আমার গল্পে তুমি পর্ব-১০

0
1865

#আমার_গল্পে_তুমি
//পর্ব-১০//
#সাদিয়া

সকাল থেকে আরনাফের মুডের বারো দুগুনে চব্বিশ টা বেজে আছে। তার মাথা এতো পরিমাণ গরম হয়ে আছে যে এখন যদি তার মাথায় ডিম ভেঙে দেওয়া হয় তাহলে তা ফুল বয়েল না হলেও হাফ বয়েল হয়ে যাবে খুব সুন্দর ভাবে। আরনাফ নিজের চেম্বারে বসে পেশেন্ট দেখছে আর দাঁত কিড়মিড় করছে। সে বুঝতে পারছে না আশার মাথায় হঠাৎ তাকে বিয়ে দেওয়ার খেয়াল কিভাবে আসলো। কিছু তো একটা হয়েছে আরনাফের আড়ালে যা সে বুঝতে পারছে না। পেশেন্ট দেখতে দেখতে ক্লাসের সময় হয়ে যাওয়ায় সে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

—জীবনটা এতো বেরঙিন কেন? কোনো আনন্দ নেই। এতো বিষাদময় জীবন কারো ভালো লাগে ধুর।
আপন মনে বকবক করতে করতে আরনাফ ক্লাসের দিকে যাচ্ছে তখনই লাগে সংঘর্ষ! সংঘর্ষের ফলস্বরূপ আরনাফ ধপাস করে নিচে পড়ে যায়।

—ও বাবা গো আমার কোমড়টা গেলো। উফফ এই কোন ইডিয়েট রে ধাক্কা দিলো।

আরনাফ উপরে তাকিয়ে দেখে একজন কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
—স..সরি স্যার।

আরনাফ দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
—স্টুপিড একটা ধাক্কা দিয়ে সরি বলা হচ্ছে।

—আ..আসলে আ..আমি দেখিনি স্যার সরি।

—ইচ্ছে করে করেছো এমন তাইনা? ওই দিন রেস্টুরেন্টে একটু কি বকেছিলাম তার প্রতিশোধ তুমি এমন ভাবে নেবে ছি।

সাদিয়া আরনাফের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। তাই সে প্রশ্ন করলো,
—প্রতিশোধ? কিসের প্রতিশোধ?

—বলছি বলছি আগে আমাকে উঠতে সাহায্য করো। হাতটা দাও।

সাদিয়ার কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে।তবে কিছু করার নেই। সে অস্বস্তি নিয়েই আরনাফের দিকে হাত এগিয়ে দিলো। সাদিয়া আরনাফকে উপরের দিকে টেনে যাচ্ছে কিন্তু একবিন্দুও নাড়াতে পারছে না।

—আজকে সকালে খাও নাই তুমি?

—খেয়েছি।

—হ্যাঁ সে তো দেখতেই পারছি।
বলেই ঝাড়ি দিয়ে সাদিয়ার হাত সরিয়ে দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়ালো আরনাফ।

—শোনো কন্যা খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করবে। যেই তুলোর মতো শরীর তোমার একটা দমকা হাওয়া আসলে তো তোমাকে আর খুজেও পাওয়া যাবে না।

—আপনি কি এবার আমাকে আপমান করছেন।
আরনাফ একটু অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
—আমি তোমায় কখন অপমান করলাম? আমি তো শুধু ফ্যাক্ট বললাম তোমাকে। বাই দ্যা ওয়ে তুমি এতো চিকন কেন?
একটু থেমে কিছু একটা ভেবে আবার বললল,
—আচ্ছা তোমার ওয়েট কত?

—জানেন না মানুষকে তার ওজন জিজ্ঞেস করতে নেই?

—কি বলো এসব? তাই নাকি? কই আমি তো জানতাম না। আমি তো রোজ কম করে হলেও ৩০-৩৫ জনকে তাদের ওজন জিজ্ঞেস করি। আর তারাও কি সুন্দর আমাকে তাদের ওজন বলে দেয়। তুমিই একমাত্র যে ত্যাড়ামি করছো।

সাদিয়ার এবার পাগল হওয়ার উপক্রম। আরনাফকে এখন সাদিয়ার কাছে পাগলাগারদ থেকে পালানো কোন পাগল ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হচ্ছে না।এই লোককে দেখে মনে হয় এই লোক এমন ধরণের কথা বলতে পারে।

—ও হ্যালো কোথায় হারালে বলো তো? আর এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

—আপনার বাসায় জানে?

—কি জানবে?

—এই যে আপনি একটা আস্ত পাগল।
বলেই হনহন করে সাদিয়া ক্লাসে ঢুকে গেলো।আর আরনাফ দাঁড়িয়ে ভাবছে সাদিয়া তাকে পাগল কেন বলে গেলো। হুয়াই? আরনাফের হঠাৎ খেয়াল হলো সে আর রেগে নেই। তার মেজাজ এয়ারকুলারের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে।

—বাহ্ ঝাঁসির রানী ম্যাজিক জানে।
মুচকি হেসে আরনাফ ক্লাসে প্রবেশ করলো।ক্লাস শেষে আরনাফ গেলো ওটিতে। আজ তার তিনটা ওটি আছে। ওটিতে তাকে অ্যাসিস্ট করবে ডা.রিয়া। মেয়েটা কিছুদিন হলো এমবিবিএস পাশ করেছে। কিন্তু ভাব এমন করে মনে হয় উনি কত্তোবড় একজন স্পেশালিষ্ট। এই মেয়েকে আরনাফের একদম সহ্য হয় না। গায়ে পড়া মেয়ে।

—আরে আরনাফ তোমার দেরি হলো কেন? আমি কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

আরনাফ হাসি মুখে জবাব দিলো,
—ডা.রিয়া আমি যতটুকু জানি আমি আপনার সিনিয়র একজন ডাক্তার তাই আমাকে নাম ধরে ডাকাটা আপনার শোভা পায় না। আর আমার এটাও মনে হয় আমার বয়সটাও আপনার থেকে বেশি। আর আমার থেকে বয়সে ছোট কেউ আমাকে তুমি করে বলবে এটা আমার পছন্দ নয়। আশা করি বুঝতে পেরেছেন?

আরনাফের কথায় রিয়ার মুখটা চুপসে গেলো। রিয়ার মুখের এমন বেহাল দশা দেখে আরনাফের প্রচন্ড হাসি পেলো। সে নিজের হাসিটা চেপে রেখে একজন নার্সকে সবকিছু রেডি করতে বলে চেঞ্জ করতে চলে গেলো।

♣️
ক্যান্টিনে বসে একের পর এক আইসক্রিম খেয়ে চলেছে আদিবা। তার পাশেই গালে হাত দিয়ে বসে আছে সাদিয়া।
—কি ভেবেছে কি এই ছেলে? হ্যাঁ কি ভেবেছে? যখন খুশি তখন ব্রেকআপ করে দিবে আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো? এটা হবে না কোনো দিন হবে না।

—আদিত্য ভাইয়া কোথায় ব্রেকআপ করলো? তুই না করলি ব্রেকআপ এখন আদিত্য ভাইয়ার দোষ কেন দিচ্ছিস?

—ও এখন তুইও ওই রামবলদের দলে। বাহ্ বাহ্ ভালো খুব ভালো। এই দিন দেখবো বলে আমি তোকে আমার বেস্টফ্রেন্ড বানিয়েছিলাম।

আদিবার কথায় সাদিয়া রীতিমতো বিরক্ত হচ্ছে।
—আদিবা আমাদের পরীক্ষার আর বেশিদিন বাকি নেই।

—জানি তো। এখন কি হয়েছে?

—আমার অনেক পড়া বাকি।

—তো?

—তো তুই তোর ড্রামার দোকান ওফ করলে আমি বাসায় যেতে পারি আর ওখানে গিয়ে পড়তে বসতে পারি।

সাদিয়ার কথায় আদিবা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠে। সাদিয়ার এখন নিজের কপাল চাপড়াতে মন চাচ্ছে।

—আরে আদিবা তুমি কাদঁছো কেন এভাবে?
তৃতীয় ব্যক্তির গলার স্বর পেয়ে দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে ডা.সিফাত হাতে এফ্রোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ডা.সিফাতকে দেখে আদিবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করা সামলেও সে ফুঁপিয়ে চলেছে। আদিবার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে এবার ডা.সিফাত সাদিয়াকে প্রশ্ন করে,
—ওর কি হয়েছে সাদিয়া?

—ব্রেকআপ হয়েছে।

সাদিয়ার উত্তরে ডা.সিফাত ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।

—কিহ্?

—জ্বী।

ডা.সিফাত অদ্ভুত ভাবে আদিবার দিকে তাকায়। তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এই মেয়ের সাথে কোন ছেলে প্রেম করে? কোন ছেলের এতো ধৈর্য যে এই মেয়ের মতো কথায় কথায় রণচন্ডী রূপ ধারণকারী মেয়েকে সহ্য করে? একবার কলেজের একটা ছেলে সাদিয়াকে কি না কি বলেছিলো পরে আদিবা ওই ছেলেকে এমন মার মেরে ছিলো এই ছেলে সাত দিন বিছানা থেকে উঠতে পারে নি।

—কি হলো স্যার কি ভাবছেন?

ডা.সিফাত মুচকি হেঁসে জবাব দিলো,
—ভাবছি আদিবার প্রেমিকের ফাটা কপালের কথা।

ডা.সিফাতের কথায় সাদিয়া শব্দ করে হেসে উঠে। সাদিয়ার হাসির শব্দ যেন ডা.সিফাতের বুকে গিয়ে আঘাত করে। এই মেয়ে এতো হাসে কেন? আর এই মেয়ের হাসির শব্দ এতো ভয়ংকর কেন তাই ভেবে পায় না ডা.সিফাত। সাদিয়ার হাসির শব্দ ডা.সিফাতের সবচেয়ে প্রিয়। যদিও সাদিয়ার সবকিছুই তার কাছে ভালো লাগে। ভালোবাসা জিনিসটাই এমন ভালোবাসার মানুষের সকল খারাপ গুন গুলোও প্রেমিকের ভালো লাগে যায়। এই কলেজের ইয়াং টিচার হিসেবে ডা.সিফাতের সকল স্টুডেন্টদের সাথে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ডা.সিফাত খুব অল্প সময়েই সকল স্টুডেন্টের সাথে মিশে যায়। এখন তার দলে আরনাফ যুক্ত হয়েছে।তারা স্টুডেন্টদের কাছে টিচার কম বন্ধু বেশি।আর হবে না-ই বা কেন তাদের দুজনের কেউই এখনো ত্রিশের কোঠায় পৌঁছায়নি।

ক্যান্টিনের সামনে এসেই আরনাফের ঠান্ডা হওয়া মাথা আবার গরম হয়ে যায়।আপনাআপনি তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।সেই সাথে চোখ গুলোও লাল বর্ণ ধারাণ করে। দেখে মনে হতে পারে আগুন বের হচ্ছে। সেই আগুন ডা.সিফাতকে ভস্ম করে দিতে যথেষ্ট। সে বড়বড় কদম ফেলে সাদিয়া আর ডা.সিফাতের দিকে এগিয়ে যায়।
—কি চলছে এখানে।

এবার আদিবা সবার আগে মুখ খুলে
—দেখুন না স্যার সিফাত স্যার আর সাদিয়া কেমন হাসছে।

আরনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—হ্যাঁ সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু হাসছে কেন?

এবার ডা.সিফাত বলে,
—আদিবার ব্রেকআপ হয়েছে।
বলেই সাদিয়া আর ডা.সিফাত একসাথে হেসে উঠে। আরনাফ ভ্রু কুঁচকে একবার সাদিয়া আর ডা.সিফাতের দিকে আরেকবার আদিবার দিকে তাকাচ্ছে। সে ঠাওর করতে পারছে না এখানে ঠিক কি হচ্ছে। একটা মেয়ে ব্রেকআপের দুঃখে কাঁদছে আর দুইজন তা দেখে হাসছে।সিরিয়াসলি?

—ওর ব্রেকআপ হয়েছে ও কাঁদছে আর তোমরা হাসছো?

—ওর এমন ব্রেকআপ দিনে দুই বার আর সপ্তাহে চৌদ্দ বার হয়।

আরনাফের চোখ কপালে। সপ্তাহে চৌদ্দ বার ব্রেকআপ? এ-ও সম্ভব?

—আদিবা তোমরা দিনে দুইবার আর সপ্তাহে চৌদ্দ বার ব্রেকআপ করলে প্রেম কখন করো?

আরনাফের এমন প্রশ্নে আদিবার থেমে যাওয়া কান্না আবার শুরু হয়ে যায়। আদিবার কান্নার শব্দে আপর তিনজন একসাথে শব্দ করে হেঁসে উঠে।

—আচ্ছা সাদিয়া তুমিও কি কাউকে ভালোবাসো? তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই?

ডা.সিফাতের প্রশ্নে সাদিয়ার হাসি থেমে যায়। মুখশ্রীতে নেমে আসে অমাবস্যা। চোখ দুটো ভরে আসে তপ্ত অশ্রুতে।

#চলবে…..ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here