আনকোরা পর্ব-২৩

0
2858

#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
২৩.

রাতের আকাশে গাঢ় অন্ধকারের ছাউনি।ঘড়িতে সময়ও কম হলো না। দিলশাদ যখন চৈতীর সাথে কথা বলতে এসেছিলেন তখন রাত দশটার ওপারে৷ সে চৈতীকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিলো, “তোদের মধ্যে কি শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিলো?”

দিলশাদের মুখে কথাটা শুনেই চৈতী মাথা নুইয়ে ফেলেছিলো৷ তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে লাগলো কোন পূর্বাভাস ছাড়াই আর এতেই দিলশাদ উত্তর পেয়ে গেল তাঁর প্রশ্নের। মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো তাঁর। সে রাতেই সে চৈতীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলো। চৈতী বারণ করলো এত রাতে এখন বের হলে বাড়ির সবাই টেনশনে পড়ে যাবে। এর চেয়ে ভালো কাল সময় করে একবার চলে যাবে। দিলশাদ হঠাৎ করে বলে উঠলেন রাতে তিনি চৈতীর সাথে ঘুমাবেন। সত্যি বলতে তার মন বলছে চৈতী তবে প্রেগন্যান্টই আর এ অবস্থায় চৈতীর মন মানসিকতা কতোটা বিধ্বস্ত কে জানে! হতে পারে মেয়ে গত তিন মাস ধরেই নিঃসঙ্গ রাতগুলো প্রচণ্ডরকম একাকীত্ব আর কষ্ট নিয়েই কাটাচ্ছে। সে পাশে থাকলে হয়তো মেয়েটা ছটফট করবে না। ভুল হয়েছে তার খুব বড় ভুল। দিহান যেদিন চলে গেছে সেদিন থেকেই চৈতীর পাশে থাকা উচিত ছিলো।রাতে সবাই যখন নিজেদের ঘরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন দিলশাদ চলে এলো চৈতীর ঘরে। তাকে দেখতেই চৈতী হাসিমুখে প্রশ্ন করলো, “তোমার কিছু লাগবে ফুপি?”

“না”

“তাহলে ঘুমাচ্ছো না কেন রাত তো অনেক হয়েছে।”

“ঘুমাতেই তো এলাম।”

ফুপির কথা শুনে চৈতী অবাক চোখে তাকায়।তার চাহনির বিষ্ময় ভাব স্পষ্ট দেখে দিলশাদ আবার বলল, “এখন থেকে তোর সাথেই ঘুমাবো আমি।”

“কি বলছো তুমি এসব? আমি কি একা ঘুমাতে পারি না!”

“পারিস কি না পারিস তা শুনতে চাইনি। আমি সাথে ঘুমাবো ব্যস।” বলেই দিলশাদ খাটে উঠে চৈতীর পাশে বসে। তার মাথায় হাত দিয়ে বলে, “আয় তুই শো আমি একটু হাত বুলিয়ে দেই মাথায়।”

“আরেহ না ফুপি তুমিও না! ফুপার শরীরটা ক’দিন ধরে খারাপ দেখছো না? তুমি এখানে থাকলে ফুপার পাশে কে থাকবে? আর তুমি যা ভাবছো তা নাও তো হতে পারে তাই না!”

“আমি অত কথা শুনতে চাচ্ছি না।”
দিলশাদ বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। চৈতী চাইছে না ফুপি এখন তার পাশে থাকুক। মনের সাথে যুদ্ধ তো এখনও অনেক বাকি। তাই আবারও জোর করলো এমনকি দিলশাদ যা ভাবছে তা সত্যি হলে মাস কয়েক পর থেকে সে নিজেই দিলশাদকে বলবে সাথে থাকতে৷ মন খারাপ করেই উঠে চলে গেল দিলশাদ। দিহানের বাবার শরীরটা বেশ কিছুদিন ধরেই এই ভালো, এই খারাপ তার উপর উচ্চরক্তচাপের রোগী। তাই দিলশাদও চৈতীর যুক্তির কাছে পরাজিত হয়েই চলে গেলেন। পরেরদিন সকালে নাশতার পর্ব শেষ হতেই দিলশাদ ফোন দিলেন অনামিকাকে। অনামিকা খন্দকার গাইনি চিকিৎসক তাই দিলশাদ ভাবলো তার কাছেই পরামর্শ নেওয়া যাক। ফোনে থাকা অনামিকার নাম্বারে ফোন করলেন দিলশাদ। প্রথম দু বার ফোন বেজে কেটে গেল রিসিভ হলো না। দিলশাদ ভাবলো হয়তো ছেলের বিয়ের প্রস্তাব এনে ফিরে গেল শূন্য হাতে তাই হয়তো এখন ইগ্নোর করছে। কিন্তু না তার ধারণা ভুল করে দিয়ে অনামিকা নিজেই কল ব্যাক করলো৷ দিলশাদের ভালো লাগলো ব্যপারটা। সে প্রথমেই চৈতীর কথা বলল না। আগে জিজ্ঞেস করলো অনামিকা কেমন আছে, তার পরিবারের সবাই কেমন আছে? এরপরই সে কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলল চৈতীর সমস্যা গুলো। সব শুনে প্রথমেই অনামিকা বলল হাসপাতালে যেতে। কিছু টেস্ট করা দরকার।ব্যস আর অপেক্ষা সয় না। দুপুরের পরই দিলশাদ চৈতীকে নিয়ে চলে গেল হাসপাতালে। সবরকম টেস্ট করা হতেই অনামিকা দিলশাদ চৈতীকে বাহিরে নিয়ে যেতে চাইলো একটু কোথাও বসিয়ে চা,কফি খাওয়াতে। সত্যি বলতে অনামিকারও চৈতীকে পছন্দ হয়েছিলো খুব তার ছেলের জন্য কিন্তু তাতো এখন আর সম্ভব নয় তবুও বন্ধুর মেয়ে, বোন হিসেবেই তাদের একটু আপ্যায়ন করতে চাইলো। দিলশাদ তা বুঝতে পেরেই বলল, “এখন না অনামিকা এটা তোমার ডিউটি টাইম।আমরা কোন একদিন তোমার বাড়ি কিংবা কোন এক আয়োজনে একসাথে হবো তখন আপ্যায়ন করো।”

কথার মাঝে দিলশাদ একবার অনামিকার ছেলের কথাও জিজ্ঞেস করলো সে এখন কোথায়? দিলশাদের চেনাজানা একটা ভালো মেয়ে ফ্যাশন ডিজাইনার চাইলে সে দেখাতে পারে বলল। অনামিকা জানালো আপাতত দরকার নেই কারণ ছেলে দু দিন আগেই তার কোন এক ডাক্তারি কোর্সে বিদেশে গেছে। এক বছর পর ফিরবে সে আর সম্ভব হলে ওখানেই স্যাটেল হবে। এরপর আর দিলশাদ আলোচনা বাড়াননি চৈতীকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। রিপোর্ট কাল সকালে এসে দিশান বা সে দিলশাদ এসে নিয়ে যাবে। অনামিকাও জানালো রিপোর্ট সে নিজে কালেক্ট করে তাকে ফোন করবে।

বাড়ি ফিরে চৈতী এক মিনিটও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ক্লান্তিতে তার শরীর নেতিয়ে গেল। দিলশাদ নিজের ঘরে গিয়ে বসে পড়লো ডিভানের ওপর।চিন্তা তাকে পুরোপুরি অসুস্থ করে দিচ্ছে ভেতর থেকে। আজকাল গরম পড়েছে খুব বাইরে। দিলশাদকে বাড়ি ফিরতে দেখেই ঐশী এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে আনলো বরফ মিশিয়ে। দিলশাদ শরবতের গ্লাস দেখেই বলল, “শরবতটা একটু চৈতীকে দিয়ে দাও মা।তার শরীরটা একদম ভালো নেই।”

দিলশাদের মুখটা ফ্যাকাশে,কপালটা কুঁচকে আছে। ঐশীর মনে হচ্ছে বড় কোন সমস্যা হয়েছে বুঝি চৈতীর!

“চৈতীর কি হয়েছে মা? ডাক্তার কি বললো?”

“টেস্ট রিপোর্ট পেলেই জানতে পারবো কি হয়েছে। কিন্তু আমার মন বলছে চৈতী প্রেগন্যান্ট।”

“কিহ!”

“হ্যাঁ ঐশী। মন বলছে আমার৷ আর এমনটা যদি হয় আমি দিহানকে কোনদিন মাফ করবো না। সে চৈতীকে ছেড়ে গেছে, পালিয়ে গেছে সব ছেড়ে। সত্যিই যদি তার সন্তান থাকে চৈতীর গর্ভে আমি তাকে এই সন্তানের খবরটাও তাকে জানতে দেবো না। সে পড়ে থাকুক তার মৃত প্রেমিকার আত্মা নিয়ে। অভিশাপ দিচ্ছি সে যেন তার সন্তানের মুখটাও দেখতে না পায়। আমি দেবো না তাকে দেখতে।”

“ফুপি!”

কাঁদতে কাঁদতে দিলশাদ যা মুখে আসছে তাই বলে চলছিল। আর তখনি দরজা বাইরে থেকে ডেকে উঠলো চৈতী।

“এ কেমন কথা বলছো তুমি?”

“ঠিকই বলছি রে, সে একটা অযোগ্য মানুষ। তার অধিকার নেই এমন সুখ দেখার। যে নেই তার জন্য যারা আছে তাদের অবজ্ঞা করে চলে গেল। তার ভালোর জন্য আমি কি না করতে চেয়েছি বল!”

ঐশী শ্বাশুড়ির কাঁধ জড়িয়ে আছে। বারবার বোঝাতে চাইছে রাগের মাথায় এমন কিছু যেন না বলে। দিহান ভাইয়া নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে তিনি ভুল করছেন৷ চৈতী ঘরে ঢুকে ফুপির পাশে বসলো। আলতো হাতে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল, “এখনও তো আমরা কিছু সঠিকভাবে জানিই না তাই না! এখন না হয় এসব কথা থাক তাকে কি দেখতে দেবে কি দেবে না। তুমি আগেই এত অস্থির হচ্ছো কেন বলোতো? অসুস্থ হলে কিন্তু আমরা সেবা করবো না কি বলো ঐশী আপু?”

ঐশী হাসছে চৈতীর কথা শুনে। দিলশাদও চৈতীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমাকে আর আমার ভাইকে ক্ষমা করে দিস রে মা। তোদের ভালো করতে গিয়ে তাড়াহুড়ায় ক্ষতিই করে দিলাম।”

“আহ্ মা, আপনি এসব কি বলছেন বলেন তো! আপনার মত বুদ্ধিমতী একজন মানুষের মুখে এসব কথা মানায় না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন খুব শিগ্রই সব ঠিক হবে। আর ভাইয়াও ফিরে আসবে দেখে নিয়েন।”

রাতের খাবার খেতে বসে আজও চৈতী কিছুই খেতে পারলো না। দিশা সোফায় বসে কাচা আম খাচ্ছিলো শুকনো মরিচ গুড়ো আর লবণ মাখিয়ে। সে চৈতী আর ঐশীকে ডাকলো তা খেতে৷ ঐশী ততক্ষণে প্লেটে ভাত নিয়েছে তাই বলল সে ঘুমানোর আগে মনে থাকলে খাবে৷ কিন্তু চৈতী অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো বেসিনের সামনে। তার বমি হলো না কিন্তু বমি বমি ভাবটা তীব্র অনুভব করলো। মাথাটাও কেমন ঝিম ধরে আছে৷ দিশা আম খেতে খেতে বলল, “চৈতী তুই কা টক আম। বমি লাগলেও ভালো লাগবে।”

সত্যিই তাই হলো; কাঁচা টক আম একটু মুখে দিতেই তার মনে হলো বমি ভাবটা কেটে যাচ্ছে। দিশার সাথে বসে আরো কয়েক টুকরো খেয়ে পরে নিজের ঘরে গেল। আজকাল রাত জাগতে কষ্ট হয় খুব৷ প্রয়োজনীয় কাজও নেই কিছু তাই খুব দ্রুতই সে ঘুমিয়ে পড়লো৷ আর ঘুমাতে ঘুমাতে সে দরজা লাগানো, বাতি অফ করা সবই ভুলে গেল। মধ্যরাতে তার গভীর ঘুমটা হঠাৎই ভেঙে গেল পায়ের ওপর কোন হাতের স্পর্শ পেয়ে। হাতটা গরম তবে শক্ত ছিলো৷ নিঃসন্দেহে হাতটা কোন পুরুষের ছিল কথাটা মস্তিষ্কে জানান দিতেই চৈতী ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। ঘরটা অন্ধকার কেন! চমকে উঠছে চৈতী। তার মনে আছে সে যখন ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়েছিলো তখন ঘরে বড় বাতিটা জ্বলছিলো।দরজাও সে লাগায়নি আজ। শরীরটা বেশ কাহিল থাকায় তার পানি পিপাসাও না মিটিয়েই ঘুমিয়েছিলো৷ ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে সে সুইচের দিকে যেতেই তার মনে হলো কেউ একজন বুঝি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে কিন্তু কে! বাতি জ্বালাতেই ঘরের চার কোণে নজর বুলালো৷ নাহ, কেউ নেই ঘরে তবুও ভয়ে ভয়ে আবার এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে৷ চোর টোর হলে তো নিশ্চিত কোন চিপায় লুকিয়ে পড়বে। দুরু দুরু বুকে বারান্দা, বাথরুম এবং পরে বসার ঘর, রান্নাঘর সব খুঁজলো চৈতী কিন্তু কোথাও কাউকে চোখে পড়লো না৷ একবার মনে হলো ফুপিকে ডেকে পাশে ঘুমাতে বলুক পরে ভাবলো থাক, এতে ফুপি চিন্তায় পড়ে যাবে। যতটুকু দোয়া,দুরুদ জানা ছিলো তাই পাঠ করতে করতে ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় গেল। বিছানায় শুতেই আবারও ঘুম নেমে এলো চোখের পাতায়।

পরেরদিন সকাল থেকেই দিলশাদ অস্থির হয়ে ফোন দিল অনামিকাকে। একজন সিজারের পেশেন্ট থাকায় সে ফোন এটেন্ড করতে পারেনি৷ বারোটার দিকে চৈতীর রিপোর্ট চেক করে সে নিজেই লাঞ্চ আওয়ারে এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে এলো দিহানকে বাড়িতে। আসতে আসতে সে পথে চাঁদের সাথে যোগাযোগ করে সুখবরটা প্রথমেই দিলো চাঁদ খানকে। আজ প্রায় অনেক গুলো বছর পর তাদের কথা হলো। সেই কথার সময়টাও ছিলো দীর্ঘ। সারা পথ কথা বলতে বলতে গাড়ি যখন দিহানদের বাড়ির সামনে এসে থামলো তখন ফোন কাটলো তারা। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলেছিলো ময়না খালা।

“দিলশাদ আপা কোথায়?”

“আফায় তো দোতালায় দিশান মামার বউয়ের ঘরে।”

“ওহ, এক কাজ করো আগে দিলশাদ আপাকে ডাকো আমি বসার ঘরে বসছি।”

ময়না খালা চলে গেলেন দিলশাদকে ডাকতে। দিশা মাত্রই গোসল সেরে বেড়িয়েছিলো৷ সে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ডাইনিংয়ের দিকে যাচ্ছিলো খিদে পেয়েছে বলে। ডাইনিং থেকে বসার ঘরের মাঝে উত্তর- পূর্ব কোণের একটা দেয়াল আছে তাই দক্ষিণ পাশটা খোলা। আর তাই কাবার টেবিল থেকে সোফায় কেউ বসলে তার পেছন থেকে মাথাটা দেখা যায় শুধু। দিশাও অনামিকার মাথা দেখে প্রথমে বুঝতে পারলো না কে এসেছে কিন্তু মানুষটা যে মহিলা তা তাঁর মাথার খোঁপা দেখে স্পষ্ট। টেবিলে রাখা ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে খেতে খেতে সে এগিয়ে গেল।

“আপনি?”

“আমি অনামিকা খন্দকার দিলশাদ আপার পরিচিত। তুমি কি দিহানের বোন?” অনামিকা ভালো করে তাকালো দিশার দিকে। সাত মাসের বেশি ভারী পেট আর গোলগাল চেহারাটা দেখেই অনামিকা আন্দাজ করলো। এমনিতেও দিশার চেহারা তার মা আর দিহানের সাথে কিছুটা মিলে যায়। তাতেই আন্দাজ করা যায় দিশা দিহানের বোন৷

দিশা মাথা নেড়ে জবাব দিলো, “আমাকে তুমি চিনবে না কারণ অনেক বছর যোগাযোগ ছিলো না তোমার আম্মুর সাথে। দিহানকে খুব ছোট দেখেছিলাম আমি।

ওহ আচ্ছা!

দিশা আর অনামিকার কথার মাঝেই দিলশাদ এসে দাঁড়ালো সামনে। চৈতী তখন নিজের ঘরে। ময়না খালা তাকে যখন বলল একজন মহিলা এসেছে হাতে মিষ্টির প্যাকেট তখন ভাবলো হয়তো দিশার শ্বশুরবাড়ির কেউ অথবা দিশানের। তবুও সে হাতে থাকা কাপড়গুলো না গুছিয়েই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বাইরে আজ রোদ থাকলেও বাতাসও আছে খুব৷ হুটহাট বাতাসের দমকে জানালার পর্দা ওড়ছে পত পত শব্দ তুলে। চৈতীর এ বাতাসে গা ভাসিয়ে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে খুব কিন্তু কেন জানি আজকাল ঘর থেকে বের হওয়ার শক্তিটাও পায়না ঠিকঠাক। কিন্তু কে এসেছে জানার আগ্রহ নিয়েই সে দূর্বল পায়ে এগিয়ে গেল বসার ঘরে। প্রথমেই চোখে পড়লো অনামিকার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। সে প্যাকেট খুলে মিষ্টি হাতে নিয়ে মাত্রই দিলশাদকে বলল, ” অভিনন্দন আপা আপনাকে,,,” কথা শেষ হওয়ার আগেই অনামিকা দেখলো চৈতীকে। তাই সে আবারও বলল, “অভিনন্দন তোমাকেও মামনি। সু খবর এসেছে রিপোর্টে। আমরা সবাই এবার নানী হবো। ওহ একটু ভুল বললাম আপা দাদী হবে।”
উচ্ছাসে ভেসে যাচ্ছে অনামিকার কন্ঠস্বর। কিন্তু সে খেয়ালই করেনি তার বলা সুখবরে বসার ঘরের উপস্থিত তিনটি মুখই থমথমে আর গম্ভীর হয়ে উঠেছে।

“কি ব্যপার আপা হা করেন। এত বড় একটা সংবাদে মিষ্টি না এনে পারলাম না। আমি তো আসতে আসতে পথে চাঁদকেও ফোন করে জানিয়েছি। আজ বোধহয় সুখবরের জন্যই যথাসময়ে ফোনটা তুলেছিলো সে।”

“চাঁদকে বলেছো!” এতক্ষণে দিলশাদের ঘোর ভেঙেছে। সে কোন এক অজানা ভয়ে যেন ভীত হয়ে গেল এবার।

“হ্যাঁ আপা। কি করি বলেন সত্যিই দারুণ একটা খবর এইটা।”

চৈতী নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো আগের জায়গা। সে তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে প্রেগন্যান্ট! সে একজন মানুষ আর তার মাঝে আরো একজন মানুষ এসেছে! ভাবতেই তার একটা হাত আপনাআপনি পেটের ওপর উঠে এলো। কোন অনুভূতিই তার অনুভবে আসছে না কেন? কেন সে বুঝতেই পারেনি এখানটায় কেউ আছে! হঠাৎ আসা জোয়ারের মত তার চোখে ছলকে উঠলো জল। বাঁধ ভাঙতে এখনো বাকি তবুও জল উছলে উঠছে। অনামিকা অনেকটা জোর করেই মিষ্টি পুরে দিলো দিলশাদের মুখে। চৈতীকে ডেকে পাশে বসিয়ে উপদেশ দিলো অনেক রকম এমনকি চৈতীর চেকাপটা সবসময় সে নিজে করবে বলেও আবদার করলো দিলশাদের কাছে। বাড়িতে একে একে সবাইকে জানানো হলো চৈতীর তেরো সপ্তাহের প্রেগন্যান্সির খবর। রাতে প্রায় ঘটা করেই দিহানের বাবা মিষ্টি আনিয়ে খাওয়ার আয়োজন করলেন। দিশান তো রীতিমতো খুশিতে মিষ্টি কাওয়া নিয়ে তার বাবার সাথে চ্যালেঞ্জ এর ব্যবস্থা করলো। আর ঠিক তখনি দিশানের ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা পকেট থেকে বের করতেই তার হাসিতে উজ্জ্বল মুখটা চুপসে গেল৷ দিহান ফোন করেছে। মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়েই সে ফোন রিসিভ করলো, “হ্যাঁ ভাইয়া বলো, কেমন আছো?”

ঘরের মধ্যে থাকা প্রত্যেক জোড়া চোখ একসাথে নিবদ্ধ হলো দিশানের ওপর। দিশান ভাইকে কিছু বলবে তার আগেই দিলশাদ ফোন চেয়ে নিলো। দিহান চলে যাওয়ার পর এই প্রথম দিলশাদ নিজে থেকে কথা বলতে চাইলো দিহানের সাথে। সে ফোন হাতে নিয়েই প্রথমে প্রশ্ন করলো, “কেমন আছিস?”

দিহান ভালো আছে মাকেও জিজ্ঞেস করলো কেমন আছে? কয়েক মিনিট কি করছে, কোথায় থাকছে, কি খাচ্ছে সব কথাবার্তা বলে আবার তার বাবাকেও বলল কথা বলতে। তিনি কথা বললেন কিন্তু অতি চতুরতার সাথে এড়িয়ে গেলেন চৈতীর খবরটা। তিনি এই চতুরতাটা শুধু মাত্র দিলশাদের গম্ভীরতা দেখেই করলেন। কারণ তিনি জানেন দিলশাদ নিজে যেহেতু দিহানকে খবরটা দেয়নি তারমানে সে কিছু ভেবে রেখেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত দিহান ফোনে ছিলো ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত ঘরের পরিবেশ নিরব রইলো। ফোন রাখতেই দিলশাদ চৈতীকে প্রশ্ন করলো, “তুই কি চাস দিহান খবরটা জানুক?”

“এসব কি বলছো তুমি শাদ! দিহান জানবে না তার সন্তান আসবে?”

“তুমি এখন কিছু বলো না দিহানের বাবা। আমি চৈতীর মতামত জানতে চাই৷ সন্তানটা যাদের মতামত তাদেরটাই চলা উচিত কিন্তু দিহান নিজেই সব ছেড়ে গেছে৷ আজ কতগুলো দিন সে বাড়ির বাইরে একটা দিন সে জানতে চায়নি তার স্ত্রী কেমন আছে? আচ্ছা তুমি আর দিশানই বলোতো দিহান এতগুলো দিনের মাঝে একটিবার জিজ্ঞেস করেছিলো চৈতী কেমন আছে? আমি জানি দিহানের সাথে তোমরা দুজন নিয়মিত কানেক্টেড ছিলে।” দিলশাদ থামতেই দিশান বলল, ” আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না। তুমি বা চৈতী যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই হবে।”

দিহানের বাবা আর কোন কথা খুঁজে পেলেন না বলার জন্য। দিলশাদ ভুল কিছু বলেনি কিন্তু তিনি খুব কষ্ট পাবেন দিহানকে সংবাদটা না দিলে। তাঁর বড় ছেলে বাবা হবে এই খুশিটা থেকে ছেলে বঞ্চিত হবে! কিন্তু এসব শুধু মনের কথা সিদ্ধান্ত তিনিও দিলশাদ যা নেবে তাই মানবেন। চৈতী অনেকটা সময় নিলো কিন্তু কিছু বলার মত উত্তর পেলো না। আর তা দেখেই দিলশাদ বলল, “ঠিক ততদিন দিহান কিছুই জানবে না যতদিন না চৈতী নিজে থেকে কিছু বলবে। সে ভাবুক সময় নিয়ে তার মন যদি বলে এ খবর তার স্বামী পাওয়ার যোগ্য তবেই জানবে সে।”

সময় চোখের পলকে গড়িয়ে যায় পানির মত। জীবনও কেটে যায় আপন গতিতে। জীবনের রং বদলায় সেই পেরিয়ে যাওয়ার সময়ের স্রোতে। চৈতীর জীবনেও বদলে যাচ্ছে দারুণভাবে। প্রেগন্যান্সির খবর পাওয়ার পর কেটে গেছে আরও তিন মাস। দিশার মেয়ে হয়েছে। বাড়িতে সারাক্ষণ এখন ছোট বাচ্চার কান্না আর বড়দের আহ্লাদী সব আওয়াজ শোনা যায়। চৈতীর শরীরের পরিবর্তন দ্বিগুণ হারে হয়ে গেছে। প্রথমে তো চৈতীই কিছুই খেতে পারেনি কিন্তু ইদানীং সে প্রচুর খায়। সকাল,বিকাল রাত তার খাওয়া চলতেই থাকে আর তা দেখে দিশান তো তাকে প্রায়ই ক্ষেপায় এটা সেটা বলে। দিলশাদেরও সময় কাটে দারুণ ব্যস্ততায় নতুন নাতি আর হবু মাকে নিয়ে। ঐশী এখন একেবারে গৃহিণী হয়ে গেছে সংসার সামলে। দিশাও বড্ড অলস সে তার বাচ্চাকে খাওয়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে চায় না। তাই বাধ্য হয়েই চৈতী আর দিলশাদ মিলে খেয়াল রাখে বাচ্চার। দিশার বাচ্চার যেদিন আকিকার অনুষ্ঠান করা হলো সেদিন আবির পুরো সময় দিহানদের বাড়িতে ছিলো। চৈতী যখন বাচ্চাকে নিতে দিশার ঘরে ঢুকলো তখন ঘরে আবির ছাড়া কেউ নেই। দিশা বাচ্চাকে নিয়ে দোতলায় ছিলো তা চৈতী জানতো না। আবিরকে দেখেই চৈতী ঘর ছেড়ে বের হতে গেলেই আবির বলল, ” কি যে করলো দিহানটা! না নিজে ঠিকমত খেতে পারলো না অন্যকে খাওয়ার সুযোগ দিলো, শালা!”

চৈতী স্পষ্ট শুনলো কথাটা এবং আবিরের কথার অর্থও সে পুরোপুরি বুঝলো। আর এ কারণেই তার রাগ উঠলো চরম পর্যায়ে। তাই না চাইতেও সে ঘুরে গেল আবিরের সামনে।

“একটা মেয়ের বাপ হয়েছেন৷ এখনও সময় আছে তওবা করে সৎ হোন তা না হলে কৃতকর্মের ফল কোন দিক দিয়ে পাবেন তা টেরও পাবেন না।”

চৈতীর কথাটা আবির গায়ে মাখলো বলে মনে হলো না। কিন্তু চৈতী আরো অনেকদিন আগেই টের পেয়েছিলো তার ঘরে মাঝরাতে সে বার আবিরই ঢুকেছিলো। হয়তো সুযোগের অভাবেই সেদিন কিছু করতে পারেনি। আকিকার অনুষ্ঠানের পর আবিরের বাবা ঠিক করলেন নাতনি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু দিহানের বাবা ধুমধামে নাতনি দিতে চান তাই তিনি সপ্তাহ খানেক পরের দিন ঠিক করলেন। অনুষ্ঠানের দিন সুইটি আর চাঁদ এলো এবার৷ তারা চৈতীকে ভিডিও কলে প্রায়ই দেখে কিন্তু চাঁদ নিজে আসতে পারে না বলে সুইটিকেও আসতে দেয়নি। তার এক কথা, মেয়ে তোমার একার নাকি? আমি না দেখতে যেতে পারলে তুমিও যাবে না। দেখবো দুজনে একসাথেই।” সুইটিও এই নিয়ে মেজাজ দেখিয়ে চাঁদের সাথে দু দিন কথা বলেনি। সে মুখ ফুলিয়ে চৈতীকে কত অভিযোগ করেছে চাঁদের নামে। চৈতী এখনও বাবার সাথে হাসিমুখে কথা বলে না কিন্তু তার কষ্ট হয় বাবার জন্যও। চাঁদ আর সুইটির সম্পর্কটা এখন অনেক ভিন্ন হয়ে গেছে। হতে পারে এটা সবসময় একসাথে থাকার কারণেই সুইটির মনের সংকীর্ণতা দূর হয়েছে। চাঁদের কাছেও এখন মনে হয় সুইটি সহজ হয়ে গেছে আগের থেকে আর এটা পাশাপাশি থাকার এক গুণ। আগে তো ছুটিতে অনেক দিন পর পর দু চার দিনের জন্য আসতো আর তার সর্বোচ্চ ছুটি হিসেবে থাকতো এক মাস। আর এতে দুজনের মধ্যে সুইটির মত ইন্ট্রুবার্ট মানুষটা সহজ হতে পারতো না।

বাড়িতে অনুষ্ঠান; চৈতী আজ কি পরবে কি পরবে করতে করতেই দিলশাদ এসে তাকে একটা কূর্তি ধরিয়ে দিলো। লং কূর্তি কিন্তু পেটের দিকটা বিশাল ঘেরওয়ালা সাথে ফিতাও যুক্ত আর নিচে স্কার্ট। চৈতী ড্রেস দেখে অবাক হয়ে তাকালো। কি সুন্দর পাকা লেবুর রঙের কূর্তি সাথে একেবারে হালকা গোলাপি রঙা স্কার্ট। সাথে ওড়নাটাও মিক্স রঙের। চৈতী ভীষণ অবাক হয়ে দেখছিলো বলেই দিলশাদ বলল, “অত অবাক হতে হবে না। এটা পরে আয় কয়েকদিনের মধ্যে তোর জন্য আরো কিছু কাপড় আনবো তখন হা হয়ে দেখিস সব।”

দিলশাদ চলে যেতেই চৈতী গোসল সেরে পোশাক পরে বেড়িয়ে গেল ফুপিকে দেখাতে। দিহান ভিডিও কলে দিলশাদ আর তার কোলে থাকা দিশার মেয়ে আরিশাকে দেখছে। চৈতী এসে ঘরে ঢুকে ফুপিকে ডাক দিতে গিয়েও থেমে গেল দিহানের আওয়াজ শুনে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো ফুপির কথা শেষ হলে পরে সে ফুপিকে দেখাবে ড্রেসটা। কিন্তু এরই মাঝে দিহান চুপ হয়ে গেল সে মনযোগে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার দৃষ্টি আটকে আছে মায়ের পেছনে থাকা ড্রেসিংটেবিলটায়। আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চৈতীর প্রতিচ্ছবি। পলকেই তার চোখ দুটো বিষ্মিত হলো, মাথার নিউরনে অনুরণন তুলল এক বিজলির মত সুক্ষ্ম যন্ত্রণা।এ কি চোখের ভুল নাকি যা দেখছে সত্যি!

“চৈতী!”

চলবে(এডিট করার সময় পেলাম না। কথা ছিলো আজ দিনের বেলায় গল্প পোস্ট করবো কিন্তু দুঃখিত লেখাই শেষ করতে পারিনি। আমি আমার সুবিধা, অসুবিধা দেখেই লেখাটা লিখবো। এতে হয়তো কখনো নিয়মিত দিবো কখনোবা গ্যাপ পড়বে। যে ধৈর্য্য নিয়ে পড়তে পারবেন পড়বেন যিনি পারবেন না পড়বেন না। আমি কারো কাছে বাঁধা নই গল্প লেখা নিয়ে। আজ এই কথাটা বলতে এক প্রকার বাধ্যই হলাম কিছু পাঠকের আচরণ দেখে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here