আনকোরা পর্ব-২৭ ২

0
2514

#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
২৭.(২য় অংশ)

মাথার ওপর নীল আকাশটা আজ কালো মেঘের দাপটে বিষন্নতায় গুমোট। শরীরের ভেতরে থেমে থেমে চলকে উঠছে রক্ত কণিকা অজানা এক ভয়ে। নিজের অজান্তেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তপ্ত জলের ধারা। আজ দ্বিতীয়বার দিহানের ভেতর আতঙ্ক কামড়ে ধরছে তার কলিজায়। প্রিয়ন্তিও যাবার আগে খুব ছটফট করেছিলো তারপরই তার হাতে মাথা রেখে শান্ত হলো সারাজীবনের জন্য; চৈতীও খুব ছটফট করছে আর মা বারবার তাকে বলছে হাত ধর মেয়েটার; সাহস পাবে। দিহান হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছে সবার সামনে। ডাক্তার তো এ অবস্থায় রোগীর পাশে তাকে কিছুতেই থাকতে দিবে না। কিন্তু সেও তো চোখের আড়াল করতে চায় না তাদের। দিলশাদ ভেবেছিলো চৈতীর লেবারপেইন উঠেছে কিন্তু চৈতীর তেমন কোন পেইন নেই। সে শুধু ব্যথা পাচ্ছে পেটের বা পাশটায় এমনটাই বলেছে। হাসপাতালে আনতেই ডাক্তাররা চেকাপ করেছে। অনামিকার রেগুলার পেশেন্ট চৈতী কিন্তু অনামিকা রাজশাহীতে আছে কোন এক কারণে। অন্য ডাক্তাররা বিভিন্ন রকম টেস্ট এবং আল্ট্রাসাউন্ডও করলেন বাচ্চা নড়ছে না একটা সমস্যা পাওয়া গেল। কিন্তু চৈতীর ব্যথার উৎসটা কিছুতেই ধরা পড়লো না। বাধ্য হয়েই অনামিকার সাথে যোগাযোগ করতে হলো। অনামিকার নির্দেশমত চৈতীকে একটা মেডিসিন দেওয়া হলো যার দরুণ তাৎক্ষণিক ব্যথাটা কমে গেল। কিন্তু তাকে আজ হাসপাতালেই রাখতে হবে। দিহান বসে রইলো নিথর ঘুমন্ত চৈতীর পাশে। দিলশাদও নড়ছে না কেবিন থেকে তাই ঐশীকেই বাড়ি ফিরতে হলো। দিশান আর তার বাবাও অনেকটা সময় হাসপাতালে ছিলো কিন্তু দিলশাদ বলল আপাতত হাসপাতালে কাউকে লাগবে না। তারা পুনরায় অফিসে ফিরলেও সকলের মন পড়ে রইলো হাসপাতালেই। সে দিনটা প্রত্যেকরই কাটলো সাংঘাতিক অস্থিরতা আর ভয় নিয়ে। কিন্তু রাতেই ডক্টর জানিয়েছিলো বাচ্চাটা বিপদমুক্ত কিন্তু সমস্যাটা আবারও দেখা দিলে হয়তো আর অপেক্ষা করা যাবে না। সিজারের পথ নিতেই হবে তখন। সারাদিন সবার এতোটাই ভয়ে কেটেছে যে, কেউ সুইটি কিংবা চাঁদকে একবার জানানোর কথা ভাবতেও পারেনি। পরেরদিন অনামিকা যখন হাসপাতালে এসে কথায় কথায় বলেছিলো এ সময়ে সুইটি আপার থাকাটা জরুরি ছিলো উনি কেন এলেন না! তখনি সবার খেয়াল হয়েছে সুইটিকে জানানো হয়নি। দিহান বাড়ি ফিরেছে শোনার পর থেকেই একটা অন্যরকম রাগে চাঁদ আর সুইটি কেউই দিলশাদের বাড়িতে আসতে চাননি৷ তারা চৈতীকেই বলেছিলো সে কি বাবা মায়ের সাথে থাকবে? তাহলে সুইটি ফিরে আসবে তাদের বাড়িতে আর চাঁদও নিয়মিত এসে দেখে যাবে। কিন্তু দিলশাদের আপত্তির মুখে পরেই চৈতী বলেছিলো সে এখানেই থাকবে। কিন্তু আজ আর কোন রাগ আটকাতে পারবে না তাদের। সুইটি খবরটা শোনা মাত্রই রওয়ানা হয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। চাঁদ তখন বাড়ির বাইরে তাই সুইটি চাঁদের কাছে খবর পাঠিয়েছে সে ঢাকা যাচ্ছে একাই৷ দু দিন পর চৈতীকে বাড়ি আনা হলো। দিহান দুটো দিন হাসপাতালেই পরে রইলো নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে। গাল ভর্তি খোঁচা দাঁড়ি, মাথায় উসকোখুসকো চুল আর কুঁচকে যাওয়া শার্ট, চোখ দুটো ক্লান্তিতে কতখানি দেবে গেছে৷ তাকে দেখে নিঃসন্দেহে বলা যায় অসুস্থ মানুষ সে নিজেই। বাড়ি ফিরেও তার মনে শান্তি নেই। চৈতীর শরীর প্রচণ্ড দূর্বল আর ওজনও কমে গেছে অনেকটা। বাচ্চা নাকি আগে পেটে লাথি দিতো কিন্তু এবার যখন নড়াচড়া বন্ধ হলো তারপর সুস্থ হয়েও আর তেমন একটা নড়ছে না। অনামিকা চৈতীকে বলেছে কোনমতে আর কিছুটা দিন সুস্থ থাকার চেষ্টা করো নয় মাসের মাঝামাঝিতেই সম্ভব হলে সিজার করে ফেলবো। বোঝা যাচ্ছে বাচ্চা কিংবা চৈতী কেউই পুরোপুরি ঠিক নেই। বাড়িতে এখন সারাক্ষণ একটা আতঙ্ক থেকেই যাচ্ছে। সুইটি আসার পর থেকে সে মেয়ের কাছ থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও সরছে না। দিলশাদ আর ঐশীও একটু পরপর এসে দেখে যাচ্ছে কিছু লাগে কিনা। দিহান আজ অফিসে গেছে কিন্তু তার মন টিকছে না একদমই। সাহস দেখিয়েই সে বিকেলে কল দিলো চৈতীর ফোনে। ফোনটা ছিলো দিলশাদের কাছে চৈতী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই। সে ইচ্ছে করেই কলটা না তুলে ময়নাকে বলল, “এটা চৈতীকে দিয়ে আয় তো।”

ময়না ফোনটা নিয়ে চৈতীর দিকে ধরতেই জিজ্ঞেস করলো কে কল দিয়েছে। ময়না জানে না বলে ফোনটা দিয়ে চলে গেল।ততক্ষণে কল কেটে গেছে। কল চেক করতে গিয়েই দেখলো পুনরায় কল এসেছে স্ক্রীণে “দিহান” নামটা জ্বলজ্বল করছে। গত দুদিনে চৈতীর হুঁশ ছিলো না তার পাশে কে থাকছে কে থাকছে না। কিন্তু সে দেখেছে দিহান পুরো সময় মাথার কাছেই ছিলো। রাগ, ক্ষোভ একেবারে উবে যায়নি কিন্তু কিছুটা ম্লান ঠিকই হয়ে গেছে। এখনও জেদ ধরে চাইলেই দিহানকে কষ্ট দেওয়া যায় কিন্তু কি নিয়ে কষ্ট দেবে! সন্তানের ক্ষেত্রে কোন কিছুই সম্ভব নয়। চৈতী ভেবে নিয়েছে সন্তানের কাছ থেকে এক মুহুর্তের জন্যও দিহানকে সে শাস্তি দেবে না শুধু নিজের সাথে জড়াবে না আর তাকে। কল রিসিভ করে কানে তুলতেই সে শুনতে পেল দিহানের ত্রস্ত কণ্ঠস্বর, “কেমন লাগছে এখন? পেটে কি কোনরকম ব্যথা হয়! দুপুরে খেয়েছিস কিছু? বেবি কি নড়াচড়া করেছে আজ?”
দিহান হড়বড় করে একসাথেই অনেকগুলো প্রশ্ন করছে। চৈতীর মনে হলো লোকটা যেমনই হোক বাবা হিসেবে খুবই সতর্ক আর সৎ হবে। তার পাশে বসে থাকা সুইটি স্পষ্ট না শুনতে না পেলেও সে শুনতে পাচ্ছে দিহান একসাথে অনেক কিছু বলছে। কিন্তু চৈতীর নিরবতা আর তার মুখের স্বাভাবিকতা দেখে বুঝতে পারছে না কি হতে পারে কথাগুলো। পরক্ষণেই, মনে হলো তারা কথা বলছে তার না থাকাটাই উত্তম। তাই সে বলল, “আমি দেখি তোর জন্য খাওয়ার কিছু নিয়ে আসি।”

দিহানও শুনলো ওপাশ থেকে মামীর কথা। সেও চুপ রইলো এবার। দু পাশেই কয়েক সেকেন্ড নীরবতা তারপর চৈতীই বলল, “এখন আলহামদুলিল্লাহ সব ঠিক আছে।”

“কিছু খাবি আসার সময় নিয়ে আসতাম?”

জড়তায় গলা রোধ হয়ে এলো চৈতীর কিন্তু চোখের কিনারায় জলের ঢেউ। কত চিন্তা, কত আবেগ, কত খেয়াল সবটাই এই পেটে থাকা মানুষটার জন্য! সংসারটা তো জোর করে সবাই করাতে চেয়েছিলো চৈতী সেই জোরটাকেই মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু একটু চেষ্টা কি দিহানও তখন করতে পারতো না! একটু যোগাযোগ কিংবা যাওয়ার আগে একটাবার বলে যেত, “আমার সময় লাগবে।” তবুও হয়তো মনে আঘাতটা এতোখানি গভীরভাবে লাগতো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল চৈতী যা দিহানের কানেও পৌঁছুলো। চৈতী বলল, “লাগবে না কিছু।”

ফোন রেখে দিলো দিহান আর চৈতী এবার নিজে দিশানকে ফোন করে বলল, “ভাইয়া, আমার জন্য হাওয়াই মিঠাই আনতে পারবে?”
দিহান জানালো সে নিয়ে আসবে।

সন্ধ্যার পর আজ দিহান বাড়ি ফিরে এলো। এসেই সে কাপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসলো কিছুক্ষণ। চা খাওয়ার ইচ্ছে হতেই সে ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলো। দিহানের ঘর থেকে বা দিকে বসার ঘর আর ডানে সামনে ডাইনিংটেবিল তার পরেই রান্নাঘর। সে রান্নাঘরের দিকে যেতেই শুনলো কলিংবেল বাজছে কিন্তু সোফায় চৈতী বসা তাছাড়া আর কেউ নেই এদিকটায়। চৈতীকে উঠতে দেখে বলল, “তুই বস আমি খুলছি।”

দরজা খুলতেই মুখে চওড়া এক হাসি ঝুলিয়ে ঘরে ঢুকলো দিহানের বাবা। বাবার পেছনে দিশান হাতে তার গোটা দশেক হাওয়াই মিঠাই।

“এতগুলো হাওয়াই মিঠাই কার জন্য?”

দিহান কৌতূহলী হয়ে হাসি মুখেই প্রশ্ন করলো। দিশানও সেভাবেই হাসিমুখে জবাব দিলো, “চৈতী বলল জুনিয়র নাকি হাওয়াই মিঠাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করছে।” বলেই হা হা করে হাসলো দিশান। সেগুলো নিয়ে চৈতীর সামনে গেল। দিহানের হাসিমুখটা হঠাৎ করেই চুপসে গেল। বুকের ভেতর চিনচিনে একটা সুক্ষ্ম ব্যথার সৃষ্টি হলো। ঠিকভাবেই ফিরে এলো তার অবহেলার শাস্তিটা। চৈতীও খুব মনযোগে দেখলো দিহানের হঠাৎ চুপসে যাওয়া মুখটা। এতে তার পৈশাচিক এক আনন্দ হওয়ার কথা ছিলো। কারণ সে জানতো দিহানকে না বলে অন্য কারো কাছে আবদার করলে এখন দিহানের ঠিক কষ্ট হবে। আর এই কষ্টটা দিতেই সে দিহানের ফোন কাটতেই দিশানকে বলেছে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আসতে। আসলে মন চাইছে বলে নয় দিহানকে অবহেলা করার উদ্দেশ্যে সে এমনটা করেছে। কিন্তু কি লাভ হলো! দিহানের অমন বিষন্ন মুখটা দেখে তার একটুও আনন্দ হচ্ছে না বরং কোথাও একটু অপরাধবোধ জাগছে। মনে হচ্ছে দিহান যা করেছে সেও একই কাজ করে দিহানের মত অপরাধী হয়ে যাচ্ছে। অবচেতন মনই তাকে আবার মুহুর্তেই কটাক্ষ করলো এটা কি শুধুই অপরাধবোধ নাকি দিহানের প্রতি দূর্বলতার শুরু! চমকে উঠছে চৈতী এ কেমন ভাবনা তার?

রাতে ঘুমানোর সময় বাঁধলো আরেক বিপত্তি৷ সুইটি গিয়ে বসে আছে চৈতীর মাথার কাছে। সে চাচ্ছে মেয়ের পাশে ঘুমাতে কিন্তু দিহানও যেন সমান দাবিদার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। সে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না কিন্তু মনে মনে বলছে মামী যেন অন্য ঘরে চলে যায়। রাত বাজে সাড়ে এগারোটা কিন্তু মামীকে দেখে মনে হচ্ছে না সে আর অন্যঘরে যাবে৷ তারও মন মানছে না অন্য ঘরে যেতে। বাড়িতে আসার পর থেকেই তো সে রাতে চৈতী ঘুমিয়ে যাওয়ার পর এসে চৈতীর পেটের সামনে বিড়বিড় করে কথা বলে। যে বাচ্চাটা এখনো দুনিয়াতেই আসেনি তার কাছেই কত কথা বলেছে দিহান আজ পর্যন্ত তার ইয়ত্তা নেই। সে ঘুমানোর সময় আলতো করে ছুঁয়ে দেয় চৈতীকে আজ তাও যে অসম্ভব। চৈতী খেয়াল করেছে দিহান এখনও বারান্দায় আর তার মাও বিছানা থেকে নামছে না। দুজনেরই মনের কথা বোঝা হয়ে গেছে চৈতীর কিন্তু সে কি করবে! কতদিন মায়ের পাশে ঘুমানো হয় না। এদিকে প্রতি রাতে সে কান পেতে শোনে দিহানের বিড়বিড়, ফিসফিস। কত আদুরে গলায় সে কথা বলে বাচ্চার সঙ্গে কত আবেগি সেই ক্ষণগুলো চৈতীর কাছে মনে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্ষণ। অনেক দ্বিধায় আরো কিছু সময় কাটার পর দিহান বুঝলো এভাবে অপেক্ষার কোন মানে হয় না। সে বারান্দা থেকে ঘরে এসে ফোনটা নিয়ে বের হতেই যাচ্ছিলো তখনি দিলশাদ এসে ঢুকলো ঘরে।

“সুইটি চলে এসো এবার ঘুমাও। সারাটাদিন একটু রেস্ট নিলে না লম্বা এক জার্নি করে এসে কালও সারারাত জেগেছিলে। তুমিও এসে ঘুমাও ওরাও ঘুমিয়ে পড়ুক। দিহান আবার অফিসের জন্য সকালে উঠবে।”

দিলশাদের কথা শেষ হতেই দিহানের চোখ মুখ যেমন উজ্জ্বল হয়ে গেল সুইটিরও ঠিক তেমন লজ্জায় লাল হলো। তার এতক্ষণে মনে হলো সে কেমন বেহায়াপনা করে ফেলল মেয়ে আর মেয়ের জামাইর ঘরে এভাবে ঘাপটি মেরে। তার বোঝা উচিত ছিলো মনের মধ্যে যতোই তার রাগ, ক্ষোভ থাক তাদের তো একটু স্পেস দেওয়া উচিত। আজ না হয় কাল এই সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতেই হবে তাহলে সেটা যত দ্রুত করা যায় ততই ভালো। সুইটি চলে যেতেই দিহান ধপাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো। তার এহেন কান্ডে চৈতী কপাল কু্ঁচকে তাকালো।

“ওহ স্যরি, বেশিই জোরে লাগিয়ে ফেলেছি।”

চৈতী কিছু বলল না সে নিজের বালিশটা ঠিক করে শুয়ে পড়লো। কয়েক সেকেন্ড পরেই দিহানও বাতি নিভিয়ে আজ খাটের পাশে থাকা ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বিছানায় এলো। চৈতী অনড় হয়ে চোখ বুঁজে পড়ে রইলো। তারও অপেক্ষা দিহান কখন তাকে ঘুমন্ত মনে করে বাচ্চার সাথে কথার ঝুড়ি খুলবে। আনন্দ লাগে তার অন্যরকম এক সুখ থাকে দিহানের এই একক কথোপকথনে। হঠাৎ শুনলে যে কারো মনে হবে বাবুটাও বুঝি তার কথার জবাব দিচ্ছে। চোখ বুঁজে রাখতে রাখতে চৈতী ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই। আজ দিহানও ঘুমিয়ে পড়েছিলো কিন্তু ভোর রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই সে আজ সন্তান নয় প্রথমেই চৈতীর সাথে কথা বলল। ঘুমন্ত চৈতীর ঘুম হালকা হয়ে এলো যখন তার কানে অস্পষ্ট কান্না মিশ্রিত ক্ষমার বাক্যগুলো প্রবেশ করলো। দিহান বারবার বলছে চৈতী কি তাকে কোনদিন ক্ষমা করবে না! তার একটা হাত চৈতীর পেটের ওপর। সে কথাগুলো বলতে বলতেই চৈতীর মুখের ওপর ঝুঁকে গেল। চৈতী টের পাচ্ছে দিহানের তপ্ত নিঃশ্বাস তার মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে। জেগে থাকা চৈতী চোখ খুলছে না শুধু অনুভব করছে দিহান তার কপালের ওপর চুমু খাচ্ছে। চুমু খেয়ে দিহান উঠে যাওয়ার আগেই তার এক ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো চৈতীর গালের ওপর। আর ঠিক তখনি চৈতী চোখ মেলে তাকালো দিহানের দিকে। নারী জাতি সত্যিই ভেজা মাটি। যখন যে পাত্রে ঢালা হয়ে তখন সেই আকারই ধারণ করে। সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত আর অবহেলা গুলো এক মুহুর্তেই ভুলে গিয়ে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠে। চৈতীর ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। দিহান তাকে অবহেলা করে একলা ফেলে গিয়ে দূরে ছিলো ছয় মাস আর ফিরে এসে ক্ষমা চেয়ে পাশে থাকার আকুতি জানাচ্ছে দু মাস ধরে। আজ যেন চৈতীর কাছে সেই ছ’মাসের চেয়ে দু মাসের ক্ষমাটাই বড় হয়ে গেল। চৈতীর মন বলল, এখন হঠাৎ জাপটে ধরি এতেই বুঝে যাবে ক্ষমা করে দিয়েছি। আবার মনে হলো না থাক জড়িয়ে ধরলে উঁচু পেটের সাথে লেগে শুধু বাবা ছেলেই আদরে মাখামাখি হবে। তারপর ভাবলো না মুখেই বলি মাফ করে দিয়েছি। তারপরই আবার ভাবলো থাক, এখন কিছুই বলবো না। সে দিহানের থেকে চোখ ফিরিয়ে চোখ বুঁজে নিলো। চৈতীর দৃষ্টি দেখে দিহানের মনটা পুলকিত হয়েও আবার মনঃক্ষুণ্ন হলো যখন দেখলো চৈতী কোন কথা না বলেই ঘুমোতে চেষ্টা করছে। দিহানের মন বলছে চৈতী কিছু বলতে চাইছে যা সে শুনতে চায়। কিন্তু তার ভাগ্য এতোটা সুপ্রসন্ন ছিলো না কখনো তবে আজ কি করে হতো! চৈতী ঘুমিয়ে গেছে আর একরাশ হতাশা বুকে চেপে দিহানও ঘুমানোর চেষ্টা করছে।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই আলস্যে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে হলো না আজ দিশানের। সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি সাথে শীতল বাতাস। বাতাসের দাপটে জানালার পর্দা সরে হু হু করে বাতাস ঢুকছে ঘরে। ঐশী রান্না ঘর থেকে মুক্ত হয়ে ঘরে এসেছে দিশানকে ডাকতে। কিন্তু দক্ষিণের বাতাস আর বৃষ্টির ছাঁটে ঘরের মেঝে অনেকটা পানিতে ভিজে গেছে। তা দেখে ঐশী হৈ হৈ করে উঠলো, “কি গো তুমি টের পাচ্ছো না বাতাসে ঘরে বৃষ্টির পানি আসছে। আল্লাহ! বিছানাও তো ভিজছে এ্যাই দিশান ওঠো!” বলেই ঐশী দিশানের পিঠে হাত রাখতেই সে তাকে হ্যাচকা টানে নিজের ওপর নিয়ে নিলো।

“আহ্ কি করছো ছাড়ো আর তুমিও উঠো। অফিসের লেট হচ্ছে না!”

” কি বেরসিক মেয়েরে বাবাহ্! আবহাওয়া দেখেছো কেমন রোমান্টিক! এই শীতল শীতল আবহাওয়ায় বউয়ের উষ্ণ দেহ ছেড়ে অফিসে যায় কোন শালা বলোতো!” বলেই দিশান টুপ করে চুমু খেলো।

দিশাও জবাব দিলো, “তোমার শালারা না গেলেও আমার শ্বশুর ঠিকই যায় এই ঝড়বাদল মাথায় করে।”

“উফ, আব্বুকে আবার টানতে গেলে কেন। দারুণ একটা মুড হচ্ছিলো বউকে একটু আদর করবো। তা না, আব্বুর কথা বলে মিটিংয়ের কথা মনে করিয়ে দিলে।ধ্যাত!” এবার লম্বা এক চুমুর পর্ব সেরেই বিছানা থেকে নেমে গেল দিশান। যে করেই হোক আজকে দশটার মিটিংয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। ভাগ্য ভালো মিটিংটা এবার নিজেদের অফিসেই হবে তাই ঝামেলা কিছুটা কম।

নয়টার মধ্যে বাবা আর দিশান বেরিয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। দিহানের আজ দুপুর পর্যন্ত ছুটি কারণ একটু পর চৈতীকে নিয়ে একটু হাসপাতালে যাওয়ার কথা বলেছে অনামিকা। তার কোন এক রিপোর্ট কাল জানানো হয়নি কিন্তু আজ সকালেই অনামিকা রিপোর্ট দেখে ফোন করেছিলো। চৈতী ছাড়া বাকি সবাই জানে আজকেই আবার এডমিট করা হবে চৈতীকে এবং সিজার করাটাও জরুরিও হতে পারে। রিপোর্টে যে খারাপ কিছু আছে তাতে আর কারো সন্দেহ নেই। তাই অনামিকার ফোন পাওয়ার পর থেকেই দিহানের অবস্থা পাগল প্রায়। দিলশাদও কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। সে বার কয়েক নিজের ঘরে বসে কেঁদেছে কিন্তু সবার সামনে এলেই নিজেকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সুইটি তো কান্না আটকাতে না পেরে দোতলায় ঐশীর ঘরে বসে কাঁদছে। চাঁদকেও ফোন করে কেঁদেকেটে বারবার অনুরোধ করছে যেন এখানে আসে। চৈতী নাশতা করতে বসে ফুপি আর মাকে খুঁজলো। কাউকেই সে সকাল থেকে একটিবারও দেখেনি। ঐশীকে দেখে মনে হলো তার মন খারাপ। দিহানের দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না। দিহানকে নাশতা আজ চৈতী নিজেই এগিয়ে দিয়েছে কিন্তু সে একটুও মুখে তোলেনি।

“তুই খা আমি শার্টটা বদলে আসি। সাড়ে নয়টায় বের হবো আমরা।”

দিহানের বিষাদমাখা মুখের কথা শুনে চৈতীর খুব হাসি পাচ্ছে। “এই শেষ মুহুর্তের কষ্টটুকু উপভোগ করো এরপর আমি আর সোনাবাবা মিলে তোমার সব কষ্ট ধুয়েমুছে নতুন করে আমাদের করে নেবো। প্রিয়ন্তি নামের মানুষটা তোমার হয়নি তাই বলে কি আমরা মা ছেলেও তোমার হবো না!” এতটুকু কথা বিড়বিড় করেই চৈতী অবাক হয়ে গেল। সে কাল থেকে কেন তার বাচ্চাটাকে ছেলে বলে সম্মোধন করছে! সে তো এখনো জানেই না ছেলে হবে নাকি মেয়ে? অবচেতন মন বারবার তার সন্তানকে ছেলে বলে ভেবে নিচ্ছে। চৈতীর ভাবনার মাঝেই দিহান বেরিয়ে এলো। সমুদ্রনীল রঙের শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে সে চৈতীর সামনে এসে দাঁড়ালো। আজই কি প্রথম খেয়াল করলো চৈতী দিহানের গালভর্তি দাঁড়িতে তাকে এতোটা সুন্দর লাগে! নাকি আজই প্রথম তার চোখ দিহানকে অন্যরকমভাবে দেখতে চাইছে! বাতাসের শীতলতা এবার চৈতীর চোখেও যেন এসে ঝাপটা দিলো। সে খাওয়া শেষ করে সোফায় বসতেই দিহান বলল, ” ঘরে গিয়ে রেস্ট নে বৃষ্টিটা কমলেই আমরা বেরিয়ে পড়বো।”

চৈতী নিজের ঘরে না গিয়ে ফুপির ঘরে গেল। দিলশাদ মাত্রই চোখ মুছে বের হচ্ছিলেন তার সাথেই এখন সুইটিও ছিলো। দুজনকে একসাথে পেয়েই চৈতী বলল, আজ তোমাদের যেতে হবে না সাথে। আমরা দ্রুতই ফিরে আসবো। চৈতীর কথাটায় দুজনের কারো মনেই স্বস্তি দিলো না। বরং দুজনেই অজানা শঙ্কায় দু পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলেন। কিছু সময় তারা চৈতীকে মাঝে রেখে দিলশাদের বিছানাতেই বসে রইলো। তারপরই বৃষ্টি কমতেই দিহান এসে তাড়া দিলে ঘরের সবাই একসাথে বেরিয়ে এলো। চৈতী অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলো সবার দিকে। মা, ফুপি, ঐশী আপু এমনকি ময়না খালাও কেমন কাঁদো কাঁদো মুখে তার সাথে গাড়ি পর্যন্ত চলে এলো।
“আরেহ! তোমরা বাইরে আসছো কেন? তোমরা সবাই এত ভয় যে কেন পাও বুঝি না৷ আজই এতো ভয় আল্লাহই জানে ডেলিভারির জন্য গেলে তোমরা কি করবে?”

চৈতীর কথা শুনে সবাই মুখে কৃত্রিম হাসি টানতে চাইলো। বুক ভরা ভয় নিয়ে ঠোঁট প্রশস্ত সবার সাধ্যে নেই। দিলশাদ ছাড়া কেউই হাসি মুখে তাকাতে পারলো না চৈতীর দিকে। দিলশাদ বারবার দিহানকে সতর্ক করে দিলেন সাবধানে যেন ড্রাইভ করে। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটও ভালো থাকবে না সে যেন খুব সতর্ক থাকে। আজই ড্রাইভারটা অসুস্থ আর আজই চৈতীকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। আর আজকেই সকাল থেকে বৃষ্টি। সকল দূর্যোগ যেন আজই মাথার ওপর এসে হাজির হলো।

দেড় ঘন্টা পর….

“ঐশী একটু দ্যাখো তো কে ফোন করছে বারবার। আমার হাতে মাংস,মশলায় চিটচিটে অবস্থা।”

দিলশাদ চেঁচিয়ে বলতেই সুইটি এগিয়ে গেল দিলশাদের ফোনের দিকে। ঐশী দোতলায় সে শুনতে পায়নি আর ফোনটাও রয়েছে সুইটির সামনেই। দিলশাদ চৈতীর পছন্দের কাবাব বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুপুরের পরই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তারা হাসপাতালে চলে যাবে চৈতীর কাছে। সুইটি ফোন হাতে নিয়ে বলল, “অচেনা নম্বর আপা।”

“ধরে দ্যাখো কে।”

সুইটি ততক্ষণে ফোন রিসিভ করেছে।

“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”

দিলশাদ এঁটো হাতে রান্নাঘর থেকে একটু উঁকি দিতেই দেখলো সুইটির দেহটা ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল।

চলবে
(অনেক ধরনের ভুল ত্রুটি থাকে লেখায়,বাক্যে এমনকি কাহিনির অনেক ছোট, বড় বিষয়েও। আপনারা মন্তব্যের মাধ্যমে সেগুলো অনেকেই শুধরে দেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও আন্তরিক ভালোবাসা।আর যারা একদমই নীরব পাঠক তাদের বলবো একটু কষ্ট করে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করবেন৷)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here