মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-২১

0
2424

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২১]

মৃদু আলোয় মেহেরকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে রাহনাফ। মাথায় এলোমেলো চুল, গাল নাক চোখ ঘুৃমের কারনে কিছুটা ফুলে আছে তার।সদ্য ঘুম থেকে উঠলে যা হয় আর কি। মেহেরের চোখে প্রচুর পরিমান ঘুম এসে ভর করেছে সেটা তার আধো খোলা চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। দু-হাতে চোখ ঢলে কিছুক্ষণ পর পর হাই তুলে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে মেহের। রাহনাফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে মেহেরের মুখ পানে। মেহের রাহনাফ কাছে এসে দাঁড়াতেই রাহনাফ বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়। তারপর সে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– বাইকে বসুন লেখিকা সাহেবা।

রাহনাফের কথা শুনে মেহের তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে বলে উঠে,

– বাইকে বসবো মানে কি? কোথায় যাব?

– সেটা গেলেই দেখতে পাবেন, এখন বসুন।

– আমি কোথাও যাচ্ছি না আপনার সাথে। চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায় মেহের। পিছন থেকে রাহনাফ বলে উঠে,

– আজকের দিনটা আমার নামে করে দিবেন বলছিলেন।তাহলে এখন কেন চলে যাচ্ছেন!

– তাই বলে সূর্য উঠার আগে চলে আসবেন! দাঁড়িয়ে বলে মেহের।

– যেহেতু পুরো দিনটাই আমার তাই সূর্য উঠার আগ থেকে ডুবার পর পর্যন্ত সবটাই আমার করে নিতে চাই।

বাইকে উঠে বসে রাহনাফ। মেহের তাকিয়ে থাকে রাহনাফের দিকে। কি হলো লেখিকা সাহেবা বাইকে বসুন। বলে উঠে রাহনাফ। রাহনাফের কথার কোন প্রতিক্রিয়া করে না মেহের। সে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের মুখ পানে। রাহনাফ হয়তো মেহেরের এমন চাহনি বুঝতে পারছে তাই সে মেহেরের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে বলে উঠে,

– আমার উপর কি একটু ভরসা করা যায় না লেখিকা সাহেবা। একবার বিশ্বাস করেই দেখুন, আসুন পাশে বসুন। বিন্দু পরিমাণও যদি বিশ্বাস করে থাকুন তাহলে বসুন আমি আপনার কোন ক্ষতিই হতে দিবো না। সামনের দিকে তাকিয়ে মেহেরের উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকে রাহনাফ।

রাহনাফের কথা শুনে মেহেরের মুখে মলিন হাসির রেখা ফুটে উঠে। সে স্মিত হাসে তারপর রাহনাফের পিছনে গিয়ে বসে রাহনাফের কাদে তার হাত রাখে। সামনে থাকা মিররে নিজের আর মেহেরের আধেক প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে রাহনাফ। দু-চোখ বন্ধকরে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে সে। এ যেন এক বড় প্রাপ্তি তার কাছে। মেহের তাকে বিশ্বাস করে তার পাশে বসেছে তার কাছে হাত রেখেছে। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে তার কাছে। চোখ খুলে মিররের দিকে তাকায়, মেহেরের আধেক মুখ দেখা যাচ্ছে তাতে। রাহনাফ মিররটা নাড়িয়ে চাড়িয়ে ঠিক করে নিলো। এবার মেহেরের পুরো মুখটাই দেখা যাচ্ছে তাতে। হুম এখন ঠিক আছে। হাত দিয়ে মাথায় চুলগুলো পিছনে ঠেলে দেয় রাহনাফ তারপর সে ছুটে চলে তার গন্তব্যের দিকে।

৩২,
রাহনাফ, চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোমের ভিতরে নিয়ে আসে তার বাইক। গেটের ভিতর দিয়ে বাইক প্রবেশ করানোর সময় মেহের বেশ অবাক হয়। রাহনাফ সাতসকালে তাকে এখানে কেন নিয়ে আসলো। আর এত সকলে সে আশ্রামেই বা কেন আসলো। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেহেরের মাথায়। সে কিছুক্ষণ পর পর রাহনাফের কাঁধ শক্তকরে চেপে ধরছে। রাহনাফ সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

– গেলেই বুঝতে পারবেন কেন এসেছি। এখন শান্ত শিষ্ট ভদ্র মেয়ের মতো বসে থাকুন।

রাহনাফের কথা শুনে শুকনো ডুক গিয়ে মেহের। বাকা চোখে বাইকের মিররের দিকে তাকিয়ে রাহনাফের মুখ দর্শনকরে সে, অমনি রাহনাফ তার বাইক থামিয়ে দেয়। ঘটনাক্রমে মেহেরের পুরো শরীরের ভর গিয়ে পরে রাহনাফের উপর। মেহের দ্রুত নিজেকে সামলে বাইক থেকে নেমে যায়। রাহনাফ ও বাইক থেকে নামে তারপর সে মেহেরের হাত ধরে অপর পাশে চাইল্ড হোমের কাছে নিয়ে যেতে থাকে।

চাইল্ড হোমের কাছে আসতেই অনেকগুলা ছেলে মেয়ে রাহনাফে ঘিরে ধরে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে থাকে। রাহনাফ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাদের সামলাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। মেহের তার হাত উচু করে তাকিয়ে আছে রাহনাফের দিকে। রাহনাফ বাচ্চাদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে সেটাই দেখছে সে। তারপর সে তার হাতের উপর হাত বুলিয়ে মৃদু হাসে। কেন হাসে সেই কারনটা অজানা তার। হাতের উপর হাত বুলিয়ে দিয়ে আবারও সে রাহনাফের দিকে তাকায়। এই ছেলেটার হাসি এত কিউট কেন? কেন! সে হাসলে আমার বুকটা ব্যাথা করে উঠে। কেন তার সাথে থাকলে আমার নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয়। বুকের উপর হাত রাখে মেহের। তাহলে কি আমিও! মুগ্ধ চোখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

দুপুরে রাহনাফ নিজে বাচ্চাদের নিয়ে ভুনা খিচুড়ি রান্না করে আশ্রামের সব বাচ্চা ও বয়স্কদের খাওয়ায়। সকলে রাহনাফের উজ্জল ভবিষ্যৎ আর দীর্ঘয়ু কামনা করছে। মেহের সারাক্ষণ রাহনাফের পাশে ঘুরে ঘুরে ওকে দেখেছে। মাঝে মাঝে যখন রাহনাফের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয়েছে তখনি সে তার দৃষ্টি নামিয়ে কোন এক কাজ করার বাহানা খুজে চলেছে। এটা দেখে মৃদু হাসছে রাহনাফ আর মাথা চুলকাচ্ছে। খাওয়া শেষে সবাই যখন বিশ্রাম নিতে ব্যাস্ত রাহনাফ তখন আশ্রামের পাশে বাগানে বসে গাছের সাথে কথা বলে। কিছুক্ষণ পর মেহের ও এসে রাহনাফের পাশে বসে। রাহনাফ মেহেরের উপস্থিতি টের পেলেও কোন প্রতিক্রিয়া না করে গাছের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে তাকিয়ে থাকে। মেহের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে রাহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

– আজ আপনার জন্মদিন, আগে বলেন নি কেন?

– জানতে চেয়েছেন কখনো?

রাহনাফের প্রশ্নের কোন জবাব দেয়না মেহের। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে সে। তারপর বলে উঠে,

– আমাকে এখনে কেন নিয়ে আসলেন? না মানে এই আশ্রম তো আপনি আগে থেকেই চিনেন, আপনি একা আসতে পারতেন তবে আমাকেই কেন নিয়ে আসলেন এখানে।

– আজকের এই দিনটা আমার কাছে খুব স্পেশাল, আর ততটাই আপনি আমার কাছে স্পেশাল। স্পেশাল দিনটা যদি স্পেশাল মানুষের সাথে নাই কাটাই তাহলে কি করে হয় বলুন তো। সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠে রাহনাফ। মেহের ততক্ষণ রাহনাফের মুখের দিকে তাকিয়েই ছিলো। রাহনাফ তার দৃষ্টি নামিয়ে মেহের দিকে তাকাতেই দুজনের সাথে চোখাচোখি হয়। মৃদু হেসে মেহের তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয় আর রাহনাফ সে তাকিয়েই থাকে মেহের মুখপানে। কিছুসময় পর মেহের তার হাত বাড়িয়ে বলে উঠে,

– আপনার মোবাইলটা একটু দেন তো।

দ্বিরোক্তি করে না রাহনাফ। সে তার মোবাইলটা মেহেরের হাতে দিয়ে দেয়। মোবাইল পেয়ে মেহের মৃদু হেসে উঠে চলে যায়। দূর থেকে এক বৃদ্ধা মাহিলা মেহেরকে দেখতে পায় তখন। সে এতক্ষণ বসে বসে একটা সোয়েটার শেলাই করছিলো। মেহেরকে দেখা মাত্রই সে সুই সুতা সোয়েটার রেখে মেহেরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সেই কবে সে দেখেছিলো মেহেরকে তারপর তার মেহেরের দেখা পায়নি সে। নওশাদ কে কত করে বলেছে মেহেরকে দেখবে, কিন্তু সৈদয় নওশাদ তো পৃথিবী সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাবা, সে বাবার অধীকার নিয়ে মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পরে না। মেয়ের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পারে না সে। বৃদ্ধা তার নাতনী মেহেরকে দেখতে পারে না। আজ কত দিন পর সে আবার মেহেরের মুখ দেখতে পেরেছে তাকে ছুয়ে না দেখলে কি করে হয়। বৃদ্ধা মেহেরকে ছুঁয়ে দেখবে বলে মেহেরের কাছে আসতে থাকে। এদিকে মেহের ফোনে কথা বলে শেষ করে আবার গিয়ে রাহনাফের পাশে বসে ওকে ওর মোবাইলটা ফিরতে দিয়ে দেয়। তারপর দুজনে মিলে তাকিয়ে থাকে গাছের দিকে।

– মে-মেহের।

ফাটানো জড়ানো কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পিছনে ফিরে তাকায় মেহের আর রাহনাফ। পিছনে থাকা লোকটা দেখে রাহনাফের মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠলেও মেহের মুখখানা বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। তিক্ততায় ভরে উঠে তার মন। চোখ ছেয়ে যায় বিরক্ততায়। মুহূর্তেই চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আসে তার। উড়নাটা নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে শক্তচোখে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকে মেহের।রাহনাফ অধোরে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,

– আরে আমার কিউট দাদি যে আসুন আসুন।

বৃদ্ধার রাহনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে মলিন হাসি উপহার দিকে মেহেরের দিকে তাকায় সে। মেহের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে রাহনাফের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধা ওদের পাশে দাঁড়াতেই উঠে দাঁড়ায় মেহের। ঘৃনাভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বৃদ্ধার দিকে। আর বৃদ্ধার দৃষ্টি স্থির মেহেরের মুখের দিকে। তার চাহনিতে ছিলো শুধু অনুতাপ মাত্র।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_মাহফুজা_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here