আমার গল্পে তুমি পর্ব-১৯

0
2616

#আমার_গল্পে_তুমি
//১৯//
#সাদিয়া

আদিবকে আজ তিন দিন পর রিলিজ দেওয়া হয়েছে। আশা আদিবকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু আদিবের মায়ের জোরাজুরিতে আদিব নিজের বাড়িতেই গেলো। যাওয়ার সাময় আফিয়া অনেক কেঁদে ছিলো আদিবের জন্য। বারবার বলেছিলো “মামা যেও না যেও না।” আদিব অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাসায় গেলো।
নিজের রুমে এসে আদিব একটা গভীর নিশ্বাস নিলো। কতো দিন পর নিজের রুমে আসলো সে। ফোনটা বের করে সাদিয়ার ছবিতে একবার হাত বুলালো সে।
—চিন্তা করো না কাজললতা সব ঠিক করে দেব আমি। তোমার অভিমান গুলোও ভেঙে দেবো নিজের ভালোবাসা দিয়ে। খুব বেশি ভালোবাসি আমার কাজললতাকে । খুব বেশি ভালোবাসি!
সাদিয়ার ছবিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে আদিব ওয়াশরুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে দিলো এক ঘুম।

সন্ধ্যায় আদিব ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। সে গোধুলি দেখছে। তখন শিশির এলো দুই কাপ কফি নিয়ে। একটা কাপ আদিবের দিকে এগিয়ে দিলো।

—থ্যাংক্স শিশির ভাই। এটার দরকার ছিলো।

শিশির আলতো হাসলো। কফির মগের এক চুমুক দিয়ে বললো,
—তোর গাড়ি ব্রেক ফেল কিভাবে করলো বল তো?

আদিব মুচকি হেঁসে বললো,
—করে নি করানো হয়েছে।

শিশির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
—কে করেছে এটা?

—সিফাত!

—সিফাত? কোন সিফাত?

—ডা.সিফাত।

—কেন? তার সাথে তোর কিসের শত্রুতা? তার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছিস তুই?

—নিজের বউয়ের কাছে ভালোবাসা জাহির করেছিলাম। ওটা তেনার পছন্দ হয়নি। তাই এমনটা করলো।

—তুই তোর বউকে ভালোবাসার কথা বলবি এতে ওই ছাগলের কিসের সমস্যা?

আদিব আলতো হেসে বললো,
—কারণ ওই ছাগলও আমার বউকে ভালোবাসে। ওইদিন ক্যাম্পে যখন আমি আমার বউকে ভালোবাসি বলেছিলাম তখন ও লুকিয়ে তা দেখেছিলো। ওইখানে কিছু করেনি। ঢাকায় এসে মজাটা দেখালো আমাকে। ইশশশ হাতটা খুব ভালো ভাবেই ভেঙেছে।

শিশির আর কিছু বললো না। কিয়ৎকাল নিরবতা পালন করে বললো,
—শিহাবকে তুই মেরেছিস তাই না?
আদিব কিছু না বলে চমৎকার ভাবে হাসলো। তবে তার চেয়াল শক্ত।
—হুম ভালোই করেছিস ওটা মেয়ে। শালা এক নম্বর মেয়েবাজ। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই ময়না ছলাৎছলাৎ! তো আগে কি করবি কিছু ভেবেছিস? সবাই সত্যিটা কখন বলবি? আর তোর বউয়ের অভিমান কিভাবে ভাঙাবি ভেবেছিস কিছু?

—বউয়ের অভিমান ভাঙানোর অনেক সময় আছে। আগে তো সবাইকে সবার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিই।

—তুই যা ভাল মনে করিস।

পরদিন সকাল বেলা। আদিবদের বাসার ড্রয়িং রুমে সবাই বসে আছে। সকলের মুখ থমথমে। সকলে আদিবের জন্য অপেক্ষা করছে। সকলকে অরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে আদিবের আগমন ঘটলো। শান্তকে দেখতে পেয়ে আদিব তাকল জরিয়ে ধরলো। শান্ত এক ঝটকায় আদিবকে নিজের থেকে সরিয়ে নিলো। আদিব ঠোঁট উল্টে বললো,
—এতো দিন পর নিজের বন্ধুকে গলা লগাতেও দিবি না?
শান্ত বাজখাঁই গলায় বললো,
—কিসের বন্ধু? কে বন্ধু? আমার কোনো বন্ধু নেই। বলেই গটগট করে সোফায় গিয়ে বসে পড়লো।

আদিব একবার ড্রয়িং রুমে বসে থাকা সকলের দিকে তাকালো। ড্রয়িং রুমের এক কোনায় সাদিয়া দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক কেঁদেছে। আদিব হাসলে।
খালি সিঙ্গেল সোফায় বসলো যা তার জন্যই বরাদ্দ ছিলো।
আকিব আহমেদ আদিবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—এবার বলো কেন করলে এমন?

—বলছি তো আগে আসল মানুষকে আসতে দাও! সে না আসলে তো আসল মজা জমবে না।
কেউ আদিবের কথার মর্মার্থ বুঝলো না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে এসে উপস্থিত হলো আদিবের ফুফু আনোয়ারা আহমেদ। তিনি আদিবকে দেখে চিনতে পারলেন না। আদিবকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
—ও কে?

—ওমা ফুপি আমাকে চিনতে পারছো না? আমি তো তোমার বড় ভাইপো গো ফুপি। আদিব! আদিব আরনাফ আহমেদ!

আদিবের কথায় তিনি বিস্ফোরিত নয়নে আদিবের দিকে তাকালে।
—এ…এটা কি করে হতে পারে? ন..না এটা হতে পারে না। হতে পারে না এটা। আদিব বেঁচে থাকতে পারে না।
মিসেস আনোয়ারা কথা শুনে সকলে অবাক হলো।

—কি যা-তা বলছিস তুই এগুলো আনোয়ারা?
তিনি ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। চুপ রইলেন।
—আদিব তুমি কি সত্যিটা সবাইকে বলবে?

—বলছি বলছি। একটু পেশেন্স রাখো। কথাটা আমি কানাডা যাওয়ার দুই বছর পরের। ওইদিন ছিলো আমার প্র্যাকটিকেল ক্লাস। সকাল বেলা তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেলাম কলেজের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠে বুঝতে পারলাম আসল ফাইলটাই আনি নি। বাস ছেড়তে বাকি ছিলো পাঁচ মিনিট। তাই সাথে থাকা ক্লামেটের কাছে নিজের ব্যাগ আর আইডি কার্ডটা দিয়ে ছুটলাম ফাইল আনতে। বাস ছাড়ার শেষ মূহুর্তে বাসে উঠলাম। আমি বাসে উঠার মিনিট দুয়েক পরেই বাসটা মারাত্মক ভাবে এক্সিডেন্ট করলো। যেইখানে বাসটা এক্সিডেন্ট করেছিলো ওই খানে সচরাচর এমন ভয়ানক এক্সিডেন্ট দেখা যায় না। এক্সিডেন্টের পর কি হয়েছিলো আমার মনে নেই। কারণ এক্সিডেন্টের তিনদিন পর আমার জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করলাম। হাসপাতালের কেবিনের সোফায় একটা পত্রিকা পেলাম ওখানে আমার ছবি দিয়ে লেখা ছিলো “মেডিক্যাল কলেজের বাঙ্গালী ছাত্রের রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যু! ” কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আয়নায় নিজের মুখ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। কারণ আমার মুখের একটা পাশ খুব বাজে ভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এর পর দিন ওইপাশে সার্জারী করা হয়। যার কারণে আমার চেহারা ৫৫% বদলে যায়। যদি শিশির ভাই না থাকতো তাহলে হয়তো আমি বাঁচতে পারতাম না।
আদিবের শেষোক্ত কথায় সকলে শিশিরের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এতে শিশির ঘাবড়ে যায়।

—আ..আব তোমরা এভাবে আমার দিকে ক..কি দেখছো?

—তুমি সব জানতে শিশির?

—হ্যাঁ আপু শিশির ভাই সব জানতো। শুধু শিশির ভাই না মেহেদী ভাইও জানতো সব। ওরা দুজনের জন্যই সেদিন আমি বেঁচে গেছিলাম।

—কিন্তু তুমি নিজেকে আড়াল কেন করেছিলে আদিব?

—কারণ আদিবের মৃত্যু ঝুঁকি ছিলো।
মেহেদীর কথায় সবাই চমকে যায়। আকিব আহমেদ মুখ খুলে,
—কি বলছো কি?

—হুম। মেহেদী ঠিক বলছে। আদিবকে মারতে চেয়েছিলো কেউ।

—কে সে? কে আমার ছেলের জীবনের পিছনে এমন ভাবে পড়েছিলো।

—আপনার আদরের ননদ আন্টি! মিসেস আনোয়ারা আহমেদ!

মেহেদীর কথায় সকলে অবাক হয়ে মিসেস আনোয়ারার দিকে তাকায়। এতে মিসেস আনোয়ারা ঘাবড়ে যায়।
—এই ছেলে এই কি আবল-তাবল বকছো? আমি কেন আমার ভাইপোকে মারতে যাবো? আর তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে?

—প্রমাণ তো আছে ফুপি ডার্লিং। প্রামান তো আছে।
এই বলে আদিব নিজের মেমোরি কার্ডটা ড্রয়িং রুমে লাগানো স্মার্ট টিভিতে এড করে।
তখনই শিহাবের চেহারা ফুটে উঠে। শিশির বলছে,
—আমার মামাতো ভাই আদিবের এক্সিডেন্ট আমি করিয়েছিলাম আমার মায়ের কথায়। তিনি আমাকে বলেছিলেন এমন ভাবে আদিবকে শেষ করতে যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে আর কিছু করতেও না পারে।

ভিডিও ক্লিপটি দেখে সবাই যেন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আকিব আহমেদ শান্ত কণ্ঠে বললেন,
—কেন করলি এমন?

—করেছি বেশ করেছি। তুমি কেন নিজের সকল সম্পত্তি আরশি আর আদিবের নামে লিখে দেবে? আমার যে দুটো ছেলে আছে তাকি তোমার চোখে পড়েনি? তুমি তো সবসময় বলতে শিহাব আর সামির তোমার কাছে নিজের সন্তানের মতো তাহলে কেন তাদেরকে সম্পত্তি দিলে না? বলো কেন কেন?

—তুই সম্পত্তির জন্য এসব করেছিস?

—হুম করেছি তো? ভেবেছিলাম আদিবকে মেরে দিয়ে সামিরের সাথে আরশির বিয়ে দিয়ে দেবো। কিন্তু আমার মাথা মোটা ছেলে কোথা থেকে এক মেয়ে ধরে এনে বিয়ে করে নিয়েছে। তার পর ভাবলাম কৌশলে তোমার কাছ থেকে আদিবের নামে থাকা সম্পত্তি শিহাবের নামে করিয়ে দেবো। কিন্তু নাহ্ তুমি তো আমার জন্য সেই পথও খোলা রাখলে না। আদিবের ভাগের সব সম্পত্তি ওই অপয়া মেয়েটার নামে করে দিলে।

মিসেস আনোয়ারার কথায় সকলে অবাক হয়। কারণ সাদিয়ার নাম সম্পত্তি লিখে দেওয়ার ব্যাপারে কেউ জানতো না। আকিব আহমেদ খুব গোপনে কাজটা করেছিলেন।
—এই অপয়া মেয়েটাকে প্রথম থেকেই আমার সহ্য হতো না। কিন্তু কিছু কারার ছিলো না। সম্পত্তি তো আমার চাই। তাই শিহাবকে সাদিয়ার পিছনে লেলিয়ে দিলাম। ভেবেছিলাম সাদিয়ার সাথে শিহাবের নাম জরিয়ে ওদের বিয়ে দিয়ে দেবো আর বিয়ের পার খুব সহজেই সম্পত্তি নিয়ে নিতে পারবো। কারণ এই মেয়ে তো কোনো কাজের না। যে যা বলে মুখ বুজে সব সহ্য করে।

আদিব এবার কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা সাদিয়ার দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি এখনো নিচের দিকে।
পুলিশ ডেকে মিসেস আনোয়ারাকে এটেম্ট টু মার্ডার কেসে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সবাই আদিবের পরিস্থিতি বিবেচনা করে আদিব কেও ক্ষমা করে দেয়।

এতোকিছুর মাঝে সাদিয়া নিরবে আদিবদের বাসা ত্যাগ করে এটা কারো চোখে না পড়লেও আদিবের চোখ এড়ায়নি। শিশিরকে বলে সেও সাদিয়ার পিছন পিছন বেরিয়ে যায়।

#চলবে….ইনশাআল্লাহ
(আজকে তো সবার সব কনফিউশান ক্লিয়ার হওয়ার কথা। যদি আরো প্রশ্ন থাকে করতে পারেন। নেক্সট পার্টে উত্তর দিয়ে দিবো। আস্সলামু আলাইকুম)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here