ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১৬
_________🖌️নাজনীন নাহার
০৩.০৪.২০২২
আমার স্বামী রাশেদ যখন কলিং বেলের শব্দ শুনে ওর নতুন প্রেমিকা মিমির জন্য দরজা খুলতে প্রায় দৌড়ে যাচ্ছিল।আমি তখন আমার শরীরের সমস্ত শক্তি একাত্ম করে ওর ডান হাতটা ধরে ফেললাম। বললাম।
——–তুমি কোথায় যাও?
—-কলিং বেল বাজল। দেখি কে এলো!
—–দেখতে হবে না।
—কেন?
—–কারণ আছে। আগে তুমি স্থীর হয়ে এখানে বসো।
—-ওই তো আবারও বেল বাজছে।আমি খুলে দিয়ে আসি।
—–না খুলতে হবে না।
—–ইলোরা তুমি এমন করছ কেন! ওই দেখ আবারও বেল বাজছে।
—-বাজুক। আগে তুমি বসো।
এবার আমি আমার কণ্ঠটা কিছুটা দৃঢ় করলাম। জীবনের কিছু কিছু মুহূর্তে কণ্ঠ, বোধ, শব্দ ও সিদ্ধান্তে নারী পুরুষ উভয়কেই দৃঢ় হওয়া খুব জরুরি বলে আমার মনে হয়েছে। স্বামী কিছু অন্যায় ও অন্যায্য করবে তার স্ত্রীর সাথে। আর সেই কারণে বাচ্চা ফেলে বা বাচ্চা নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে স্ত্রীকে বা মা’কে। এটা কোনো সমাধান নয়।আবার স্ত্রী কিছু অন্যায় ও অন্যায্য করবে তার স্বামীর সাথে আর সাথে সাথে তাকে সন্তান রেখে বা সন্তান সহ ঘর থেকে বের করে দিতে হবে বা বেরিয়ে যেতে বলতে হবে এটাও সমাধান নয়। সমাধান ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে, আলোচনা করে ও যৌক্তিক ভাবে আদায় করে নিতে হবে। আর এরপরও যদি সমাধান সম্ভব না আসে তখন তো আইন আছেই সমাধানের জন্য। তাই আমি এই বোধকে উপলব্ধি করে রাশেদকে বললাম।
—তুমি এখানে বসো। আমি দেখে আসছি।
—-আরে তুমি যাবে কেন? যদি কোনো পুরুষ মানুষ হয়! আমি দেখে আসি।
—-আর যদি কোনো বেপর্দা মেয়ে হয় তাহলে!
রাশেদের মুখটা একটু কাচুমাচু হয়ে গেল। আমি এবার বললাম।
—–তুমি বসো।আজকে একদম উঠবে না। আমি দেখে আসছি। আমি জিজ্ঞেস করেই দরজা খুলব। পুরুষ হলে চলে আসব। তুমি চিন্তা করো না।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম মিমির অস্থির কণ্ঠস্বর। সে বিরবির করে আরও একবার বেলটা চেপে সেন্ডেলের হিলের শব্দ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। আমি ফিরে এসে রাশেদের মুখোমুখি বসলাম। রাশেদের মুড অফ।
—– মিলি এসেছিল। আমি দরজা খুলিনি।
রাশেদ আজ কিছু বলার সাহস পেল না চুপ করে রইল।
—-রাশেদ একটা বিষয় আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।
—-কী বিষয়?
—মিলির বিষয়। আমি খেয়াল করলাম মিলি যখনই খুব সাজুগুজু করে বাইরে যায়।আর রাত করে বা বিকেল সন্ধ্যা যখনই ফিরে আসে।সে আমাদের বাসায় দেখা দিয়ে যায়।নরমাল যখন বের হয় তখন কিন্তু সে সবসময় আসে না।কিন্তু শাড়ি পরলে বা খোলামেলা ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরলে সে অবশ্যই যেতে আসতে দু’বার আমাদের ঘরে আসে।
—–ও তো ইফতির জন্য পাগল। ভীষণ ভালোবাসে আমাদের ইফতিকে।
—-আমি ওর ন্যাকামির বিষয়টি পছন্দ করছি না রাশেদ। সে যখন খুশি যে কোনো খোলামেলা পোশাকে চলে আসে। তুমি যে একটা পুরুষ মানুষ আর তাছাড়া তুমি যে এগুলো পছন্দ করো না।এরপরও মিমির বেলাল্লাপনা বেড়েই যাচ্ছে। আসলে আমি চাই না এরপর থেকে তুমি মিলির জন্য দরজা খুলো। আমি চাই না মিলি আর যখন তখন আমার বাসায় আসুক। আমি চাই না তুমি আর কখনোই মিলির সাথে কথা বলো।
–আরে সামনে পরে গেলে কথা তো বলতেই হবে। এটা আর এমন কী!
—মিলির পোশাক, চলাফেরা আর সবকিছুই আমার অপছন্দ। তোমারও তো অপছন্দ। মেয়েটা দিনদিন আরও বেশি উশৃংখল হচ্ছে তুমি খেয়াল করোনি!
—–ঠিক আছে তুমি মিলিকে বলে দিও। বলে দিও আর যেন আমাদের বাসায় না আসে।
—–আমাদের কারোরই বলে দিতে হবে না। আমরা আমাদের আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেব।ওর এসব বেলাল্লাপনা আমরা পছন্দ করি না।
—কেন! সরাসরি বলবা। তুমি ওদের সাথে মুখে মুখে ভালোও থাকতে চাইবা।আবার ভেতরে ভেতরে কাহিনিও করবা!
— তার মানে কী রাশেদ! তুমি আমার উপর এতো বিরক্ত হচ্ছ কেন!
—-বিরক্ত হচ্ছি কোথায়! হঠাৎ তোমার মধ্যে কী এমন ঘটল যে তুমি ওদের সাথে এমন শুরু করলে।
—-কারণ আছে।
–কী কারণ!
—কারণ মিলি তোমার সাথে দেখা করার জন্য আমার বাসায় আসে। তোমাকে তার সাজ পোশাক দেখানোর জন্য আমাদের বাসায় আসে।
—–এগুলো তুমি অযথাই আজেবাজে চিন্তা করছ ইলোরা। আমাকে দেখাতে আসবে কেন!
—তাহলে আর সমস্যা কী! আমরা কৌশলে ওদেরকে এড়িয়ে চলব। ওরা তো আর আমাদের পরিবারের কোনো আত্মীয় পরিজন না।
রাশেদ তুমি আর ওর সাথে কথা বলবা না। প্রথম দিকে যেমন থাকতে সে রকম থাকবে তুমি।
— এটা কেমন কথা ইলোরা! আমি কথা না বললে ওরা কী মনে করবে!
—-ওরা কী মনে করল বা না করল তাতে আমাদের কী! আমি তো ভাবছি ওদেরকে আমি বলে দেব যে। আমার হাসবেন্ড তোমাদের এমন খোলামেলা পোশাক পছন্দ করে না।
রাশেদ এক রকম রেগে আমার সামনে থেকে উঠে গেল। মনে হলো সে সহ্য করতে পারছে না। আবার আমাকেও কিছু বলতে পারছে না।কারণ আমি তো এখনও রাশেদকে কিছু বলিনি। মেয়েটির দোষটাই দেখাচ্ছি বারবার।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। রাশেদ আমার সাথে কেমন মুড অফ করে থাকল সারাটা সময়। মনে হচ্ছে আমি তার ভাতের থালায় ছাই দিয়ে দিয়েছি। আমার একদিকে রাশেদের আচরণে ভীষণ জেদ লাগছিল। আবার কিছুটা শান্তিও লাগছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর এই ঘা বাড়তে দেব না।বহু বেড়েছে আর না।
বাসায় কেমন একটা শীতল আবহাওয়া আমার আর আমার স্বামীর মধ্যে চলছে।
রাত সাড়ে এগারোটায় আবারও কলিং বেলের শব্দ। রাশেদ কেমন উসখুস করছিল। আমি উঠে দরজার কাছে গেলাম। একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। দু’বার কলিং বেল চেপে নিজেদের বাসায় ঢুকে গেল মিলি। রাশেদ বেডরুম থেকে ডাইনিং এ এসে পানি খাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর খুব অস্থির লাগছে।
আমার ভয়ঙ্কর কষ্ট হচ্ছিল। এই আমার স্বামী রাশেদ! এই আমার জন্য তার ভালোবাসা! এভাবে অন্য নারীর কাছ থেকে জোর করে স্বামীকে টেনে এনে কী লাভ! কী শান্তি পাবো আমি! এই মানুষটার হাতের স্পর্শ কী আর আগের মতো প্রেমোময় লাগবে আমার! আর কী ইহজীবনে আমি রাশেদকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারব! আমার ছেলেটা ঘুমাচ্ছে।ওর পাশে শুয়ে আমি ইফতিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে নিরবে খুব কাঁদলাম। রাশেদ আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে রইল সারারাত। হয়তো তার প্রিয়তমার মুখখানি দেখেছে ঘুম স্বপ্নে কিংবা খোলা চোখে। আর আমি তার বিবাহিত স্ত্রী হয়ে আছি মহাশত্রু হয়ে।
পরের দিন ভোর বেলা পত্রিকা নেয়ার নাম করে রাশেদ বার বার দরজা খুলছে। আমার খুব বিরক্ত লাগছে। আমার ছেলেটা খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে যায়। তাই আমাকেও বেশ আরলি ঘুম থেকে উঠতে হয়। ছেলেকে কোলে নিয়ে ডাইনিং এ বসে ছিলাম। দেখছিলাম রাশেদের অস্থিরতা।
—- কী হলো! বারবার দরজা খুলছ কেন?
— আজ পেপার দিলো না এখনো।
—- এখনও তো সাতটা বাজেনি! সাতটার পরে রোজ পেপার দেয়। তুমি ভেতরে যাও।পেপার তো দরজার নিচে দিয়ে দিয়ে যায় ছেলেটা। পেপার আসলে আমি তোমাকে দিয়ে আসব।
বলতে না বলতেই মিমি ওদের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একটা লম্বা টিশার্টের আভরণে।
—- ভাইয়া আসলা মালাইকুম!
আধুনিক শিক্ষার সালাম।
—ওয়া আলাইকুম আসসালাম।
—ভাইয়া কালকে বাসায় ছিলেন না আপনারা !কতবার আমি কলিং বেল দিলাম।
বলেই রাশেদের গায়ের সাথে ঘষা দিয়ে ডাইনিং এ চলে এলো মিমি।আমি ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে তাদের তামাশা দেখছিলাম।আমার কোলে ইফতি।মিমি এসে ইফতিকে কোলে নিতে গেলে আমি থামিয়ে দিলাম।
—-বাবুকে এখনও ফ্রেশ করিনি। তুমি পরে আসো মিমি। তোমাকে দেখেও তো মনে হচ্ছে তুমিও ফ্রেশ হওনি।
—– আপা দেন না বাবুকে। আমি কালকে ওকে সারাদিন দেখতে পাইনি। সারারাত আমি ইফতির জন্য মনখারাপে ঘুমাতে পারিনি।
বলেই আর চোখে রাশেদের দিকে তাকাল। রাশেদ এসে ডাইনিং এর চেয়ার টেনে বসল।
—-মিমি তুমি এখন বাসায় যাও বোন। আমাদের একটু কাজ আছে।
মিমি রাশেদের দিকে তাকাচ্ছে। রাশেদ আমার দিকে তাকাচ্ছে। মিমি একটু বিরক্ত হয়ে চলে গেল।আমি দরজাটা বন্ধ করে বেড রুমে যেতেই রাশেদ আমার কাছে জবাবদিহি চাইতে চলে এলো।
—- ইলোরা তুমি মিমিকে অপমান করলে কেন!
—- মানে!
–মানে কী বুঝো না!
—-না বুঝি না। বলো তো রাশেদ মিমি কে? এতো মিমি মিমি করছ কেন! শোনো রাশেদ আমি ভেবেছিলাম সমঝদারকে লিয়ে ইশারাই কাফি।এখন দেখছি না।তুমি বুঝেও না বুঝার ভান করছ।
—কী বলতে চাও তুমি?
—তুমি রাতে ফিরলে নিরিবিলি বসে কথা বলি আমরা।
—-না এখনই বলো। আমি এখনই শুনব।
—-আমি তোমাকে আমার দেখা কিছু সত্য বলব। তুমি সেই সত্যগুলো নিতে পারবে তো রাশেদ!
— নাটক রাখো! তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠী কী নাটক করত! গতকাল থেকেই যা নাটক বাজি শুরু করছ তুমি।
—– এই তো শুরু করার আগেই ক্ষেপে যাচ্ছ। আমি বলব কীভাবে! আর আবারও তুমি কিন্তু আমার চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে টানাটানি করছ। এটা বন্ধ করো। নয়তো আমিও তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে আসব ভাই!
আমার দহনগুলো তীব্র হলে আমি রাশেদকে কথায় কথায় ভাই বলে ফেলি।
—থাক আর আমার চৌদ্দ গোষ্ঠী আনতে হবে না। কী বলতে চাও বলো আমি শুনি।শুনে ধন্য হই। যা শুরু করেছ তুমি!
বাসার মেয়েটাকে ডেকে আমার ছেলেকে ওর সাথে ড্রইং রুমে পাঠিয়ে দিলাম খেলনা দিয়ে। আমার মনে হলো রাশেদ অনেক চিল্লা চিল্লি করতে পারে। সন্তানের কাছ থেকে বাবা-মায়ের ঔদ্ধত্তপূর্ণ আচরণ যতটা সম্ভব গোপন রাখা উচিত আমার মতে। বাবা-মায়ের মন্দ স্বভাবের প্রভাব সন্তানদের উপর খুব খারাপ ভাবে পড়ে। আর এর ফলে সন্তানের মানসিক ও শারীরিক গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলাফল সন্তান ও পরিবারকে বহন করতে হয় জেনারেশন টু জেনারেশনও। আমি চাইলাম না আমাদের সম্পর্কের জটিলতাগুলো এতোটুকু বয়স থেকে আমার সন্তান দেখুক। আর হীনমন্যতায় ভুগে বড়ো হোক। আমার সন্তানের জন্যই আমার সবকিছু এখন। আমি এখন একজন মা।
তাই আমি বেড রুমের দরজাটা চাপিয়ে দিলাম। এবার আমি বসলাম খাটের একপাশে। গলা নরম করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম।
—- আমি তোমাকে গতকাল মিমির বিষয়ে যা যা বলেছি তা তোমাকে পালন করতে হবে রাশেদ।
—- পালন করতে হবে মানে! আজব কথা তো! প্রতিবেশীদের সাথে স্বাভাবিক একটা সম্পর্ককে তুমি অযথা জটিল করে ফেলছ। আমি এসব পালন করতে পারব না শুধু শুধু।
— কেন পারবে না বলো!
—- কারণ আমি এমন কিছু খারাপ করছি না। একজন প্রতিবেশির সাথে আরেকজন প্রতিবেশিদের ভালো রিলেশন হতেই পারে।এতে দোষের কী! আর রিলেশনটা করেছ তুমি। আমিও তো তোমাকে একসময় নিষেধ করেছিলাম।কৈ তখন তো তুমি আমার নিষেধ শোনোনি।
— তখন আমি বিষয়টি স্বাভাবিক মনে করেছিলাম। মা মেয়েদের সাথে আমি মেয়ের সম্পর্ক। সেখানে তো দোষের কিছু ছিল না।কিন্তু এখন দোষের হচ্ছে। কারণ মিমি যেমন তোমার সাথে রং ঢং করে আনন্দ পায়।তুমিও ওর রং ঢং দেখে আনন্দ পাও।
—- মুখ সামলে কথা বলো ইলোরা।
— কেন! তুমিই তো বললা আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে। তাই আমি আমার কষ্টটা ও অনুভূতিটা তোমাকে জানাচ্ছি। রাশেদ আমি সত্যি সত্যি তোমার আচরণে ভয়াবহ কষ্ট পাচ্ছি। ইদানীং লক্ষ্য করছি মিমি কলিং বেল চাপলেই তুমি বাথরুম ও বারান্দা থেকে দরজা খোলার জন্য দৌড়ে চলে যাও। তুমি এই মেয়েকে একদিন বাজে মেয়ে বলেছ। আমার মেলামেশায়ও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছ। ওদের খোলামেলা পোশাক অপছন্দ করতে। ওদেরকে নিয়ে কত কত বাজে কথা বলেছ। আর আজকে তুমি ওর সাথে ঢলে ঢলে কথা বলো। ওর পছন্দের খবর তুমি রাখো। ও তোমার গায়ের উপর ঢলে ঢলে পড়ে। তুমি যে ওর প্রতি আসক্ত হয়ে গেছ রাশেদ।এটা মিমিও বুঝতে পেরেছে।
আমি বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম।
—রাশেদ আমাকে তোমার এখন আর ভালো লাগে না। সত্যি যদি আমাকে তোমার ভালো না লাগে তাহলে আমাকে তুমি বলে দাও। আমি চলে যাব আমার ছেলেকে নিয়ে। কিন্তু আমি তোমাদের এইসব আচরণ আর মেনে নিতে পারব না। এইসব করে তুমি রীতিমতো আমাকে অপমান করছ। আমি আজকেই চলে যাব ইফতিকে নিয়ে। তুমি তোমার সংসারে মিমিকে নিয়ে থাকো।
সাথে সাথে রাশেদ আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল।
—– পাগলি বউটা আমার। তুমি অযথাই আমাকে ভুল বুঝেছ। দূর! আমি এইসবের মধ্যে নাই। তুমি যে মনে মনে এতোকিছু ভেবে নিয়েছ।তা সম্পুর্ণ ভুল। আর কেঁদো না তুমি সোনা বউ।
এই আমি তোমাকে কথা দিলাম।আমি আর মিমির সাথে কথা বলব না। আর কখনোই দরজা খুলতে যাব না। আমার পাগলিটা। উঠো মুখ ধুয়ে আসো। ক্ষুধা লেগেছে। চলো নাস্তা করতে হবে।
আমার তখন মনে হলো আলহামদুলিল্লা। যেহেতু রাশেদ সব অস্বীকার করল। তার মানে এখন ওকে একটু সাপোর্ট দেই, সম্মান দেই। যাতে করে ওর মনের মধ্যে যেটুকু মিমি আছে তাও আর না থাকে। আমাদের দাম্পত্য জীবন সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকে।
—-তুমি সত্যি বলছ রাশেদ এসব আমি ভুল ভেবেছি!আসলেই দেখো আমি তোমার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গেলাম। আমার এতো ভালো পরহেজগার দ্বীনদার স্বামীকে আমি ভুল বুঝলাম। ছিঃ আল্লাহ আমাকে গুনাহ্ দেবে। আমি সরি রাশেদ। আমাকে তুমি মাফ করে দাও। আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিন।
শোনো রাশেদ ওরা ভালো মেয়ে না। ওরা একদম বাজে মেয়ে। আমরা কৌশলে ওদেরকে এড়িয়ে চলব। আর এতো খাতির দরকার নাই আমার। আমি আমার স্বামী আর সন্তান নিয়ে শান্তিতে থাকতে চাই।
লাভ ইউ রাশেদ লাভ ইউ।
—– লাভ ইউ সোনা বউ লাভ ইউ।
এমন সময় আমার ছেলের কান্নার শব্দে আমরা দু’জনই হুড়মুড় করে দৌড়ে ড্রয়িং রুমে আসলাম। ছেলে সোফা ধরে হাঁটতে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে ব্যথা পেয়েছে একটু তাই কাঁদছে। ছেলেকে নিয়ে আমরা দু’জনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার কাছে মনে হলে আমি আমার রাশেদকে সবটুকু ফেরত পেয়েছি।
এরপর কয়েকদিন আমার আর রাশেদের খুব ভালো কাটলো দিনগুলো। রাশেদ আর দরজা খুলতে যায় না।বাসায়ও আগের চেয়ে কম থাকে।রাত করে বাড়ি ফিরে। কিন্তু সপ্তাহ খানেক পর থেকে রাশেদের মধ্যে আচরণে বেশ পরিবর্তন আসতে লাগল।কথায় কথায় আমার উপর বিরক্তি দেখায়। এটা ওটা নিয়ে আমাকে অযথা কথা শোনায়। সব মিলিয়ে আমার আবারও কেমন অস্থির লাগতে লাগল।
একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে তোমার রাশেদ!
—– কী হবে আবার!
—- তুমি আমার সাথে এমন আচরণ করছ কেন!
—-কী আচরণ করছি! তুমি আমার সাথে যা করেছ।তারপরও আমি তোমার সাথে যথেষ্ট ভালো আচরণ করছি।
—- আমি আবার কী করলাম তোমার সাথে!
— কী করতে বাকি রেখেছ! তুমি আমার চরিত্রে দাগ লাগিয়েছ। আমার নামে মিথ্যে অভিযোগ করেছ। আমি মিমির সাথে কিছুই করিনি।অথচ তুমি আমাকে বাজে অভিযোগ করেছ।
—- রাশেদ আমি তোমার স্ত্রী। তোমাকে নিয়ে আমি যা যা দেখেছি। যা মনে হয়েছে তোমাদের আচরণ দেখে আমি তাই বলেছি। তোমার সাথে আলোচনা করেছি। আমার কষ্টগুলো শেয়ার করেছি।
তুমি অস্বীকার করেছ।আমি মেনে নিয়েছি। বলছি যদি তুমি এমন কিছু না করে থাকো তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। আমার তাহলে ভুল হয়েছে। সরি বলেছি। সেখানেই সব শেষ করেছি রাশেদ। আমরা দু’জন ঠিক আছি। আর তো এগুলো নিয়ে কোনো কথা বলার দরকার নাই।
—- দরকার নাই মানে! তোমার কতো বড়ো সাহস।তুমি আমাকে দোষারোপ করলা।মেয়ে ঘটিত বিষয়ে জড়াইলা আমাকে।আমি জীবনেও তোমাকে ক্ষমা করব না। আমি জীবনেও এই অপমানের এই আঘাত ভুলতে পারব না।
— তুমি তো এগুলো ওভাবে মনে করে করোনি।তাহলে তো তুমি নির্দোষ। আর কেন এগুলো টেনে আনছ!
—- আনব না মানে! আমি তোমার অপমান সারাজীবনেও ভুলব না। তুমি খুব খারাপ মহিলা। নিজে পিরিত করে বেড়াচ্ছ। তাই নিজের দোষ ঢাকার জন্য আজকে আমাকে দোষী বানিয়েছ। নিজের রাস্তা ক্লিয়ার করতে চাও তুমি। তাইতো আমার নামে বদনাম শুরু করছ! নিজে চরিত্রহীন হয়ে আবার আরেকজনের চরিত্র নিয়ে কথা বলো।
রাশেদের মুখে এমন বাজে কথাগুলো শুনে মনে হলো আমি যেন আসমান থেকে মাটিতে পড়লাম। ছিঃ আমি পিরিত করি! কী জঘন্য কথা! মানুষ এতো নিচ হয় কীভাবে!
রাশেদ তো আমার থেকে বয়সে মিনিমাম দশ বছরের বড়ো। তার মধ্যে তো অন্তত একটা ম্যাচুরিটি থাকা দরকার ছিল। তা না।সে আমাকে নিজের প্রতিপক্ষ ভেবে নিল!
আমাকে ছোট করে।আমাকে অপবাদ দিয়ে রাশেদ কী জিতে যাবে! ও কী ওর গায়ের জোরে, মুখের জোরে জিতে যেতে পারবে! আর মুখে মুখে আমাকে অযথা নোংরা কথা বলে জিতে গেলেই কী আমি ওকে মন থেকে সৎ চরিত্রের সার্টিফিকেট দিয়ে দেব! হায়রে পুরুষ মানুষ!
তোমরা তোমাদের আতে ঘা লাগলেই নারীর চরিত্র নিয়ে টানাহেঁচড়ার করো! আরে মিয়া তোমরা অধিকাংশ পুরুষ লুচ্চা পুরুষ। তোমরা লুচ্চারা কোনোদিন মানুষ হবা না।
আমার আর রাশেদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। আমি ওর সামনে থেকে সরে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আমাকে বলল।
—–কোথায় যাও! তোমার নগরের কাছে!
—- অনেক হয়েছে রাশেদ অযথা বাজে কথা বন্ধ করো। আমি কী তোমার মতো!অযথা ফালতু কথা বলে আমার সাথে মজা করতে এসো না!
—-মজা তো তুমি করো বারান্দায় বসে বসে। তুমি কী মনে করছ! আমি জানি না কিছু! তা কবে কখন যাবা তোমার নাগরের সাথে ঘর সংসার করতে !এই জন্যই তো সেদিন বললা। আমি বললেই তুমি চলে যাবে আমার জীবন থেকে। যাও যাও তোমার নাগরের কাছে যাও।
— কী জঘন্য তুমি রাশেদ! নিজের সংসার, দুই বেলা রান্না, বাচ্চা এসব নিয়ে বিজি থাকতে থাকতে শান্তিমতো একটু বসার সময় পাই না। আর আমি বারান্দায় যাব! ছিঃ রাশেদ! তুমি আর কতটা নিচে নামবা বলো!
—ও আচ্ছা! আজকে আমি উচিত কথা বললাম বলে এখন নিচ হয়ে গেলাম! তুমি যখন আমাকে বলছ তখন!
আমি বুঝতে পারলাম রাশেদ নিজের কলঙ্ক মুছতে চায়। আর নিজের কলঙ্ক মুছতে রাশেদ আমার নামে মিথ্যে অপবাদের ইরেজার তৈরি করে নিয়েছে মনে মনে। পুরুষ মানুষ সে। তাই যে কোনো উপায়ে তাকে জিততেই হবে। আমি নরম কণ্ঠেই আবারও বললাম।
—- আমি সত্যিটা বলেছি রাশেদ।দিনের পর দিন আমার চোখে দেখা ঘটনাগুলো বলেছি। আর তুমি মনগড়া ইতিহাস বলছ। যদি সত্যি সত্যি এমন কোনো পুরুষকে আমার সামনে এনে দাঁড় করাতে পারো।তাহলে আমি সেদিনই তোমার কাছে নাকে খত দিয়ে তোমার সংসার ছেড়ে চলে যাব।
—- বাঃ বেশ তো গুছিয়ে নিয়েছ।
— নিয়েছি বা নেব। বাট আর একটা কথাও বলবা না।প্রমাণ নিয়ে আমার সামনে আসবা রাশেদ। তার আগে জাস্ট স্টপ।
বলে আমি চলে যেতেই রাশেদ ডাইনিং এ গিয়ে একটা চেয়ার মাথার উপর তুলে ফ্লোরে আছাড় দিল। আমি শুধু ঘুরে একবার তাকালাম। দেখলাম গর্দানে বিষাক্ত বর্ষা বিঁধে যাওয়া ষাঁড়ের মতো ফোঁসফোঁস করছে রাশেদ।
আমি আর দাঁড়ালাম না। আমি নিজের কাজে চলে গেলাম। যদিও আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু আমি কাঁদলাম না। আমার শরীর, মন আর মাথাটা কেমন বিবশ লাগছিল। একটা বোধহীন মানুষ হয়ে যেতে লাগলাম আমি। শুধু আল্লাহকে বলতে লাগলাম আমাকে ধৈর্য আর শান্তি দিন আল্লাহ।
আমি উপলব্ধি করি আর ভাবি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কগুলো কতটা নাজুক! কোনো কারণে দু’জনার মধ্যে মতের অমিল হলে বা কোনো ঝামেলা হলে।একে অপরকে কতটা তুচ্ছ নগণ্য বানিয়ে ফেলি আমরা। অথচ আজীবন একসাথে থাকার ব্রতে খুব ভালোবেসে গত রাতে বা কিছুক্ষণ পূর্বেও কতটা নিকটবর্তী হই স্বামী স্ত্রী। থাকি ভীষণ আপনজন। মুহূর্তেই কতটা বিচ্ছিরি আর নোংরা কথায় আক্রমণ করে ফেলি একে অপরকে কত অবলীলায়! আহা কী ভয়ঙ্কর বাস্তব এই দাম্পত্য সম্পর্ক! ভালো থাকার চুড়ান্ত সম্পর্ক আবার মন্দ থাকারও চুড়ান্ত সম্পর্কে এই দাম্পত্য সম্পর্ক!
এভাবেই রাশেদের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে যেতে লাগল। নিজের ছেলেকেও আগের মতো আদর করে না রাশেদ। ইফতি সামান্য কিছু উল্টো পাল্টা করলে রাশেদ আমাকে কথা শোনায়। ছেলেকে ভালো কিছু শেখাতে পারছ না। ছেলে মানুষ করতে পারছ না ইত্যাদি।
ইফতির তখন দেড় বছর বয়স। একদিন সে জেদ করে হাত থেকে মেলামাইনের পানির গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। রাশেদ এসে ছেলেকে চিৎকার করে বলে উঠল। হচ্ছ তো মায়ের গোষ্ঠীর মতো বেয়াদব আর অসভ্য। এভাবেই ছেলের একটু উনিশ-বিশে আমাকে ও আমার বংশকে ছোট করে খোঁচা দিয়ে অপমান করে রাশেদ। আবার যখন তার মুড ভালো বা শরীর দরকার হবে তখন ভালোবাসায় ভরপুর হয়ে যায় সে। একদিন আমার ছেলেকে মানুষ করা নিয়ে রাশেদের বাজে কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি খুব নরম গলায় রাশেদকে বললাম।
—– রাশেদ শোনো! আমার ছেলে যত যত ভালো কাজ করবে সারাজীবন। সব তোমার আর তোমার বংশের কারণেই করবে। আর ও যত রকম মন্দ বা খারাপ কাজ ওর সারাজীবনে করবে সব আমার আর আমার বংশের কারণেই করবে। তাই তুমি অযথা বারবার এক কথা বলো না যে আমার গোষ্ঠীর মতো খারাপ হচ্ছে।আমি এটা মেনে নিয়েছি ভাই। তুমি আর তোমরা ভালো। আমি আর আমরা খারাপ। ব্যাস হলো তো। জানা কথা রোজ রোজ বলার কি আছে!
এভাবেই রাশেদ আর আমার দাম্পত্য জীবন চলছিল এক রকম রেষারেষিতে আর কম্প্রোমাইজে। আমি রাশেদের সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলি না। সারাদিন আমি আমার ঘরের কাজে আর বাচ্চাকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকি। রাশেদ হাসলে হাসি।রাশেদ শরীরে আসলে শরীর খেলে।ভালোভাবে কথা বললে ভালো। না বললে না।
বারকয়েক মনে হয়েছিল চুপচাপ রাশেদকে ছেড়ে চলে যাই। কোথায় যাব! আমার বাবা-মা আমাকে মেনে নেবে না।তাদের সম্মান হচ্ছে সন্তানের চেয়ে বড়ো। আমি লেখাপড়ার জন্যই বাবা-মায়ের সাপোর্ট পাইনি।সেখানে স্বামীর ঘর ছাড়ার জন্য তো পাবোই না। সন্তানকে ছেড়ে একা পথে নামলে আমি মা বাঁচতে পারব না।কারণ আমার সন্তান আমার জীবন হয়ে গেছে।
তারপর সন্তানের ভবিষ্যত। আমার ছেলেকে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছি।আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া আমার অংশ ইফতি। ওকে ভালোভাবে লেখাপড়া করাতে হবে। ডাক্তার হবে আমার ছেলে। শুধু পুরুষ নয়।একজন অনন্য মানুষ হবে আমার ছেলে।
নিজের সাথেই নিজে কথা বলি। আমি ছাড়া আমার তো আর কোনো বন্ধু নেই। আমার আল্লাহ আছে। আমার আমি আছি।আর আছে আমার পড়ার জন্য নানান বিষয়ের বই। নিজের সাথে আর আল্লাহর সাথে প্রচুর কথা বলি। নিজেকে গুছিয়ে রাখি।ভালো রাখার চেষ্টা করি। আর নারী জীবনের গল্পগুলো খুব মনোযোগে পড়ি বাস্তব দেখে দেখে। কেউ কেউ অনেক সাহসী। কেউ দূরদর্শী, কেউ ভীতু, কেউ রাগী, কেউ বোকা কেউ হেরে যাওয়া কেউ জিতে যাওয়া নারী। কখনও কখনও মনে হয় এর সবগুলোই আমি। কখনও কখনও মনে হয় আমি এর কিছুই না।
আমি ঠিক কেমন আছি কেমন থাকি আমি জানি না। আমি কেবল মেনে আর মানিয়ে নিয়ে চিরায়ত নারী জীবন কাটাই। আর মনে মন স্বপ্ন বুনি একদিন আমিও!
এভাবে আরও একটা বছর চলে গেল। মিমিরা এখনও আমাদের প্রতিবেশি। আগের মতো রং ঢং আমার স্বামীর সাথে না হলেও। একটা ভাব ও দৃষ্টি বিনিময় থেকেই গেছে। আমি আমার সন্তানের দিকে চেয়ে যতটা সম্ভব সহজ করে থাকার চেষ্টা করছি। এরমধ্যে মিমির বিয়ে হয়ে গেল। মিমি বিয়ে করে কানাডা চলে গেল। এর একমাস পরে রাশেদ হঠাৎ বাসা বদলের জন্য উঠে পরে লাগল। আমি কিছুই বললাম না। তবে এতোদিন একটা যায়গায় থিতু হওয়া আমির কিছু মন খারাপ হলো বাসাটা ছেড়ে যেতে। আমরা শহরের অন্য একটি এলাকায় চলে এলাম।
আমি দ্বিতীয়বার কন্সিভ করলাম। এবারও আমার পুত্র সন্তান হলো। দুই ছেলেকে নিয়ে আমার মহা ব্যস্ত জীবন। রাশেদের পছন্দের রান্না, ওর কাপড় ধুয়ে পরিপাটি করে রাখা। ঘরের বিভিন্ন যায়গায় ইনডোর প্লান্ট।বারান্দা জুড়ে মানিপ্লান্ট আর হরেক রকম ফুল ফলের গাছ। বাঁধা কাজের মানুষ কখনও পাই কখনও পাই না। ছুটা আর বাঁধা কাজের সহকারী মানুষের সহায়তা নিয়ে সংসার বাচ্চা বইপাড়ায় আমার ঘরে ব্যস্ত জীবন। আর টাকা ইনকাম, ব্যাবসা নিয়ে রাশেদের ঘরের বাইরে ব্যাস্ত জীবন।
বছরে একবার দু’বার অন্তত রাশেদের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাই। আমাদের বাড়ি সেভাবে যাওয়া হয় না আমার। আমার ছোট বোন নাদিরাকে আব্বা বিয়ে দিয়ে দিয়েছে এক স্থানীয় ব্যবসায়ী ছেলের সাথে। নাদিরা ক্লাস এইটে উঠেছিল। আমার অতটুকুন ছোট্ট বোনটা একটা পুরুষ মানুষের সংসার করে। মেয়েরা মনে হয় জন্মই নেয় পুরুষের শরীরের আর সংসারের জন্য। আমার মাঝে মাঝে খুব নাদিরার মতো হতে ইচ্ছে করে। কারণ আমার মন ও মগজে যত জিজ্ঞাসা যত বেদন, যত ভাবনা! নাদিরা সেই তুলনায় খুবই সহজ করে পৃথিবী দেখে। ওর নিশ্চয়ই কেনো মন ও মগজের ব্যথা নাই। আমিও ব্যথাহীন থাকতে চাই। কিন্তু পারি না।
মাঝে মাঝে রাশেদ খুবই ভালো মানুষ। আমাকে আদর মায়া ভালোবাসায় পৃথিবীর মাহাসুখী মানুষে পরিণত করে। আবার মাঝে মাঝে ওর কথা ও আচরণে আমার জন্য পৃথিবীর নরক বানিয়ে দেয় জীবন। তখন ছেলে দু’টোকে নিয়েও পালাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পালানো আর হয় না।
আমার বড়ো ছেলে ইফতির বয়স চার।ছোট ছেলে ইনতেজার রাশেদ ইনতির বয়স এক বছর। আমরা ঢাকা থেকে সব ভাশুর দেবররা গ্রামের বাড়ি কুরবানির ঈদ করতে গিয়েছি। সবাই মিলে বেশ ভালো সময় কাটছিল আমাদের। ছোট বাচ্চাদের সারাক্ষণ খেয়াল রাখা। এখন আর আমি আগের মতো আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির সেবা করতে পারি না।তবে চেষ্টা করি তাদের সুবিধা অসুবিধাগুলো জানতে। এবার বাড়ি এসে দেখি আমার শ্বশুর ও শ্বাশুড়ির রুমে কেসেট প্লেয়ারে ওয়াজ বাজে। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি প্রায় সারাদিনই ওয়াজ শোনে। আমার খুব ইচ্ছে হলো শ্বশুরকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি কেন তিনি এখন কেসেট প্লেয়ার বাজায়। তিনি তো একসময় কেসেট প্লেয়ারকে নাজায়েজ বলেছেন।তাহলে এখন জায়েজ হলো কেমন করে!
আমি ইলোরা প্রতিদিন অগুনতি অনিয়ম মেনে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে চলি। আবার আমি ইলোরা কিছু অনিয়মের দহনে খুব করে ভুগি। কখনও কখনও আমার মন, চিন্তা ও বিবেক আমাকে অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি করে। মানুষের কথায় ও কাজে মিল না পেলে আমার আত্মা বিচলিত হয়।হয় প্রতিবাদী।
আমি ইলোরা অনেক ভালো ছাত্রী হয়েও ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজালে জড়িয়ে উচ্চ শিক্ষা নিতে পারিনি। তুলনামূলক অল্প বয়সে বাবা বিয়ে দিয়ে দিলে সংসার ও স্বামী আঁকড়ে জীবন পাড় করে যাচ্ছি। আমার আল্লাহর কাছে খুব করে চেয়ে নিজের পেটে দু’টো ছেলে সন্তান পেয়েছি। আমি পৃথিবী বলতে আমার এইসএসসি অবধি পড়াশোনার অভিজ্ঞতায় যতটুকু পেরেছি পৃথিবী ও পৃথিবীর নিয়ম কানুন চিনেছি। নামাজ, কোরআন পড়া শিখেছি। একজন মুসলিম হিসেবে আল্লাহকে পুরোপুরি মান্য করি নামাজ কালাম পড়ি। হিজাব পরে চলি।আমি নিজের আগ্রহ থেকেই কোরআন ও হাদিসের কিছু বয়ান পড়ে পড়ে ইসলামের কিছু বিধিনিষেধ শিখেছি। কিছু বাবা-মা, শিক্ষক, শ্বশুর শ্বাশুড়ি, ভাশুর, ননদ ও দেবরদের কাছ থেকে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে শুনে শিখেছি। তাই আমি মানুষ ও অমানুষ বলতে আমার চোখে দেখা জানা মানুষগুলোকেই বুঝি। বুঝি তাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি দেখে দেখে।
আমি ধর্ম ও ধর্ম পালন বলতেও আমার পরিবারের মানুষগুলোর আচরণ ও জীবন প্রক্রিয়া বুঝি। বুঝি ধর্মের অপব্যবহারগুলোও।
ঈদের পরের দিন রাতে এশার নামাজের পরে আমার শ্বশুর তার রুমে বাড়ির সকল বউদেরকে ডেকে নিয়ে বসালেন কেসেট প্লেয়ারে ওয়াজ ও বয়ান শোনার জন্য। আমরা সবাই বেশ মনোযোগের সাথে ওয়াজ শুনতে বসেছি। একজন আলেম তার চমৎকার কণ্ঠে বয়ান শুরু করলেন।
আমার শ্বশুর আবারও আমাদের সকলকে বাতলে দিলেন। মনোযোগের সাথে কথাগুলো শোনো বউমা তোমরা। তোমাদের কাজে লাগবে। বয়ানগুলো শোনো আর পরকালের ভয় করো। আল্লাহর কথায় জীবন চালাও। তোমার শ্বাশুড়িকে তো রোজ শুনাই। শোনো ছয় প্রকার নারীরা কেন জাহান্নামে যাবে।
বুকের মধ্যে আৎকে উঠল! এই বয়ান আমি বাড়ি আসার পরে শুনেছি আমার শ্বশুরের রুমে বেশ কয়েকবার। এখানে তো এক ধরনের প্রহসন করা হয়েছে এই ওয়াজে। বারবার শুধু নারীর জাহান্নামে যাওয়ার কথা বলছেন বয়ানকারী হুজুর।কিন্তু ঐ একই কারণে তো পুরুষদেরও জাহান্নামে যাওয়ার কথা। অথচ হুজুর একবারও তা বলছেন না। এ কেমন ওয়াজ! আমার শ্বশুর এ আবার কোন ধরনের অধর্ম করবেন আমাদের সাথে ধর্মের নামে! আমার নারী মন খুব আতঙ্কিত হলো। না আমাকে অযথা কোনো অসত্য মানাতে পারবে না। আমি সত্যের জন্য যথার্থ প্রতিবাদ করবোই করব। মনটাকে দৃঢ় করলাম। আর আমি ও আমরা সবাই চুপচাপ বসে শুনতে লাগলাম।
বয়ান শুরু হলোঃ
হুজুর বলছেন,
ছয় প্রকার নারী জাহান্নামে যাবে এটি মুসলিম হাদিস ও রাসুলুল্লাহ সাঃ মেরাজ থেকে এসে বলেছেন যে ছয় প্রকার নারী জাহান্নামে যাবে।এক হলো যে নারী……..
(চলবে)