তোমায় ঘিরে #শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-৬

#তোমায় ঘিরে
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৬

বাসায় যাওয়ার সাথে সাথে সে পড়ল নতুন বিপাকে। সিয়ামের জন্মদাত্রী মা সাহিদা করিম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন

“তোর সম্পর্ক আছে আগে বললেই পারতি। শুধু শুধু পাত্রীর সামনে আমাদের কেন বেইজ্জতি করলি? পাত্রীর সামনে নাকি তোর জি এফ এসে হানা দিয়েছে। কতটা লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেললি আমাদের। পছন্দই যখন ছিল তাহলে আমাদের মেয়ে দেখতে কেন বললি? মান সম্মান তো সব ধুলোয় মিশিয়ে দিলি। ”

সিয়াম দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। কোনো কথায় সে বলছে না শুধু শুনে যাচ্ছে। সে জানে কথা বলতে গেলে সে কথা আরও বড়ো হয়ে পাখা হয়ে উড়তে থাকবে। আর এক পর্যায়ে মেঘের মতো উড়ে বৃষ্টি হয়ে তার মায়ের চোখ দিয়ে নামবে। সাহেদা করিমের বলা শেষে সিয়াম নম্র গলায় উত্তর দিল

“মা তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?”

সিয়াম কথাটা বলে যেন আরও বিপাকে পড়ে গেল। মায়ের কথার গতি আরও বৃদ্ধি পেল। সিয়াম এবার মায়ের কথা উপেক্ষা করে রুমে প্রবেশ করল। রুমে প্রবেশ করতেই তার বাবা আমজাদ সাহেব একই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। সিয়ামের কানে যেন তালি লেগে যাচ্ছে। কিছুটা বিরক্ত গলায় বলে উঠল

“মেয়ে যা বলেছে সব মিথ্যা। ঐ মেয়েটা আমার ভার্সিটির স্টুডেন্ট। ভুলক্রমে আরেকজন মানুষকে ধুলাই দিতে গিয়ে আমাকে দিয়ে ফেলেছে। ফলস্বরূপ এতগুলো কাহিনির সন্নিবেশ ঘটলো৷”

এবার সাহেদা করিম আর আমজাদ সাহেব ছেলের কথা শুনে ছেলের কাছে আসলো ঘটনা জানার জন্য। সিয়াম বাধ্য হয়ে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। আমজাদ সাহেব বেশ রসিক মানুষ। সিয়ামের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল

“মেয়েটা রাগী হলেও মেয়েটা ভালো হবে। আমার মনে হয় তোদের মধ্যে কিছু একটা হবে। ভালোবাসার শুরুটা তো এভাবেই হয়। প্রথমে ঝগড়া তারপর রাগ তারপর ভালোবাসা। ”

সিয়াম ভ্রূটা কুঁচকে উত্তর দিল

“সব কিছুতে তোমরা ভালোবাসা খোঁজো কেন? ঐরকম কিছুই না। এ মেয়েকে যে বিয়ে করবে তার জীবন তেজপাতা হয়ে যাবে। একটুতেই সাপের মতো ফুস করে উঠে। খেয়েদেয়ে কাজ নেই এমন নাগিন বিয়ে করব। আমি আর বিয়ে করব না। এমনিতেই বিয়ের ব্যাপারে আমার এলার্জি আছে। অনেক জোর করার পর মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। আজকে যে কাহিনি হলো বাবা, মা তোমাদের দুজনের কাছে মাফ চাই। আমাকে আর বিয়ে নিয়ে কিছু বলো না।”

কথাগুলো এক নাগারে বলে সিয়াম হনহন করে নিজের রুমের দিকে এগুলো। আমজাদ সাহেব জোরে জোরে তখন বলতে লাগলেন

“সময় করে একদিন মেয়েটাকে নিয়ে আসিস। আমি দেখব আমাদের বৌ মা দেখতে কেমন। কী বলো সাহু।”

আমজাদ সাহেব সাহেদা করিমকে ভালোবেসে সাহু নামে ডাকেন। সাহেদা বেগম আমজাদ সাহেবের কথা শুনে আরেকটু হেসে বললেন

” তা তো দেখতেই হবে।”

এদিকে সিয়াম তার মা, বাবার কথা মাথায় না ঢুকিয়ে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিল। চোখটা বন্ধ করেই চমকে গেল। ধরীতার মুখটা চোখে ভেসে আসছে। তার কপাল থেকে টুপটুপ করে রক্ত পড়ার দৃশ্যটা এখনও সে ভুলতে পারছে না। কেন জানিনা না চাইতেও ধরীতার জন্য এক ধরণের চিন্তা কাজ করছে। মেয়েটার শরীর ঠিক আছে কিনা। কেন তাকে এভাবে মারা হলো? কী দোষ মেয়েটার। কে ঐ মহিলা যিনি তাকে এভাবে আক্রমণ করল। অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সিয়ামের মনে। এর মধ্যেই সাহেদা করিমের কণ্ঠসুর আসলো সিয়ামের কানে। সাহেদা করিম ডেকে বললেন

“বাবা খেতে আসো।”

সিয়ামের একদম খেতে ইচ্ছে করছে না। তার উপর ধরীতার মুখটা যতই ভেসে উঠছে ততই তার খারাপ লাগছে। এ অবস্থায় তার গলা দিয়ে খাবার নামবে না। সে কিছুটা চুপ হয়ে থেকে বলল

“মা শরীরটা ক্লান্ত লাগছে। এখন আর খাব না। পরে খাব। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। খাবার ফ্রিজে রেখে দাও। আমার ভালো লাগলে আমি নিজেই গরম করে খেয়ে নিব।”

সাহেদা করিম পুত্রের কথার বিপরীতে গেলেন না। পুত্রকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে নিজের রুমে শুতে গেলেন। সিয়াম বিছানা থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে পুনরায় বিছানায় এলিয়ে দিল নিজেকে। চোখটা বন্ধ করতেই আবারও চমকে গেল সে। সেই ধরীতার মুখটা তার চোখে ভাসতে লাগল। যতই চোখ থেকে মুখটাকে ম্লান করতে চাচ্ছে ততই যেন ধরীতার মুখটা আরও স্পষ্ট হয়ে ভাসতে লাগল। অদ্ভুত এক মায়া কাজ করছে ধরীতার প্রতি সিয়ামের। কেন এমনটা হচ্ছে তার জানা নেই। নিজেকে বেশ ছন্নছাড়া লাগছে তার। ধরীতা মেয়েটা এতটা রাগী হয়েও কী করে এত অত্যাচার সহ্য করল সেটাই ভাবছে সিয়াম। এ মুহুর্তে ধরীতাকে দেখার এক প্রকার তীব্র নেশা কাজ করতেছে তার মনে। তবে সে নেশাকে সায় দিলে অনেক বড়ো ভুল হবে। তাই নেশার সাগরে নিজেকে তলিয়ে না দিয়ে সামলে নিল সে। চোখটা বন্ধ করে ঘুমানোর প্রচন্ড চেষ্টা করতে লাগল। আস্তে আস্তে সিয়ামের চোখের পাতায় ধরীতার মুখ অবয়ব অস্পষ্ট হতে লাগল আর একটা পর্যায়ে সে ঘুমের গলিতে তলিয়ে পড়ল।

রাত বাজে সাড়ে তিনটা। অধরা ধরীতার মাথায় ব্যান্ডেজ করে তার জন্য লুকিয়ে খাবার নিয়ে এসে ফিসফিস গলায় বলল

“দ্রূত খেয়ে নে। নাহয় মা এসে তোকে কথা শুনাবে। আর রাগ করে না খেয়ে থাকিস না। শরীর খারাপ হবে। কাল ক্লাস আছে ভুলে যাস না। ”

অধরার কথা শুনে ধরীতা অধরাকে ঝাঁপটে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল

“জানিস কেন আমি কোনো ছেলেকে সহ্য করতে পারি না।”

“তা তো জানিই রে। তবে সব কিছু তো এক না। সবাই এক না। হাতের আঙ্গুলও সব এক না। একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে তুই সবাইকে খারাপ বলতে পারিস না। আজকে তোর কপালে যা ছিল হয়েছে। আর মায়ের উপর কষ্ট নিস না। মা, বাবাকে ক্ষমা করে দিস। তারা হয়তো না বুঝেই এমন করছে। ফুফু পাশের রুমে বসে কাঁদছে আমি স্বান্তনা দিয়ে আসলাম। বলেছি তোকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আমার। সুতরাং উঠে খেয়ে নে।”

ধরীতা অধরাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল। এ বাসায় ধরীতার মা ব্যতীত কেউ যদি ধরীতার আপন হয় সেটা অধরা। কিছুক্ষণ অধরাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। তারপর অধরাকে সাথে নিয়ে খাবার টা খেয়ে নিল। মাথাটা টনটন করে ব্যথা করছে তার। বালিশে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করে রইল সে। সিয়ামের মুখটা চোখে ভাসতেই চোখটা খুলে ফেলল সে। কেমন জানি অন্যরকম অনুভূতি জাগছে সিয়ামকে ঘিরে। এ অনুভূতির সাথে মোটেও সে পরিচিত না। কেন যে অবলা মন এমন অনুভূতির সম্মুখীন করায় তা ভেবেই সে বিরক্ত হচ্ছে। মনের বিপরীতে মাঝে মাঝে চলা খুব কঠিন হলেও বাস্তবতার নিরীখে মাঝে মাঝে মনের বিরুদ্ধে চলতে হয়। ধরীতাও তাই করল। জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করল।

বাইরে আযানের ধ্বনি। ধরীতার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে কোনোরকম চোখ টেনে উঠে জ্বরের একটা ট্যাবলেট খেয়ে নামাজে দাঁড়াল। নামাজ টা শেষ করে আবার শুয়ে পড়ল। বেলা ১০ টায় চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভাঙল। ধরীতা বুঝতে পারছে না কেন এত চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে। গা টা বেশ গরম থাকা সত্ত্বেও নিজের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে শুয়া থেকে উঠে দাঁড়াল। রুম থেকে বের হয়ে ড্র ইং রুমের দিকে এগিয়ে গেল। ড্রইং রুমে প্রবেশ করতেই সে আঁৎকে উঠল।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here