উপন্যাসঃ ঘাসেদের ফাগুন-৩
___________🖌️নাজনীন নাহার
৮.০৩.২০২২
আমি বলছিলাম আমার এক দূর সম্পর্কের দাদির নারী জীবনের সত্য ঘটনা। দাদির স্বামী আমার সেই দাদা। দাদির সাথে তাদের নিজেদের পচাত্তর বছরের দাম্পত্যের অবসান ঘটালেন। পুরুষ হিসেবে তার ধর্মীয় অধিকারের প্রয়োগ ঘটিয়ে। তিন তালাক শব্দের উচ্চারণে। দীর্ঘ পচাত্তর বছরের সুখ দুঃখের সাথী প্রিয় স্বামীর মুখের তালাক শব্দের ভয়ঙ্কর আঘাতে ঘরের দরজায় বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা স্ত্রীকে ডিঙিয়ে সেই বৃদ্ধ পুরুষ ভেতর ঘরে চলে গেলো সদ্য তরুণী নতুন স্ত্রীকে নিয়ে।
আপনাদের কী মনে হচ্ছে এটা আদি যুগের ঘটনা! কিন্তু আপনারা কী জানেন! এখনও বহু পুরুষ। কথায় কথায় তালাক শব্দের হুমকি ও প্রয়োগে বিচ্ছেদ ঘটায় দীর্ঘ দিনের দাম্পত্যের! এখনও বহু নারী নিজেকে সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিকভাবে খুব অসহায় মনে করে!
বলছিলাম দাদির জীবনের কথা।দাদির ঘটনাটা এখানেই শেষ হলো না। দাদা নতুন স্ত্রীর সাথে সুখের বাসর রচলেন। এদিকে দাদির হুশ ফিরে আসলে নিজে তেমন কিছু ঠিকঠাক মনে করতে না পারলেও। আশেপাশের সকলে তাকে মনে করিয়ে দিলো তার তালাকের কথাটি। দাদি কারও সাথে আর কোনো কথা বলল না। কেমন স্থবির পাথর হয়ে গেলো সে। মাত্র সাত বছর বয়সে দাদিকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল বারো বছর বয়সের এই দাদার সাথে। ভাইবোনের মতো একসাথে বড়ো হয়েছিলো তারা। তারপর মায়া, প্রেম, ভালোবাসা আর দাম্পত্য সুখ দুঃখের জীবন ছিলো তার। ভালোই ছিলো তারা। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে চৌদ্দটি সন্তানের জননী সে। দীর্ঘ পচাত্তর বছরের সম্পর্ক আজ মাত্র একটি কথায় ভেঙে গেলে দাদিকে সবাই আলাদা করে থাকতে দিলো। দাদির আর দাদার সাথে দেখা করা হারাম হয়ে গেল। ইসলামি আইনে তালাকের পর স্বামী স্ত্রী পরস্পরের জন্য হারাম হয়ে যায়। দাদা তো নতুন বউ, নতুন সঙ্গ, নতুন গল্প , নতুন গন্ধে ডুবে রইল। এদিকে দাদি একা হয়ে গিয়ে কেবল পুরনো মানুষটা, পুরনো গল্প, পুরনো গন্ধ খুঁজে খুঁজে চোখের পানিতে দিন রাত কাটাতে লাগল।
দাদির বৃদ্ধ শরীরটা আর কোনো শরীর খুঁজে না।কিন্তু তার মনটা ঠিকই প্রিয় মনকে খুঁজে। প্রিয়জনকে খুঁজে। তার নারী জন্মটা হঠাৎ কেমন অভিশাপ হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে নিয়মিত নামাজ পড়া দাদি নাকি সেইদিনের পর থেকে আর একবেলাও নামাজ পড়েনি। যতদিন বেঁচে ছিলেন একবারও তার মুখে আল্লাহ ডাকের শব্দ কেউ শুনেনি। সবাই বলতো দাদি তার এই শেষ বয়সের আঘাতে খুব অভিমান করেছিল তার সৃষ্টিকর্তার উপর।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়। দাদিকে কী আল্লাহ দুনিয়াতেই দোজখের যাতনা দিয়ে নিয়েছেন! ওপারে কেমন আছেন দাদি! সে কী আল্লাহর বেহেশতে আছেন! কী জানি!
এদিকে দাদার সেই তালাকের পর থেকে দাদি একাই থাকত। ছেলের বউয়েরা এক একজন তাকে খাবার দিয়ে যেতো। কারও সাথে খুব একটা কথা বলত না সে। কখনও বাগানে গিয়ে বসে থাকত। কখনও পুকুর ঘাটে। দাদি নাকি একদিন ফজরের আজানের পরে একা একা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো তার বাবার বাড়ি। কিন্তু সেখানে তার জন্য কোনো যায়গা হয়নি। দাদির ভাইয়েরা ততদিনে মারা গিয়েছিল। ভাইয়ের ছেলেরা তাকে সেভাবে নিজেদের কাছে রাখতে চায়নি।
আসলে কী অদ্ভুত দহন একজন নারীর! বাবার বাড়িটা আর নিজের থাকে না। স্বামীর বাড়িটাও নিজের হয় না। পরাশ্রয়ী হয়ে অধিকাংশ নারীর জীবন কাটে নিরন্তর।
সেই বৃটিশ আমলেও একজন নারীর কোনো নিজস্ব বাড়ি ছিলো না। আজকের এই বাংলাদেশ আমলেও অধিকাংশ নারীর কোনো নিজস্ব বাড়ি নেই। না দিয়েছে ধর্ম, না দিয়েছে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র। এই তো
এখনই কেউ কেউ বলবেন। ইসলাম ধর্ম নারীীকে উত্তরাধিকারের অধিকার দিয়েছে বাবার ও মায়ের সম্পত্তিতে। সত্যি করে বলুন তো!সেই সম্পত্তিটাও কখন পায় একজন নারী! আর পেতে গিয়েও সামাজিক একটা অসম্মান জুড়ে দেয়া হয়েছে নারীর মননে হীনমন্যতার নামে। বাবার বাড়ির সম্পত্তি নেয় ক’জন! এমন ধারণা বলে বলে! আহা নারী!
আমার নিজের নানুমণি তার বাবার বাড়ির সম্পত্তি নিজের নামে দলিল করে নিতে যায়নি কখনো। কারণ লজ্জা। আমার মা তার বাবার বাড়ির সম্পত্তি নিজের নামে নেয়নি। কারণ লজ্জা। ইদানীং শুনলাম আমার মায়ের নানুর বাড়ির ও আমার নানুর বাড়ির কিছু সম্পত্তিতে নাকি আমার মায়ের উত্তরাধীকার সূত্রে নাম এসেছে। যার সূত্র ধরে আমরা ভাই বোনেরা সেই সম্পত্তির অধিকার পেয়েছি। সেখানেও সামাজিক সম্মান পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। আমার বড়ো ভাইয়ের কথা হলো।মা ও নানু যা নেয়নি আমরা কেন তা নেব! অবশ্য আমার বড়ো ভাইয়ের অনেক সম্পত্তি রয়েছে। কিন্তু আমার একটা বোন খুবই দরিদ্র। অথচ এই সামাজিক অসম্মানের ভয়ে আমার দরিদ্র বোনটিও বঞ্চিত থাকছে উত্তরাধীকারের সম্পত্তি থেকে।
মাঝে মাঝে আমার জানতে ইচ্ছে করে। নানানরকম ভাবে নারীর মন ও মস্তিষ্কে কে বা কারা ধর্মের, সমাজের, সম্মানের ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে! আর এটা কার স্বার্থে করেছে! বিষয়টির গভীরে গিয়ে দেখুন তো!এখানেও পাবেন একমাত্র পুরুষের গহীন গোপন স্বার্থ।
পবিত্র কোরআনে পাকে যা বলা হয়েছে আল্লাহর বাণী রূপে তার ব্যাখাা বিশ্লেষন মূলত কে করছে! একজন পুরুষ।
তাইতো মসজিদ থেকে, তাফসির ও তবলিগ থেকে ফিরে একজন পুরুষ কিন্তু তার স্ত্রীকে রান্না করে খাওয়ায় না।সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব নেয় না। অথচ পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বয়ান অনুসারে শুধু সন্তান গর্ভে ধারণের দায়িত্ব পালনটুকুই করবে নারী।কিন্তু লালন পালনের দায়িত্ব আল্লাহ পুরুষকে দিয়েছেন। আজ পর্যন্ত আপনারা কেউ শুনেছেন এই সকল ওয়াজ বা বয়ান! শোনেননি।শুনবেনও না। কারণ এগুলো পুরুষের আধিপত্য কনট্রোল করার বয়ান তো। তাই কে বলবে এইসব! পুরুষ কী জেনে বুঝে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে! মারবে না। তারা শুধু নিজেদের সুবিধার বয়ানে নিজেদের আত্মতৃপ্তি রচে।
যেখানে পবিত্র কোরআনে পাকে বলা হয়েছে সকলকে শিক্ষা গ্রহণ করার কথা। যেখানে হাদিস শরীফে বলা হয়েছে জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীনে যাও। সকলের জন্য বলেছে।কিন্তু পুরুষের জন্য ব্যবহার করে পুরুষরা। নারীকে মাহরাম পুরুষের বিধানে বন্দি করে কর্মে ও স্বাধীনতায় দমিয়ে রাখতে চায় কিছু পুরুষ।
একটু খেয়াল করে দেখবেন। বিভিন্ন ধর্মে পুরুষদেরই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বেশি। গঠনগত ভাবেও নারী কিছুটা দুর্বল। তারপরও ধর্ম, ও আইন নারীদেরকে যতটুকু অধিকার দিয়েছে। তারও যথাযথ প্রয়োগ হয় না!
আহা নারী! দুনিয়ায় নানানভাবে নারীরা বঞ্চিত হতে হতে। আবার নাকি আখেরাতের হিসেব নিকেশ শেষেও দোজখের অধিকাংশ অংশ দখল করবেন নারীরাই। আমার তো মনে হয় যেখানে সৃষ্টিকর্তাই এই বিধান রেখেছেন। সেখানে আমি তুমি কীভাবে নারী নিয়তি থেকে অসহায়ত্ব দূর করব!
এই অসহায়ত্বের কারণেই দাদিও তার স্বামী কতৃক তালাকের পরে নিজের বাবার বাড়িতে অধিকার না পাওয়ায়। আরও ভেঙ্গে পড়লেন।এক পর্যায়ে তার ছেলেরা গিয়ে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন আবার সেই তার অপমানের স্বামীর বাড়িতে।
এদিকে দাদার নতুন বউ বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আর বুড়োর সংসারে ফিরতে চায়নি। এখানেও দাদা পুরুষ ও সমাজে প্রভাবশালী বলে কেউ কিছু বলার সাহসও পায়নি। কারণ পুরুষ মানুষ এসব কোনো বিষয়ই না। কিন্তু আশেপাশের অনেকেই সেই নতুন বউ নারীকেই নানান প্রশ্ন করে করে বিব্রত করত। কেন বুড়ো লোকটাকে বিয়ে করল ইত্যাদি! কেউ জানলো না নতুন বউটা নিজের বাবার সংসারের অভাবের বলি হয়েছিল। তার বাবা পুরুষটা এই মেয়েকে বাধ্য করেছিল বৃদ্ধ লোককে টাকার জন্য বিয়ে করতে। শুনেছি দাদার নতুন বউ বাবার বাড়ি থেকে আসতে না চাওয়ার অপরাধে বউয়ের বাবার কাছে অত্যাচারিত হয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আহা নারী! তোমাকে অপমান করতে তেমন কিছুই লাগে না। আর তুমি মেয়ে পালিয়েই যেহেতু গেলে। তা এমন বিয়েটার আগে কেন পালালে না।
আচ্ছা বলুন তো! এই মেয়েটার জীবনটা কী আদৌ শান্তিময় হবে আর! সে কী আর জীবনেও সামাজিক সম্মান পাবে! হয়তো তার জীবনটা পরবর্তীতে একজন ভাসমান পতিতার জীবন হয়েছিল। কে জানে! তার বাবা ও পরিবার হয়তো আর তাকে গ্রহণ করেনি। সে যে অচ্ছুৎ হয়ে গেছে। আর এই অচ্ছুৎ এর সংজ্ঞাও পুরুষের দেয়া। পুরুষ অহরহ নারীকে ছুঁয়ে অচ্ছুৎ বানিয়ে দেয়।অথচ তারা নিজেরা অচ্ছুৎ হয় না। কী অদ্ভুত সমাজ দর্শন আমাদের! এখনও যে কত কত নারী নিজের নারী জন্মের পাপ পোহাতে পোহাতেই জীবন পাড় করে দেয়!
দাদার নতুন বউ চলে যাবার পরে দাদির জন্য ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার বদলে আরও বিপর্যস্ত হলো। আসলে দাদি তো নারী।তাই দাদির জীবনের ট্রাজিডি শেষ হলো না। অতীতের চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর এক বীভৎস বাস্তবতা অপেক্ষা করছিলো দাদির জন্য। দাদার নতুন বউ চলে যাবার পড়ে যেখানে দাদার জীবনে বিপর্যয় নেমে আসার কথা ছিল। সেখানে তা হলো না। দাদা তো পুরুষ। তাছাড়া দাদার নামে বিশাল সম্পত্তি। তাকে কেউ কিছু বলার সাহস তো রাখে না।
তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করলেন। তিনি নতুন বউ পেলেন। তার বউ আবার চলেও গেল। এগুলো সব সকলের কাছে স্বাভাবিক। অথচ দাদিকে তালাক পেতে হলো।দাদিকে অপমান ও লজ্জায় ভুগতে হলো। দাদিকে ঘর ছাড়া হতে হলো। তার কোনো বিহিত নেই।
এদিকে সকলেই বলল দাদিকে দাদার সাথে আবার সংসার করতে। সবাই মিলে ঠিকঠাক করল। দাদা দাদি আবার একসাথে সংসার করবে। দাদির বয়স তখন তিরাশি বছর। দাদার বয়স অষ্টআশি বছর। এই বয়সের দু’জন নারী পুরুষদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কের তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তবুও তাদের তালাকের কারণে সংসার করার ক্ষেত্রে ধর্ম ও সমাজ কতগুলো জটিল নিয়ম নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। আর তা হলো হিল্লা বিয়ে।
দাদা দাদিকে বিয়ে করতে হলে আগে দাদিকে এক ভিন্ন পুরুষের সাথে বিয়ে দিতে হবে।
বিয়ের পরে তার সাথে রাত কাটাতে হবে দাদিকে এক ঘরে। এরপর সেই ভিন্ন ব্যক্তি দাদিকে তালাক দেবে। তারপর দাদি চারমাস তালাকের ইদ্দত পালন করবেন। এবং তখন দাদা তাকে বৈধভাবে বিয়ে করে সংসার করতে পারবেন।
কী বীভৎস বাস্তবতা নেমে এলো দাদির জীবনে। অপরাধ করলো দাদা। অথচ সমাজ ধর্মের দোহাই দিয়ে শাস্তি দিচ্ছে নারীকেই।
এদিকে দাদির হিল্লা বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে সকলে একজনকে পাত্র হিসেবে নির্বাচন করল। সে হলো দাদার বাড়ির গোয়াল ঘরে কাজ করা গাবুর মানে কাজের লোক।
দাদি কী করবে তখন!
স্বামীর সঙ্গ ও সংসারে থাকার বৈধতার জন্য বাড়ির গাবুরকে বিয়ে করবে!
নাকি থামিয়ে দিতে পারবে তার প্রতি হওয়া সকল অন্যয় ও অবিচারের প্রহসন!
(চলবে)