চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-২৬

0
3012

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২৬|

বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই কথাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল রমিজা। কথার কপাল থেকে রক্ত পড়ছে। তড়িঘড়ি করে হাতের কাজ ফেলে কথার কাছে ছুটে এলো সে।

-ও নতুন বউ! কী হইছে তোমার? কপালে রক্ত কেন? কপাল কাটলো কেমন কইরা? কোথাও পইড়া গেছিলা? অ্যাক্সিডেন্ট হইছে তোমার।”

কথা তাচ্ছিল্যের চোখে রিমজার দিকে দেখল। তার কপাল থেকে রক্ত পড়ছে এতে তার যেন কিছুই আসে যায় না।

-কী হইলো কিছু কও না কেন? বড় সাহেবরে খবর দিমু? ডাক্তার ডাকমু। কেমনে এমুন হইলো?”

-অনেক কৌতূহল তোর, না?”

রমিজা হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে কথার দিকে তাকিয়ে থাকল। নতুন বউ তাকে তুইতোকারি করছে? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না সে। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

-তু-তুমি আমাকে তুই কইলা! ত-তু…

-চুপ। কোন কথা বলবি না। ওকে নিয়ে তোর অনেক আগ্রহ। অনেক কৌতূহল। ওর কৌতূহল আমি মিটিয়ে দেব।”

-এসব তুমি কী কইতাছো নতুন বউ! কী হইছে তোমার?”

-তোকে যেন কথার আশেপাশে ঘেঁষতে না দেখি। ওর উপর নজর রাখছিস তুই? ওইদিন বাগানে দেখিসনি? আরও কিছু দেখার বাকি আছে?”

কথার চোখ মুখ কেমন পাল্টে গেছে। ওকে দেখে ভয় পাচ্ছে রমিজা। সে এতদিন শুধু সন্দেহ করত নতুন বউয়ের সাথে কিছু আছে। আজ নিশ্চিত হলো। নতুন বউকে জ্বীনে ধরে। ওই জ্বীন আজ তাকে মেরে ফেলবে। নতুন বউকে যে সে পছন্দ করে না এটা জ্বীন জেনে গেছে। কিছু বুঝতে না পেরে চিৎকার শুরু করে দিল রমিজা। নীড় বেরই হচ্ছিল। আজ তার জ্বর নেই বললেই চলে। কয়টা দিন বাড়িতে থেকে হাত পায়ে ঝং ধরে গেছে। রমিজার চিৎকার কানে আসতে দৌড়ে এলো সে।

-ও মা গো! আল্লাহ গো, এই জ্বীন আমারে মাইরা ফেলব গো। নতুন বউয়ের জ্বীন আমারে মাইরা ফেলব।”

ছুটতে ছুটতেই নীড় জানতে চাইল,

-কী হয়েছে রমিজা? কাঁদছ কেন তুমি?”

-ও ছোড সাব আপনার বউ আমারে মাইরা ফেলব।”

-কী বাজে বকছো?”

নীড়কে দেখার সাথে সাথেই কথা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। কথার শরীর মাটিতে পড়ার আগে নীড় ওকে বাহুডোরে ধরে ফেলল। ওর কপালে রক্ত দেখে উৎকণ্ঠিত গলায় বলল,

-কথার কী হয়েছে? ওর কপালে রক্ত কেন?”

রমিজা কাঁপতে কাঁপতে বলল,

-এই কথাই তো আমি জানতে চাইছিলাম। কিন্তু নতুন বউ আমার উপর রাইগা আমার ঘাড় মটকানির কথা কইল।”

নীড় রেগে রমিজার দিকে তাকালো। রমিজার স্বভাব বরাবরই তিলকে তাল বলা। কথার একটা অসুখ আছে। তাই বলে কথা কারো ঘাড় মটকানোর কথা বলবে!

-নতুন বউয়ের উপর জ্বীনের আছড় আছে ছোড সাব। বিশ্বাস করেন। জ্বীনে ধরলেই মানুষ এমন করে।”

-জ্বীনদের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তা জ্বীনের সাথে তোমার কিসের শত্রুতা? তোমার ঘাড় মটকাতে চাইবে কেন? কিছু করেছ নাকি তুমি?”

-জ্বীনটা নতুন বউয়ের সাথে থাকে এইডা আমি জাইনা গেছি বইলাই খবিশ জ্বীন আমারে মারতে চায়।”

-এবার তো শিওর তোমার রক্ষা নেই। এক্ষুনি যে জ্বীনে খবিশ বললে এটা কি ওর অজানা থাকবে?”

নীড় কথাকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

-শোন রমিজা, কথার সাথে কোন জ্বীন ভূত নেই। তুমি তোমার এই বানানো গল্প বলা বন্ধ না করলে তোমার চাকরি খাব আমি। তোমার বড় সাহেবও কিন্তু তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।”

নীড় ঘরে গিয়ে কথাকে শুইয়ে দিল। কথার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ও। কথার বড় কোন অসুখ আছে। যে অসুখ চোখে দেখা যায় না। বা এর লক্ষণ দেখেও বোঝা যায় না। নিজের কথাই মনে করল সে। সিঁথি মারা যাবার পর তার অবস্থাও অনেকটা এইরকমই হয়েছিল। কথাকে কি কোন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যাবে? হ্যাঁ তাই করতে হবে। কথাকে সে ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপে দেখেছে। নীড় ফাস্টএইড বক্স এনে কথার কপালের রক্ত মুছে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কথার কপালের সামনের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিল। ঝুঁকে এসে কথার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল।

-তোমার সে সমস্যাই থাকুক আমি তার সমাধান খুঁজে বের করব। তোমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমার কথা। চাইলেও তোমার অতীত আমি পালটাতে পারব না। কিন্তু তোমাকে সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ তো দিতে পারব। অন্তত চেষ্টা তো করতেই পারব।”
—————-
চোখ খুলে কথা নীড়কে সামনে পায়নি। কথা জাগবার একটু আগেই নীড় বেরিয়ে গেছে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দু’টো চোখের পাতা খুব কষ্টে টেনে খুললো। কোথায় আছে সে বুঝতে সময় নিল।

-ঘরে কীভাবে এলাম আমি? কখন এলাম?”

কপালের ডান পাশের জায়গাটা টনটন করছে। ব্যথার উৎস খুঁজে কপালে হাত রাখতেই কাতর শব্দ করলো কথা।

-আহ! মাথায় আবার কী হলো? ব্যথা পেয়েছি নাকি? ইশ কী ব্যথা!”

বিছানা ছেড়ে উঠে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রমিজা কথাকে দেখেই এক দৌড়ে পালিয়ে গেল। কথার সামনে পড়তেও ভয় পাচ্ছে সে। কথা রমিজার অদ্ভুত আচরণ দেখে বোকা হয়ে চলে রইল।

-রমিজা খালা, কোথায় যাচ্ছ তুমি? কী হয়েছে তোমার?’

বাবার ঘরের লাইট জ্বালানো। সিঁথির কথা মনে পড়ে গেল ওর। বাবার ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলো কথা। নাহিদ চৌধুরীর শরীরটা কিছু দিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। মরতে তার ভয় নেই। যথেষ্ট জীবন পার করে এসেছেন তিনি। কিন্তু ছেলেটার জন্য চিন্তা হয়। নীড়কে এখনও জীবন সম্পর্কে কোনকিছুই শেখাতে পারলো না। তিনি চলে গেলে সবকিছু সামনে নিতে নীড়ের কষ্ট হবে।
কথাকে দরজার সামনে দেখতে পেয়ে মন থেকে ওসব চিন্তা দূর করে দিলেন। নীড়ের পাশে কথা আছে। নীড়কে ঠিক সামলে নিবে ও। মেয়েরা সময়ের সাথে স্নেহমহী হবার পাশাপাশি কঠোরও হতে পারে।

-এলো মা। ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

বাবার উপর কথার ক্ষীণ অভিমান কাজ করছে। বাবা জানতো নীড় তাকে পছন্দ করে না। তবুও এমন একটা সম্পর্কে আটকে ফেলল ওকে।
নাহিদ চৌধুরীর দৃষ্টি কথার কপালের উপর পড়লো। ব্যান্ডেজ করা দেখে জানতে চাইলেন।

-কপালে কী হয়েছে? কীভাবে ব্যথা পেয়েছ?”

কথা কপালে হাত রেখে মনে করার চেষ্টা করলো এই আঘাত কখন কীভাবে পেয়েছে ও। কিন্তু মনে করতে পারল না। তার মাঝে মাঝে এমন হয়। অনেক কিছুই মনে থাকে না ওর। মা তাকে এমন এমন কাজের জন্য শাস্তি দিয়েছে যা সে কখনও করেই নি। কোনোদিন কাঁচের ক্লাস, থালাবাসন ভেঙে ফেলা তো কোনোদিন তার থেকে বড় কিছুও করে ফেলা। একদিন নাকি সে মা’র হাত মুচড়ে ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল। এরজন্য মা তার হাতে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়েছিল। সত্যি বলতে ওসবের কিছুই তার মনে নেই। অনেক ভেবেও মনে করতে পারেনি। সে কি স্বাভাবিক না? অল্প অল্প করে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলছে ও!

-কী ভাবছ বৌমা?”

-জানি না বাবা। কীভাবে যেন ব্যথা পেয়েছি মনে নেই।”

ছেলের বউয়ের সাথে কথা চালিয়ে যাবার সময়ও নাহিদ চৌধুরী অসুস্থ বোধ করছেন। ক্রমশ শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে উনার। কিন্তু তিনি কথাকে কিছুই বুঝতে দিলেন না।

-বাবা আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”

-কী বলবে বলো।”

-আমি সব জেনে গেছি বাবা। আপনার ছেলে আমাকে বিয়ে করতে চায়নি। ও তো অন্য একটা মেয়েকে পছন্দ করতো। আপনি কেন ওদের মেনে নিলেন না বাবা?”

-তোমাকে এসব কথা কে বলেছে মা? নীড় বলেছে!”

-না। আমি জানি।”

-তুমি কতটুকু জানো তা আমি জানি না মা। কিন্তু নিজের ছেলে জেনেশুনে আগুনে হাত দিতে যাবে এটা বাবা হয়ে আমি কীভাবে মেনে নিতাম বলো। আমি কেন, কোন বাবাই চাইবে না তার ছেলে ভুল সিদ্ধান্ত নিক। মেয়েটা গরীব হলেও আমার কোন আপত্তি থাকতো না। ওর সাথে নীড়ের বিয়ে দিলে ওরা কেউই ভালো থাকতো না। মা রে জীবন দেখেছি আমি। তোমাদের থেকে আমার অভিজ্ঞতা একটু হলেও বেশি। নীড় যে পথে চলতে চেয়েছিল সেই পথে হাজারটা কাটা বিছানো ছিল। চলার পথে ও ক্ষতবিক্ষত হতো। হুঁচট খেত, রক্তাক্ত হতো। শেষ পর্যন্ত ওরা গন্তব্যে পৌছুতে পারত কিনা সেটাও অনিশ্চিত ছিল। তুমি এখনো মা হওনি, মা। যেদিন তুমি মা হবে সেদিন বুঝবে আমি কোন ভুল করিনি। সন্তান ভুল করতে চেয়েছিল আমি তাকে বাধা দিয়েছি মাত্র। আমি যা কিছুই করেছি ওকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবার জন্য করেছি। বাবা হয়ে ছেলের ভালো চাওয়াটা নিশ্চয় অপরাধ না। আমি আমার একটিমাত্র ছেলেকে জীবনে সুখী দেখতে চেয়েছি মাত্র। আমার এই চাওয়াটা কি ভুল? তুমিই বলো, আমি কি অন্যায় কিছু করেছি?”

কথা কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল,

-না বাবা। আপনি অন্যায় কিছু করেননি। সন্তানের ভালো চাওয়া অন্যায় না। অপরাধও না। আপনি বাবা হবার দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন।”

-ওই মেয়েটার মৃত্যুর আফসোস আমারও আছে। আমি কোনোদিনও চাইনি ও এভাবে মারা যাক। ওর পরিবার আমাকে আর আমার ছেলেকে ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী করে। সিঁথিকে আমি কোনদিনও ভয় দেখাইনি। ওর সাথে খারাপ আচরণও করিনি। একজন বাবা হয়ে ওর কাছে গিয়েছিলাম আমি। বাস্তবতা সম্পর্কে ওকে বুঝিয়েছি। মেয়েটা বুঝেও ছিল। কিন্তু শেষে ও এমন কিছু করে বসবে তার সম্পর্কে আমার বিন্দু পরিমাণ ধারণাও ছিল না। নীড় সেদিন যা করেছে ভেবেচিন্তে করেনি। সিঁথির বিয়ে ভেঙে দিলে ও ওকে পেয়ে যাবে এমনটাই ধারণা করেছিল হয়তো। জীবনের এমন একটা পরতে আমরা কেউই নিজেদের জায়গায় ভুল ছিলাম না।”
—————-
কারো কান্নার শব্দে নীড়ের ঘুম ভেঙে গেল। এত রাতে কে কাঁদছে? চোখ খুলে তাকাতে তার হাতে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করল। কথা কাঁদছে? নড়লো না নীড়। ওভাবেই পড়ে থাকলো। কথা নীড়ের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে সমানে কেঁদে যাচ্ছে।

-আপনি আপনাকে ভালোবাসতে না-ই পারেন তবুও আমাকে কোনোদিন আপনার থেকে দূরে সরিয়ে দিবেন না। এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। আমি আপনার সাথেই থাকতে চাই। আমার ভাগ্যে কোনোদিনও কারো ভালোবাসা লেখা ছিল না। আমার নিজের মা কেমন ছিল সেটাও মনে নেই। সৎমা মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার সবরকম চেষ্টাই করেছি আমি। কিন্তু ওই মানুষটা আমাকে ওকে মা ডাকতেও দিল না। ভেবেছিলাম বিয়ের পর স্বামী সুখ হয়তো কপালে জুটবে। সেটাও আর হলো কই? এই পৃথিবীতে আমার কোন প্রয়োজনই নেই। আমার মত এক কথা না থাকলেও কারো জীবনে কোন ক্ষতি হবে না। এতটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে কেন এলাম আমি?”

কথার হাতে ধরা নীড়ের হাতের উপর কথার চোখের পানি পড়ছে। ওর হাতটা অবশ হয়ে আসছে। কথাকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি নেই তার।
এই মেয়েটাকে সে কখনও বোঝার চেষ্টা করেনি। কিন্তু নীড় এখন চাইলেও এটা অস্বীকার করতে পারবে না কথার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। কথাকে নিজের থেকে দূরে সরাতে পারবে না। কথা তার জীবনের বড় একটা অংশ জুড়ে নিজের অস্তিত্ব গেড়ে বসেছে। এই মেয়েটাকে ভালো রাখার সবধরনের চেষ্টা করে যাবে সে।

চলবে_
বিঃদ্রঃ রোজার মাসে একদিন পরপর গল্প দেব। ইফতার করে এই পর্ব রিচেক দেওয়ার মত শক্তি, ধৈর্য কোনোটাই নেই। বানান ভুল ক্ষমা করবেন পাঠক মহল।

@মায়ামহল (নিপা’র গল্প)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here