ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ৪

0
761

দাদি খুব কাঁদছে।কারণ দাদিকে এই তিরাশি বছর বয়সে বাড়ির গোয়াল ঘরের ( গাবুর) কাজের লোকের সাথে হিল্লা বিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিয়েটা দেয়া হচ্ছে ক্ষমতা ও ধর্মের অপব্যবহার ও অপব্যাখ্যা করে। কারণ সর্বকালেই নিজেদের স্বার্থে কতিপয় সমাজপতি ও ভণ্ড ধার্মিকেরা সমাজে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করে নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শাসন, শোষণ ও নিপীড়ন চালিয়েছে। সেই নিপীড়নেরই একটি ঘটনা এই দাদির হিল্লা বিয়ে।

দাদি স্বামী কতৃক তালাকপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। আজ তার হিল্লা বিয়ে হচ্ছে। দাদি অনবরত কাঁদছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে। সেই যুগে নারীদের জন্য কী আদৌ হার্ট এট্যাকের বিষয়টি বরাদ্দ ছিলো!থাকলে নিশ্চয়ই সেই দাদি এতো বড়ো অপমানে হার্ট অ্যাটাক করতেন।
দাদির বড়ো ছেলের বউ দাদির কাছে এলো। ছেলের বউটাও কাঁদছে।
——–আম্মা ওডেন। কাচারিতে কাজি সাব আসছেন। গাও গেরামের হগগল মহিলারাও কাচারির পিছনে আইয়া ভিড় করছে। এহনই বিয়া পড়াইব! ও আম্মা ওডেন। ওজু কইরা কাপড়ডা পালডাইয়া লন। আপনারে তো অইহানে যাইতে হইবো।

বড়ো ছেলের বউটারও কান্না থামছে না। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে যেমন বৃষ্টি একবার শুরু হলে থামার নাম থাকে না। তেমনই দাদির আর তার ছেলের বউয়ের কান্না আর থামছে না আজ। ছেলের বউটাও একজন নারীই।সে কী শ্বাশুড়ির অপমানে কাঁদছে! নাকি নিজের এমন নির্মম ভবিষ্যতের আশঙ্কায় কাঁদছে কে জানে!

মেয়েরা বড্ড কোমলপ্রাণ হয়। বেশিরভাগ মেয়েরা এমনিতেই কথায় কথায় কান্নাকাটি করে। তারমধ্য কাউকে কাঁদতে দেখলেই হলো কারণ ছাড়াই কেঁদে ফেলে। হয়তো নিজের শ্বাশুড়িকে অনবরত কাঁদতে দেখেই ছেলের বউটাও এভাবে কাঁদছে।

এদিকে দাদি ঠাঁয় বসে রইলেন। তিনি একটুকুও নড়াচড়া করলেন না। তিনি ওজুটাও করলেন না। মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত দাদির হয়তো মনে হচ্ছে। তার জীবনে এটা কোনো পবিত্র কিছু হচ্ছে না। কী হবে তার অজু করে! এমন ভাবনায় বুদ হয়ে আছেন হয়তো! এমন সময় দরজার বাইরে থেকে দাদা হাঁক ছেড়ে ডাকলেন।
————বড়ো বউ এতো দেরি করো ক্যান। তোমার শাওড়িরে লইয়া কাচারি ঘরের পিছে আহো।
————–আইতাছি আব্বাজান।
দীর্ঘদিন পরে নিজের প্রিয় স্বামীর কণ্ঠ শুনে কোন সে অজানা কারণে দাদির কান্না হঠাৎ থেমে গেল। দাদির বুঝি খুব ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল তার স্বামীর কাছে।
———– আম্মা চলেন যাই।
একরম টেনে টেনে দাদিকে নিয়ে গেলো বিয়ের মঞ্চের পেছনে অর্থাৎ কাচারি ঘরের পেছনের মহিলা মহলের মাঝে। কুপির আলোতে দাদির পোড় খাওয়া মুখটায় নাকি দুঃখগুলো রূপার মতো চকচক করছিল।
আধো আলো আধো অন্ধকারে গাঁয়ের উৎসুক অগুনতি মহিলাদের ভিড়ে দাদি বসে আছেন। এর চেয়ে মনে হয় ফাঁসির মঞ্চে উঠাও ভালো ছিলো তার জন্য।দাদির বুকের মধ্যে ভয়ঙ্কর এক অশান্ত ঝড়।কিন্তু মুখে কথা নেই। যেন জীবন আছে কিন্তু প্রাণ নেই এমন একটা অবস্থা!
কাচারিতে কাজি সাহেব, দাদা, দাদির ছেলেরা, নাতিরা ও গ্রামের গণ্যমান্য লোকজনের সমাগম হয়েছে। নানান জানের নানান কথায় গম গম করছে কাচারি ঘরের টিনের চালা। সকলকে সাক্ষী রেখে এই বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। নইলে সমাজের এই সকল ভণ্ডমহাজনদের সুবিধার জন্য বানানো তথাকথিত পরকাল নষ্ট হবে।
বাড়ির কাজের লোকটা আজ বিয়ের পাত্র। কাচারি ঘরে রাখা হ্যাজাক লাইটের আলোতে তার মুখটা অনেকটা কুরবানির গরুর মুখের মতো লাগছে। নিজের কোনো মত নেই, পথ নেই। কুরবানির সময় হুজুরের হাতে যেমন লম্বা ধারালো ছুরি থাকে। সামনে থাকে গরুটা। গরুটাকে বেশ কয়েকজন শক্ত সামর্থ লোক দড়ি দিয়ে বেঁধে চেপে ধরে রাখে। গরুর মাথাটা মাটির সাথে চেপে ধরে ঘাড়টা টান করে ধরে।যাতে গরু নড়াচড়া করতে না পারে।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে এখনই কুরবানির জন্য জবাই হবে গরুটা। সব জেনে বুঝে বা না বুঝে কুরবানির গরুর চোখ মুখের অভিব্যক্তি কুরবানির আগের মুহূর্তে যেমন হয়। এখন এই বিবাহের পাত্রের মুখের অবস্থাও অনেকটা তেমন। সব মেনে নেয়ার সহজাত পরিস্থিতি। চোখে মুখে একটা নিরব অসহায়ত্ব ছাড়া আর কিছু করার নেই।

অতিরিক্ত দারিদ্রতার কারণে এই গাবুর মানুষটা বিয়ে করতে পারেনি। বয়স এখন পঞ্চাশ পেরিয়েছে তার।আগেকার সময়ে মানুষ পেটে ভাতে কাজ করত মহাজন ও বিত্তশালীদের বাড়িতে। কেউ আবার ওই সময়টাকে বর্তমান সময়ে টেনে এনে অস্থির হবেন না প্লিজ।
প্রথম বিয়ে বলে কথা। কত কত রঙিন স্বপ্ন মনে নিয়ে বিয়ের কবুল বলে সকলে। কিন্তু বাড়ির মালিকের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সাথে তার শর্ত সাপেক্ষে বিয়ে মানে তো একরকমের জীবন মান বলি হচ্ছে তার। এটা পুরোপুরি নিশ্চিত বলেই তার এমন কঠিন হাল।
হঠাৎ কাচারির সকল গুঞ্জন ছাপিয়ে কাজি সাহেব উচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগলেন।
_______মরহুম অমুকের ছেলে তমুকের সাথে। মরহুম তমুকের মেয়ে অমুকের এতো টাকা দেন মোহর বাবদ বিবাহ সম্পন্ন হচ্ছে। বল কবুল।

বিয়ের পাত্র চুপ। ডরে ভয়ে তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
এখানে একটা কথা আমি ইলোরা রাশেদ আবারও বলে রাখছি।তা হলো এই ঘটনা বর্তমান সময়ের না। তাই তিন তালাক বা তালাকের সঠিক নিয়ম কানুন ও সিদ্ধান্ত নিয়ে অযথা তর্কে আসবেন না। আর হিল্লা বিয়ে নিয়েও তর্কে আসবেন না প্লিজ। কারণ আমি এখানে নিজের কোনো ফতোয়া বা মতামত দিচ্ছি না। একটা সময় ক্ষমতা ও ধর্মকে ব্যবহার করে বহু পুরুষ, সমাজ ও সমাজপতিরা নারীদেরকে ব্যবহার করেছে। অপমান করেছে। সমাজচ্যুত করেছে।পাথর ও দোররা মেয়েছে। ঘটনাগুলো খুব দূরের কথা নয়। তর্ক না করে একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন।পেয়ে যাবেন নিকটবর্তী অতীতেও এমন বহু নিপীড়নের দলিল। এখনও আমাদের সমাজে বেলাল্লাপনার নাম করে, ইজ্জত ও সম্মানের ভয় দেখিয়ে বহু নারীকে ও নারীর প্রতিভা বিকাশকে দমিয়ে রাখছে কিছু মানুষ ও কিছু পরিবার। নারীকে বিয়ের প্রলভন দেখিয়ে শরীর ভোগ করে মেরেও ফেলছে অনেকেই। আর এসব চোখের সামনে দেখেও আমরা কিছু জ্ঞানীরা খুনীর দোষ ভুলে গিয়ে মেয়েটির দিকে আঙুল উঠিয়ে বলে থাকি। বেশি লোভ করতে গিয়েছিল বুঝলেন। বড়লোক হতে গিয়েছিল। উচিত বিচার হয়েছে। আচ্ছা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো এই দলে কে কে নেই আমরা!
আর বলুন তো!
কারা তারা!
যারা এখনও টাকা, ক্ষমতা ও পৌরুষত্বের জোরে নারীকে পণ্য বানিয়ে ব্যবহার করছে!

আপনারা এখন বলবেন সবাই তো আর এমন খারাপ মানুষ না। আমরা বেশির ভাগ মানুষ দ্বীনদার ও আল্লাহ ভক্ত এবং ভালো মানুষ আলহামদুলিল্লাহ। বলবেন আসলে সমাজে তো এখন আর কোনো অধর্ম নেই। নেই অনিয়ম। তালাক এখন বৈধ প্রক্রিয়ায় নিয়ম মেনে হয়। বিবাহ এবং পুনর্বিবাহ সব সঠিক নিয়ম মতোই হয়।গ্রাম্য সালিশ ও বিচারিক আইনের নতুন সংশোধনী সঠিক আইন অনুযায়ীই হয়েছে।
নারীকে এখন আর কোনোরূপ জুলুম করা হয় না। নারীদের মতামতের ও সিদ্ধান্তের গুরুত্ব রয়েছে পরিবারে ও সর্বত্র। সব মেয়েরা এখন নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী নিজের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করতে পারে। নারী এখন পূর্ণ স্বাধীন আর পূর্ণ মানুষ হয়েই বেঁচে আছে।

যদি তাই হয়! তাহলে কেন এখনও এই উত্তর আধুনিক যুগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পুরুষ শিক্ষকের নির্যাতনে তার শিক্ষক স্ত্রীর দু’টো চোখ হারাতে হল!
এখনও কেন শুধু সন্দেহের বসে নৃত্যকলা বিভাগের মেধাবী ছাত্রীকে তার স্বামী খুন করে। এখনও কেন চাকরিজীবী নারীদের চরিত্র নিয়ে টানাটানি করে অধিকাংশ পুরুষ ও পরিবার! এখনও রোজ রোজ সংবাদ শিরোনামে থাকছে নারী নির্যাতনের নির্মম ঘটনাগুলো।
যদি সত্যি সত্যি নিরাপদ হয়ে থাকে সকল পুরুষরা নারীদের জন্য। তাহলে এখনও কেন শিশু, তরুণী, বৃদ্ধা রমনীগণকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়!
তারপরও যদি বলেন আমার ভুল হচ্ছে কোথাও।তাহলে বলব এই যে আমি ইলোরাকে কেন শুধুমাত্র কাপড়ের ডিজাইন করে অনলাইনে প্রকাশের কারণে কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ সরকার কতৃক সম্মাননা পেলাম বলে, প্রচার হলো বলে। আমার স্বামী আমার হাত ভেঙে দিয়ে চায়। আমার গায়ে হাত তোলে!
কেন এই লেখার পোস্টে হাজারও নারীদের হাহাকারের কমেন্ট। কেন তাদের নির্যাতিত হওয়ার কথা তারা অকপটে বলছে কেউ কেউ!কেউ আবার চেপে রেখে গুমরে কাঁদছে!
কে বা কারা আমাদেরকে ও তাদেরকে নির্যাতন করছে শারীরিক ও মানসিক!
কারা তারা!
একবার ভাবুন তো!
এখানে আমি আমার জীবনের কথা আপনাদেরকে বলে বলে আপনাদের কাছ থেকে শুধু সিমপ্যাথি পেয়ে কী হবে আমার! সিমপ্যাথি দিয়ে জীবন চলবে না।বাহবা দিয়ে সমাধানে পৌঁছানো যাবে না। সঠিক সমাধান বলুন এবং চলুন তা কার্যকর করি।
চলুন আমরা আমাদের সকলের মননে ও মস্তিষ্কে পরিবর্তন আনি। আসুন নারীকে সকলে মানুষ মনে করি। সত্যিকারের সম্মান করি এটা পুরুষ নারী সকলেই করি আসুন। অধিকাংশ পুরুষ এখনও নারীদেরকে নানান বাহানায় এবং ধর্মের অপব্যবহারে যেভাবে অধিনস্ত করে রাখছেন, হেনস্থা করছেন। এবং এভাবে সুবিধা নিচ্ছেন। তার বিহিত ভাবুন।

আসলে এসব আর কত বলব।চলুন মূল ঘটনায় যাই। সমাজ ও সভ্যতায় নারীর অবস্থানগুলো একটু দেখি সেই অতীত থেকে বর্তমান।

দাদির হিল্লা বিয়ে চলছে। পাত্র কবুল না বলায় হুজুর আবারও বললেন।
——-কই!
বল কবুল।
দাদা লোকটিকে নিজের হাতের লাঠিটা দিয়ে একটা গুতা দিলেন। সাথে সাথে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে লোকটি ভয়ার্ত আর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল।
______কবুল
এভাবে তিনবার কবুল পড়ানোর পরে হুজুর তার গলার আওয়াজ আরও একটু উঁচু করে বললেন।
——বাহিরে বসে আছেন অমুক মা। আপনার সাথে মরহুম অমুকের ছেলে তমুকের সঙ্গে আপনি তমুকের মেয়ে অমুকের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হলো।বলুন কবুল।
কোথায় মা জননী!
বলুন কবুল।
দাদির কানে সব কথাই পৌঁছাল। কিন্তু দাদি কিছুই বলছেন না। দাদির চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে।
কাজি সাহেব বারংবার কবুল বলতে বলার পরেও দাদি কবুল বলে না। কাচারি ঘর ও কাচারি ঘরের বাইরে লোকজনের কথার সোরগোল বেড়ে যায়।
গমগমে গলায় কাচারি ঘর থেকে দাদার গলায় বিরক্তির ডাক।
———–বড়ো বউমা!
তোমার শাওড়িরে কবুল বলাও। কী হলো! তাড়াতাড়ি করো।
——— আম্মা কবুল বলেন। ও আম্মা কবুল বলেন।
দাদি কোনো শব্দ করে না। আসেপাশের মহিলারাদের গুনগুন বেড়ে যায়। কাজি সাহেব আর বড়ো ছেলের বউয়ের কবুল কবুল শব্দের মধ্যে থেকে হঠাৎ গাঁয়ের এক মুরব্বি মহিলা নিজের শরীরের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল। কবুল কইছে, কবুল কইছে।
ঘরে বাইরে সকলে সমস্বরে গুঞ্জরন করে দাোয়া ও মোনাজাত শেষ করল।
কাজি সাহেব সকলকে বললেন।
———-এবার তোমরা সকলে যে যার বাড়ি যাও।
কিন্তু প্রায় সকলেই নড়েচড়ে এ ওর মুখের দিকে চেয়ে আগের অবস্থানে দাঁড়িয়ে এবং বসে রইল।
আসলে এমন বিবাহের পরে সকলে নতুন বিবাহিতদেরকে একসাথে একঘরে অবস্থান করাটা নিশ্চিত করেই যাবে মনে হচ্ছে। কারণ এরকম হিল্লা বিয়ের ভুল প্রয়োগ ও অপব্যাখা করে এক সময় সমাজের মধ্যে গোপনে গোপনে সমাজপতি, কাজি ও এরকম বিবাহের পাত্রকে টাকা দিয়ে বা ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে চুক্তি ভিত্তিক হিল্লা বিয়ে করানো হতো। এইসকল ভুল মতবাদের বিয়ে মাত্র এক রাতের জন্য করানো হতো অধিকাংশ সময়।

দাদির হিল্লা বিয়েটা সম্পন্ন হওয়ার পরে অধিকাংশ মানুষ কিছুটা ক্লান্ত হয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে একরকম বাধ্য হলো। কাজি সাহেব ও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ থেকে গেলেন। কারণ তারা রাতটা এই বাড়িতে উপস্থিত থেকে উক্ত বিবাহের পরবর্তী কার্যবিধি সম্পন্ন করবেন। যদিও এভাবে চুক্তি ভিত্তিক হিল্লা বিয়ের এই প্রক্রিয়াটা সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। তবুও নিজেদের মনগড়া ফতোয়া দিয়ে কাজটি করে নিলেন কতিপয় গণ্যমান্য ব্যক্তি।

কাচারি ঘরের পেছন থেকে বড়ো ছেলের বউ দাদিকে নিয়ে পাশের একটা ঘরে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পরে কাজি সাহেব দাদির বিবাহিত নতুন স্বামীকে নিয়ে ঘরের দরজায় এলেন।
এবং মা মা বলে দাদিকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে আবারও কাচারি ঘরে চলে গেলেন।
ছেলের বউয়ের হাতটা দাদি শক্ত করে ধরে রাখলেন। দু’জনই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন।
ঘরের বাইরে থেকে আবারও দাদার হাঁক।
———–বড়ো বউমা! তাড়াতাড়ি বাইরে আসো। কাচারি ঘরে মেহমানগো খাওন দেও।
——— আইতাছি আব্বাজান।

বলেই শরীরের সকল শক্তি দিয়ে শ্বাশুড়ির হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল বড়ো বউমা।

ঘরের দরজা তখনও খোলা। টিমটিম করে একটা কুপির আলো জ্বলছে ঘরের দরজার এক কোনে। নিচু গলায় কেউ একজন দাদির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গাবুর লোকটাকে কানে কানে বলল।
————- শালার পুত। তুই হইলি একজন গাবুর। তুই হারাডা রাইত ওই যে ছালা বিছানো আছে ওইহানে হুইয়া থাকবি। চাচী জানের ধারে কাছেও যাবি না। ফজরের আযানের পরে গিয়া নাইয়া ধুইয়া কাজি সাবের লগে নমাজ পড়বি। আর হুন।কাজি সাব যা যা জিগগাইব তোরে। এইডা করছসনি! ওইডা করছসনি। কবি হ করছি।হ করছি।
যদি রাইতে চাচীর ধারে কাছেও যাস।বা কাজি সাবরে কিছু উল্টা পালটা কইছস।
তাইলে কিন্তু তিনদিন পড়ে তোরে জবাই কইরা তিন টুকরা কইরা ওই ছালার মইধ্যে ভইরা গাঙে ভাসাই দিমু। এইডা দাদার হুকুম। যা অহন ভিতরে গিয়া ঘুমা।

গাবুর লোকটি মাথা নেড়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল। দাদি কাঁদছে খুব ক্ষীণ স্বরে। রাতে তার খাওয়াও হয়নি। এখন খুব ক্ষুধা পাচ্ছে। এতো দুঃখ আর অপমানে নিশ্চয়ই ক্ষুধা পাবার কথা নয়। তবুও পরিস্থিতির ভয় থেকে মনে হয় ক্ষুধাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো দাদির। পেটের মধ্যে খুব গোলাচ্ছিলো তার! দাদির বুকের মধ্যে ভয়ানক হাতুড়ি পেটাচ্ছে নানান রকম শঙ্কা ভয়ে! দাদি শুধু ভাবছে বাড়ির গোয়াল ঘরে কাজ করা নিজের চোখের সামনে বড়ো হওয়া ছেলেটা এখন তার হিল্লা বিয়ের স্বামী। হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ একজন দরজাটা বন্ধ করে দিল। দরজার পাশের কোনায় থাকা কুপির আলোটা দপ করে নিভে গেল দরজার বাতাসে।
সাথে সাথে ভয়ে দাদির মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল। আর দাদি গরগর করে বমি করে দিল।

(চলবে)

উপন্যাসঃ ঘাসেদের ফাগুন পর্ব- ৪
_____________🖌️নাজনীন নাহার
১০.০৩.২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here