অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৭১

0
5209

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৭১ ❤

সকালের পর থেকে দুপুর অবধি সাদিদের আর মুখ দর্শন পাওয়া গেল না। এমনকি ছোট করে আদুরে কন্ঠের একটা ডাকও না। এতদিন নীলাসহ তাদের পিচ্চি সোনা মণিটাকে ঘিরেই সাদিদের চব্বিশ ঘণ্টা কেটেছে। ইম্পরট্যান্ট কাজ থাকলেও নীলা আর বেবির জন্য স্কিপ করে গিয়েছে। যার ধরুন তার এখন শান্তিপূর্ণভাবে শ্বাস ফেলার অবকাশ নেই।
তাই শূন্যতা বুকে ঝাপটে নিয়েই নীলা নিজের কাজগুলো সামলাতে ব্যস্ত থাকলো। অবশ্য কাজ বললে ভুল হবে শুধু হাতগুলো আর পাগুলো একটু আধটু নাড়ানো। নতুবা বেশি নাড়াতে গেলে সাদিদ তার পাগুলোই কেটে রেখে দিবে। আপাতত সেলাই শুকনো পর্যন্ত তার সকল প্রকার আজাইরা কাজকর্ম সাদিদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারই সাথে নিধি, শায়লা রহমানও একযোগ হয়ে সমর্থন জানিয়েছে। তাই সেখানে নীলার হাজার বিরক্তি এসে জমা হলেও কিছু করার নেই।
নীলা মেয়ের ছোট্ট ছোট্ট কাপড়গুলো গুছিয়ে তার জন্য কেনা ছোট বেবি ওয়ারড্রবে রাখলো। দায়িত্বশীল বাবা ইতিমধ্যে নিজের আদরের টুকরোর জন্য সর্ব রকম সুবিধার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। নীলা মৃদু হেসে মেয়ের কাছে এগিয়ে গেল। ছোট্ট হাতগুলো নাড়িয়ে সে তখন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। নীলা হয়তো মেয়ের মনের ভাবখানা মুহূর্তেই ধরে ফেলতে পারলো। তাই ঘাড় উঁচিয়ে দেয়াল ঘড়িটাতে নজর দিলো। দুপুর একটা ত্রিশ বাজতে চলেছে। এখন পর্যন্ত সাদিদের সাথে একটিবারের জন্য কথা হলো না। কাজে ব্যস্ত আছে বিধায় নীলাও তাকে আর বিরক্ত করলো না। ছোট মেয়েটা রুমে থাকতে থাকতে বিরক্ত হচ্ছে ভেবে নীলা তাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় আসলো। দুপুরের কড়া রৌদ্রের উত্তাপে সেখানেও টিকে থাকা গেল না। অন্যথায় রুম থেকে বেড়িয়ে পাশের রুমে গেল। কেননা সাদিদের কড়া বারণ উপেক্ষা করে সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবার সাহস কুলিয়ে উঠতে পারেনি।
শাদ তখন মা-বাবার রুমে হন্তদন্ত হয়ে কি যেন খুঁজতে ব্যস্ত। নীলা মেয়েকে ভালোভাবে ধরে ভিড়ানো দরজাটা পুরোপুরি খুলে দিলো। আকষ্মিক আওয়াজে শাদ পিছনে ফিরে তাকালো। নীলাকে দেখে যতটাই না স্বাভাবিক ছিল তার কোলে পিচ্চি নীয়ানাকে দেখে ততটাই যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তড়িঘড়ি করেই বলল,

— ‘ খালামণি তুমি এখানে? ‘
— ‘ এইতো তোমার বোনকে নিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম। ‘

ছোট অপ্রস্তুত মুখটাতে সেই মুহূর্তে রাজ্যের বিরক্তি দেখা গেল। বিরক্তিকর মনটা আপনমনেই বিড়বিড় করলো,

— ‘ আই হেইট দিস ওয়ার্ড! ‘
— ‘ কি বলো বাবা? শুনি না তো। ‘
— ‘ তোমাদের না বারণ করলাম আমার সামনে বোন শব্দটা উচ্চারণ করবে না? আবার করলে আমি এই শব্দ যেখানে নেই সেখানেই চলে যাব। ‘

ফর্সা মুখটা যেন রাগ-বিরক্তির সংমিশ্রণে তেতে উঠেছে। নীলা খানিকটা থমকালো। অতঃপর ভরকানো স্বরেই বলে উঠল,

— ‘ রাগ করেনা বাবা। খালা মণি আর বলছি না। কিচ্ছুটি বলছি না। ‘

নীলা বিস্মিত পূর্ণ মুখশ্রী নিয়েই যাওয়ার জন্য সামনে পা বাড়ালো। কিন্তু পিছন থেকে শাদের এতক্ষণের রাগ ভুলে খানিকটা নিচুগলায় মিইয়ে যাওয়া স্বর শুনে থেমে গেল।

— ‘ কি হয়েছে বাবা? ‘

শাদ আড়চোখে নীলার কোলে ছোট্ট তুলতুলে শরীরটার দিকে তাকালো। সে আবারও যেন বিব্রত হয়ে পড়ল। তার গালগুলো হঠাৎ এমন গরম লাগছে যেন? আড়চোখে একবার এসির দিকেও তাকালো। ২৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এসির টেম্পারেচারে রুমের বর্তমান অবস্থা বেশ হিমশীতল। তারপরও শাদের মনে হচ্ছে ছোট শরীর বেয়ে তার অঝোরে ঘাম ঝরছে। নিজের শরীরের হঠাৎ এমন পরিবর্তনে সে আরও বিব্রতবোধ করতে লাগলো।

— ‘ তোমার মেয়ের কান চেপে ধরো। একটা কথা বলবো। ‘

আজ বোধহয় অবাক হবার দিবস। নতুবা থমকে গিয়ে ভরকে যাবার প্রহর। নতুবা নীলা বারংবার এমন পরিস্থিতিতে পরবে কেন?
নীলা একপলক নিজের বুকের সাথে লেপ্টে থাকা ছোট্ট নীয়ানার দিকে তাকালো। সে বরাবরের মতোই ছোট হাতগুলো নাড়িয়ে মায়ের পরিহিত কাপড় নিয়ে খেলতে ব্যস্ত। এই পিচ্চির কানে কেন ধরবে? সে এমন আজব প্রশ্নের উত্তর খোঁজে পেল না। অবশেষে কন্ঠে আকাশসম বিস্ময় নিয়েই সে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

— ‘ কেন বাবা? ‘
— ‘ আগে ধরো নতুবা বলছি না। বউয়ের শোনা বারণ। এসব ওর কান অবধি যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। ‘

ছোট্ট মামুষের এমন পাকা কথায় নীলা যারপরনাই অবাক হলো। কিন্তু সেটা নিজের মধ্যে চেপে রেখে বিছানায় বসে ছোট্ট কানের উপর আলতো করে হাত রাখলো।
মেয়ে অসন্তুষ্ট নজরে তার দিকে তাকালো। অর্থাৎ বিষয়টা তার একদমই পছন্দ হয়নি। সেই বাঁদর ছেলের বাঁদরামি কথাবার্তা মা কেন শুনবে?
নীলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক মেকি হাসলো। মাঝে মাঝে সে নিজেই বুঝে না যুগ এতো ফাস্ট কিভাবে চলছে!

— ‘ ধরেছো? ‘
— ‘ হ্যাঁ বাবা ধরেছি৷ এবার অন্ততপক্ষে বলো। ‘

শাদমান তবুও উঁকিঝুঁকি দিয়ে শিউর হলো। পিচ্চির কানে নীলার হাত দেখে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। অতঃপর ধীরে স্বরে বলল,

— ‘ মাকে একটু ডেকে নিয়ে আসো। খবরদার সবার সামনে বলবে না। মা কারণ জানতে চাইলে বলবে খুবই প্রাইভেট। শাদমানের মুখ থেকে এই শব্দ বের হবে না। মা যেন স্বয়ং এসে আমার প্রাইভেট খবর দেখে যায়। ‘

নীলার কপালে ছোট্ট দুইটা ভাঁজ পরলো। এই পিচ্চি ছেলে-পুলেগুলো নির্ঘাত একদিন তার মাথা খেয়ে নিবে।

— ‘ আমাকে বললে সমস্যা কি? ‘
— ‘ প্রথম ভেবেছিলাম বলবো কিন্তু এখন রিক্স নিতে চাইনা। তোমার বেয়াদব মেয়ে যদি আমার প্রাইভেট কথা আড়িপেতে শুনে নেয়! তখন? তখন কি হবে? তাই আমি মোটেও সেই রিক্স নিবো না। ‘
— ‘ তাহলে এতোক্ষণ দাড়া করিয়ে ভাষণ ছাড়লি কেন? ‘

নীলা ক্ষেপে গিয়েছে। আর সেইটার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে শাদমানকে তুই বলে সম্বোধন করেছে। এটা তাদের খালা-ভাগিনার আদুরে সম্পর্ক। যখন পরিস্থিতি অনুকূল থাকে তখন আপনি পর্যন্ত চলে যায়। আর যখন প্রতিকূল তখন তুই যেতেও তাদের সময় লাগে না।

— ‘ অনেকদিন টিভিতে ভাষণ দেখে দেখে প্রেক্টিস করেছি। তাই আজকে তোমার উপর একটু এপ্লাই করলাম। ‘
— ‘ তোর এই বাঁদরামি…
— ‘ ফর গড সেক খালামণি মাকে একটু ডাক দাও। আমি আর পারছি না। ‘

শাদমান এবার জিন্সের থ্রি কোয়ার্টার পেন্ট ধরেই লাফালাফি শুরু করেছে। নীলার এবার সম্পূর্ণ বিষয়টা নজরে আসলো। এতক্ষণ শাদমান চেয়ারের আড়ালে দাড়িয়ে ছিল বিধায় প্রাথমিক বিষয়টা সে আঁচ করতে পারেনি। কিন্তু এবার ঘটনা বুঝে আসতেই তার বেশ হাসি পেল। কিন্তু ভুলেও এই কাজ করা যাবে না। নতুবা ভূমিকম্প হবার তীব্র সম্ভাবনা। তাই সে মুখ চেপে শুধু বললো,

— ‘ বেশি নড়াচড়া করিস না। যেভাবে লাফাচ্ছিস! আমি আপুনিকে ডেকে নিয়ে আসছি। ‘

নীলা কথা বলে সেখানে আর একমুহূর্ত দাড়ালো না। সিঁড়ির উপর থেকেই নিধির উদ্দেশ্য হাঁক ছাড়ল। ছোট্ট নীয়ানাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে যাওয়া তার জন্য সম্পূর্ণ বারণ। নতুবা ভালো করতে গিয়ে হিতে নীলার গর্দানও যেতে পারে। অসভ্য পুরুষদের মতিগতি বুঝা বড় দায়!

.

প্রখর রৌদ্রদীপ্ত দিপ্রহরের সমাপ্তি ঘটলো। একে একে রক্তিম সূর্যও পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার সময় ঘনিয়ে এলো। আর তখনই বহু প্রত্যাশিত মানুষটির দুদন্ড সময় হলো।
ফোনের রিংটোন প্রথমবার বেজে উঠতেই নীলা দ্রুত রিসিভ করলো।

— ‘ আসসালামু আলাইকুম। ‘
— ‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি করা হচ্ছে? ‘
— ‘ আমাদের কথা পরে। আগে আপনি বলেন লাঞ্চ করেছেন কি-না? আমার মেসেজের রিপ্লে এলো না কেন? ‘

ফোনের অপরপাশে সাদিদের নিচু গলায় হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। সে হাসি চেপেই ধীরে সুস্থে গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ সরি লক্ষীটি। সারাদিন ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। আর সবেমাত্রই তোমার মেসেজটা চোখে পরলো। আর মাত্রই কল করলাম। ‘
— ‘ সরি বলতে হবে না। আমি জানিতো। এইজন্যই কল দিয়ে বিরক্তি করিনি। ‘
— ‘ এখন কিন্তু মার পরবে। তুমি কল দিলে আমি বিরক্ত হবো সেটা তোমাকে কে বলল? ‘

ফোনের এইপাশে এবার নীলাও হেসে ফেলল। বিছানার মাঝখানে সাদা জামা পরিহিত শুভ্র পরিটাকে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার ঠোঁটের কোণ আরও বিস্তৃত হলো। মেয়ে যে বাবার প্রিয় শিষ্য সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নীলা তার নরম গালে আদুরে হাত বুলিয়ে বলল,

— ‘ আচ্ছা দিয়েন। কিন্তু এবার তাড়াতাড়ি লাঞ্চটা করেন। নতুবা সেটা একেবারে ডিনারে পরিণত হবে। ‘
— ‘ আচ্ছা করবো। কিন্তু আগে বলো আমার প্রিন্সেসটা কি করে? ‘
— ‘ প্রিন্সেস তার বাবাকে খোঁজে। ‘

নীলার রাশভারী কন্ঠস্বর। সাদিদ মাথা চুলকে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মৃদু হাসল। অপরপাশ থেকে এই সুমধুর মিষ্টি কন্ঠে নীলাও ফিক করে হেসে ফেলল।

— ‘ মেয়েকে একটু দেখাও তো। আমি ভিডিও কল দিচ্ছি। ‘
— ‘ আচ্ছা। ‘

সাদিদ ফোন কাটতে গিয়েও আচমকা থেমে গেল। এবং তড়িৎ গতিতে বলল,

— ‘ শুনো শুনো, আমার মেয়ে ছোট। তুমি ল্যাপটপ অন করো। ফোনে ওর চোখের সমস্যা হবে। আর শুনো, মেয়েকে কিন্তু স্ক্রিনের থেকে দূরে রাখবে। আমি দূর থেকেই তাকে দেখবো। ‘

সাদিদের গলা বোধহয় শুকিয়ে এলো। এক নিঃশ্বাসে সব কথা বলে সে দম নিলো। নীলার মুখের চাপা হাসিটা এখনও বিদ্যামান। মানুষটা এতো ভালো কেন? তাদেরকে এতো বেশি ভালোবাসে কেন?
নীলার তো নিজের ভাগ্যকেই বিশ্বাস হয় না। এতোটা রাজকপাল নিয়ে কে জন্মায়!
ল্যাপটপের স্ক্রিনে মেয়ের আদুরে মুখটা দৃশ্যমান হতেই সাদিদের চোখজোড়া ম্লান হলো। মেয়েটাও একদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। চোখের দৃষ্টিতে বাবার অনুপস্থিতির কারণে অভিমান-অভিযোগের বিশাল সম্মেলন। সাদিদ নিষ্পলক চোখে মেয়ের কোমল মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইল। ক্ষণ, বহুক্ষণ। অতঃপর ভীষণ আদুরে স্বরে ডাকলো,

— ‘ প্রিন্সেস? ‘

ছোট্ট মেয়েটা কি বুঝলো সে নিজেই জানে। কিন্তু তার পিচ্চি মনের বিশাল অভিমানের পাহাড়টা ধীরে ধীরে ভঙ্গুরের পথে এগিয়ে গেল। পাতলা ঠোঁটের কোণে ঈষৎ মিষ্টিরাঙা ঢেউ খেলে উঠল।
পাশ থেকে এমন দৃশ্যে নীলাও মনে মনে বেশ প্রশান্তি অনুভব করলো। কিন্তু মুখে বলল,

— ‘ ইশশ বাপ-মেয়ের কতো আহ্লাদ! ‘
— ‘ এই পাখি, দিন দিন তুমি বড্ড হিংসুটে হচ্ছো! ‘
— ‘ ছাই হচ্ছি। ‘
— ‘ মুখেমুখে তর্ক করো? ‘
— ‘ তর্ক করার জন্যই মুখ দেওয়া হয়েছে। ‘
— ‘ আমার ক্ষেত্রে কিন্তু ভিন্ন। শুধু তর্কই নয় বরং অনেককিছুই করা যায়। এক্সামপল চাও নাকি? ‘

সাদিদের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসিটা দেখে নীলা এবার নিভে গেল। তৎক্ষনাৎ লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল।
পিচ্চিটা তখনও একধ্যানে বাবা-মায়ের খুনসুটি দেখতে ব্যস্ত। সাদিদ লজ্জাবতীকে আর লজ্জায় না ফেলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ‘ বাবাই রাখি এখন? ‘

মেয়ে স্ক্রিনের দিকে হাত বাড়াতে চাইল। যেন বাবার মুখটা আলতো হাতে ছুঁয়ে দিয়ে চায়। সাদিদ একপ্রকার দমবন্ধ করেই কল কাটলো। আর আবারও বিরামহীনভাবে কাজে লাগলো। এখন যে আরও দ্রুত সব কাজ শেষ করতে হবে। আদুরে প্রাণগুলোর কাছে ফিরতে হবে যে।

_________________

নিস্তব্ধ রাত্রির সবাই যখন ঘুমে বিভোর সাদিদ তখন পদ্মলয়ায় পা রাখলো। অতিদ্রুত সব কিছু শেষ করতে যেয়েও শেষ করতে পারলো না। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে সে নিজেই দরজাটা খুলে ভেতরে গেল। সিঁড়ি বেয়ে দক্ষিণ পাশের রুমটার সামনে আসতেই তার বুকচিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো।
দরজাটা সে আসবে বিধায় চাপা দেওয়া ছিল। সাদিদ হালকা করে ধাক্কা দিয়ে একপ্রকার বিনা শব্দেই ঘরে প্রবেশ করলো। নীলচে আলোয় বিছানায় ঘুমন্ত তুই মানবীকে দেখেই তার ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি ফুটে উঠল। অফিসিয়াল জামা-কাপড় নিয়েই সে ওয়াসরুমে ডুকে গেল। একেবারে শাওয়ার শেষে ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে আসতেই কিছুটা অবাক হলো।
কেননা নীলা ততক্ষণে ঘুমঘুম চোখে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে। ঘরের মৃদু নীলচে আলোর সাথে এখন বেডসাইড টেবিলের ডানপাশের টেবিল ল্যাম্পটাও জ্বালানো। যার ধরুন প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখটা সেই আলোতে অনেকটাই দৃশ্যমান। সাদিদ তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতেই এগিয়ে আসলো।

— ‘ উঠে পড়লে যে? ‘
— ‘ এমনি। ঘুম ভেঙে গেল। আপনি আমাকে ডাকেননি কেন? ‘

সাদিদ তার প্রশ্নের প্রতিউত্তর দিলো না। বরং ভেজা তোয়ালেটা চেয়ারের উপর মেলে দিয়ে নীলার কাছে এগিয়ে আসলো। নিচু হয়ে নীলার মাথায় সময় নিয়ে নিজের পুরুষালী রুক্ষ ঠোঁটগুলো ছুঁইয়ে রাখলো। নীলাও তার কাজে বাধা দিলো না। নিঃশব্দে, নিঃসংকোচে স্বামীর একান্ত ভালোবাসা উপভোগ করলো।
সাদিদ তাকে ছেড়ে নিজেই টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে দিয়ে ঘরটাকে নীলচে আলো-অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখলো। অতঃপর নীলার অপরপাশে গিয়ে ঘুমন্ত মেয়ের ছোট্ট শরীরটাকে নিজের সাথে আঁকড়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করলো।
নীলা এতক্ষণ কেবল নিঃশব্দে সাদিদকে দেখলো। কিচ্ছুটি বললো না। কেননা ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে আসার পরপরই নীলা তার ক্লান্ত মুখে মলিন হাসিটা খেয়াল করেছে। সাদিদ যেহেতু নিজে কিছু বলেনি তাই নীলাও তাকে ঘাটতে গেল না। বলার হলে সাদিদ নিজেই তাকে বলবে। এতোটুকু বিশ্বাস তো নীলার তাকে চোখবন্ধ করেই হয়। তাই কেবল কোমল হাতটা প্রিয়তমের ভেজা চুলে গলিয়ে দিলো। খুবই যত্নের সাথে কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতে লাগল।
নীলার স্পর্শে সাদিদ আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারলো না। এই সর্বনাশা রমণী যে তার সবকিছুতেই নিজের রাজত্ব চালায়। কষ্টটুকুও তাকে একা ভোগ করতে দেয় না। এতটাই পাষাণ সে!
সাদিদ উবু হয়েই মুখটা একটু উপরে তুলে নীলার চোখে চোখ রাখলো। অতঃপর শান্ত সিক্ত স্বরে বলল,

— ‘ প্রাণপাখি, একটু বুকে আসবে? ‘

নীলা সম্মোহনের মতো নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। অতঃপর সাদিদের পাশে গিয়ে তার ছোট্ট নরম শরীরটা বলিষ্ঠ বুকে মেলে দিলো। সাদিদ কালবিলম্ব করলো না। তৎক্ষনাৎ শক্ত পোক্ত হাতগুলো দিয়ে নীলাকে নিজের সাথে একপ্রকার পিষে নিলো। বুকের ভেতরের ঝড়টা যেন বিপরীত কালবৈশাখীর ন্যায় অগ্নিয় ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরেছে। খুব যেন প্রশান্তি। ঘুমন্ত মেয়েটা না উঠে যায় যার ধরুন সাদিদ বলিষ্ঠ পুরুষালী হাতে তুলোর মতন নরম শরীরটাকে আলতোভাবে কোলে তুলে নিলো। রুমের ধূসর বর্ণের ডাবল সোফাটায় প্রিয়তমার নরম শরীরটাতে তখন নিজের ভেতরকার ঝড়ের বাতাস বয়তে লাগলো। আগ্রাসী কামড়ে, চুমুতে নীলা তখন তিরতির করে কাঁপছে। সবেমাত্র গোসল করার পরও সাদিদের সিক্ত শরীর বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো। সে মাথা গলিয়ে পাতলা সাদা ট্রিশার্টটা খুলে মেঝেতে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলল। দক্ষ হাতে নীলার বিনুনি করা চুলগুলোও মেলে দিলো। অতঃপর পরনের খুবই মোলায়েম পাতলা জামাটাতে হাত দিলো। কিন্তু এবার নীলা বাধা দিতে চাইলো। দুর্বল হাতটা দিয়ে সাদিদের হাত চেপে ধরল। সাদিদ একবার ঘাড় উঁচিয়ে নীলার মুখের দিকে তাকালো। হালকা নীলচে আলোতেও প্রিয়তমার রক্তিম মুখশ্রী তার নজর এড়ালো না। তাই ধরে রাখা হাতটাতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। নীলার হাতের চাপ নিমিষেই আলগা হয়ে এলো। সাদিদ ঝুকে এসে উন্মুক্ত গলায় মুখ গোঁজল। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির মৃদু ঘষায় নীলার হাতগুলো তখন সাদিদের মাথার পিছনের মসৃণ চুলগুলো টেনে ধরেছে। সাদিদ আরও নিচে নেমে এলো। এবং একান্ত ব্যক্তিগত জায়গায় শরীরে ঝড় তোলা উষ্ণ স্পর্শ দিলো।
নীলচে আলোয় বদ্ধ রুমে কতক্ষণ এই প্রেমের মাতলামি চললো সেটা ঘড়ির কাটাতে সময় নির্ধারণ করা কষ্টকর।

— ‘ কি হয়েছে বলুন আমাকে? আপনি এতো অস্থির কেন? আসার পর থেকেই দেখছি। ‘

সাদিদ উত্তর দিলো না। কেবল নীলার বুকে আরও মুখটা গোঁজে নীলার ডানহাতটা তার মাথায় রাখলো।

— ‘ চুলগুলো টেনে দাও। ‘

নীলা আর পূর্ববর্তী প্রশ্নের টান এনে সাদিদকে বিরক্ত করলো না। খুবই যত্ন নিয়ে নিয়ে কোমল হাতগুলো চুলের ভাঁজে চালাতে লাগলো।

— ‘ তানহা আজকে সুইসাইড এট্যাম্প করার চেষ্টা করেছিলো। ‘

দীর্ঘ সময়ের নীরবতার রেশ টেনে সাদিদের আচমকা এমন একটি কথাতে নীলার চক্ষুযুগল আপনাআপনিই গোলগোল হয়ে এলো।

— ‘ কি! ‘
— ‘ তোমার খারাপ লাগবে চিন্তা করে এতদিন তোমাকে জানাইনি। কিন্তু আজকে যেন সবকিছুর উর্ধ্বে চলে গিয়েছে। তানহার মেন্টাল কন্ডিশন অনেক দিন থেকেই খারাপের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। কারাগারের প্রথম কিছুদিন পাগলামো করতো। কর্তৃপক্ষ তার পরিবারের লোকদের ইনফর্ম করে। সেই সুবাদে আমি, ভাইয়া এবং মা-বাবাও জানতে পারি। কিন্তু তোমাদের ইচ্ছে করেই বলা হয়নি। শুধু এতটুকুতেই শেষ হলে পারতো। কিন্তু কালক্রমে সেটা আত্মহত্যা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। আজকে অফিসে ফুফু এসেছিল। রাগের মাথায় অনেককিছুই বলে গিয়েছে। তাইতো বাসায় আসতে এতোটা লেইট হলো৷ কেননা অফিস থেকে সোজা হসপিটালে গিয়েছিলাম৷ ভাগ্য ভালো ছিলো বিধায় হয়তো লাস্ট পর্যায়ে এসে বেঁচেছে। নতুবা…

সাদিদ বাক্যটুকু সমাপ্ত করতে পারলো না। ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। মাথা তুলে নীলার দিকে তাকাতেই অন্ধকারেও জলে টলমল করা প্রিয়তমার চোখগুলো সাদিদের নজর এড়ালো না। সাদিদ নিমিষেই তাকে নিয়ে পাল্টি খেয়ে নীলাকে নিজের বুকে টেনে নিলো। দুইহাতে চোখের জল মুছে দিয়ে মুখটা আঁজলা ভরে ধরলো।

— ‘ এসব করো বিধায় কিন্তু এতদিন কথাগুলো জানাইনি। কান্না বন্ধ করো। তুমি জানো না এটা যে আমি সহ্য করতে পারি না? কান্না বন্ধ করো নীলাঞ্জনা। ‘

শেষের কথাটুকুতে হালকা ধমকের রেশ ছিল। যার ধরুন নীলা মুহূর্তেই চোখ-মুখ মুছে ভদ্র বালিকা।

— ‘ তোমাকে আজকেও বলতাম না। কেবল তানহার জন্যই বলতে হলো। ওর মানসিক কন্ডিশন ভালো না। হসপিটালের বেডে শুয়েই আমার কাছে বায়না ধরেছে তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিতে। তুমি যেন একবার হলেও যাও। তাই অনিচ্ছা স্বত্বেও তোমাকে এসব জানালাম। কেন যেন মেয়েটার অবস্থা দেখে মুখের উপর না করতে পারিনি। ছেলেবেলার খেলার সাথী তো। তারউপর বোন। তাই হাজারও খারাপ মুহূর্ত মনে থাকলেও তার মধ্যে কিছু ভালো সময় অজান্তেই স্মৃতিপটে চলে আসে। ‘
— ‘ আমি আপুকে দেখতে যাব। কবে নিয়ে যাবেন? ‘

সাদিদ নিঃশব্দে মলিন হাসলো। সে তো এটা আগে থেকেই জানে। তার পাখিটা যে বড্ড নরম। শরীরটার থেকে মনটাও যেন আরও কয়েকগুণ বেশি কোমল। শত্রুপক্ষের থেকে হাজারও আঘাত পাবার পরেও তাদের ব্যাথায় তার চক্ষু ম্লান হয়। তাদের আঘাতে মন কাঁদে।
সাদিদ হালকা ঝুঁকে এসে নীলার নরম কোমল গালগুলোতে ছোট্ট করে চুমু দিলো। অতঃপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে পুরুষালি ঘন স্বরে ভীষণ আদরের ছোঁয়া মিশিয়ে বলে উঠল,

— ‘ তোমাকে ভালোবেসে আমি ভুল করিনি নীলাঞ্জনা। একদমই করিনি। ‘

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here