গুহায় ঢুকে যাচ্ছে। সাবধানে পা ফেলছে জেহেন। দুই পাশে দেয়াল। মাঝেই চার ফিট প্রশস্ত সিঁড়ি। জেহেন বুঝে শুনে পা ফেলছে। আলোর পরিমান কমে আসছে। কারণ, ওপরে সেই বাক্সের মতো জায়গাতেই বাতি লাগানো। তার আলো সিঁড়িতে যৎসামান্য পড়ে। ধীরে ধীরে ক্ষীণ প্রভাতে এসে থামল জেহেনের পদযুগল। তার চোখের রং উজ্জ্বল হলো। তোভিয়া দুর্বোধ্য বাঁধনে আবদ্ধ করল জেহেনের গলদেশ। জেহেন ফিক করে হেসে বলল—

“পদ্মকুমারীরে আজ এই কাল কুঠুরিতে রেখে যাব। অনেক জ্বালিয়েছ আমাকে।”

তোভিয়া কথা বলল না। জেহেনের বলা প্রতিটি শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। গা হিম হয়ে এলো তোভিয়ার। সে কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। তার চোখ আবদ্ধ জেহেনের জ্বলজ্বলে দুই সবুজ চোখে। জেহেন চট করে চুমু খেল তোভিয়াকে। তোভিয়া হতভম্ব হয়ে গেল। মানুষটার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই! এটা কোনো পরিবেশ হলো চুমু খাওয়ার!
তিক্ত অনুভূতি নিয়ে জেহেনের দিকে তাকাল তোভিয়া। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এসেছে। খাড়া সিঁড়ি এখন বক্র। তা গোলাকার হয়ে নিচের দিকে নামছে। তোভিয়া নিঃশ্বাস ফেলছে গুনে গুনে। এবার জোর করেই তাকে চুমু খেল জেহেন। তোভিয়া তেতে উঠে বলল—

“উন্মাদ হয়েছেন আপনি? এমন করছেন কেন? ”

গমগম করে উঠল সেই লাইন দুটো। তোভিয়া ভয়ে নেতিয়ে গেল। একটু আওয়াজেই যেন তিনগুন হয়ে ফিরে আসে তা আবার।

“কথা বলছ না কেন? আর এভাবে তাকিয়ে আছ কেন আমার দিকে? তাহলে কিন্তু খেয়ে ফেলব। তোমার কারণে, অনেকদিন তাজা মাংস উদরে পড়ে না আমার।”

তীব্র বিতৃষ্ণায় তেতো হলো তোভিয়ার গলা। সে উচ্চ গলায় বলল—

“এখানে এসে আপনার এসব মনে পড়ছে? না কি আমাকে হ/ত্যা করে তাজা মাংস খেয়ে উদরপূর্তি করতে নিয়ে এসেছেন!”

“বাহ! পদ্মকুমারীর বুদ্ধি আছে বটে!”

তোভিয়া তীক্ষ্ম চোখে তাকাল। জেহেন মিটিমিটি হাসছে। থেমে গেল সে। পায়ে প্রশ্বস্ত জায়গা টের পেতেই তোভিয়াকে নিচে নামাল। জেহেনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল তোভিয়া। আতঙ্কগ্রস্ত নজরে তাকাতে থাকল। কিন্তু আঁধারে কিছুই দেখতে পেল না। সহসা বাতি জ্বলে উঠল। দেয়ালে লাগানো সুইচ অন করল জেহেন। সে এখানে পূর্বেই এসেছে। তাই সবকিছু নখদর্পণে তার। এখান থেকে বাকি সিঁড়ি ঢালু, আর খানিকটা প্রশ্বস্তও। তোভিয়া আরাম করে নামতে পারবে। হঠাৎ সে খেয়াল করল নিচের দিক হতে আলো আসছে। তোভিয়া উৎসুক চোখে জেহেনের দিকে চাইল। জেহেন তাকে নিচের দিকে নামার জন্য ইশারা করল। শাড়ির আঁচল ভাঁজ দিয়ে কাঁধে তুলে নিল তোভিয়া। এক পা এক পা করে সন্তর্পণে নামছে সে। জেহেন তরতর করে নেমে গেল। থমকে গিয়ে পেছন ফিরে হাসল সে। তোভিয়ার অন্তঃকরণ এখনো ভয়ে জমাট বেধে আছে। একদম নিচে নামতেই সেখানে দাঁড়িয়ে রইল জেহেন। এখানেই সিঁড়ি শেষ। একটা দরজা দেখতে পেল তোভিয়া। দরজার শিয়রে একটি উজ্জ্বল সাদা রঙের বাতি। এর আলোই সিঁড়ি থেকে দেখতে পেয়েছে তোভিয়া। জেহেন পকেট থেকে চাবি বের করল। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বেই জুতো খুলে বাইরে রাখল। তোভিয়াও তাই করল। ভেতরে প্রবেশ করতেই তার শরীর ঝনঝন করে ওঠে। পায়ের পাতা শিউরে উঠল। তাকে ছুঁয়ে গেল এক বরফশীতল অনুভূতি। তোভিয়ার মনে হলো সে কোনো বরফের মেঝেতে পা রেখেছে! নিচে তাকাল তোভিয়া। সফেদ মেঝে ঝকঝক করছে। তার মনে হলো সেই মেঝের আবরণ দেখতে ঠিক তেমন, যেন উষ্ণ তাপে বরফ গলে মসৃন হয়ে আছে!

তোভিয়া স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জেহেন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল—

“চলুন পদ্মকুমারী। এক অদেখা ভুবনে পদচারণা হোক আপনার। এক আঁছোয়া অনভূতির প্রত্যক্ষদর্শক হোন আপনি। এক মায়াবী জগতে কাটুক আজকের রাত আপনার। আর এই অধম, আজ সারারাত আপনার সেবায় নিয়োজিত।”

তোভিয়া হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। শুভ্রতার মায়ায় আবৃত এই কক্ষ মাটির কত গভীরে তা সে জানে না! শীতলতার এক অদৃশ্য শামিয়ানায় আচ্ছাদিত বিশাল কক্ষের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চেয়ে আছে তোভিয়া। একপাশে অরঞ্জিত পর্দা। বিশাল পর্দার ওপাশে কী আছে তা এপাশ থেকে ধারণা করা যাবে না। কক্ষের ছাদের একটু নিচে থেকে মেঝেতে ছুঁয়ে থাকা পর্দা আড়াল করে রেখেছে ওপাশের দৃশ্য। তোভিয়া অন্যপাশে তাকাল। দেয়ালের সাথে সেটে আছে বৃহদাকার কাঠের তাক। যার চারপাশ কাঠের তৈরি হলেও মাঝের ব্যবচ্ছেদ তৈরি পুরু কাচের। বিশ ধাপ বিশিষ্ট কাচের সারিগুলোতে থরে থরে সাজানো কাচের তৈরি পাত্র। প্রতিটির ভেতরে অদ্ভুত সব প্রাণী রাখা। তোভিয়া ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইল। পাত্রগুলো রাসায়নিকে পরিপূর্ণ। যেগুলোতে সংরক্ষণ করে রাখা আছে প্রাণীগুলোর দেহ। হরি*ণ, বা*ঘ, সিং*হ, সা*প থেকে শুরু করে ছোট্ট কাঠবিড়ালের ছানা পর্যন্ত স্থান পেয়েছে সেই পাত্রগুলোর কোনো কোনোটিতে। তোভিয়া দীপ্ত চোখে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। জেহেনের গহন সংসর্গ তোভিয়ার পেলব, তুলতুলে, অনাবৃত উদরে। তোভিয়ার চুলে মুখ গুঁজে দিলো জেহেন। লম্বা নিঃশ্বাসের সাথে প্রিয়তমার সুগঠিত কায়ার সুগন্ধ নিংড়ে নিল সে। তোভিয়া আড়ষ্ট, সমাহিত, স্থবির। জেহেন দুর্দমনীয় ছোঁয়াতে তোভিয়াকে জাগাতে চেষ্টা করল। তার গ্রীবাদেশ ভিজিয়ে তুলল ওষ্ঠাধরে গাঢ় মায়ায়। তোভিয়া ক্ষীণ স্বরে আকাশসম কৌতূহল নিয়ে বলল—

“এসব কী জেহেন? কে করেছে এসব?”

জেহেন নেশাক্ত,উন্মত্ত। তোভিয়ার সারা অঙ্গে তার পুরুষালী ছোঁয়া। তাতে সে আন্দোলিত হলেও তোভিয়া সংশয়ে বুঁদ হয়ে আছে। তোভিয়ার ঘাড়ে, পিঠে, গালে নাসিকা ঘষল জেহেন। তার উদরে হালকা চাপ দিয়ে নিজের বুকের সাথে ভালো করে চেপে ধরল। এহেন মুহূর্তে তোভিয়ার শরীর সায় দিলেও মন সায় দিচ্ছে না জেহেনকে। তোভিয়া অনেকটা বিরক্তির সাথে অস্বস্তি নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখল সেখানে একটা সাদা কাপড়ে কিছু ঢেকে রাখা। সে প্রশ্ন ছুড়ল—-

“ওখানে কী জেহেন?”

জেহেন ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিলো তোভিয়ার। অস্পষ্ট স্বরে বলল—

“বাবার সৃষ্ট তার কাঙ্খিত নারী। দুর্লভ যার গাত্রবরণ, অসহনীয় যার হাসি, ক্ষণে ক্ষণে যার চাহনি আহ্বান করে মৃত্যুর! ”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here