মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্বঃ১৭

0
1715

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ সতেরো

‘এই চিঠিটা তুই সত্যিই মাস্টারমশাই এর বাড়ি থেকে পেয়েছিস, বকুল?’

ঘর্মাক্ত মুখ খানা আরেকবার ওড়না দিয়ে মুছে বকুল উপর নিচ মাথা নাড়ালো। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে বললো,
-‘হ্যাঁ রে বাবা,হ্যাঁ। মাস্টারমশাই এর পড়ার ঘরেই পেয়েছি।’

তিস্তা ছোট্ট চিরকুটটার গুটি গুটি অক্ষর গুলো আরও কয়েকবার পড়লো। চিরকুটটা’র লেখা গুলো কেমন একটা ঘেঁটে গেছে। হয়তো ভীষণ যত্নে লিখা চিরকুটখানা অযত্নে পড়ে ছিলো। ইশ,সে আগে কোনো দেখলো না? তবে লেখাগুলো ঘেঁটে গিয়েও মাস্টারমশাই এর আকুতি গুলোর ক্ষমতা একচুল পরিমাণও কমাতে পারে নি। বরং তা ভীষণ ভাবে ফুটে উঠেছে।

তিস্তা হাতের ভাঁজে থাকা চিরকুট টা আবারও পড়লো। এ নিয়ে কয়েক মিনিটের মাঝেই গুণে গুণে সাতবার পড়া হয়ে গেছে। প্রতিবারই সে প্রশ্ন করেছে এটা মাস্টারমশাই এর বাড়িতে সত্যিই পেয়েছে কিনা। আর বকুল প্রতিবারই বিরক্ত না হয়ে উত্তর দিয়ে গেছে।

কিন্তু এবার তিস্তা আর একই প্রশ্ন করলো না। বরং তার কৌতূহল অন্য দিকে গেলো। সে কপালে তিনটা ভাঁজ ফেলে বললো,
-‘কিন্তু তুই হঠাৎ মাস্টারমশাই এর বাড়ি গেলি কেনো? আর আমি তো সেদিন গিয়েছিলাম,তখন তো দেখলাম সব ঘর আটকানো। কেবল সদর দরজায় তালা দেয় নি। অবশ্য মাস্টারমশাই’র বাড়িতে কেউ চুরি,ডাকাতি করবেও না। পড়ার ঘরও বুঝি খোলা ছিলো? ইশ, আরেকটু ভালো করে দেখলেই হতো। সেদিনই পেয়ে যেতাম মন বশ করার ওষুধ।’

কথাটা বলেই চিরকুট খানায় আবার চোখ বুলালো তিস্তা। চেঁপে ধরলো নিজের সিক্ত শরীরের বক্ষ মাঝে। হৃদয়ে এখন আর তেমন জ্বালা পোড়া করছে না। কেবল শীতল অনুভব হচ্ছে।

বকুল বান্ধবী’র এমন কান্ড-কারখানা দেখে মিটমিট করে হাসলো। বান্ধবীর ঠান্ডায় ফ্যাকাসে হওয়া মুখটায় সযত্নে হাত বুলিয়ে বললো,
-‘শুনিস নি? মাস্টারমশাই’র বিয়ের খবর ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে। হরপ্রসাদ দাদা বলেছে। গ্রামের সবাই তো বেজায় খুশি। তাদের গ্রামে শহুরে বউ আসবে। আর এতদিনের অযত্নে নিশ্চয় মাস্টারমশাই এর বাড়ির উঠোনে শুকনো পাতার ভীড় জমিয়েছে। ধূলো পড়েছে দরজা-জানলায়। পিঁড়েটারও মাটি ক্ষয়েছে। নতুন করে আবার লেপে দিতে হবে ভালো মাটি দিয়ে। তাই সবার ভাবনা দেখে আমার মা-ই উৎফুল্ল হয়ে বললো আমিই সবটা পরিষ্কার করবো। আমি গেলাম পরিষ্কার করতে। তখন গিয়ে দেখি মাস্টারমশাই এর টেবিলের পাশে সমতল জায়গা টাই এ চিরকুট খানা। সব দরজা জানালা বন্ধ ছিলো বিধায় উড়ে যায় নি কোথাও।’

তিস্তা স্বস্তি পেলো। মাঝে মাঝে হিমশীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। সে কিছুটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মধুসখী’র টলমলে পানি ছুঁয়ে করা প্রতিজ্ঞা টা সে রাখতে পারে নি। ঐ যে,বাঁচার লোভ। আর সাঁতার জানা মানুষ কী কখনো নদীতে ডুবে মরতে পারে? তাও স্ব-ইচ্ছায়? তাই তিস্তাও পারে নি। তন্মধ্যেই, বকুল চিরকুট নিয়ে নদীর পাড়ে হাজির হয়।

তিস্তা টলমলে চোখে, শীতল কণ্ঠে বললো,
-‘তুই আমার সাথে কখনো কথা বলবি আমি ভাবি নি রে। আমি তো নষ্ট মেয়ে। নষ্ট মেয়েদের সাথে কথা বললে তুইও তো নষ্ট হয়ে যাবি। তাই না, বকুল?’

বকুল ভিজে শরীরে থাকা তিস্তাকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘তুই তো নষ্ট না। নিজেকে এসব কেনো বলিস? তুই সব থেকে পবিত্র। একদম সদ্য ভোর কিংবা ফুটন্ত ফুলের মতন। আমার মা নিজেই জানে না তার আচরণের মানে। তাই তোর সাথে এমন আচরণ করেছে। সৃষ্টিকর্তার এমন সৃষ্টি কখনো নষ্ট হতে পারে?’

তিস্তা’র যেনো মনের ভেতর গড়া নিজের প্রতি ঘৃণার কার্তুজ ভেঙে গুড়িয়ে গেলো। কেটে গেলো দুই বান্ধবী’র নিরব কিছুটা সময়। প্রকৃতির বুকে আধাঁর করা সন্ধ্যা নামলো। তারা বাড়ির পথে রওনা হলো। তিস্তা পুরো ভেজা জামাটা এখন শুকিয়ে গেছে প্রায়।

বকুল তিস্তাকে তার বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিলো। বাড়িতে প্রবেশ করার ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ বকুল ক্ষীণ স্বরে ডেকে উঠলো,
-‘তিস্তা।’

তিস্তা ফিরে তাকালো। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-‘বল?’

-‘মৃত্যু কী এতই সোজা? তোর বাবার এখনো তো সংসারে উপার্জন করার ক্ষমতা নেই। কেবল,নিজের কথা ভাবলে হবে? স্বার্থপর তো তুই ছিলি না। তবে আজ কেনো? ভালোবাসার জন্য? আমি যতদূর জানি,ভালোবাসা উদার করতে শেখায়। নিঃস্বার্থ ভাবে বাঁচায়। তবে তোর ভালোবাসা উল্টো শেখালো যে? নাকি ভুল শিখলি সব?’

তিস্তা চুপ থাকে। বকুল বুজে ফেলেছে তবে! আশেপাশে তখন ঝিঁঝিঁ পোঁকার ডাক শোনা যাচ্ছে। তিস্তা অর্ধ ভেজা ওড়নাটা জড়িয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বললো,
-‘কই আর স্বার্থপর হলাম? ভালোবাসার কৃতিত্বে মরে গিয়েও তো বাঁচার আশা কুড়িয়ে আনলাম। সেটা দেখলি না?’

বকুল হাসে। সে আজ একটা মৃত হৃদয়ের মেয়েকে আবার বাঁচাতে পেরেছে বলে খুশি হয়। তিস্তার মাঝে সে নিজের স্বপ্ন পূরণ করার ইচ্ছে পোষণ করে। কঠোর বাস্তবতার কাছে তো,তার স্বপ্ন হেরে গেলো। অনেক পড়াশোনা করা যে আর হলো না। এই মেয়েটা অনেক পড়ুক। ভীষণ বড় কিছু হোক। ওর কলঙ্ক যেনো মুছে নেয় সাফল্য।

তিস্তা বিদায় নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। বকুল সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গান ধরলো। কি ভীষণ মিষ্টি সে সুর। নিরব প্রকৃতি আরও নিরব হলো। সময় করলো মধুময়। বকুল মিহি স্বরে তখনো গেয়ে যাচ্ছে,

“প্রণয়ের শিখা আবার প্রাণে দিলো আশা
তুমি আমার প্রিয় বিষাদ,নীল ভালোবাসা,,

আমি হারায়ে খুঁজেছি পথ
নিরলস নিরন্তর,
তবুও নির্বাসিত প্রেম দিয়েছে
মরীচিকার বালুচর।

প্রণয়ের শিখা আবার প্রাণে দিলো আশা
তুমি আমার প্রিয় বিষাদ,নীল ভালোবাসা।”
~মম
___

আগামীকাল বিয়ে,কিন্তু বিয়ে বাড়ি হিসেবে কোনো জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন নেই বিষাদিনীদের বাড়িতে। তবে একটা ভিন্ন জিনিস আছে। আজ রাতে বিষাদিনী একা ঘুমায় নি। তার সাথে আজ বিলাসিনীও আছে।

বারান্দা থেকে একটা বিদেশী ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। কিছু মাস আগেই বাবা আনিয়েছিলেন। বাবা তাকে সবই দিয়েছে, কিন্তু যেটা দেওয়ার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো সেটা দেয় নি।

আকাশে বিশাল গোল চকচকে চাঁদ উঠেছে। বারান্দা তখন জোৎস্না বিলাস করতে ব্যস্ত। বারান্দায় জোৎস্নার আলো তে স্নান করছে নীল বিষাদে আচ্ছাদিত যুবতী।

চোখের কোণ থেকে টপটপ ধারায় অশ্রু ঝড়ে পড়ছে তার। ইশ,বিষাদ এত কষ্টের কেনো? ভালোবাসা অশ্রু ছাড়া আর কিছু দিলোই না তাকে। আহা! ভাগ্য তার বেলাতেই এত নিষ্ঠুর কেনো?

গলা ছেড়ে গান এলো তার। আরেকবার সে গেয়ে নিবে বিষাদমাখা সুরে। অপূর্ণতার তিক্ততা থেকে সে নিজেকে মুক্তি দিবে খুব শীগ্রই। এইতো,কাল হতে ভাগ্য না, সে রটবে নতুন এক উপন্যাস। যেখানে বিষাদিনীর কেবল বিষাদ না, অনুভূতির অন্যান্য বস্তু গুলোই থাকবে।

কণ্ঠে সুর এলো। গানের প্রথম লাইন গুলো সে গাইলো না বরং বেছে বেছে রবীন্দ্র সংগীতের মাঝের লাইনের বিষাদ। বেছে নিয়ে গলা ছেড়ে গাইলো,

“তুমি সুখো যদি নাহি পাও,
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে,
আরও কিছু নাহি চাই গো…”

-‘এত উদারতা তোমায় কী দিলো আপুই? তাকে সুখের সন্ধানে পাঠাতে গিয়ে সারাজীবন অশ্রু বিসর্জনের পথ টুকু যে বেছে নিলে। কান্না বুঝি তোমার এত প্রিয়? জানো আপুই,আজ আমার মনে হয় – কারো সুখ কারো অশ্রু হয়ে ঝড়ে। এমন বিষাদ অশ্রু না আসুক। কিছু মানুষ সুখী না হোক।’

বিষাদিনীর ধ্যান ভাঙলো। সামন্য চমকে উঠলো। বিলাসিনী কথা গুলো বলেছে? ঘুমায় নি মেয়েটা এখনো? সে তো উঠে আসার সময় দেখে এসেছিলো মেয়েটা গভীর ঘুমে। তবে! মেয়েটা অভিনয় করছিলো?

বড় বোনকে চুপ থাকতে দেখে এগিয়ে গেলো বিলাসিনী। অসহায় কণ্ঠে বললো,
-‘কে সে দূর্ভাগা? যে এত বেশি ভালোবাসা পায়ে ঠেললো?’
-‘সে আমার বিষাদের আকাশ। লুকিয়ে রাখা অশ্রু। তারে আমি প্রকাশ করি কেমনে?’
-‘তাহলে বিয়েটা কেনো করছো? বিষাদ হৃদয়ে পুষে,কাউকে আবার নতুন করে ভালোবাসা যায়? তবে ঠকাচ্ছো কেনো তাকে?’

-‘আমি তো দিবানিশি অপ্রাপ্তির দহনে পুঁড়ি। তাই সবাইকেই তার আঁচ দিতে চাচ্ছি।’

বিলাসিনী কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না। তার বোন তো স্বার্থপর না। তবে আজ কেনো? ভালোবাসার অপ্রাপ্তি বুঝি বদলে দেয় মানুষকে?

দুই বোনের নিরবতার মাঝে বাড়ির বড় লোহার গেট টা খোলার শব্দ হলো। বাড়িতে গাড়ি প্রবেশ করলো। দু বোনই দৃষ্টি দিলো সেখানে। মিনিট খানেক পেরুতেই গাড়ি থেকে বাবা নেমে এলো।

কোনো রকম ঢুলতে ঢুলতে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। কাল যার মেয়ে বিয়ে, আজ সে মধ্য রজনীতে নেশা করে বাড়ি ফিরছে। এমন বাবার মেয়ে, কতই বা ভালো থাকবে? গাড়ির শব্দ বন্ধ হলো। আবার সব চুপ। গাড়ির সামনের লাইট টা বন্ধ হতেই আবার প্রাকৃতিক আলোয় আলোকিত হলো রাস্তা। চাঁদনী রাত তো। নিরব চারপাশ।

বিষাদিনীর ভিষণ দরকারী কথা মনে পড়লো। বোনকে যদি আর বলা না হয়? এখনেই বলে ফেলা উচিত।

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বোনের হাতটা টেনে সামনে দাঁড় করালো। চুল গুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বললো,
-‘ভালো থেকো। জীবন একটাই। একটা জীবন খারাপ থেকে কাটাবে কেনো? ভালো থাকতে হবে তোমায়। নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব কারো উপর দিবে না। নিজেকে নিজে ভালো রাখবে। বাবা-মা কি করছে,না করছে তা না দেখে ভালো থাকবে। বেঁচে থাকার জন্য ভালো থাকার প্রয়োজন। বিষাদ নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। মৃত মনের মানুষ বেঁচে থেকেও লাশ।’

কথা শেষ করেই ঘরে চলে যায় বিষাদিনী। চোখে তার অশ্রুকণা ছিলো। এ রাত তাকে যন্ত্রণা দেয় কেবল। ভালোবাসা এত তিক্ত কেনো?

____

আজ তিস্তাদের বাড়ির উঠানেও চাঁদের আলো পড়েছে। চাঁদের আলোয় মাস্টারমশাই এর ঘেটে যাওয়া লেখা গুলোকে স্পষ্ট করছে। সাথে প্রশান্তি দিচ্ছে তিস্তার মনে। ভালোবাসা এত মিষ্টি কেনো?

কী অদ্ভুত তাই না? একই রাত, একই শব্দ দু’জনকে দু’রকমের অনুভূতি দিচ্ছে। এমন ভাবেই তো মানুষ বেঁচে থাকে। কেউবা সুখে,কেউবা বিষাদ নিয়ে বুকে।
___

আজ গ্রামে বাজার বসবে। পুরো সপ্তাহের শুক্রবারই বেচাকেনা দারুণ চলে। তিস্তা সকাল বেলা উঠেই স্নান করে তৈরী হলো।

তনয়া বেগম মেয়েকে তৈরী হতে দেখে অবাক কন্ঠে বললো,
-‘কোথায় যাচ্ছো তুমি এত সকালে?’

তিস্তা ঝরঝরে ফকফকে উত্তর দিলো,
-‘আজ তো হাট বসবে। দোকানটা খুললে একটু বিক্রি ভালো হবে। তাই হাঁটে যাচ্ছি।’

তনয়া বেগম কিছুক্ষণ থ বনে রইলো। পেছন থেকে লতিকা বেগমের ভীষণ ঘৃণিত কণ্ঠে বলা কথা ভেসে এলো,
-‘ছেঃ মুখ পুড়িয়ে শান্তি মেলে নি? তোর মতন নোংরা মেয়ে দেখি নি। এত জ্বালা তোর? নোংরা মেয়েছেলেদের দলে নাম লেখা।’

তিস্তা থমকে যায়। এসব দাদী বলছে? হঠাৎ শরীরটা ঘিনঘিন করে উঠলো তার। মানুষ গুলো তাকে ভালো থাকতে দিবে না?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here