বেলীফুল পর্ব-৩

0
1730

#বেলীফুল
পর্ব-৩

রাত আটটার দিকে লোডশেডিং হয়েছে। গুমোট গরম ঘরের ভেতর। বাড়িটা অনেকগুলো বাড়ির মাঝে পড়ে যাওয়ায় বাতাস আসার তেমন জায়গা নেই, শুধু সামনের দিক থেকে হালকা বাতাস থাকে, আজ তাও নেই। গাছের পাতাটাও নড়ছে না৷ ঘরের ভেতর বসে হাসফাস লাগছে কাননের। মোবাইল সে তেমন একটা ব্যবহার করে না। বাসায় থাকলে টিভি চালিয়ে বসে থাকে। তেমন কিছু দেখে না, তবে চ্যানেল বদলে নানান বিষয়বস্তু দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়৷ ইদানীং রাত নয়টায় গন্ডার নিয়ে অনুষ্ঠান দেখায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে, সেটা বেশ পছন্দ তার। বিশালাকার গন্ডারের কার্যকলাপ দেখতে ভারি ভালো লাগে। মাঝে মাঝে নিজের চোখে দেখার সাধ হয়। তখন মনে হয় জীবনে নয়টা থেকে পাঁচটার চাকরি করে কোনো লাভ নেই। আসল জীবন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারদের।

আজকে কারেন্ট চলে গেল বলে গন্ডারের শো আর দেখা হলো না৷ কাননের একটু মন খারাপ লাগল। এতদিন পর তার কোনোকিছু মনে ধরেছিল। এদিকে ঘরেও থাকা দুষ্কর হয়ে উঠছে। সে উঠে বাইরে বেরিয়ে গেল। রাস্তা দিয়ে হাঁটাহাঁটি করলে মন্দ হয় না। কাছেই পার্কটাতে ঘুরতে যাবে বলে ঠিক করল৷ শীতের পর আর সেখানে যাওয়া হয়নি।

ঘর থেকে বের হতেই ধাক্কা খেতে খেতে বাঁচল। হুড়মুড় করে ওপরে উঠছিল মেয়েটা। এই বাড়িতেই থাকে, তিন তলায়। নামটা বোধহয় তুলনা, নাকি তুলন?

তুলন বলল, “ছাদে যাবেন ভাইয়া? ইলা আছে ছাদে।”

“না আপনি যান।”

তুলনের সাথে এই প্রথমবার কথা বলল কানন। তার মতো ছোট্ট মেয়েকে যে আপনি করে বলবে এই লোক, সে ভাবেনি। পুরোই বেরসিক এই লোকের প্রেমে মানুষ কেমন করে পড়ে? ইলার রুচি বলতে কিচ্ছু নেই। আজকে ওকে বলে যদি পথে আনা যায় তো ভালো। এই হনুমানের সাথে প্রেম করলে ওর জীবনটা শেষ। কানন নেমে গেলেও তুলন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। হাতে থাকা মোবাইল টর্চের আলোয় ভালো করে দেখল তাকে। দেখতে শুনতে তো অত খারাপ নয়, শুধু স্বভাবটা যাচ্ছেতাই!

ছাদে উঠে তুলন দেখল ইলা বাদাম খাচ্ছে। ওকে দেখে পেয়ালাটা এগিয়ে দিল ইলা।

তুলন একমুঠ বাদাম তুলে বলল, “তোর হনুমানকে দেখলাম। আরেকটু হলে ধাক্কা খেতাম।”

“কোথায়? সে তো ঘর থেকে বের হয় না তেমন।”

“দেখলাম বাইরে গেল। যা গরম, পাগলও ওই খুপরিতে থাকতে পারবে না। বাইরে তাও বদ্ধ গরমটা নাই।”

“কোনদিকে গেছে জানিস?”

“না মাত্রই নামল।”

ইলা এক দৌড়ে ছাদের কোণে চলে গেল যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। এত ওপর থেকে অন্ধকারে মানুষ চেনা সম্ভব না, কিন্তু ইলা ঠিকই চিনল। এই লোকের ছায়া দেখলেও বুঝি সে চিনবে। কানন দাঁড়িয়েছিল রাস্তার এক মাথায় একটা ডিসপেনসারির উল্টোদিকে। ইলা তুলনের হাতে বাদামের পেয়ালা দিয়ে বলল, “আমি গেলাম।”

“কোথায় যাবি?”

“ওর কাছে।”

বলতে বলতে নিচে এক ছুট দিল। তুলন বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল ওপরে। মনে মনে বলল, “যেমন দেবা তেমনি দেবী। হনুমানের জন্য পারফেক্ট গাধি।”

ওদের ছাদের একপাশে অনেকগুলো ছোট ছোট ক্যাকটাস আছে। তুলনের অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে ক্যাকটাসগুলোর কাটা ছিঁড়ে নিয়ে ওর বড় ভাবির বিছানার নিচে রেখে দিতে। শুধু ভাইয়া আর ওর বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে থেমে গেছে। আজও সেই মহিলা মায়ের কান ভাঙানি দিচ্ছিল ওর বিয়ে দিয়ে দিতে। নিজে পড়াশোনা করেনি, বিয়ে করে ছয় বছরের মাথায় তিনটা বাচ্চার জন্ম দিয়েছে, আর অন্যদেরও সেই পথে ঠেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে! অবশ্য তুলন এখন ওদের জন্য একটা আস্ত ঝামেলা। ও বাবা মায়ের চোখের মণি বলে ওকে দেখতেই পারে না ভাবিরা। তার ওপর ছোট ফ্ল্যাটে এতগুলো লোক জায়গা হতে চায় না। কোনোরকমে থাকতে হয়। বড় ভাই আলাদা হতে চায় কিন্তু সংসার চলে বাবার টাকায়, সে কোনো টাকা দেয় না। এখন ভিন্ন হলে তারই লোকসান। সেজন্য পড়ে আছে এখানে। আর যতসব কুটনামী করছে তার বউ৷

একটা মেসেজ এলো তুলনের মোবাইলে। রুমন পাঠিয়েছে। সেদিন ওকে চিঠি দেবার পর থেকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে। চিঠিতে কী লেখা ছিল দেখা হয়নি তুলনের। চিঠি বাবা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন সেটা বললে মানসম্মান থাকবে না। রুমন বোধহয় প্রেমপত্র লিখেছিল তাই উত্তর চাইছে। তুলন চেষ্টা করছে এটা সেটা বলে কাটিয়ে যাওয়ার। কিন্তু ছেলেটা বড় বেশি জেদি।

এখন লিখেছে, “কী করছ রোজি?”

তুলনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। রোজিটা কে? অন্য মেয়ের মেসেজ তাকে পাঠিয়েছে? কয়টা গার্লফ্রেন্ড ওর?

ও লিখল, “রোজি কে?”

উত্তর এলো, “তুমি চিঠি পড়োনি তাই না? ঠিক বুঝেছিলাম। তোমাকেই বলেছি রোজি। তোমার গালদুটো পুরো গোলাপের মতো। গোলাপি বললে আবার যদি রাগ করো, তাই ইংরেজিতে রোজ থেকে রোজি।”

তুলন হতাশ হয়ে লিখল, “সত্যি চিঠি পড়িনি। বাবা ফেলে দিয়েছে। কী লিখেছিলে?”

“এখন আর বলব না। দেখা হলে বলব।”

“আচ্ছা বাই।”

আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বিদায় জানাল তুলন। এই ছেলের সাথে দেখা করলে তাকে সেদিনই ধরে বিয়ে দেবে৷ কাউকে না পেলে বাড়ির দারোয়ানের সাথেও দিতে পারে। বা হয়তো রুমনের সাথেই। তাও চায় না তুলন। বাড়ির যা অবস্থা! এখন এসব ছেলেদের থেকে দূরে থাকাটাই ভালো।

কিন্তু একটা কাজের চিন্তা তার মাথা থেকে কিছুতেই দূর হচ্ছে না। বাড়িতে তার কোনো প্রাইভেসি নেই। কাজটা যে করতেই হবে! কেমন করে করবে? ইলাদের ফ্ল্যাটটা খালি পড়ে থাকে। কিন্তু কথাটা বলা যাবে না ওকে। ভাবতে ভাবতে ছাদের এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটতে শুরু করল তুলন৷

পাশের বাড়ির একটা বদমাশ ছেলে অনেকদিন ধরেই ওকে জ্বালাতন করছে। রাস্তায় দেখা হলে পেছন পেছন হাঁটতে থাকে, এটা সেটা বলে। বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফোঁকে আর ওর দিকে তাকিয়ে আজেবাজে ইঙ্গিত দেয়। কথাটা বাবাকে বলতে গিয়েও বলা হয়নি। ছেলেটাও যে ওদের ছাদে ছিল সেটা দেখেনি তুলন। আওয়াজ শুনে তাকাল। ছেলেটা সিটি বাজিয়ে বলল, “কী করো তুলন বেইবী?”

তুলন কিছু বলতে যাওয়ার আগেই পেছনে শব্দ শুনতে পেল। ছোট ভাবি দাঁড়িয়ে আছে। কখন এলো? হায় হায়!

নাজমিন বলল, “তুমি না বলেছিলে ছাদে ইলার সাথে এসেছিলে, ইলা কোথায়?”

“ও…ও একটু বাসায় গেছে।”

“কী করতে এসেছিলে দেখতেই পাচ্ছি।”

“ভাবি আমি এই ছেলেটার সাথে কথা বলতে আসিনি। ও আমাকে টিজ করে!”

“তাহলে ছাদে একা দাঁড়িয়ে ওকে টিজ করতে দিচ্ছ কেন?”

তুলন কী বলবে ভেবে পেল না। নাজমিন ঠান্ডা স্বরে বলল, “চলো নিচে।”

তুলন ঢোক গিলল। সব শেষ। এই ছেলেকে সে সুবিধামতো পেলে নিশ্চিত খুন করবে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here