আনকোরা পর্ব-১৪

0
2976

#আনকোরা

#রূবাইবা_মেহউইশ
১৪.

“দ্যাখ চৈতী বারবার বলছি ফ্যান বন্ধ কর। তোর ঘরে না এসি ছিলো সেটা কোথায়?”

” এসি তো আরও বছর খানেক নষ্ট হয়ে গেছে । এরপর আর টাকার অভাবে লাগায়নি।” কথাটা বলার সময় চৈতী তার মুখভঙ্গি একেবারে বেচারি বেচারি করে রইলো তা দেখে দিহান শোয়া থেকে বসে বলল, “একদম ঠাটিয়ে একটা লাগাবো৷ তোর বাপের টাকার অভাব!”

“পারোই শুধু যখন তখন থাপ্পড়ের ভয় দেখাতে। বড় হয়ে একদম দুনিয়া কিনে নিছে যেন!”

“বেশি বকবক না করে এ ঘর থেকে বের হ আমি ঘুমাবো৷ তুই মামীর কাছে গিয়ে ঘুমা।” দিহান আবার শুয়ে পড়লো। কিন্তু এরই মধ্যে সুইটি এসে চৈতী বলে বাইরে থেকে ডাকলো।

“মা ঘরে এসো বাইরে থেকে ডাকছো কেন?” দিহান তড়িঘড়ি আবার উঠে বসলো সেই সাথে চৈতীকে চোখ রাঙালো তার কথার জন্য। চৈতী এখনও অত চালাকি করা বুঝতে না পারলেও দিহান সবটাই বোঝে। চৈতীর মা একটু সময় নিয়ে পরেই ঢুকলেন ঘরে৷ হাতে তার একটা নকশি কাঁথা।সে চৈতীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “বাইরে বৃষ্টি এখনও, রাতে ঠান্ডা লাগলে এটা নিস তোরা।কম্বল তো আবার বেশিই ভারী গরম লাগবে।”

“তোরা!” বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করলো চৈতী।

“আমি আজকে তোমার সাথে ঘুমাই?”

“তোরা বাবা আসতেছে তো।”

বাবা আসবে শুনে চৈতীর মুখে আর কোন কথা আসলো না। তার খুব ইচ্ছে করলো এই বৃষ্টির রাতেই বাড়িটা ছেড়ে চলে যেতে। অভ্রকে সে যতোই ভালোবাসুক বাবার চেয়ে বেশি না। কিন্তু বাবার প্রতি যে অভিমান, অভিযোগ আর রাগের পাহাড় জমে আছে তা কি করে সরাবে অন্তর থেকে! দিহান পরিস্থিতি বুঝতে পারলো এও বুঝলো আজও চৈতীর সাথেই থাকতে হবে। কিন্তু এই লুঙ্গি!

“মামী আমাকে মামার ট্রাউজার দিয়েন তো!”

দিহানের কথায় চৈতী আর সুইটি দুজনেই তাকালো। মা-মেয়ের তাকানোতে হঠাৎই লজ্জা লাগলো দিহানের। না চাইতেও আবার বলে ফেলল, “আমি আসলে লুঙ্গি পরে ঘুমাতে পারি না।”

সুইটি আর দাঁড়ালেন না। এবার তারও আজব লাগছে কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করতে পারছে না। তিনি যেতে যেতে চৈতীকেও যেতে বললেন। কিছু সময় বাদেই চৈতী তার বাবার একটা পায়জামা আর গেঞ্জি এনে দিলো দিহানকে। ট্রাউজার পরেই তার পাগল পাগল অবস্থা। চাঁদ খান খুব লম্বা মানুষ দিহান ততোটা নয়। কিন্তু তাই বলে মামার ট্রাউজার পরার পর যে তার নিজেকে লিলিপুট বলে মনে হতে পারে এ কথাটা ধারণায় ছিলো না কখনো৷ চৈতীও খুব লম্বা, তাদের বংশের প্রায় প্রত্যেকেই লম্বা। দিহানদের পরিবারে তার মা আর দিশানও খুব লম্বা কিন্তু দিহানের উচ্চতা তার বাবার মত। একেবারে লম্বা নয় আবার বেঁটে খাটোও বলা চলে না। দিহান পায়জামার পায়ের দিক প্যান্টের মত ভাঁজ করতে চাইলে তা ঠিকঠাক হচ্ছে না। আর এই দেখে চৈতী খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। রাত বাড়ছে আবার বৃষ্টিও খানিকটা কম। কিন্তু গায়ের তাপমাত্রা দিহানের অস্বাভাবিক রকম বাড়ছে৷ সে বুঝতে পারছে তার জ্বর আসবে আসবে ভাব। তাই আপাতত চৈতীর হাসিতে মনযোগ না দিয়ে সে চুপচাপ শুয়ে পড়লো কাঁথা মুড়ি দিয়ে। চৈতীর হাসি নিমেষেই বন্ধ হয়ে গেল তা দেখে। তারও দু চোখের পাতায় ঘুম নামতে চাইছে। আবহাওয়া আজ হঠাৎ হঠাৎই বর্ষা কিংবা শ্রাবণের রুপ ধারণ করছে। ঘরের বাতি বন্ধ করতেই চৈতীর মনে পড়লো অভ্র তাকে আজ একটি মেসেজ দিয়েছিলো। সমরেশ মজুমদার এর লেখা দুটো লাইন,

তুমি যখন যেভাবেই ফিরে আসো তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। তুমি আমার রক্তে মিশে গেছো আর রক্ত কিভাবে ধুয়ে ফেলতে হয় আমি জানি না।

—সমরেশ মজুমদার

চৈতী মেসেজটা সিন করেও আর জবাব দিলো না। সে অভ্রকে চায় কিন্তু তাই বলে অভ্রের মা, বোনের মাথার ছায়া সরিয়ে নয়। অভ্র এতোটা আবেগি কেন হচ্ছে সে জানে না কারণ, তাদের সম্পর্কের গভীরতা অন্তত মা, বাবার কষ্টের চেয়ে বেশি নয়। চৈতী বিছানায় বসতেই টের পেল দিহান খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আজ অব্দি কখনো সে খেয়াল করেনি দিহান ঘুমালে তার নিঃশ্বাসের আওয়াজ কতোটা স্পষ্ট হয়। কিন্তু আজ শুনে মনে হচ্ছে এটা স্বাভাবিক শ্বাস নেওয়া নয়। আবার বিছানা ছেড়ে সে বাতি জ্বালালো। ভালো করে খেয়াল করলো দিহানের ঘুম গভীর হয়েছে কিনা। কাছে এসে ভয়ে ভয়েই দিহানের কপাল ছুঁলো চৈতী। তার ধারনাই ঠিক দিহানের শরীরে জ্বর উঠছে। তাপমাত্রা কিছুটা বাড়তি। কিন্তু এখন কি তার মাকে ডাকতে যাওয়া উচিত হবে! আবার মনে পড়লো মা বলেছে বাবা আসবে। আজ বাবা কেন আসবে! আর কখন আসবে? ভেবে কাজ নেই আর বাতি বন্ধ করে সেও বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো।

বৃষ্টি থেমেছে বেশি সময় হয়নি৷ দিশানকে আজ শ্বশুর বাড়ি এসেই খাওয়া নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। আসার পর থেকে একের পর এক খাওয়া চলছেই। পেট ভর্তি কিংবা আর খাবো না বললে কেউই শুনছে না কথাটা। বাধ্য হয়েই সে রাত দশটা বাজতেই ঐশীকে বলল, “এ্যাই শোনো, দরজা বন্ধ করে বাতি বন্ধ করো৷ সবাই যেন ভাবে আমরা শুয়ে পড়েছি। খাওয়া নিয়ে অত্যাচার আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”

দিশানের কথায় ঐশী হাসতে হাসতে তার গায়ের ওপর পড়ছে। বেচারা সত্যিই নাকাল হচ্ছে এই খাওয়া নিয়ে তা সে দেখেছে৷ সেই সাথে তার ভাই বোনের দল আবার পকেটও সাফ করেছে তার। বিয়ে আর বৌভাতেই তার কার্ড খালি হয়ে গেছে শালা শালির আবদার মেটাতে। একবার তো ঐশীকে বলেই ফেলেছে, “তোমার ভাই বোনরা কতদিন ধরে উপোষ করে আছে গো!”

ঐশী এ কথায় অবাক হলো ভীষন, “মানে!”

“মানে আবার কি, কাল গেট ধরা, হাত ধোঁয়ানো আর জুতা চুরি বাবদ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা মেরে দিয়েছে আমার। আজ আবার বলছে তাদের নাকি দ্বিতীয় বাসরের ট্রিট দিতে হবে! মগের মুল্লুক নাকি৷ আমার পকেট কেটে এরা মাস্তি করবে!”

“অন্যায় তো কিছু করছে না। তারা তাদের আদরের বোন দিয়ে দিয়েছে আর তুমি সামান্য কিছু টাকা দিতে পারবে না দিশান! আমার মান সম্মান এখন সব যাবে ছোট ভাই বোনদের কাছে!” মুখ ফুলিয়ে ঐশীও চমৎকার অভিনয় করে নিলো। দিশান বেচারা সত্যিই ফান্দে পড়ে গেছে বিয়ে করে। ওদিকে আবার গায়ে হলুদে নিজের কাজিনদের বর আর বউদেরও কত কি দিতে হলো। ঐশীর ব্ল্যাকমেইল কাজে দিয়েছিলো। দিশান আবারও সাত হাজার টাকার ট্রিট দিলো রাতের বেলা দ্বিতীয় বাসরের লোভে। শালা শালির দল টাকা নিয়ে তাকে এনে ঐশীর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেই বুঝতে পারল সে ধোঁকা খেয়েছে। দ্বিতীয় বাসর আবার কি বউ তার এখন প্রতি রাতই বাসর রাত। শালা শালিরা তো ঘরে ফুল তো দূর একটা আগর বাতিও দেয়নি। ঐশীকে সে বোকার মত জিজ্ঞেস করেছিলো, “আমাদের না দ্বিতীয় বাসর হওয়ার কথা তোমাদের বাড়িতে। কই রুম তো তারা সাজিয়েই দিলো না।”

“ইশ, কি শখ উনার! কালই না বাসর গেল আবার কিসের দ্বিতীয় বাসর ঘর!”

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে দিশান। তারপরই মনে হলো ভাইয়া কাজকর্ম ঠিকঠাক করে না তাই ভাইয়ার বিয়েতে খরচও দুই টাকা হলো না। আর আমি শালা পছন্দের মানুষকেই বিয়ে করছি তাও এ্যারেঞ্জের নামে লাখ লাখ টাকা জলে ভাসাইছি!

“কি হলো তোমার, ঘুমাবে না? আমার কিন্তু ঘুম পেয়েছে।” দিহানের বাবা কথাটা বলেই নিজের বালিশে মাথা রাখলেন। দিলশাদ হাতের মোবাইলটাতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু ভাবছে কিন্তু চোখ দেখে মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে দিবে। দিহানের বাবা তা লক্ষ্য করে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কি গো কিছু বলছো না যে!”

“দিহানের আব্বু, আমি কি দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ মা!”

শোয়া থেকে উঠে বসলো দিহানের বাবা।স্ত্রীর থমথমে মুখ আর এমন কথা শুনে তার ভেতরটা আৎকে উঠলো। দিলশাদকে তিনি বিয়ে করেছিলেন পরিবারের জোরজবরদস্তির মুখে পড়ে। আজও তাঁর মনে পড়ে দিলশাদকে বিয়ে করে বাড়িতে আনার পরের সময়টা। তাঁর নিজের একজন পছন্দের মানুষ ছিলো। কিন্তু পরিবার দিলশাদকে এনেছে। তিনি প্রথম প্রথম সমঝোতা করে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন দেখলেন এই লম্বাটে, ছেলে ছেলে আচরণ করা মেয়ে মানুষটা জীবনে একটা ধৈর্যের অধ্যায় হয়ে গেল। জীবনের কত সংকটময় মুহূর্ত আর ব্যবসায়ের সব কিছু পুড়ে ছাই হওয়ার মত লোকসানের ভয়ানক অধ্যায়টাতেও এই শক্ত মনের মহিলাটি তার কোমল জীবনের খুঁটি হয়ে পাশে ছিলো। কোন দিন তার চার আঙ্গুলে মসৃণ কপালটাতে তিনি ভয় কিংবা আফসোসের রেখা দেখেননি। আজ বিয়ের এতগুলো বছর পর যখন ছেলে মেয়ের নতুন নতুন সংসার হলো তখন এমন একটা বাক্য তাঁর ভেতরে ভয় তৈরি করলো। তিনি এগিয়ে দিলশাদের কাঁধে হাত রাখলেন৷

“এমন কথা বললে কেন!”

দিলশাদ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললেন। না চাইতেও মনের ভেতর জমা কষ্ট অশ্রুর স্রোতে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই সে নিজেই বলল, “দিশা আজ ফোন করেছে।”

“সে বলেছে তুমি খারাপ মা! আর তুমিও তাই সত্যি ভেবে কষ্ট পাচ্ছো?”

” তার দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। দিশানের বিয়ে তার পছন্দের মেয়ের সাথেই দিয়েছি। দিহান ছন্নছাড়া হয়ে পাগল হচ্ছিলো বলেই আমি ষড়যন্ত্র করে চৈতীকে দিহানের বউ করেছি৷ আমি স্বার্থপর মা৷ ছেলেদের জন্য আমার যত ষড়যন্ত্র অথচ মেয়ে বলে তাকে নাকি সবসময় দুরকম দেখেছি।” কান্নার বেগ বেড়ে গেল দিলশাদের।

“তুমি কেন তার কথা শুনে কষ্ট পাচ্ছো বলোতো? আমরা মেয়েকে মানুষ করতে পারিনি ঠিকভাবে তাই আমাদের শুনতেই হবে এমন কথা৷ দিশান তার পছন্দের মানুষকে তার সততা দিয়ে পেয়েছে, যোগ্যতায় পেয়েছে। আমাদের মেয়ে তো তেমন কিছুই করেনি। সে যা করেছে তাতে আমাদের সমাজে অপমানিত হতে হয়েছে। আর যদি বলে দিহানের কথা তবে দিহানও কোন অন্যায় করেনি। তার দূর্ভাগ্য উপরওয়ালা সেই মেয়েকে বেশিদিন হায়াত দেননি।”

রাত বাড়লো আর বাড়লো দিহানের জ্বরের তাপমাত্রা। চৈতী তার পড়ার টেবিলটাতে মাথা রেখে শুয়েছিলো ঘন্টাখানিক আগেই। ঘুমের ঘোরেই ঘাড়ের টনটনে ব্যথা টের পেতেই সে ঘাড় সোজা করে বসেছিলো। ঘরে মৃদু আলোটাও জ্বালিয়ে রাখেনি সে। ডান হাতে ঘাড়টা হালকা ম্যাসাজ করতে করতে আলো জ্বেলে দিলো। বিছানায় চোখ পড়তেই অবাক হলো সে। দিহান কাঁথা মুড়িয়ে একেবারে একটুখানি হয়ে শুয়ে আছে। তার গা কাঁপছে একটু একটু। চৈতী এগিয়ে গিয়ে কপালে হাত দিতেই চমকে উঠলো। জ্বর তার অনেক বেশিই। এত জ্বর কি করে এলো! ফোন নিয়ে সময় দেখলো রাত বারোটা বেজে গেছে। মা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে৷ কি করবে ভাবতে ভাবতে বালতিতে করে পানি আনলো। মাথায় পানি ঢাললে ভালো হবে। যেমন ভসবনা তেমন কাজ। পানি ঢালতে গিয়ে বাঁধলো আরেক বিপত্তি। দিহানের কাঁপুনি মাথায় পানি দিতেই দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তড়িঘড়ি আবার কম্বল নামালো নিয়ে জড়িয়ে দিলো৷ দিহানের ঠোঁট দুটো শুকিয়ে কেমন ফাঁটল ধরেছে। সে মাথায় পানি পেতেই চোখ মেলার চেষ্টা করলো। আধো আধো অস্পষ্ট উচ্চারণে চৈতীকে বারণ করলো পানি দিতে। চৈতী শুনলো না। একটানা আধঘন্টা পানি ঢেলে সেও অসুস্থবোধ করতে লাগলো ঘাড়ের ব্যথায়। পানি ঢেলে মাথা মুছিয়ে দেখলো দিহান কাঁপছে না তবে কেমন যেন নেশাতুর চোখে তাকিয়ে দেখছে তাকে। বিষ্ময়ে চৈতী ভাবতেই পারছে না এমন করে কেন তাকাচ্ছে সে! অস্বাভাবিক লাগলো তার দিহানের দৃষ্টি সেই সাথে ভয়ও হলো।

চলবে
( মন্তব্য আর পোস্ট করে প্রেডিকশন দিয়েন পাঠকগণ।শুধু আপনারাই পড়বেন তা কি ঠিক! আমিও পড়তে চাই 😌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here