অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-১১

0
1938

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_১১

সকালের মিষ্টি কিরণ ফুটে উঠেছে চার পাশে। কোলাহলের বসতি ফের কোলাহলে মেতে উঠেছে। ঘড়ির কাটা বরাবর দশটায়। আজ ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়েছে। গতকাল গভীর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার ফল স্বরূপ উঠতে দেরি হয়েছে। গতকাল আপু অরিদ্রকে যেই বকা বকেছে মনে খুব শান্তি পেয়েছি। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম। ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ালাম। মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে। উদ্দেশ্য এক কাপ চা।
বাবা খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে আছেন। মাঝে মাঝে পাশের ব্যক্তির সাথে মত বিনিময় করছেন। পাশের ব্যক্তি খানিকক্ষণ বাদে বাদে আড় চোখে আমাকে দেখছে আর নাক মুখ গরম করছে। তার মুখটা টকটকে লাল হয়ে আছে। তাকে এই অবস্থায় দেখে হেসে ফেললাম। মায়ের কাছ থেকে এক কাপ চা নিয়ে এসে বাবার পাশে বসে পড়লাম। বাবাকে বললাম,

‘বাবা নিউজে কি দেখছো? ডাক্তাররা যে তাদের ভাবির হাতে কান মলা খায় তা কি খবরে এসেছে?’

বাবা আমার কথায় চমকে উঠলেন। অরিদ্র তার চোখ মুখ আরো শক্ত করে নিলেন। আমি চাপা হাসি দিলাম। বাবা কয়েক মুহূর্ত বিড়ম্বনায় বললেন,

‘ডাক্তার হচ্ছে সেবক জাতি। তারা কান মলা খাবে কেন? কান মলা তো খাবে তোর মতো পড়া চোররা।’

আমি মুখ ফুলিয়ে নিলাম। ‘আমি কখন পড়া চুরি করলাম? আমি এখন পড়ি অনেক পড়ি।’

‘তা তো সামনে দেখবো তুমি কি পড়ো আর কি করো।’

‘তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারলে?’

‘তা তোকে কিভাবে বলবো? তুই যা তোকে তাই বলেছি।’

আমি মুখ ফুলিয়ে চা পানে ব্যস্ত হলাম। পাশের মানুষটির মুখে উপচে পড়া হাসি। মনে মনে সে হয়তো পৈশাচিক আনন্দ নিচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

আমি সেখান থেকে রান্না ঘরে পা বাড়ালাম। চায়ের কাপ টা রান্না ঘরে রেখে আসতেই মায়ের হাস্যজ্জল চেহারাটা বেশ খেয়ালে এলো। মা বললেন, ইশা আজ তোর মেজ খালা আসবে। কত্ত দিন পর আমাদের বাড়িতে আসবে জানিস! কত্ত দিন হলো বোনটাকে দেখি না।

মায়ের বাণী আমায় একটুও খুশি করতে পারলো না। বরং আমায় আরো বেশি বিষন্ন করে দিলো। আমার মায়েরা চার বোন। মাই সবার বড়। মেজ খালাকে আমার কোন কালেই সহ্য হতো না। মানুষকে খোঁচা দিয়ে কথা বলার স্বভাবের জন্য সে আজীবনই আমার অপছন্দের তালিকায় তালিকাভুক্ত। তাকে নিয়ে মাথা ঘামানোটাকে বেশি জরুরি মনে করলাম না। আপাতত আমায় ভার্সিটিতে যেতে হবে। সামনে পরীক্ষা আপাতত পড়াশোনায় দৃষ্টিপাতই আমার জন্য শ্রেয়। রুম্পিকে ফোন করে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওয়ানা দেওয়াই আমার বর্তমান। যেই ভাবনা সেই কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মায়ের আহাজারি আনন্দ এখনো শুনতে পাচ্ছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে ব্যস্ত হলাম। রেডি হয়ে বইপত্র ব্যাগে নিতেই শুনতে পেলাম এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

‘ইশারা আপনি কি বের হবেন?’

জ্বি, ভার্সিটিতে যাবো।

‘কখন ফিরবেন?’

‘তা জেনে আপনার কি হবে?’

‘আমার প্রশ্নের উত্তরে আপনি প্রশ্ন করে ফেললেন! এটা তো বুদ্ধিমতী মেয়েদের কাজ না।’

‘আমি কোন বুদ্ধিমতী নই তাই হয়তো।’

খানিকক্ষণ নিশ্চুপতা কাটিয়ে সে বললো,

‘মন খারাপ?’

‘না, মন খারাপ কেন থাকবে?’

‘বিকেলে চলে যাবো।’

‘তাতে আমার কি?’

‘আপনার কিছু না?’

‘কিছু হওয়ার কথা বুঝি?’

‘আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?’

‘আমার ভার্সিটিতে যেতে হবে দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

তাকে উপেক্ষা করে চলে আসলাম। এই মুহূর্তে কথা বলার ইচ্ছে নেই। বিষন্নতায় ঘেরা আমি। আমায় চেপে ধরেছে এক রাশ মন খারাপ। কিন্তু তা কি আর প্রকাশ করি? আমার তো তা বারণ! নিজের ভুলের মাশুল নিজেকেই গুণতে হবে আমার‌।

দুপুর দুটো বেজে একুশ মিনিট। ক্যাম্পাসে বসে আছি আমি। মাথার উপর উপস্থিত সোনার থালার আকারের সূর্যটা। গ্রীষ্মের প্রথম ভাগ। মাথার উপর খাড়া ভাবে সূর্য কিরণ পতিত হচ্ছে। পুরো শরীর ঘেমে একাকার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে পুকুর থেকে মাত্রই সাঁতার কেটে এসেছি। বন্ধুমহল মেতে উঠেছে জমজমাট আড্ডায়। দীর্ঘ দিন পর আড্ডা দিচ্ছি বন্ধু মহলে। তরী, তনয়া, রুম্পিতা, অর্পণ, নির্ঝর এই নিয়েই আমার বন্ধু মহল। সবার সাথেই বেশ শখ্যতা আমার‌‌। দীর্ঘদিন পরে সবার সাথে বসেছি। তরী এখন আমাদের মধ্যে নেই। ক্লাস শেষেই বাড়ি চলে গেছে ও। এই গরমে একদম কাহিল হয়ে পড়েছে। বিগড়ে যাওয়া মেজাজ আমার এই মুহূর্তে বেশ ফুরফুরে।

‘এই ইশা তোর ওই শহুরে আশিকের কি খবর?’

জমজমাট আড্ডার মাঝে অর্পণের কথাটা ঠিক হজম হলো না। আমার আশিক? কি বলতে চাচ্ছে ও?

‘আমার আশিক আবার পেলি কোথায়?’

নির্ঝর মাঝ থেকে ফোড়ন কেটে বললো, ‘কেন এমন ভাব করতাছোছ মনে হয় জানস না?’

‘আশ্চর্য তো! আমি কি করলাম?’

অপর্ণ দ্বিতীয় বার বললো, ‘ওই যে শহর থেকে আইছে কি যেন ডাক্তার না ফাক্তার।’

রুম্পি বললো, ‘দোস্ত ওর বোনের দেবর। একদম সেই লেভেলের হ্যান্ডসাম।’

নির্ঝর রসিকতার ছলে বললো, ‘হ হ আমার জানের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া ব্যক্তি।’

অর্পণ নির্ঝরের পেটে ঘুষি দিয়ে বললো, ‘ ওই শা*লা তোর জান মানে? কয়ডা লাগে তোর? খাড়া আজকেই পূর্ণিরে কমু। এরপর তোর ইশা ছুটামু।’

অর্পণের দেওয়া ধমকিটাতে নির্ঝর চুপসে গেলো। সে জানে অর্পণের সাথে বেশি বকলে সত্যিই সে পূর্ণির কাছে যাবে। এতো দিন ধরে কত কাঠখড় পুড়িয়ে মেয়েটার মন পেয়েছে সে‌। দ্বিতীয় বার তাকে হারাতে পারবে না। দীর্ঘ তিন বছর ধরে মেয়েটার পিছন ঘুরতে ঘুরতে মেয়েটা রাজি হয়েছে। কিছুতেই তাদের সম্পর্কে সে ফাটল ধরতে দিবে না। পূর্ণি যথেষ্ট সন্দেহ করে তাকে। এই খবর যদি একবার তার কাছে যায় ব্রেকআপ করতে দ্বিতীয় বার ভববে না সে। তাই এই মুহূর্তে চুপ থাকাটাই তার জন্য কল্যাণকর।

অর্পণ হাসতে হাসতে বললো, ‘কিরে মামু চুপ হইয়া গেলা? তোগরে চুপ করার টেকনিক আমার জানা আছে।’

নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিস? নিতে থাক। দিন আমাদেরও আসবে মামা তখন বুঝবা।’

অর্পণ কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, অর্পণের কখনো এখন দিন আসবে না। সো কুল।

দুজনের লেগে যাওয়ার ভাব দেখে বললাম, ‘তোরা চুপ কর তো প্লিজ। একদমই ভালো লাগে না।’

অর্পণের বিড়বিড় করে বলা কথাটা আমার কানে ঠিকই পৌঁছালো। অর্পণ বিড়বিড়িয়ে বললো, আমগো কথা তো তোমার ভালো লাগতো না। ডাক্তার কইলে ভালো লাগতো।’

সন্দেহ সূচক দৃষ্টি নিয়ে ওকে বললাম, ‘কি বললি তুই?’

অর্পণ বললো, ‘তোগো মাইয়া গো কান না জানি কি আল্লাহ মাবুদ! শুনছিসই তো কি কইছি আমার জিজ্ঞেস করছ কেন?’

রুম্পি বললো, ‘অর্পণ ইদানিং বেশি কথা বলিস তুই।’

অর্পণ মুখ ভেঙিয়ে বললো, ‘তোর মতো চুপ থাইকা কি করমু? তুই কথা কম কছ কারণ তুই তোর জামাইয়ের লেইগা জমাইতাছস। আমার সিঙ্গেল লাইফ তোগো লগেই একটু আকটু কথা কই। মজ মাস্তি করি।’

রুম্পি মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। আমি হেসে ফেললাম। বললাম, ‘কেন? তোর লাইফ সিঙ্গেল কেন? তুই কি জীবনেও ডাবল হবি না?’

‘না রে। শা*লীর মাইয়া গো ভাব দেখলে শরীর চুলকায়।’

অর্পণকে মুখ ভেংচে রুম্পি বললো, ‘আহারে! কি মহাপুরুষ মাইয়া দেখলে তার গা চুলকায়। যখন নিজেরটা পাইবা দেখবো এই চুলকানি কই যায় তোমার।’

আমি নিরবে গালে হাত দিয়ে ওদের কথা শুনছি। অর্পণ বললো, ওই গালে হাত দিছ না তাইলে জামাই মইরা যাইবো।

‘জামাই আসবে কোথা থেকে? আমার নিয়তি আমায় ছেড়ে দিয়েছে‌। আমি একজন ডিবোর্সী।’

‘এটা কি ধরনের কথা ইশা? ওই শা*লা তোর যোগ্যই না।’ শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো নির্ঝর।

তনয়া বললো, ‘ তাই রে। এই জন্যই তো হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, মানুষের জন্মই হইলো অপাত্রে ভালোবাসা দান করার জন্য। যাদেরকে ভালোবাসার কোন যোগ্যতা নেই তাদেরকেই মানুষ ভালোবাসে।’

সবসময় চুপচাপ থাকা মেয়েটি মুখ খুললো।

‘হু’ রুম্পির আহত কণ্ঠস্বর।

অপর্ণ চোখ মুখ শক্ত করে আমায় বললো, ‘আরেক বার এই কথা কবি সত্যি তোরে নিয়া অজগর স্যারের পুকুরে চুবাবো।’

‘ওটা আজগর হবে গরু। ঠিক মতো উচ্চারণও করতে পারিস না।’ রুম্পির জবাবে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো অর্পণ। বললো, ‘তোরে এতো কিছু জিজ্ঞেস করছি? ওই ব্যাটায় একটা অজগরই। ওই ব্যাটার বিষ বেশি।’

নির্ঝর বললো, উনি আমাদের স্যার কিন্তু অর্পণ।

‘আইছে আমার স্যার কওয়া ব্যক্তি। তুমি তলে তলে কি কি কও জানা আছে আমার।’

বেশ লেগে গেলো রুম্পি, অর্পণ আর নির্ঝর। সবার উদ্দেশ্য জিতা। কে কাকে কথায় হারাতে পারে। বার বার ওদের থামানোর চেষ্টা করছি কিন্তু কেউ ই পাত্তা দিচ্ছে না। ব্যর্থ হয়ে চুপ করে দেখতে লাগলাম। দুজনের কেউই অর্পণের সাথে পেরে উঠতে পারছে না। ওরা একটা বললে অর্পণ পাঁচটা বলে বসিয়ে দিচ্ছে ওদের।

হঠাৎ রুম্পি বলতে লাগলো, ‘গায়েস! গায়েস! স্টপ প্লিজ। ঝগড়া শেষ এখন একটা শকড নিউজ আছে।’

রুম্পির কথায় উত্তপ্ত মহল এখন শান্ত। রুম্পি বলতে লাগলো, ‘গায়েস আই থিংক আমি যদি ভুল না করি তাহলে ডাক্তার বাবু এসেছে।’

রুম্পির কথায় সবার দৃষ্টি মেইন ফটকের দিকে গেলো। আমার দৃষ্টিও সেদিকে। কালো শার্ট এবং পরিহিত যুবকের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ হলো। শার্টের হাতা গুলো গুটিয়ে রেখেছে। বা হাতটায় একটা বেল্টের ঘড়ি। কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা। গ্রীষ্মের গরমে ঘেমে সব একাকার। ডান হাতটায় পাতলা টিস্যু পেপার। যা দিয়ে অনবরত ঘাম মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চমশাটা ঝুলছে। এক অদ্ভুত মানব মনে হচ্ছে ব্যক্তিটিকে!

অর্পণ বললো, দোস্ত এডাই তোর ডাক্তার?

চলবে………

(রিচেক হয় নি। অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here