আমার গল্পে তুমি পর্ব-১৫

0
1719

#আমার_গল্পে_তুমি
//পর্ব_১৫//
#সাদিয়া

মৃদ্যু কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। শীত বিদায় নিয়েছে হাতেগুনা কয়েক দিন। সকালের দিকে রোদের দেখা পাওয়া কষ্টকর। দুপুরের দিকে রোদের দেখা মিললেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।

নিজের রুমে কম্বল মুড়ে শুয়ে আছে সাদিয়া। আসলে সে শুয়ে শুয়ে অচেনা আগন্তুকের কথা ভাবছে। সাদিয়া এতোদিন এটাকে নিজের ভ্রম ভেবে আসলেও কালকে তার ভ্রম কাটে যে এটা তার ভ্রম ছিলো না! সে ছিলো সত্য! সাংঘাতিক সত্য! বিছানার এক পাশে সাদিয়া আগন্তুকের চিন্তায় মত্ত আর তার পাশেই আদিবা আদিত্যের সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত। আদিবা কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সাদিয়াকে অনবরত খুচিয়ে চলেছে। এটা আদিবার পুরোনো অভ্যাস তাই এই নিয়ে সাদিয়া কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে না।

—দিয়ু আপু..আদিবা আপু.. তোমাদের কাকি ডাকছে। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে আসো।

—আসছি তুই যা।

বলে সাদিয়া কম্বল দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলো। তার পুরো শরীরে যেন আলস্য ভর করেছে।
—উফফ এই শীতের দিনেও কেউ বিয়ে করে?

—করে তো! আর বিয়ে না করলেও অসহায় কিছু সিঙ্গেল ছেলেপেলে এই শীতকালে বিয়ের ইচ্ছে পোষণ করে! আর এখন তো শীতকাল চলে গেছে।

আদিবার কথায় ভ্রু কুঁচকালো সাদিয়া। সাদিয়ার তাকানো দেখে আদিবাসী বললো,
—বুঝিস নাই তাই-না?
সাদিয়া উপর নিচে মাথা ঝাকালো। এতে যেন আদিবা বলার আগ্রহ পেলো।
—শোন তবে..

আদিবা কিছু বলতে যাবে তার আগেই বাহির থেকে আরশির গলার আওয়াজ ভেসে আসে।
—এই যে দুই মহারানী ডাক্তার সাহেবাগণ! আপনাদের সকাল কি এখনো হয় নাই? তাড়াতাড়ি বাইরে আসুন। অনেক কাজ পরে আসে।

—আসছি আরশি আপু তুমি যাও।

—এই সাদি?

—হু বল।

—আমরা কি বিনা বেতনের কর্মচারী রে?

—কেন বলতো?

—কেন আবার, কই ভাবলাম বদল ভাইয়ের বিয়েতে ফাটিয়ে ইনজয় করবো তা না কাল থেকে এটা ওটা করতে করতে কোমড়ের আমার বারো দুগুনে চব্বিশটা বেজে গেছে।

আদিবার কথায় সাদিয়া ছোট ছোট চোখ করে বললো,
—তা কালকে থেকে আপনি ঠিক কি কি কাজ করেছেন শুনি?

আদিবা কিছু না বলে আমতা আমতা করতে করতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। আদিবার যাওয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে সাদিয়া আবারো কম্বলে নিজের মুখ লুকায়।

.
বিয়েতে আদিবদের বাসার কেউ আসতে পারবে না। কালকে রাতে আদিবের ফুপাতো ভাই শিহাবের কার এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়। অতিরিক্ত পরিমাণে মাদক সেবন করে ড্রাইভ করছিলো যার কারণে ভারসাম্য হারিয়ে বড় গাছের সাথো গাড়িটির ধাক্কা লাগে আর পুরো গাড়িতে আগুন লেগে যায়। একটু আগে মিসেস আয়শা ফোন করে এসব জানালেন।
শিহাবের মৃত্যুর কথা শুনে সাদিয়া মনে মনে কোথাও যেন খুব একটা শান্তি পেলো। এই ছেলের জন্য সাদিয়াকে কম অপমান সহ্য করতে হয় নি। কম কাঁদতে হয় নি। সেই ভয়ংকর রাতের কথা মনে হলে সাদিয়ার পুরো শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠে।

সেদিন ছিলো আরশির গায়ে হলুদ। সাদিয়া নিজেকে হলুদ শাড়িতে আবৃত করেছিলো। সাথে হালকা কিছু গহনা আর বরাবরের মতো চোখ ভর্তি কাজল। এতো মানুষের কোলাহল সাদিয়ার ভালো লাগছিলো না বলে ঘরে চলে এসেছিলো। ঘরে তখন কেউ ছিলো না। সবাই স্টেজে মজা করতে ব্যস্ত। সাদিয়া যখন রান্না ঘরে পানি খেতে যায় তখন সে তার পিছনে কারো অস্তিত্বের টের পয়। সাদিয়া বরাবরই একজন ভিতু মেয়ে। সে ভয় পেয়ে যায়। আচমকা কেউ পিছন থেকে তার কোমড় জরিয়ে ধরে। অনেক কষ্টে সাদিয়া লোকটিকে সরিয়ে তার দিকে ঘুরে দেখে এটা শিহাব। শিহাবের মুখে বিশ্রী হাসি।
—শি…হাব ভাই? আ…আপনি এখানে?

—তোমাকে কম্পানি দিতে আসলাম বেবি। তুমি একা একা বোর হচ্ছো তাই আসলাম।

—আ..আপনি এখান থেকে যান শিহাব ভাই।

—কেন বেইবি আমার সঙ্গ কি তোমার ভালো লাগছে না।
বলেই শিহাব সামনে আগাতে লাগলো।
—আ..আপনি এভাবে সামনে এগুচ্ছেন কেন শিহাব ভাই?

শিহাব কোনো কথা না বলে সাদিয়ার হাত চেপে ধরে। সাদিয়া অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারলো না। শিহাব যখনই নিজের মুখটা সাদিয়ার দিকে আগাতে নেয় তখনই কেউ তাকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দূরে ঠেলে দেয়। সাদিয়া সামনে তাকিয়ে দেখে আদিবের মা, বাবা আর আরশির বর শিশির দাঁড়িয়ে আছে। সাদিয়া দৌড়ে গিয়ে মিসেস আয়শাকে জরিয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠে।

—তোর এতো বড় সাহস তুই আমার বাড়িতে এসে আমার মেয়ের সাথে অসভ্যতা করিস? আজ তো তোকে আমি মেরেই ফেলবো।
এতটুকু বলে আদিবের বাবা শিহাবকে চড় দিতে গেলে শিহাব তার হাত ধরে ফেলে। এতে আদিবের বাবার রাগ আকাশচুম্বী হয়। এতোক্ষণে সবাই এখানে এসে জড়ো হয়ে গেছে।

—কি হয়েছে ভাই? তুই শিহাবকে মা’রতে কেন যাচ্ছিো?

—কি হয়েছে তা তোর এই চরিত্র’হীন ছেলেকে জিজ্ঞেস কর। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে সে আমার মেয়ের সাথে অসভ্য’তামি করেছে।

—কি বলছো ভাই আরশিকে তো শিহাব নিজের বড় বোনের মতো দেখে। আর আরশি তো এতক্ষণ স্টেজে ছিলো সবার সাথে। আর আমার ছেলে মোটেও এমন হয় ভাই।

—ও আরশির সাথে নায় সাদিয়ার সাথে অসভ্য’তামি করেছে।

সাদিয়ার নাম শুনতেই আদিবের ফুফুর মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠে। এই মেয়েকে তিনি একদম সহ্যই করতে পারেন না। এই মেয়ে একেবারে তার গলার কাটা হয়ে বিধে আছে। একে তিনি না পারছেন গিলতে আর না পারছেন উগলাতে।

—আমার কোনো দোষ নেই মা। সাদিয়াই আমাকে এখানে একা ডেকেছিলো।

শিহাবের কথায় আদিবের ফুফু সাদিয়াকে যেন পেয়ে বসে।
—আমার ছেলেকে মারার আগে এই অপয়া মেয়ের গালে দুইটা দাও ভাই। এই মেয়ে আমার ছেলের মাথা খেয়েছে। আগে তো এই মেয়ে নিজের বাপ-মা আর স্বামী খেয়ে শেষ করেছে আর এখন আমার ছেলের পিছনে পড়েছে।

তিনি থামছেন না। একের পর এক কটু কথা তিনি সাদিয়ার উদ্দেশ্য বলে চলেছেন। আদিবের বাবার ধমকে সেদিন ক্ষান্ত হন তিনি। আদিবের বাবা শিহাবের এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দেয়। যার জন্য সাদিয়ার প্রতি আদিবের ফুফুর রাগ আরো বেড়ে যায়। কিন্তু তিনি চাইলেও সাদিয়াকে কিছু করতে পারবেন না।

সেদিন আদিবের বাবার জন্য সাদিয়া বেঁচে যায়। কিন্তু সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা সে আজো ভুলতে পারে না।
শিহাবের মতো নিচু মানসিকতা সম্পন্ন মানুষেরা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তাই তাদের আল্লাহ্ পেয়ারা হলেই ভালো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাদিয়া নিজের কাজে মন দেয়। বিয়ে বাড়িতে কাজের আভাব নেই!

.
—স্যার আপনি যেমন যেমন বলেছিলেন তেমন করেই শিহাবের মৃত্যু এক্সিডেন্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে। তার তার সাথে রিপোর্টে এ-ও বলা হয়েছে শিহাব একজন ড্রাগ এডিক্টেড পার্সন।

—গুড। কিন্তু তোমাকে আরো একটা কাজ করতে রাসেল।

—কি কাজ স্যার।

—শিহবকে বাসায় নিয়ে যেতে আরো এক ঘন্টা সময় লাগবে। আর তোমার কাছে এই এক ঘন্টা সময় আছে।

—কি করতে হবে স্যার?

—শিহাবের বাসার প্রত্যেকটা কোণায় সিসি টিভি ক্যামেরা লাগাতে হবে।

রাসেল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
—সিসি টিভি ক্যামেরা কেন স্যার?

অন্ধকারে বসে থাকা লোকটি বাঁকা হাসে বলে,
—আমি শিহাবের মায়ের কান্না দেখতে চাই রাসেল! সন্তানের জন্য একজন মায়ের হৃদয়বিদারক যে চিৎকার আমি সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে চাই রাসেল!

রাসেল অবাক হয়ে তার স্যারের দিকে তাকালো। আজকে রাসেলের মনে হচ্ছে সত্যি তার স্যার একজন হৃদয়হীন মানুষ। বিনা শব্দে রাসেল রুম ত্যাগ করে।

মনিটরের স্ক্রিনে সাদিয়ার হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবি ভাসছে। অন্ধকারে বসে থাকা মানবটি আলতো করে সাদিয়ার ছবিতে হাত বদলাচ্ছে।
—চিন্তা করো না পাখি সবাই সবার কৃতকর্মের শাস্তি পাবে। সবাইকে শাস্তি পেতে হবে। কেউ বাঁচতে পারবে না। সবার শান্তির ঘুম কেড়ে নেবো আমি। আমাদের সাথে হওয়া প্রত্যেকটা অন্যায়ের শাস্তি তাদের পেতে হবে। সবাইকে পেতে হবে। সবে তো শুরু। কেউ ছাড় পাবে না। কেউ না।

ঘন্টা খানেক পরে আবার রাসেল আসে।
—কি রাসেল? অল ডান?

—ইয়েস স্যার। ওদের পুরো বাড়ি এখন সিসি টিভির আওতায়।

অন্ধকার মানব বাঁকা হেঁসে রাসেলকে বিদায় জানায়। রাসেল প্রস্থান করতেই সে সাদিয়ার ছবির দিকে তাকিয়ে বলে,
—চলো পাখি আমরা রিয়েলিটি শো দেখি!

শিহাবদের বাড়িতে মৃত্যুর শোক। শিহাবের বাবা-মা ছেলের অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না। শিহাবের মায়ের চিৎকার বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে। শিহাবের মায়ের চিৎকারের শব্দ শুনে অন্ধকার মানব পৈশাচিক হাসি হাসছে। এ এক তৃপ্তির হাসি! সুখের হাসি!
—কাঁদো আরো বেশি করে কাঁদো। এটাই তোমাদের প্রাপ্য। আজকের পর থেকে কান্না-ই হবে তোমাদের সঙ্গী। যেখানে যাবে সেখানেই কান্না পাবে। এটা তোমাদের পাপের। তাই কষ্ট পেয়ো না। মেনে নাও। মানিয়ে নাও। যত তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে পারবে কষ্ট তত কম পাবে। সবে তো শুরু!

মনিটরটা বন্ধ করে অন্ধকার মানব আলোর দিকে পা বাড়ায়।

#চলবে…..ইনশাআল্লাহ
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পার্টটা কেমন হইছে জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here