অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ২০

0
6329

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২০

নীলাদের আজ বাংলাদেশে ফিরবার দিন। কিন্তু ফ্লাইটের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা সৌন্দর্যে ঘেরা দার্জিলিয়ের আরও কিছু জায়গা ঘুরে দেখল।
সিঙ্গালিয়া ন্যাশনাল পার্ক, শরণার্থী কেন্দ্র তিব্বতিয়ান সেলফ হেল্প সেন্টার, আভা আর্ট গ্যালারি, শতবর্ষের প্রাচীন দিরদাহাম টেম্পল, গঙ্গামায়া পার্কসহ দার্জিলিং শহরের লাডেন-লা রোডের মার্কেটে তারা টুকটাক কেনাকাটা করল। এখানে শীতের পোশাক, হাতমোজা, কানটুপি, মাফলার, সোয়েটারসহ লেদার জ্যাকেট, নেপালি শাল এবং শাড়িসহ অ্যান্টিক্স ও গিফট আইটেম লেদার সু, সানগ্লাস ইত্যাদি পাওয়া যায়।
তাদের সবাইকে চমকে দিতে সাদিদ রাতের খাবারের সময় আরও একটি কথা বলে উঠেছিল। তারা যাবার সময় মিরিকও দর্শন করবে।
সেটাতে প্রবলেম ছিল না। কিন্তু একটা কথায় তানবীর-অর্ণব বারবার তুলেছিল যে, সময় কুলিয়ে উঠতে পারবে কি-না? কিন্তু সাদিদও এককথায় বলেছিল,

— ‘ দেখি না কতটুকু সম্ভব হয়। দার্জিলিং শহরটাই তো এমন। আমরা ১৫ দিনের ভ্রমণে আসলেও যাবার সময় মনে হবে সময়টা কম হয়েছিল। এককথায় দার্জিলিং ঘুরে দেখার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটা হচ্ছে সময়। কেননা এখানে এতএত দেখার জিনিস রয়েছে যে ঘুরে শেষ করা সময়সাপেক্ষ। তাই আমাদের এই অল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু ওদেরকে দেখাতে পারি ততটুকুই লাভ। ‘

সাদিদের এই কথার পর তারা আর দ্বিমত করেনি। তারাও তো আবারও একবার সৌন্দর্যে ঘেরা মিরিক দেখতে আগ্রহী। যেহেতু তাদের ফ্লাইট সন্ধ্যায় তাই তাড়াতাড়ি রউনা দিলে ঘুরে দেখা হয়ে যাবে। সবচেয়ে বেশি আগ্রহী তাদের সাথের বাকি তিনজন মেয়ে। তারা ইতিমধ্যে দার্জিলিয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছে। এখন আবার মিরিক। তাদের তো রীতিমতো খুশি প্রকাশে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা আনন্দে-উৎসাহে দিশেহারা।
কিন্তু দার্জিলিং শহরকে ছেড়ে আসার সময় নীলার চক্ষু অশ্রুজলে টইটম্বুর। সাদিদ তার অবস্থা দেখে তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। মাথায় চুমু দিয়ে বলল,

— ‘ পাখি, মন খারাপ করে না। আমরা আবারও দার্জিলিং আসব। তখন আরও বেশি সময় হাতে নিয়ে আসব। নতুন অনেক কিছু দেখতে পারবে। এখন আর মন খারাপ করে না। ‘
— ‘ ইচ্ছে করে করছি না। এমনিতেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ‘

সাদিদ নীলার কথায় হাসল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তার মনটা ভালো করার চেষ্টাতে লাগল। আসলেই দার্জিলিং জায়গাটাই এমন যে ছেড়ে যাবার সময় না চাইতেও মন খারাপ হতে বাধ্য।

দার্জিলিং থেকে মিরিকের দূরত্ব ৪৯ কিমি (৩০ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে। সাদিদরা মিরিকে এসে গাড়ি থেকে নামল। মিরিকের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে সুমেন্দু লেক। সাদিদরা সেখানে যাবে বিধায় পাশের হোটেলে রুম বুক করল। কেননা তারা একেবারে দার্জিলিয়ের হোটেল থেকে চেক আউট করে বেড়িয়ে গিয়েছে।
সাদিদরা এখানে বেশিক্ষণ থাকবে না। কিন্তু যতটুকু সময় আছে নিজেদের ব্যাগপত্রগুলো রাখার জন্যই মূলত হোটেল রুম বুক করা। সুমেন্দু লেকের অপরপ্রান্তে অনেকগুলি হোটেল ও রেস্তোরাঁ আছে। তাই রুম নিয়ে সমস্যা হলো না। নীলার মনটা এতক্ষণ খারাপ থাকলেও মিরিকের সৌন্দর্য দেখে তাতে ভাটা পড়ল।
তারা সবাই অল্প সময়ে মিরিকের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লেগে গেল। সাদিদ-নীলা সামনে মাঝখানে অর্ণব-প্রিয়তী আর তার পিছনে হাঁটছে তানবীর-শান্ত।
শান্ত আশেপাশে দেখতে দেখতে সামনের একটা ইটের টুকরোর সাথে হুঁচট খেল। হালকা ব্যাথায় সে মৃদু ব্যাথাজনক আওয়াজ করল। তানবীর তার পিছনেই আসছিল। তাই দ্রুত শান্তর দিকে এগিয়ে আসলো।

— ‘ কি হয়েছে? ‘

শান্ত ততক্ষণে ব্যাথায় মাটিতে বসে গিয়েছে। তানবীরও এবার হাঁটু ভাজ করে শান্তর সাথে মাটিতে বসে পড়ল। শান্তর পায়ে হাত দিতে গেলেই সে দ্রুত সরিয়ে নিলো।

— ‘ কি করছেন? ‘
— ‘ দেখছি কতটা ব্যাথা পেয়েছ। ‘
— ‘ তেমন কিছু হয়নি। আপনি পায়ে হাত দিবেন না। ‘

তানবীর বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে নিলো। শান্ত-তানবীরকে মাটিতে বসতে দেখে সাদিদরাও পিছিয়ে আসলো।

— ‘ কি হয়েছে তানবীর? ‘
— ‘ আমি নিজেই তো জানি না কি হয়েছে। এই ন্যাকা মেয়ে দেখতেই তো দিচ্ছে না। ‘
— ‘ দেখছেন আমি ব্যাথা পেয়েছি। আর আপনি এখনও আমার সাথে ঝগড়া করছেন? ‘
— ‘ কিছু লোকের জন্ম-ই হয় ঝগড়া করা এবং সহ্য করার জন্য। তুমিও তাদের দলের-ই লোক। ‘

শান্ত ভ্রুজোড়া বাঁকা করে তানবীরের দিকে তাকালো। চোখ-মুখ তার রাগে-বিরক্তিতে তেতে আছে। তানবীর সেসবকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে জোরপূর্বক তার পা টেনে ধরল। শান্ত আবারও বাধা দিতে চাইলে সে এবার চোখ গরম করে তাকালো। তার চোখে কিছুতো একটা ছিল যার ধরুন শান্ত বাধা দেওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু কি ছিল?
অধিকারবোধ? কিন্তু কি জন্য? শান্তর উপর তার কিসের অধিকার!
নীলাও শান্তর পাশে বসে পড়েছে। ব্যাথা বেশ ভালোই পেয়েছে। বুড়ো আঙ্গুলের নখটা উল্টে গিয়েছে।

— ‘ ওর ড্রেসিং লাগবে। তোরা লেকের পাড় ঘুরে দেখ। আমি তাকে নিয়ে হোটেলে ফিরছি। সেখানে ড্রেসিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ‘

শান্তর আসলেই অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে। তাই তানবীরের কথার পিঠে আর কিছু বলতে পাড়ল না। তানবীর তাকে উঠার জন্য সাহায্য করল। নীলাও তার পিছু যেতে চাইলে সাদিদ তাকে বাধা দিলো। নীলা অবাক চোখে তাকালো।

— ‘ আমি যাব তো। হাত ছাড়ুন। ‘

সাদিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল। নীলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ ওদেরকে একা ছেড়ে দাও। তাদের মধ্যে যাওয়া উচিত হবে না। ‘
— ‘ কেন? শান্ত ব্যাথা পেয়েছে। আর আপনি বলছেন আমি যাব না? ‘
— ‘ বোকা মেয়ে, যেতে মানা করছি না। কিন্তু এখন যেতে বারণ করছি। আর তাছাড়া তানবীর তো সাথে রয়েছে। শান্তর কোনোরকম সমস্যা সে হতে দিবে না। এটুকু আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলছি। ‘

নীলা নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সাদিদের কথাটা সে মানতে চাইছে। কিন্তু বোন সমতুল্য বান্ধবীর জন্য হৃদয়ে নিশপিশ করছে। সাদিদও তার প্রাণপাখির মন বুঝতে সক্ষম। কিন্তু তার এখন হাসিও পাচ্ছে। নীলা এত অবুঝ কেন? সাদিদ শিউর না হয়ে তাকে কিছু জানাতে চায় না৷ কিন্তু সাদিদের মন এবং মস্তিষ্ক বলছে তার অনুমানটাই সঠিক হবে। কিন্তু তারপরও সে আগে তানবীরের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক। তাই সে নীলাকে আগলে বুকে নিয়ে আসলো। তার থুতনিতে ধরে মুখটা উঁচু করে বলল,

— ‘ মন খারাপ? ‘
— ‘ না ঠিক আছি। ‘
— ‘ কিন্তু মুখতো অন্য কিছু বলছে। ‘

নীলা উত্তর না দিয়ে নতজানু হতেই সাদিদ হাসল। তাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

— ‘ আমার উপর বিশ্বাস রাখ। শান্তকে নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। তার খেয়াল তানবীরের থেকে বেশি আর কেউ রাখতে পারবে না৷ ‘

সাদিদের কথাটাতে আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না৷ তাই নীলাও এবার স্বাভাবিক হলো। সাদিদের সাথে পা মিলিয়ে মিরিকের সৌন্দর্য অবলোকন করতে লাগল।

_______________

তানবীরের দিকে তাকাতেই শান্তর লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। একটু আগে কি করল সে? শান্ত নিজের শরীরের দিকে তাকাতেই আবারও একদফা কেঁপে উঠল। সে একহাতে কোমড় স্পর্শ করল। হ্যাঁ ঠিক এই জায়গাটাতেই তো তানবীর বলিষ্ঠ হাতে চেপে ধরেছিল। বুনেছিল শান্তর পাগলাটে মনে শত নাম না জানা অনুভূতির খেলা।
তখন শান্ত একপা উঁচু করে সামনের দিকে হাঁটছিল। কিন্তু বেসামালভাবে পড়ে যেতে ধরতেই তানবীর দ্রুত তাকে ধরে ফেলেছিল। ব্যালেন্স রাখতে গিয়ে একহাতে ধরেছিল শান্তর কোমড়। দুইজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ একে অপরের ছিল খুব নিকট। যার ফলে দুইজনই জর্জরিত হয়েছিল নতুন ভিন্ন এক অনুভূতিতে।
তানবীরের খেয়াল আসতেই সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছিল। তারপর হোটেল রুমের বাকি রাস্তাটুকু সে শান্তকে একহাতে জড়িয়ে নিয়েই এসেছে। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত শান্ত চোরা দৃষ্টিতে তানবীরকে দেখছে। চলমান পরিস্থিতিতে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাই মাথা নিচু করে সে অনবরত নখ দিয়ে বিছানার চাদরে আঁকিবুঁকি করছে।
অপরদিকে তানবীরের সেসবে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই৷ সে নিজের পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শান্তর পায়ে ভায়োডিন লাগিয়ে ড্রেসিং করছে। হঠাৎ পায়ে ব্যাথা লাগতেই শান্ত চোখ-মুখ কুঁচকে মুখ দিয়ে ব্যাথাজনক শব্দ করল। তানবীর দ্রুত হাত থামিয়ে মুখ এগিয়ে ফুঁ দিতে লাগল।

— ‘ ঠিক আছ? ‘
— ‘ জ্বি। ‘

বলেই শান্ত আবারও নতজানু হলো। তানবীরের দিকে সত্যিই আর তাকানো যাচ্ছে না। লজ্জারা এসে আচমকাই তাকে ঘিরে ধরেছে।
তানবীর শান্তর পায়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হোটেলের স্টাফদের থেকে সুবিধা করে সে ব্যাথানাশক ঔষধও নিয়ে নিয়েছে। তাই ঔষধ এবং পানির গ্লাসটা শান্তর দিকে এগিয়ে দিলো।

— ‘ খাও। ‘

ব্যস এতটুকুই। কিন্তু শান্ত বিনাবাক্য ঔষধ খেয়ে নিলো। সবসময় এই ছেলেটার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা মেয়েটা আজ পুরোপুরি চুপসে গিয়েছে। লজ্জারা তার ঝগড়ুটে মনোভাবকে পরাজিত করেছে। শান্তকে ঔষধ খাইয়ে তানবীর নিজের ফোন হাতে নিলো।

— ‘ হ্যাঁ কই তোরা? ‘
— ‘ _____________
— ‘ আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। তোরা ঘুরে দেখে নে। আমরা রুমেই আছি। ‘
— ‘ ______________
— ‘ না এখন ব্লিডিং অফ হয়েছে। কিন্তু হাটাহাটি করলে ব্যাথা পেতে পারে। তাই রুমে থাকলেই ভালো হবে। ‘
— ‘ ______________
— ‘ আচ্ছা প্রয়োজন হলে জানাব। ‘

তানবীর ফোন রেখে শান্তর দিকে তাকাতেই তার ভ্রুজোড়া কুঁচকে এলো। কেননা শান্ত চোখ বড় বড় করে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ভাবটা এমন যে, যেন সে সাক্ষাৎ ভূত দেখেছে। তানবীর ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল,

— ‘ কি হয়েছে? এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছ কেন? ‘
— ‘ আমি এখনই বাহিরে চলে যাব। ইচ্ছে হলে আপনি রুমে বসে থাকেন। আর ইচ্ছে হলে ঘুমিয়েও থাকতে পারেন। ‘
— ‘ বেশি কথা বললে আছাড় মেরে সুমেন্দু লেকে ফেলে দিব৷ ‘
— ‘ আমি বোধহয় চেয়ে চেয়ে আপনার মুখ দর্শন করব? আছাড় না দিতে পারি ধাক্কা মেরে অবশ্যই ফেলে দিব। ‘
— ‘ ওহ তাই? আচ্ছা তাহলে দেখাই যাক কে কাকে ফেলে। ‘

বলেই তানবীর জ্যাকেটের হাতা গুটিয়ে সামনে এগিয়ে আসতেই শান্ত কিছুটা পিছিয়ে বসল। শুকনো ঢুক গিলে দ্রুত বলে উঠল,

— ‘ প্লিজ, প্লিজ না। আপনি এমন করছেন কেন? আমরা আজকেই চলে যাব। তাই মিরিকের মতো এমন একটা জায়গায় এসে কি বসে থাকা যায়? প্লিজ একটু বুঝার চেষ্টা করুন৷ আমি মিরিকটা ঘুরে দেখতে চাই। ‘

তানবীর বোধহয় এবার কিছুটা দমল। সে নিচের ঠোঁট কামড়ে ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগল। খানিক সময় পর চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করল,

— ‘ তুমি পারবে? কষ্ট হবে না? ‘
— ‘ আমি পারব। প্লিজ যেতে দিন। ‘
— ‘ আচ্ছা। তাহলে তোমার কথায় রাজি হতে পারি। কিন্তু আমার একটা শর্ত রয়েছে। ‘
— ‘ আমি সব শর্তে রাজি। ‘

শান্তর চোখে-মুখে খুশি দেখে তানবীরেরও ভালো লাগল। তার ঠোঁটের কোণেও ফুটে উঠল হাসির রেখা।
শান্ত হাসিমুখে রাজি হলেও তার ঠোঁটের কোণে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কেননা তানবীর এমন আজব একটা শর্ত দিয়েছে যেটা শান্তর ভাবনার বাহিরে। সে দাঁতে দাঁত চেপে তানবীরের হাত ধরে রয়েছে। আর তানবীর একহাতে তার পিঠ জড়িয়ে সামনে হেঁটে যাচ্ছে। সে শান্তর চোখ-মুখের ইতস্ততবোধ লক্ষ্য করেছে। কিন্তু সে নিরুপায়। শান্তকে সে এই অবস্থায় কোনোভাবেই একা চলতে দিবে না৷ তাদেরকে আসতে দেখে এবার সাদিদরাও উঠে দাঁড়াল। এতক্ষণ দুই কাপল যুগল লেকের পাশেই বসে সময় কাটিয়েছে। তানবীরকে এভাবে শান্তর সাথে দেখে সাদিদ অর্ণব একে-অপরের দিকে তাকালো। কেউ হয়তো তাদের দুজনের হাসিমুখের কারণ বুঝতে পাড়ল না। কিন্তু দু’জনের মুখেই ছিল বর্ণনাবিহীন মিষ্টি হাসি।

তারা সবাই এবার সামনের পথে পা বাড়াল। প্রিয়তী-অর্ণব সামনে সাদিদ-নীলা মাঝে এবং তানবীর শান্তকে নিয়ে পিছনে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে৷ আর সে তীক্ষ্ণ চোখে বারবার শান্তর হাঁটার রাস্তা পর্যবেক্ষণে রয়েছে। ভাবটা এমন যে আবারও কোনোরকম ব্যাথাজনক যন্ত্রণা তানবীর তাকে সহ্য করতে দিবে না। তারা সবাই-ই নিজস্ব জায়গা থেকে মিরিকের সৌন্দর্য উপভোগ করছে।
মিরিক মূলত ভ্রমণপিপাসুদের মানচিত্রে নিজের জায়গা করে নিয়েছে তার আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং যাতায়াতের সুব্যবস্থার জন্য। সুমেন্দু লেক এখানকার প্রধান আকর্ষণ। ৫,৮০০ ফুট উচ্চতার এই পাহাড়ি শহরের বুক চিতিয়ে শুয়ে আছে এই সুমেন্দু হ্রদ। যার একদিক বাগান এবং অন্যদিক পাইন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। সুদীর্ঘ পাইনের বনানী আর তার ছায়া এসে পড়ে লেকের টলটলে জলে। দেখে মনে হবে যেন একটা মায়াঘেরা জায়গায় এসে পড়েছি।
এই দুটিকে একসঙ্গে যুক্ত করছে পায়ে হাঁটা খিলান সাঁকো ইন্দ্রেনি পুল। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ ফুট। লেকটিকে ঘিরে থাকা সাড়ে তিন কিমি লম্বা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সূদূর দিগন্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ ভ্রমণার্থীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। লেকের জলে নৌকাবিহার এবং টাট্টু ঘোড়ায় চেপে লেকের চারপাশ প্রদক্ষিণ করায় আছে এক অনাবিল আনন্দ।
সাদিদরা লেকটা ঘুরে দেখে নৌকায় উঠার প্ল্যান করল। নীলাতো সেই খুশি। কেননা সে বরাবরই পানি পাগল।
তারা অনেকক্ষণ সময় নিয়ে লেকের পানিতে নৌকায় চড়ল। তারা যেহেতু ঘোড়ায় চড়বে না তাই তারা নিজেদের পরবর্তী প্ল্যানের পথে হাঁটল।
তানবীর হাঁটতে হাঁটতে আবারও বলল,

–‘ ব্যাথা করছে? ‘

শান্ত চোখে-মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তাকালো। কেননা সে আর কতবার এই একই প্রশ্নটার উত্তর দিবে? সে বুঝতে পাড়ছে না এই ঝগড়ুটে ছেলের তার উপর হঠাৎ এতে কেয়ার কিভাবে জেগে উঠল!
শান্তর উত্তর না পেয়ে তানবীর হাঁটা থামিয়ে দিলো৷ আবারও বলল,

— ‘ বলছ না কেন? ব্যাথা করছে? ‘
— ‘ আর কয়বার বলব? ‘
— ‘ আমি যতবার জানতে চাইব৷ ‘

ইশশ কি নির্লিপ্ত উত্তর। শান্ত রাগীভাব নিয়ে হেঁটে যেতে নিতেই তানবীর এসে তার হাত টেনে ধরল।

— ‘ শর্ত কি ভুলে গিয়েছ? ‘
— ‘ আমার কিন্তু এবার সত্যিই ইচ্ছে করছে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিতে। ‘
— ‘ ভালোই হবে। তোমার মতো ঝগড়ুটের সাথে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। খানিকটা রিলেক্স হওয়া যাবে। ‘
— ‘ আপনি একটা অসহ্য। ‘
— ‘ তোমার লেবেল ক্রস করা পসিবল নয়। তুমি মাত্রাতিরিক্ত। ‘
— ‘ নিজে মেয়েদের মতো পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করেন। অথচ আমাকে আবার ঝগড়ুটে বলেন? ‘
— ‘ আমি খুবই ভালো ছেলে। সঙ্গ দোষে বদ হয়ে যাই৷ ‘
— ‘ আপনি কি কোনোভাবে আমাকে বদ বলছেন? ‘
— ‘ আমি কখনোই এমনটা বলিনি। কিন্তু তুমি বোধহয় এমনটা শুনতে চাও। বলব নাকি, বদের হাড্ডি? ‘

শান্ত রেগে ঝাড়া মেরে তানবীরের হাতটা সরিয়ে দিলো। তানবীর নিঃশব্দে হেসে আবারও তাকে আগলে ধরল। শান্ত রাগ মাথায় নিয়েই তার সাথে হাঁটতে লাগল। বলে যেহেতু লাভ নেই, তাই আপাতত চুপ থাকা শ্রেয়।
সাদিদরা সুমেন্দু লেক ছাড়িয়ে দূরে পাহাড়ের মাথায় চলে আসলো। এখানেই রামেতি ভিউপয়েন্ট। মেঘ না থাকলে এখান থেকেই দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। আজকের আকাশ মেঘমুক্ত। বেশ রৌদ্র ঝলমলে। তাই তারা সবাই এই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখা থেকে বাদ পড়ল না।
কি অপূর্ব দৃশ্য! না দেখলে বিশ্বাসই করা যাবে না যে প্রকৃতি আপন খেয়ালে নিজের রূপ-রং-গন্ধ কী ভাবে বদলাচ্ছে। দুপুরের শেষভাগের সোনারোদ চলকে পড়ছে সেই পবিত্র শিখরচুড়োর শরীরে। এই অপরূপ শোভা যে কারও মন ভরিয়ে দেবে। আর পাহাড়ের গায়ে মখমলি সবুজ চা বাগানের ঢেউ যেন এক কথায় অনবদ্য।
নীলা আবেগপ্রবণ হয়ে আনন্দে মুখে হাত চেপে ধরল। সাদিদ হেসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখল। পাশ থেকে নীলার আনন্দ অশ্রু দেখে হাসতে হাসতে বলল,

— ‘ বউ, এত চোখের জল কোথায় থেকে আসে? ‘

নীলা মাথা নিচু করে লাজুক হাসল। আঙ্গুল দিয়ে চোখের জলটা মুছিয়ে নিয়ে বলল,

— ‘ কি করব বলেন? মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ হয়ে যাই৷ সবকিছু এত মনোমুগ্ধকর কেন? এত সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ কেন? ‘
— ‘ যার চোখ সুন্দর তার কাছে সবই সুন্দর দেখতে হয়। যার মন সুন্দর তার কাছে সবই মনোমুগ্ধকর মনে হয়। ‘
— ‘ আপনি কি জানেন? আপনি একজন মারাত্মক লেবেলের চাপাবাজ? ‘
— ‘ ইশশ বউ, কিসব বলছ? তোমার হাসবেন্ডের মতো সাদাসিধা, ভুলা-বালা ছেলে তুমি আর একটাও জগতে পাবে? ‘
— ‘ নিজের ঢোল নিজেই বাজান! ‘
— ‘ কি করব? কেউ না বাজালে নিজেকেই তো বাজাতে হয়। ‘

নীলা এবার উচ্চ স্বরে হেসে ফেলল। সঙ্গে তার হাসিতে সাদিদও মৃদু হাসল।
রামিতে ভিউ পয়েন্ট থেকে তারা এবার আসলো টিংলিং ভিউপয়েন্টে। এখান থেকে চা-বাগানগুলির ৩৬০ডিগ্রী প্যানারমিক ভিউ পাওয়া যায়। মিরিকে এবং এর চারপাশে অনেকগুলি চা বাগানে বিখ্যাত ‘দার্জিলিং চা’ এর চাষ হয়। বলাবাহুল্য চায়ের বাগানের এমন মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য হলেও দার্জিলিং টুঁ মারা উচিত। এককথায় অপূর্ব এক দৃশ্য, বর্ণনাহীন!
কমলালেবুর বাগিচার জন্যও মিরিক খ্যাত। মিরিকে খুব উচ্চমানের কমলালেবুর চাষ হয়। মিরিক বস্তি, মুরমা ও সৌরেনি বস্তি অঞ্চলে কমলালেবুর ফলন হয়। সাদিদরাও কমলালেবুর বাগিচা দেখতে গেল। তারা সাথে করে কিছু কমলা কিনেও আনলো। এতো সুন্দর বাগানে এসে এমন খালি হাতে আসা যায় কি করে? তারা সাথেসাথেই কমলা ছিলে খেয়ে দেখল।

— ‘ ইশশশ! খুব মিষ্টি। ‘

সাদিদ আশেপাশে একপলক তাকিয়ে নীলার দিকে ঝুঁকে আসলো। নীলা কমলা খাওয়ায় ব্যস্ত। সাদিদ তার হাতের কমলার কোয়াটা নিজের মুখে পুরে নিলো। তারপর নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ তোমার থেকে কম। আমিতো এই মিষ্টির পরিমাণ নির্ধারণ পর্যন্ত করতে পারব না। এত মিষ্টি কেন তুমি? আমিতো রোগে আক্রান্ত হয়ে যাব৷ ‘

নীলা মৃদু ধাক্কা দিয়ে সাদিদকে দূরে সরাল। মুখ ঘুরিয়ে আপন মনে লাজুক হেসে বলল,

— ‘ অসভ্য একটা। ‘

মিরিকের জনপ্রিয়তা যেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আরও একটি জিনিসের জন্য বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক ফুলের বাজারের অন্যতম দামি অর্কিড সিমবিডিয়াম চাষের জন্য মিরিকের জলবায়ু খুবই উপযোগী। মিরিকে সিমবিডিয়াম অর্কিডের বাগান রয়েছে যার নাম “দার্জিলিং গার্ডেন্স প্রাইভেট লিমিটেড”। সাদিদরা অল্প সময়েও অর্কিড বাগানটা পর্যবেক্ষণে গেল। এত কাছে এসে এই জিনিসটা মিস করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
মিরিকের থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দরের দূরত্ব প্রায় ৫২ কিমি(৩০ মাইল)। তাই সাদিদরা এবার ফিরে যাবার উদ্দেশ্য টেক্সিতে বসল। ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই আর লেইট করলে হবে না।
টেক্সি ডাইভার সাঁই সাঁই করে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল বাগডোগড়ার দিকে।
প্রত্যেকের মুখটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মলিন। সবারই একটা কথা মনে হচ্ছে, সময়টা বোধহয় খুব দ্রুতই কেটে গেল।
আসলে এমনটাই ঘটে যখন প্রিয়মুখগুলো আমাদের পাশে থাকে। তারউপর সাথে থাকে এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
নীলা সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ তাকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে রয়েছে।

— ‘ শুনছেন? ‘

সাদিদ চোখ নিচু করে নীলার দিকে তাকালো। নীলার নাকে নাক ঘষে দুষ্টু হেসে বলল,

— ‘ এমন করে বলে না পাখি। খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। ‘
— ধ্যাত। ‘

নীলা বাহিরে তাকিয়ে লজ্জারাঙা মুখ লুকাতে ব্যস্ত। সাদিদ পিছন থেকে তার পেট জড়িয়ে ধরল। নীলা তার উষ্ণ স্পর্শে মুহূর্তেই কেঁপে উঠল। সে কিছু বলবে তার আগেই সাদিদ বলল,

— ‘ বলো। ‘

নীলা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। সাদিদের মিষ্টি মুখটা দেখে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো। মিষ্টি হেসে বলল,

— ‘ না, কিছু না। ‘

সাদিদও মৃদু হাসল। নিঃশব্দে নীলার কপালের একপাশে চুমু খেল। তারপর সিটে হেলান দিয়ে তাকে টেনে নিজের বুকে আনলো। দুইহাতের বাহুবন্ধনে তাকে শক্ত করে আবদ্ধ করল। নীলাও তার জীবনের পরম উষ্ণতার জায়গাটুকুতে মুখ গুঁজল। একধ্যানে শুনলে লাগল ভালোবাসার মানুষটির বুকে, তার নামের ছন্দে তোলা হৃদকম্পন।

#চলবে…

[ পাঠকগণ আপনাদের পাঠপ্রতিক্রিয়াগুলো আমাকে জানাবেন। আমি আপনাদের ভালোলাগা-মন্দলাগাগুলো জানতে আগ্রহী। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here