মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্বঃ১৩

0
1665

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ তেরো

নিজের ঘরের বিছানাতে নেতিয়ে আছে ছুটন্ত তিস্তা। সময়টা ঠিক ভরসন্ধ্যা। বাড়ির পাশে বাতাবিলেবু গাছটা থেকে লেবুর কড়া সুবাস আসছে। জোনাকির ডাকও ভেসে আসছে দূর হতে। কিন্তু তিস্তার মস্তিষ্ক অব্দি যাচ্ছে না কিছুই।তার শরীরের কাপড় বদলানো হয়েছে আগেই। মাথার কাছে বৃদ্ধ লাতিকা অনবরত তালপাতার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। তনয়া খাটের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।

তখন মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে প্রথমে মনে অনাকাঙ্খিত, ভয়ঙ্কর ভাবনা এলেও পরক্ষণেই মেয়েকে আকড়ে ধরতেই তার ভাবনা বদলে গেলো। মেয়েটা’র শরীরে প্রাণ আছে। গ্রামের মানুষের সাহায্যে তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। তখনও জ্ঞান ছিলো না। পানি দিয়ে শরীর ধুঁয়ে পড়নের জামাকাপড় বদলে দিয়েছে।

গ্রামে তেমন কোনো ভালো ডাক্তার নেই। সবাই যখন বেশ উৎকণ্ঠিত মেয়েটার সাথে কী হয়েছে জানার জন্য তখনই একজন দেখলো শহর থেকে মোড়লদের গাড়ি এসেছে। সবাই হৈ হৈ করে ছুটলো মোড়লদের বাড়ি। কারণ শহর থেকে গাড়ি এলে মাহিনই আসে। এতদিন সে গ্রামে ছিলো না। মাঝে মাঝে ছুটিতে আসে।

সবাই ছুটে গেলো মাহিনের কাছে। তিস্তার ব্যাপারে সব জানাতেই মাহিন ছুটে এলো।

বেশ কতক্ষণ তিস্তাকে পর্যবেক্ষণ করলো মাহিন। তনয়া তখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে। মাহিন ধীরে উঠে বাহিরে চলে গেলো।

মাহিনের পিছে পিছে তনয়াও বের হলো। লতিকা বেগম নাতনির শরীরে হাত বুলিয়ে বাতাস করে যাচ্ছেন। ভেতর থেকে কান্না’রা দলক পাকিয়ে আসছে। তার ছটফটে নাতনির এ কী হলো! কার কুনজর পড়লো এমন পাখির উপর! কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে মেয়েটার?

গ্রামবাসী তখন উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার যা ভাবছে তা সঠিক কিনা সে কথাটা ডাক্তারের মুখ থেকে শোনার জন্য।

মাহিন বের হতেই নেপাল ঠাকুর এগিয়ে এলেন। এ একটা মানুষের মনে চাঞ্চল্যকর খবর শোনার উৎকন্ঠা নেই। বরং সে মেয়েটার শরীরের অবস্থা জানার জন্য আগ্রহী।

মাহিনের কাছে গিয়ে নেপাল ঠাকুল হাত জোড় করে বললেন,
-‘আমাদের মেয়েটা’র কী খবর ডাক্তার? কোনো বড় সমস্যা হইলো নাকি? সদরে নিতে হইবো?’

মাহিনের মুখে তখন রাজ্যের আমবস্যা। সে কোনোরকমে বললো,
-‘না আর সদরে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। একটু পরই হুঁশ ফিরবে।’

এবার গ্রামের মুরব্বিরা এগিয়ে এলেন। একজন চাঁপা হুঁশিয়ারি স্বরে বললেন,
-‘কী দেখলেন ডাক্তার সাব? মাইয়াটা’র সতিত্ব নাই তাই না?’

সবাই যেনো এ প্রশ্নটারই অপেক্ষায় ছিলো। উন্মুখ হয়ে চেয়ে রইলো উত্তরের আশায়। তনয়া বেগমও তাকালো মাহিনের দিকে। মাহিন কতক্ষণ চুপ রয়। একদম নিরবতায় কেটে যায় কতক্ষণ। তারপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,
-‘আপনারা এ ব্যাপার পুলিশদের জানান নি? তারা তদন্ত করছে তো ঠিক ভাবে? এভাবে তিন তিনটা মেয়ের সতিত্ব কারা নষ্ট করলো? তাও তো তিস্তা বেঁচে ফিরেছে কিন্তু বাকিদের তো মেরে ফেলেছে।’

ডাক্তারের প্রশ্নেই যে ছিলো গ্রামবাসীর উত্তর তা আর বুঝতে বাকি রইলো না কারো। তনয়া ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। তার দুনিয়াটা যেনো আঁধার করে আসে। উঠানের খাটে বসে থাকা আমান শেখ ডুকরে কেঁদে উঠে। নিমিষেই এক দারুণ ঝড় বয়ে যায়। সবাই হা হুতাশ করে কতক্ষণ। মহিলাদের মাঝে কয়েকজন ছুটে এসে তনয়াকে বাতাস করে, স্বান্তনা দেয়। পুরুষেরা আমান শেখকে ভরসা দেয়। মাহিন গটগট পায়ে চলে যায় সেখান থেকে।

সন্ধ্যা টা কেটে যায় ভয়ঙ্কর সত্য মানতে না পারার গুঞ্জনে।

_____

তিস্তা বিছানার পাশে জানালাটা’র দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে। তার জ্ঞান ফিরেছে প্রায় দশ, পনেরো মিনিট হবে। এখন প্রায় মধ্যরাত। কেউ তার আশেপাশে নেই। হারিকেনের আলো জ্বলছে ছোট্ট বসার টুলের উপর। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে তার। এতদিন পর নিজেকে নিজের বিছানায় দেখে বেশ অবাক হয় সে। অতঃপর মনে পড়ে আজকে ভোরের ঘটনা। সে ঐ বন্ধ ঘরটার থেকে পালিয়ে সোহাগ চাচাদের কাছারি বাড়ির সামনে এসে জ্ঞান হারায়। তারপর কী হয়েছিলো কিছুই মনে নেই তার।

জানালার বাহির হতে ভেসে আসছে জোনাকির ডাক। দু একটা জোনাকি ঘরে ঢুকছে। তাদের জ্বল জ্বল আলোখানা তিস্তার মন ভরিয়ে দিচ্ছে।

তিস্তার বড্ড ইচ্ছে করছে একটু ছুঁয়ে দিতে তাদের কিন্তু সে ধরছে না। থাক,ওরাও একটু নিজেদের মতন উড়ুক। বাহিরের থেকে ভেসে আসা লেবুর ঘ্রাণটা তিস্তা শুষে নিলো ক্ষাণিকটা। কতদিন পর আবারও নিজের নীড়ে ফিরে এসেছে সে। গত পাঁচদিন যাবত একটা ঘরে নাক, চোখ,মুখ বন্ধ করে তাকে ফেলে রেখেছিলো। এমন অবস্থায় তো মনে হয়েছিলো মরেই যাবে সে। কিন্তু অবশেষে মুক্তি পাবে কে জানতো!

তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে। মাস্টারমশাই এর কথা মনে পড়ে ভীষণ। এই রাত, এই আধাঁর একদিন মাস্টারমশাই ঘুঁচিয়ে দিয়েছিলো তার আবদারে।

তখন সময়টা ছিলো শরৎকাল। তিস্তাকে তখন প্রায় মাস্টারমশাই বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিতো। সেদিনও পৌঁছে দিচ্ছিলো। শুধু তিস্তা না, সাথে আরও ছেলেমেয়ে প্রায়ই থাকতো। সেদিনও ছিলো। তিস্তা, ভ্রমরী,বকুল, রাসেল, সোহেল আরও অনেকে।

আঁধারের পথখানায় মাস্টারমশাই নিজের টর্চ লাইট টার আলো দিয়ে আধাঁরটা কিছুটা হালকা করার প্রয়াস চালিয়ে হাঁটছে গ্রামের পথ দিয়ে। তিস্তার তো চরম দুরন্তপনা। সে ছুটতে ছুটতে,লাফাতে লাফাতে হাঁটছে। হঠাৎ বাঁশবাগানের সাথে দিয়ে আসার সময় এক ঝাঁক জোনাকিপোকা জ্বল জ্বল আলো দিয়ে পুরো পথটা যেনো আলোকিত করে দিলো।

তিস্তার বরাবরই স্বভাব জোনকি দেখলেই হাতের মুঠোয় চেঁপে ধরা। তার মনে হয় আকাশের মস্ত বড় চাঁদ তার মুঠোয়। সেই অভ্যাসবশত জোনাকি ধরার প্রয়াসে সে একটু লাফ দিতেই ছিটকে পড়ে রাস্তা থেকে পাশের ছোট্ট গর্তটায়। ভীষণ ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে। সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেছিলো।

মাস্টারমশাই ডানে বামে না দেখে তিস্তার কাছে এসেই ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় তার গালে। তিস্তা ব্যাথা ভুলে আহম্মক হয়ে তাকিয়ে রয়৷ মাস্টারমশাই তাকে মেরেছে সে কথাটা মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই ছিটকে আসে কান্নার দল। যেই ঠোঁট ভেঙে সে কান্নায় মনোনিবেশ করবে তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে মাস্টারমশাই বাম গালে আরেকটা চড় বসিয়ে দেয়।

এবার যেনো অতি বিষ্ময়ে কান্না গুলোও আটকে যায় কোথাও। মাস্টারমশাই তিস্তাকে পাঁজাকোলে তুলে ধমকাতে ধমকাতে বললো,
-‘মন তো চাচ্ছে আরও চারটা চড় বসাই তোর গালে। শান্তি দিবি না আমায়? একটুর জন্য আমার জানটাই বের হতে নিচ্ছিলো। কী দরকার ছিলো অন্ধকারে লাফ দেওয়ার?’

তিস্তা হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই মাস্টারমশাই এর ধমক শুনে হুঁশ ফিরতেই কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো,
-‘আমি তো জোনাকিরে ধরতে গিয়েছিলাম। কে জানতো পরে যাবো!’

তিস্তার এহেন বোঁকামার্কা কথা শুনে প্লাবন আরও ক্ষাণিকটা বকে দেয়।

পায়ে বেশ ব্যাথা পাওয়ায় পরেরদিন পুরোটা সময় ঘরে বসিয়ে কাটায় সে। রাত তখন দশটা কি এগারোটা। সবে খাবার খেয়ে তিস্তা ঘুমাতে এসেছিলো। হঠাৎ জানলার কাছে একটা জ্বলতে থাকা কাঁচের বয়াম দেখে চমকে উঠে। আরেকটু ভালো করে দৃষ্টি দিতেই দেখে হাসি হাসি মুখ করে সাদা পাঞ্জাবি খানা পরে দাঁড়িয়ে আছে তার মাস্টারমশাই। তিস্তা অবাকে হা হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই তার ভয়ডর ততটা নেই তাই সে ভয় পায় নি প্রথমেই।

মাস্টারমশাই’কে দেখে তিস্তা দ্রুত ছুটে গেলো খাটে। মাস্টারমশাই তখন জানালা ধরে বাহিরের দিকটায় দাঁড়িয়ে। তিস্তাকে ছুটতে দেখে চোখ রাঙিয়ে সাবধান করে।

তিস্তা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
-‘আপনি এত রাতে এখানে!’

জোনাকির আলোয় চোখে পড়ে মাস্টারমশাই এর মিষ্টি হাসি। মিষ্টি হেসে সে বললো,
-‘তোর জন্য কিছু সুখ কুড়িয়েছি। এই যে, বয়ামে বন্দি করে এনেছি। এগুলোর জন্য ই তো কাল ব্যাথা পেলি।তাই এনে দিলাম।’

তিস্তা খাটে থাকা বয়ামটা আকড়ে ধরলো। খুশি যেনো তার ধরে না। এতগুলা জোনাকি তো সে কখনোই একসাথে ধরতে পারে না। মাস্টারমশাই তাকে কত গুলো জোনাকি দিলো! কত ভালো মাস্টারমশাই টা।

প্লাবন তিস্তার বাঁধনহারা খুশি দেখে জানালার লম্বা শিকের ফাঁকাটা দিয়ে নিজের হাতটা এগিয়ে তিস্তার মাথায় আদুরে, স্নেহের হাত বুলালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
-‘কবে বড় হবি? তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা না।’

কথাটা বোধগম্য হয় নি তিস্তার। সে তখন তার জোনাকি দেখায় ব্যস্ত। সেই মধ্য রাতের মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই এর বিমোহিত কণ্ঠের ছোট্ট বাক্যের অর্থ বুঝিনি অবুঝ তিস্তা। কিন্তু আজ বুজছে সেই আকুতি মাখা বাক্যের তাৎপর্য। আজ বড়ও হয়েছে। কিন্তু কোথায় সে মাস্টারমশাই? যার জন্য বড় তিস্তার বুকের বা’পাশ খালি লাগে, কোথায় সে? মধ্যরাতের সে সুখ বিক্রেতা পুরুষ আজ এক আকাশ বিষন্নতা দিয়ে কোথায় গেলো?

এসব ভাবনার মাঝে নিজের শরীর ভীষণ ধাক্কা অনুভব করে। দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখে তার মা দাঁড়িয়ে আছে ভাতের থালা নিয়ে। কতদিন পর মাকে দেখলো।

তিস্তা তৎক্ষনাৎ মাকে জড়িয়ে ধরলো। এতদিনের কান্না ঝড়িয়ে দিলো ভীষণ ভাবে। তনয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলালো। মেয়েটা কাঁদছে কেনো! তবে কী খারাপ ঘটনা গুলো মনে করে কাঁদছে?

তনয়া ভাতের থালাটা খাটে রেখে স্বান্তনার স্বরে বললো,
-‘কাঁদছো কেনো? কিচ্ছু হয় নি। ভাগ্যে যা ছিলো তা হয়েছে। তুমি এর জন্য নিজেকে দোষ দিও না। ওরা তোমার সাথে যা সর্বনাশ করেছে তার বিচার হবে।’

মায়ের কথায় তিস্তা অবাক হয়। সর্বনাশ করেছে! আটকে রাখাটাই কী সর্বনাশ? তিস্তা অবুঝ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কী সর্বনাশ মা? আটকে রেখেছে যে?’

তনয়া অবাক হলো। মেয়েটা কেমন প্রশ্ন করছে! পাগল হলো নাকি? কী সর্বনাশ ও কী বুঝে না!

বাহির থেকে দাদী ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-‘তোর সতীত্ব ছিঁইড়া খাইছে জানোয়ারের মতন। এর চাইয়া বড় সর্বনাশ হয়!’

দাদীর কথায় তিস্তা জেনো আকাশ থেকে পরলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘ওরা তো আমায় কিছু করে নি,যুবতী!’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here